সাইদ মাহমুদ'র ছড়া


 বোশেখ ঝড়ে
 
আকাশ ভেঙে ঝড় নেমেছে
বোশোখের এক দুপুরে
গুড়ুম গুড়ুম মেঘের ডাকে
নাচে কৈ উপুড়ে।
 
কোত্থেকে সব ঢিল ছুঁড়েছে
টিনের চালের মাচায়
ঘরের উপর আমগাছটা
কোন পাগলে নাচায়?
 
উড়তে দেখি খড়ের চালে
বাতাবীলেবুর মূল
চালতে গাছের মগডালে
কচি জামের দূল।
 
দুলছে খুঁটি- ঘরের দুয়ার
দুলছে কাকের ছানা
কোত্থেকে এক উটকো ঝড়
দিলো এমন হানা?
 
গুড়ুম গুড়ুম কালো মেঘ
সাদা মেঘের দলে
ঝড়ের শেষে হারিয়ে গেলো
পুকুর ভরা জলে।
……………………………………………
 
যেই ছেলেটা
 
যেই ছেলেটা নাটাই হাতে
ঘুড়ি নিয়ে ছুটতো মাঠে
বিকেল হাওয়ায় ফড়িং ধরে
সন্ধ্যে বেলায় ফিরতো পাঠে।
 
যেই ছেলেটা উদোম পায়ে
গরম রোদে হাঁটতে থাকে
কলমি গাছের চিকন ডালে
পরাগ খুলে সুবাস মাখে।
 
যেই ছেলেটা পুকুর জলে
সাঁতরে যেতো ভেলায় করে
দুপুরবেলা ফিরতো বাড়ি
বাদলা মেঘের ভীষণ ঝড়ে।
 
যেই ছেলেটা মাঝ দুপুরে
পাখির বাসায় খুঁজতো ছানা
পরের গাছের পাকা ফলে
মাঝেমধ্যে দিতো হানা।
 
সেই ছেলেটা স্কুলে যায়
শিখছে পড়া
সেই ছেলেটার ভেতর জুড়ে
মানুষ গড়া।
……………………………………………
 
কাকতাড়ুয়া
 
খুকুর চুলের সিঁথির মতো
আউস ধানের আলে
বসে আছে কাকতাড়ুয়া
শুকনো শিমুল ডালে।
আমি না হয় ফিঙে হবো
বসবো তার পাশে
আমায় দেখে যে বা হাসুক
কি বা যায় আসে!
 
ঢিলেঢালা দেহ হবো
একগাদা খড় পেটে
চোখ হবো, নাক হবো
চুনকালি বেটে।
লম্বা ইয়ে পা হবো
হবো বাঁকা খড়ের হাত
আমায় দেখে ভয়ে কাঁপে
যখন নামে রাত।
 
বাতাস পেলে ঘাড় বাঁকাবো
মিটিমিটি হেসে
যে চলুক সামনে দিয়ে
বলবো তুমি কে সে?
আমি মানুষ নই কাকতাড়ুয়া
মানুষেরই মতো
আমারও আছে দুঃখ-কষ্ট
হাসি-কান্না ক্ষত।
……………………………………………
 
নদীর সাথে
 
খিলখিলিয়ে যে নদীটা
রোজ হেঁটে যায় সাগরে
ছুটবো আমি তার পিছে
যেতে দে না মাগোরে।
 
শালুক পাতার ডিঙে আছে
হোগলা পাতার ছুই
বোয়াল মাছের দাঁড়ির মত
পালতোলা এক রুই।
 
নীল ঘোলা জল বুকে ঠেলে
পথ ভোলা এক জোয়ারে
আমায় দেখে পালিয়া গেলো
হাঁসের পাল সব খোয়ারে।
 
হলুদ রোদে রুপোর বাটি
মিষ্টি জলের ঢেউ
তারাও নাকি আমার মত
পথ ভোলা সব কেউ!
 
