সাম্যবাদী নজরুলের মানবতাবাদী ঘোষণা_তৈমুর খান

 
কবি নজরুল মানসে দেখতে পাই সবার উপরে এক সর্বব্যাপী মানবতাবাদ কাজ করেছে। তাঁর কৈফিয়ত দানের মধ্যে দিয়ে বার বার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ধর্মভেদ, জাতিভেদ, মানুষে-মানুষে বৈষম্য আর ভণ্ডামির তিক্ত অভিঘাত। সাম্যের গান গেয়ে, মানুষকেই বড় ভেবে, মহীয়ান ভেবে সারাজীবন তিনি আপন বৃত্তে অবস্থান করেছেন। মানুষের লাঞ্ছনা, দুর্দশা দেখে ব্যথিত হয়েছেন। মেকি নেতাদের, বিলাসী সাহিত্যিকদের, পুঁথি পড়া ধর্মগুরুদের তথাকথিত বিধান কত প্রাণহীন, শুষ্ক, অমানবিক তার প্রতিবাদ করেছেন। তাঁর এক পেলব অনুভূতিপ্রবণ উদার প্রকৃতি দেশদরদী হৃদয় ছিল বলেই তিনি সহ্য করতে পারেননি। আর মাটির পৃথিবী থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ঊর্ধ্বচারীও হতে পারেননি। মানুষের মুখ তিনি দেখেছেন, মানুষের যন্ত্রণার গান তিনি শুনেছেন, মানুষের হাহাকার তিনি অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছেন। মার্কসীয় মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে সশস্ত্র বিপ্লবের উত্থান কামনা করে তিনি যে সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তা সম্ভব হয়নি। তার বদলে জ্বালাময়ী রচনায় তিনি মানুষকে উদ্দীপ্ত করতে চেয়েছেন। অমর কাব্য লিখে কালজয়ী হবার বা যশস্বী হবার আকাঙ্ক্ষা কবির নেই। অমর কাব্য লিখতে গেলে যে স্থিরতা, নিরবচ্ছিন্ন সাধনা দরকার তার সময় কবির ছিল না। তিনি যুগের কবি মাত্র, যুগাতীত হতে চান না। সবার মাথার উপর চিরসূর্যের দীপ্তিতে বিরাজমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তিনিই বেঁচে থাকবেন সবার হৃদয়ে। তাঁর জ্যোতিবলয়ে পাক খাবে শত শত বাংলার কবিরা। কবিই শুধু আলাদা। কল্পনা নয়, তত্ত্ব নয়, আদর্শ নয়, রসতীর্থ কোনও পথেরই পথিক তিনি নন। তিনি প্রতিবাদের, বিপ্লবের, বিদ্রোহের কবি । তাই নিজের মর্মবেদনা, ক্রোধ, অভিশাপ উজাড় করে তিনি উচ্চারণ করেছেন :
 
“প্রার্থনা করো — যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্তলেখায় তাদের সর্বনাশ।"
 
এখানেই মানবতার জয় ঘোষণা। যতই কবিকে ছন্নছাড়া, অন্ধ আবেগসর্বস্ব, দুর্বোধ্য মনে হোক —মানুষের কাছে তিনি নিজেকে ধরা দিয়েছেন। মানবপ্রেমের কাছে নিজেকে দায়বদ্ধ রেখেছেন। কবির পরিচয় তিনি হিন্দু নন, মুসলমান নন —তিনি মানুষ। এই অসাম্প্রদায়িক চেতনা তাঁর সমগ্র জীবনপরিধিতে বেজে উঠেছে। তিনি “রাজবন্দীর জবানবন্দী"তে নিজেকে সৈনিক হিসেবেই উল্লেখ করেছেন।
 
      কবি তাঁর গণমুখী অবস্থান সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন বলেই রসসৃষ্টি, ব্যঞ্জনা সৃষ্টির দিকে মনোযোগ দেননি। কাব্যমূল্য থেকে ঢের বেশি মূল্য দিয়েছেন বর্তমানের ইতিবৃত্ত এবং মানুষ। আর সেই কারণেই কৃষক, শ্রমিক তাঁর কাব্যে অস্থিদানকারী দধীচি হয়ে উঠেছে। “ফরিয়াদ" কবিতায় এই প্রতিধ্বনি শুনতে পাই :
 
“এই ধরণীর ধুলিমাখা তব অসহায় সন্তান
মাগে প্রতিকার, উত্তর দাও, আদিপিতা ভগবান।"
 
