সাহিত্যের ঘোরে রাজপথ ছেড়ে হারিয়ে যেতেন অচেনা ভূবনে_সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল
আবদুল
মান্নান সৈয়দ কখন কি ভাবে যে
‘মান্নান ভাই’ হয়ে গেলেন, তা বলা মুশকিল।
আশি দশকের শুরুতে আমরা ‘লিটল ম্যাগে’র প্রতিশব্দ হিসেবে
‘ছোটকাগজ’ হিসেবে চালু করার সিদ্ধান্ত নেই। সেই প্রেক্ষিতে আরো অনেক পরে আমি, ফরিদ কবির এবং মাহমুদ মান্নান ‘ছোটকাগজ’ সম্পাদনা করি। ছোটকাগজ থেকে প্রথম কবিদের স্বকন্ঠে কবিতার ক্যাসেট বের করি। রাত বারোটা এক মিনিটে প্রতি
২০/২১ ফেরুয়ারি টিএসসির
সড়কদ্বীপে কবিতা পাঠের আয়োজন করি। এভাবে আমরা ‘ছোটকাগজ’ নিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখি। মান্নান ভাই আমাদের সাথে সরাসরি যুক্ত না হলেও নেপথ্য
থেকে প্রেরণা
ও পরামর্শ দিতেন, লিখতেন।
বর্তমানে মুদ্রণ যত সহজ, সেই সময় আমরা হ্যান্ড কম্পোজ, গেলি প্রুফ, কাঠের ব্লক, লেটার প্রেসে বহু কষ্ট করে, ধৈর্য ধরে রাতদিন পরিশ্রম করে কখনো পরনো ঢাকায় বুলবুল চৌধুরীর প্রেসে বা তাহেরবাগ লেনে কিংবা হাতিরপুরের গলি অথবা আজিমপুরের ছাপড়া মসজিদের কাছাকাছি কোথাও পত্রিকার কাজ করতাম।
এভাবেই সত্তর দশকের আনওয়ার আহমদ, হারুন হাবীব, আবিদ আজাদ, ফারুক মাহমুদ, শহিদুজ্জামান ফিরোজ, আশরাফ আহমদ, হালিম আজাদ, সলিমুল্লাহ খান, তুষার-লালন-মুজাহিদ-সেলিম, আবু সাইদ জুবেরী, আহমদ বশীর, হারুন রশিদ, তসলিমা নাসরিনেরা শিল্পতরু, নতুন কবিতা, স্বকাল, প্রাক্সিস জার্নাল, তারুণ্য, সিম্ফনী, ঢেউ, রূপম-কিছুধ্বনি সম্পাদনা করতেন। তাঁদের অনেকেই ‘চারিত্র’র সম্পাদক মান্নান সৈয়দকে ঘিরে গ্রীনরোডে প্রতি শুক্রবার সকাল থেকে মধ্য দুপুর পর্যন্ত আড্ডা যোগ দিতেন। প্রথমে মান্নান সৈয়দকে তাঁর বড় ভাইয়ের ওষুধের দোকানে, পরে ভোজনবিলাস চায়ের দোকানে আমাদের দীর্ঘ আড্ডা চলতো। তাঁর করতলে মহাদেশ, তাঁর হাতে শুদ্ধতম কবি, তিনি দশ দিগন্তের দ্রষ্টা । আমরা মুগ্ধ হয়ে পড়তাম আর আড্ডায় শোনতাম- কলকাতার কথা, অপ্রকাশিত জীবনানন্দ দাশের গল্প, বুদ্ধদেব বসুর কবিতা। কিংবা পাকিস্তান আমলে অর্থাৎ ১৯৬৮ সালে আইয়ূব সরকার সমকামের অভিযোগে কি ভাবে নিষিদ্ধ হলো- তাঁর গল্পগ্রন্থ- ‘সত্যের মত বদমাশ’।
আমাদের সেই স্মৃতিময় আড্ডার সময় লিখছেন- ‘কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড’। ভিন্ন মেজাজের মজার মজার কবিতা। তরতাজা কবিতাগুলো আড্ডায় পড়ে শোনাতেন। তাঁর এক বইয়ের কবিতা থেকে আরেক বইয়ের কবিতার সম্পূর্ণ পৃথক। ফলে ‘জ্যোৎস্না রৌদ্রের চিকিৎসা’, ‘ও সংবেদন ও জলতরঙ্গ’, ‘ কবিতাগুচ্ছ’, ‘মাছ সিরিজ’, ‘পরাবাস্তব কবিতা’র ধারায় কোনো মিল নেই। গবেষণায় নিমগ্ন মান্নান সৈয়দের কবিতাও ছিলো স্বতন্ত্র স্বাদ। আমি তাঁর ‘কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড’ নিয়ে একটি আলোচনা লিখলাম আমার সম্পাদনায় ‘প্রচ্ছদে’। লেখাটি পড়ে ‘পরাবাস্তব কবিতা’ নিয়ে লেখার জন্য একটি বই দিয়ে বললেন, রিভিউটা লিখে আমাকে দিবেন।