আমায় দেখে মিটমিটিয়ে
সন্ধ্যা তারার দল
বললো ডেকে যাচ্ছো কোথায়
এবার বড়ি চল।
 
সন্ধ্যে নামে লাল আবিরে
এবার চলো ঘরে
নদীর ঘাটে মা-যে আমার
একলা খুঁজে মরে।
……………………………………………
 
বেলজিয়ামের টাক
 
ভাবখানা তার কমলালেবু
তালখানা তার ঠাকুর
মাথার ছাদে চশমা থাকে
মুগুর চোখের কাকুর।
 
বড্ড খেয়াল খবর রাখে
রাজনীতি আর দেশের
সব বিষয়ে জ্ঞান ভারি
জ্ঞান নাই তার কেশের।
 
বাচ্চা-বুড়ো সবাই ডাকে
বেলজিয়ামের কাকা
শুলনে রেগে আকাশ ফাঁটায়
দৌঁড়ে করে ফাঁকা।
 
টাকটা যেন মস্তবড়
চকচকে এক আয়না
পাড়া জুড়ে সবাই ছুঁড়ে
নানা কথার বায়না।
 
খবর পড়ে চমকে উঠে
বিজ্ঞাপনে টাক
এক ঔষধে গজাবে চুল
বাঁচবো এবার যাক।
 
খুশির সুরে ডাকছে কাকু
কইগো গেলে গিন্নি
টাকের জ্বালা গুচবে এবার
মসজিদে দাও শিন্নি।
 
থলে ভরে খবর কাগজ
চললো কাকু শহরে
টাক নির্মূলের দোকান খুঁজে
হাজার লোকের বহরে।
 
খুঁজে খুঁজে চোখ পরে যায়
বিজ্ঞাপনের দেয়ালে
এক ফাইলেই চুল গজাবে
এমন খুশির খেয়ালে।
 
দম হাঁকিয়ে ঢুকে পরে
দাওয়াখানার চেম্বারে
ডেকে বলে আসুন আসুন
টাক সমিতির মেম্বারে।
 
মলম দিলো শালশা দিলো
এটা খেলেই শেষ
সপ্তা দু'এক সময় লাগবে
আসবে নতুন কেশ।
 
এমন খুশির খবর নিয়ে
আসলো কাকু বাড়ি
পাড়া ঘুরে মিষ্টি খাওয়ায়
দু, চারটা দশ হাঁড়ি।
 
'দিন পরে মাথা ফুলে
পঁচন ধরে চামড়ায়
পঁচে পঁচে পোকা হলো
সেই পোকারা কামড়ায়।
 
মা-বাবা গো গেলাম গেলাম
ক্যান যে গেলাম শহরে
মিষ্টি কথায় ক্যান ভাসলাম
প্রতারকদের নহরে।
 
টাক ছিলো- ভালো ছিলো
ছিলো আগের কাল
চুল গজানোর ইচ্ছে আমায়
একি করলো হাল!
……………………………………………
 
ভাবতে পারো পর
 
আমি একলা যখন হাঁটি
অন্ধকারে কড়া নেড়ে
সরছে পায়ের মাটি
আমি একলা যখন হাঁটি।
 
মাথায় মস্ত আকাশ রাখি
চোখ দিয়ে সব শূন্য নীলে
উড়তে দেখি পাখি
মাথায় মস্ত আকাশ রাখি।
 
তখন রাত্রি জমে বুকে
আমি অন্ধকারে চোখগুলোকে
হাত দিয়ে যাই ঠুকে
তখন রাত্রি জমে বুকে।
 
যখন হারিয়ে ফিরি ছায়া
তখন শূন্য নদী উজান স্রোতে
ভাসায় কারো কায়া
যখন হারিয়ে ফিরি ছায়া।
 
যখন তখন আর হবো না
কারো বুকের ঘর
আমিতো নষ্ট মানুষ
আমাকে ভাবতে পারো পর।
……………………………………………
 