নজরুলের এই সংগ্রাম মানবতাবোধেরই উৎস থেকে আত্মবোধে উৎক্ষিপ্ত হয়েছে।
 
       নজরুলের বিদ্রোহের মূলভিত্তি ছিল সাম্যবাদী চেতনা। তিনি সমাজে যে অন্যায় অবিচার পীড়ন বঞ্চনা লক্ষ করেছিলেন তার মূলে ছিল সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মনৈতিক নানা বৈষম্য। যার জন্য মানুষের প্রকৃত মূল্য তিনি খুঁজে পাননি। তাঁর সাম্যচিন্তার কতকগুলি দিক আমাদের চোখে পড়ে :
 
ক) শাসক ও শাসিতের বৈষম্য
খ) শোষক ও শোষিতের বৈষম্য
গ) নারী ও পুরুষের বৈষম্য
গ) ধার্মিক ও পাপীর বৈষম্য
 
১৯২৫ সালের ডিসেম্বর মাসে “লাঙল" পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় “সাম্যবাদী" নামে একটি দীর্ঘ কবিতা লেখেন। মূল কবিতাকে কয়েকটি অংশে ভাগ করে আলাদা আলাদা নামকরণও করেন। যেমন : সাম্যবাদী, ঈশ্বর, মানুষ, পাপ, বারাঙ্গনা, নারী, কুলিমজুর প্রভৃতি । এই কবিতার জন্য পত্রিকার চাহিদা প্রচুর বেড়ে যায়। ফলে পাঠকের আগ্রহের কারণে “সাম্যবাদী" নাম দিয়ে একটা কাব্যই প্রকাশ করেন। পরে তা “সর্বহারা" নামে মূল কাব্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই সাম্যবাদী কবিতাতেই নজরুলের মানবতাবাদ ও সাম্যবাদ ভাবনার বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে।
 
      কবি এক উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মানবতাবাদের জয়গান গেয়েছেন। যে মানবতাবাদ রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথের কণ্ঠেও ধ্বনিত হয়েছে। যে মানবতাবাদ বাংলার কবি-মনীষীরা বার বার উচ্চারণ করেছেন। সত্যেন্দ্রনাথের কণ্ঠে আমরা শুনেছিলাম :
 
“জগতে এসেছে নতুনমন্ত্র বন্ধন ভয়হারী
সাম্যের মহাসংগীত সব গাহ মিলি নর-নারী।"
 
রবীন্দ্রনাথের “এই মানবের মহাসাগরের তীরে জাগোরে ধীরে"  অথবা বিবেকানন্দের চণ্ডাল ভারতবাসী, মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসীকে “ভাই" বলে ডাকার আবেদনেই সাম্যবাদী চেতনা লুকিয়ে ছিল। যার উত্তরসূরী হিসেবে নজরুলের আগমন ঘটল। চণ্ডীদাস আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন —“সবার উপরে মানুষ শ্রেষ্ঠ, স্রষ্টা আছে বা নাই"—সেই সূত্রেই আমাদের মনন-মানসিকতায় মানবতাবাদের প্রশ্রয় ও প্রসার ঘটতে শুরু করেছে। নজরুল উদ্দাম তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে দিতে চাইলেন নানা অসাম্যকে। তার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন সর্বক্ষেত্রে সাম্য নীতিকে। মানবতাবাদ আরও দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হল।
 
        পলাশীর প্রান্তরে বাঙালির খুনে ক্লাইভের খঞ্জর রঙিন হয়ে ওঠার পর থেকেই “বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ড রূপে পোহাল শর্বরী"। তখন থেকে শাসক ও শাসিতের মধ্যে দেখা গেল বৈষম্য। ইংরেজ ও ভারতবাসী। সাদা চামড়া, কালো চামড়া। ভারতবাসী শিক্ষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, কর্ম সব ক্ষেত্রেই বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত হতে লাগল। ভারতবাসীর মনুষ্যত্ব শাসকগোষ্ঠীর কাছে উপেক্ষিত হল। বুটের লাথি, চাবুকের আঘাতে এদেশের কৃষক সাধারণ শ্রমজীবী মানুষেরা হল জর্জরিত। বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান ফেনিয়ে উঠল । বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদতে লাগল। নজরুল ডাক দিলেন দুর্গতিনাশিনীকে :
 
“আর কতকাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল!"
                                            (আনন্দময়ীর আগমনে)
 
শাসকগোষ্ঠীর এই বৈষম্যের চূড়ান্ত রূপ দেখা গেল “কুলিমজুর" অংশে। শ্বেতাঙ্গ ইংরেজ সাহেবের বুটের ঘা খেয়ে কুলি-মুটে-মজুরেরা রেলের নিচে পড়ে যায়। তাদের চোখ ফেটে জল আসে। যে আরাম আয়াস বিলাসের মধ্যে তারা জীবন কাটাচ্ছে তার সব উপকরণ এই কুলিমজুরদেরই অবদান। পাহাড় কেটে পথ তৈরি করেছে, জঙ্গল কেটে প্রাসাদ বসিয়েছে। এককথায় পৃথিবীর স্বর্গ নির্মাণে তারাই বিশ্বকর্মা, কিন্তু তাদের প্রতি এমন হৃদয়হীন ব্যবহার কবি সহ্য করেননি। প্রতিবাদে গর্জে উঠেছেন :
 
“এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মারখাবে দুর্বল?"
 