পরের সাপ্তাহিক আড্ডায় আলোচনাটা দিলাম। তিনি চায়ে চুমুক দিতে দিয়েই পড়ে শেষ করে হো হো করে হাসলেন। হাসির অর্থ থেকে বোঝা গেলো লেখাটি পছন্দ করেছেন। কিন্তু খুবই একটি ‘অপছন্দের’ কাজ করে বসলেন মান্নান ভাই। লেখাটি ছাপতে দিলেন তাঁর প্রিয় ছাত্র সাজ্জাদ হোসাইন খানের কাছে, দৈনিক সংগ্রামে! যার জন্য আমি সারা জীবনের জন্য বিব্রত হয়ে আছি। কারণ, অই কাগজটিতে জীবনে আমার একটি লেখাই ছাপা হয়েছে- ‘মান্নান সৈয়দের সুরলিজম কবিতা’।
এই নিয়ে মান্নান ভাইয়ের সাথে অনেক দিন কথা বন্ধ ছিলো। শুধু একবার নয়, অনেক বার তাঁর সাথে আমার ঝগড়া হয়েছে, কথা বন্ধ হয়েছে। আর এ সব মান-অভিমান, রাগ-অনুরাগ ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে নয়; সম্পূর্ণ সাহিত্য সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে। আজ তার রগ চটা আচরণের কয়েকটি চিত্র উপস্থাপন করতে চাই।
সিনে সাপ্তাহিক চিত্রালী আর সাপ্তাহিক পূর্বানীতে দু’টো লেখা জন্য মান্নান ভাই আমার সাথে বেশ কয়েক বছর কথা বলেন নি। ফারুখ ফয়সলের অনুরোধে শামসুর রাহমানের ‘অধুনা’ এবং মান্নান সৈয়দের ‘চারিত্র’ নিয়ে লিখলাম। ম্যাকাপের সময় ফারুখ ফয়সল খুঁজে পাননি মান্নান ভাইয়ের ছবি। তাই ‘অধুনা’র প্রচ্ছদের পাশে রাহমান ভাইয়ের ছবি ছাপা হলেও ‘চারিত্রে’র পাশের বক্সে সেখানে তাঁর ছবি যাবার কথা ছিলো, সেটা কালোকালির ব্রাশ টেনে দিয়েছিলেন!
আর পূর্বাণীতে শেখ আব্দুর রহমান ছাপলেন- মুক্তধারা থেকে প্রকাশিত ‘মান্নান সৈয়দের শ্রেষ্ঠ কবিতা’র আলোচনা। বইটির সবুজ রঙের প্রচ্ছদে মান্নান ভাইয়ের নাম জিংকের ব্লকে ভুল ছিলো, আব্দুল মন্নান সৈয়দ। আর বইয়ের শেষে তাঁর পরিচিতিতেও ছিলো এক অদ্ভূত মুদ্রণ প্রমাদ। যা অর্থের আকাশ-পাতাল বদলিয়ে দিয়েছিলো। সত্যের মত বদমাশ, হয়েছিলো- ‘সত্যের মাতা বদমাশ’! এই মুদ্রণত্রুটি তুলে ধরার জন্য এমন খ্যাপা খ্যাপলেন যে, ক’বছর পর পুরানা পল্টনস্থ তৎকালীন ভোরের কাগজের অফিসে সাহিত্য সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফের কক্ষে দেখা। আমরা দু’জন বসে আছি। দু’তিন বার জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন আছেন মান্নান ভাই?’ অনেক্কখণ পর বললেন, আরো পাঁচ বছর পর আপনার সাথে কথা হবে। কারণ, আপনারা শামসুর রাহমানের ছবি ছাপবেন আর মান্নান সৈয়দকে ব্ল্যাক করে ‘ব্ল্যাক লিষ্ট’ করবেন। তা তো হতে পারেনা!