শহর
 
শহর শহর শহর
লম্বা গাড়ির বহর
ঘাম ঝরা এক নহর
শহর শহর শহর।
 
ইট পাথর কাঁচে
মানুষগুলো বাঁচে
ভোরের কাক নাচে
ইট পাথর কাঁচে।
 
ছুটছে সবাই ছুটছে
জীবনটাকে লুটছে
ভালো-মন্দ গুডছে
ছুটছে সবাই ছুটছে।
 
পার্ক, গলি, সড়কে
রোদ-বৃষ্টির নরকে
সবাই সমান বড়কে
পার্ক, গলি, সড়কে।
 
শহর শহর শহর
তোমার আমার বহর
অর্থকড়ি জহর
শহর শহর শহর।
……………………………………………
 
জল হেঁটে যায়
 
জানালার কাঁচে জল হেঁটে যায়
জল হাঁটে ওই ঘাসে
জল হেঁটে যায় ক্ষুধার্ত পায়ে
শরতের সব কাশে।
 
জলে হেঁটে যায় মেঘের চোখে
জল হাঁটে ওই মাটিতে।
জল হেঁটে যায় ভরা চাঁদে
জোস্ন্যা মাখা বাটিতে।
 
জল হেঁটে যায় মসজিদ পানে
জল হাঁটে ওই মন্দিরে
জল হেঁটে যায় ঈশ্বরে আর
বুকের কপাট বন্দিরে।
 
জল হেঁটে যায় টিয়ারগ্যাসে
জল হাঁটে ওই রাইফেলে
জল হেঁটে যায় স্বাধীন পায়ে
নিজের আপন ভাই ফেলে।
 
জল হেঁটে যায় কাঁন্নাতে আর
জল হাঁটে ওই চিৎকারে
জল হেঁটে যায় মজলুমের ওই
বুকের অট্ট ধিক্কারে।
 
জল হেঁটে যায় জন্ম থেকে
জল হাঁটে ওই মরণে।
জল হেঁটে যায় আজন্মকাল
ক্রীতদাসের বরণে।
……………………………………………
 
দেশের ছড়া
 
আগুন, পাখি, নদী, সাগর ফুল ছিলো
এদের নিয়ে মোদের স্বপ্নেরগুল ছিলো।
হঠাৎ করে আকাশটা তো দুলছিলো
এতো লাশ সব কী তবে ভুল ছিলো?
 
গাঁঙের চরে,পথে-ঘাটে ভাসছিলো
আকাশ জুড়ে শকুনগুলো হাসছিলো।
বাতাস জুড়ে পঁচা লাশের বাসছিলো
পুরো দেশটা ওদের হাতের তাসছিলো।
 
মানুষগুলো নদীর মত জ্বলছিলো
বুকের ভেতর চাপা কথা বলছিলো।
ঘরে ঘরে মুক্তিকামীর দলছিলো
সব হারিয়ে চোখের কোনে জলছিলো!
 
এই দেশের এই সোনার মাঠে ধানছিলো
এই নদীর এই মাঝির কথায় গানছিলো।
হঠৎ করে সবুজ দেশটা কাঁনছিলো
রক্ত দিয়ে স্বাধীন সূর্য আনছিলো।
……………………………………………
 
জীবন ভাগে অন্য গল্প
 
বাটির ভেতর জল থাকলে
তাতে নামে শুভ্র চাঁদ
আকাশ সম মনের ভেতর
পাইনা কেন তোমার হাত ?
 
আজ পৃথিবীর ছুটি হলে
ঘুমিয়ে পড়বে তারার থাল
তুমি যাকে বলছো সেকেন্ড
আমার কাছে মহাকাল।
 
পৃথিবীর এই রাতের খেলা
হয়তো চলবে বহুকালে
তুমি আর আমি দুটি পাখি
ভাগ হয়ে যাবো দুটি ডালে।

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.