কুলিমজুর হলেও তারা মানুষ, তাদেরও সকলের সাথে বেঁচে থাকার সমান অধিকার আছে, এ দাবি চিরন্তন। তাই তাদের জন্য কবির এই স্তুতি :
 
“তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান।"
 
    পৃথিবীর সকল নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ-জাতি, ধনী-দরিদ্রের মধ্যে কোনও পার্থক্য থাকতে পারে না। মানুষকে শুধু মানুষ নামেই ডাকা যাবে। কোনও শ্রেণিকরণ করা চলবে না। “সাম্যবাদী" কবিতার প্রথমেই কবি গাইলেন :
 
“গাহি সাম্যের গান —
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান ।
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ মুসলিম-ক্রিশ্চান।"
 
এই সাম্যবাদের পথ ধরেই মানুষকেই কবি বড় করে দেখেছেন। পার্সী, জৈন, ইহুদী, সাঁওতাল, ভীল, গারো যে যে-জাতি হবে হোক ; যে ধর্ম পালন করবে করুক ; কোরান, পুরাণ, বেদ-বেদান্ত, বাইবেল, ত্রিপিটক, জেন্দাবেস্তা, গ্রন্থসাহেব যা খুশি পড়ুক —মানুষকে ভালবাসার থেকে আর বড় ধর্ম কিছু নেই। মানুষের হৃদয়ই বড় কাবা-মন্দির :
 
“সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা খুলে দেখ নিজ প্রাণ।"
 
এই জন্য কোথাও তীর্থে যাওয়ারও দরকার নেই। নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন, বুদ্ধগয়া, জেরুজালেম, মদিনা, কাবাভবন সবই এই হৃদয়। ঈশ্বর হৃদয়েই বিরাজ করেন। যত মহামানব যুগে যুগে পৃথিবীতে এসেছেন, তাঁরা অতি সাধারণ মানুষ হিসেবেই এসেছেন। আর আপন অন্তরের মধ্যেই ঈশ্বরের রূপ দেখেছেন। কুরুক্ষেত্রের হিংসাশ্রয়ী দ্বন্দ্বের মধ্যে শাশ্বত প্রেমের বাণী নিয়ে এসেছেন শ্রীকৃষ্ণ, মেষের রাখাল হয়ে এসেছেন হজরত মুহাম্মদ ; শাক্যমুনি মানুষের দুঃখে রাজ্য ত্যাগ করেছেন। কবি তাই সকল ভেদাভেদ ভুলে হৃদয়ধর্মের আরাধনায় ঈশ্বর প্রাপ্তির শেষ সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন :
 
“এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির কাবা নাই!"
 
“মানুষ" অংশেও যেন এ-কথারই প্রতিধ্বনি। সূচনায় কবি উল্লেখ করেছেন :
 
"গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!"
 
দুটি ঘটনা উল্লেখ করে তিনি সমাজে ধর্মধ্বজাধারী মানুষের সঙ্গে অনাহারজীর্ণ মানুষের লাঞ্ছনা দেখিয়েছেন। মন্দিরের পুরোহিত মন্দিরের মধ্যে এক ভিখিরির খাদ্যের প্রার্থনা গ্রাহ্য না করে তাকে দুর দুর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। তেমনি মসজিদে অঢেল গোস্ত-রুটি থাকা সত্ত্বেও ভুখারী মুসাফিরকে মোল্লা সাহেব নামাজ না-পড়ার আছিলায় এক মুঠোও দেয় না। এইভাবেই পুরোহিত-মোল্লারা সব মন্দির-মসজিদ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির আখড়ায় পরিণত করেছে। এই ভেদ-বৈষম্যকে আঘাত হানলেন। চিরকাল অসহায় মানুষেরা এভাবে লাঞ্ছিত এবং ধর্মের নামে এক শ্রেণির মানুষ তাদের উপর অত্যাচার চালাবে তা হতে পারে না। এরা স্বার্থবাজ, ভণ্ড। মানুষের জন্যই ধর্ম এসেছে, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। মানুষই শাস্ত্র রচনা করেছে, শাস্ত্র মানুষ সৃষ্টি করেনি। মানুষের বেশেই এসেছেন ঈশ্বর প্রেমের বাণী শোনাতে। কোনও মানুষকেই ঘৃণা করা, অবজ্ঞা করা উচিত নয়। যে ভিখিরিকে লাঞ্ছিত করা হল, “তারি মাঝে কবে এলো ভোলানাথ গিরিজায়া তা কি চিনি"?
 
দেবতা মানুষের বেশেই প্রতিনিয়ত আমাদের সংসারে বিরাজ করেন। অতএব “ জীবে প্রেম করে যেই জন,
                         সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।"
     যদি কোনও মানুষ পাপীও হয়, তবু তাকে ঘৃণা করা উচিত নয়। কারণ পাপীও মানুষ। পৃথিবীটাই একটা পাপের মুলুক। এখানে কেউ সাধু নয়। তেত্রিশ কোটি দেবতা পর্যন্ত কামনার শিকার। আদম হতে কবি পর্যন্ত সকলেই পাপের কবলে পতিত হতে বাধ্য। সুখ-দুঃখ, সাদা-কালো, দিন-রাত্রি যেমন আছে, তেমনি পাপ-পুণ্যও থাকবে। অন্য কেউকে পাপী বলে ঘৃণা করার আগে নিজেকে জানা প্রত্যেকেরই কর্তব্য। টুপি পরে, টিকি রেখে নিজেকে ধার্মিক বলে ঘোষণা করার প্রয়োজন নেই। বরং এই আস্ফালনের মধ্যেও পাপ লুকিয়ে আছে। কবি এখানেও ঘোষণা করেছেন :
 
“সাম্যের গান গাই! —
যত পাপী তাপী সব মোর বোন, সব হয় মোর ভাই!"
 
পুরুষ শাসিত সমাজে যুগ যুগ ধরে নারীরা নির্যাতিতা হয়ে আসছে। মানুষ হিসেবে নারীদের কখনোই গণ্য করা হয় না। তারাও যে পুরুষের সমকক্ষ, সমানভাবে বাঁচার অধিকার তাঁদেরও আছে কবি তা লক্ষ করেছেন। নানা পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ করে দেখিয়েছেন কোনও কোনও ক্ষেত্রে নারীরাও পুরুষের থেকে শ্রেষ্ঠ। পৃথিবী এত সুন্দর, এত কল্যাণময় হয়ে ওঠার কারণ পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও আছে বলে। যুদ্ধে, শাসনে, জ্ঞানে, সঙ্গীতে, শস্যক্ষেত্রে সর্বত্র নারী অংশ গ্রহণ করে চলেছে। অথচ পুরুষ সমাজ অন্যায়ভাবে নারীকে আলাদা করে রাখতে চায়। কবি তাই ঘোষণা করলেন :
 
“সাম্যের গান গাই
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!"
 
অথবা,
 
“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।"
 
মধ্যযুগের বর্বরতা আর নেই। নারীর আপন ভাগ্য জয় করার সময় এসেছে। পুরুষের নির্ধারিত নীতি-নিয়ম তারা নাও মানতে পারে। কবি কারণ হিসেবে উল্লেখ করলেন :
 
“বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি ।"
 
কেউ কারও বন্দি থাকবে না। আর বন্দি করলেও যুগের নিয়মে সে পীড়ন এসে তাকেই পীড়া দেবে। কবি দূরদ্রষ্টার মতো নারী-স্বাধীনতার ভবিষ্যৎবাণী করেছেন :
 
“সে-দিন সুদূর নয় —
যে-দিন ধরণী পুরুষের সাথে গাইবে নারীরও জয়!"
 
“বারাঙ্গনা" অংশে নারীকে বারাঙ্গনা বলে ঘৃণা করেননি। এখানেও দেবতা থেকে মানুষ —সকলের কামনার ক্ষুধায় নারীরা বারাঙ্গনা হতে বাধ্য হয়েছে। আবার যাদের আমরা বারাঙ্গনা বলি, তাদের পেটেই অনেক মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেছেন। কবি বলেন :
 
“শোনো মানুষের বাণী
জন্মের পর মানবজাতির থাকে না'ক কোনো গ্লানি!"
 
অতএব সতী-অসতীর কোনও ভেদ নেই। জারজ-কামজের কোনও তফাত নেই। জন্মের প্রক্রিয়ায়, কামচরিতার্থের প্রক্রিয়ায় সকলে একই।
 
     এইভাবে সমগ্র কবিতাটিতে সাম্যবাদের আলো-বাতাসকে তিনি প্রজ্জ্বলিত, প্রবাহিত করে দিয়েছেন। কবির মূলমন্ত্র মানুষ। “মানুষ" নামকরণের মধ্যে দিয়েই তিনি তাঁর আকাঙ্ক্ষিত বলিষ্ঠ মানবতাকেই তুলে ধরতে চেয়েছেন। 

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.