পরে আবার আমাদের সম্পর্ক ভালো হলে প্রায়ই আজিজ সুপার মার্কেটে ‘পাঠক সমাবেশে’ এলেই মাঝে মাঝে আমার কার্যালয়ে আসতেন, আড্ডা দিতেন। পরে কুমিল্লা থেকে প্রদত্ত ২০০২ সালে অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার দিলে তিনি খুশি হয়ে বললেন, আমি কলকাতা ছাড়া পৃথিবীর কোথাও যাইনি। আপনার তো আন্তর্জাতিক যোগাযোগ আছে, আমাকে একবার লন্ডন নিউ ইয়্যূর্ক পাঠানোর ব্যবস্থা করেন, ঘুরে আসি।
২০০৪ সালে আমি লন্ডনে গিয়ে ‘নজরুল পরিষদে’র সাথে আলাপ করে পরবর্তী ১১ জ্যৈষ্ঠের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে মান্নান ভাইকে ঠিক করে নিমন্ত্রণ, নজরুলের ছবি সম্বলিত টিশার্ট, পুরনো ব্রুশিয়ার নিয়ে আসি। মান্নান ভাই তখল নজরুল ইনিষ্ট্রিটিউটের নির্বাহী পরিচালক। খবরটা পেয়ে তিনি বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কিন্তু নিজের কারণে আর যেতে পারেননি। কারণ, কিছু দিন পর ‘নজরুল পরিষদের’ পক্ষে লন্ডন থেকে আনুষ্ঠানিক নিমন্ত্রণ নিয়ে এসে মান্নান ভাইয়ের অফিস এবং বাসায় বার বার ফোন করেছিলেন। অফিসে ফোন ধরেন নি, ব্যস্ততা আর অচেনা ব্যক্তি হিসেবে আর বাসায় ফোন করলে তিনি কখনো লিখছেন, কখনো ঘুমুচ্ছেন। পরে ‘নজরুল পরিষদের’ সেই ব্যক্তি রাগ করে তাঁকে বাদ দিয়ে সম্ভবত আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদকে নিয়ে যান।
অনেকদিন পর মান্নান ভাইকে এই ঘটনা বললে, তিনি খুব হতাশ হন!
পরে মান্নান ভাইয়ের সাথে এতো খাতির হয় যে, সর্বশেষ প্রেমে পরা মেয়েটিকে নিয়ে লেখা খড়সা কবিতা পড়ে শোনাতেন, তার গল্প করতেন আর প্রাণ খুলে খুব সুখের হাসি হাসতেন। তখন আমি ঢাকায়। আমার ‘নীড়ে নিরুদ্দেশে’ দ্বিতীয় মুদণ হবে শোনে বললেন- ‘দাঁড়ান, আমি একটা ভূমিকা লিখে দিচ্ছি’। পাঠক সমাবেশের দোতলা অফিসে বসে লিখে দিলেন দু’পাতার অপূর্ব ভূমিকা। যাতে প্রশংসা করতে বিন্দুমাত্র কর্পণ্য করেননি।
আজ থেকে সাতাশ-আটাশ বছর আগে, ১৯৮৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর নাসিমা সুলতানা আর আমার যৌথ কাব্যগ্রন্থ ‘তবু কেউ কারো নই’এর প্রকাশনা উৎসবে মান্নান ভাই বলেছিলেন-‘সত্তর দশকের শেষ দিকে যে ক’জন কবি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, তাদের মধ্যে নাসিমা ও দুলাল অন্যতম। দুলালের কবিতায় সময় ও সমাজের চিত্র চমৎকার। শৈল্পিক নান্দনিকতায় পাঠককে আকৃষ্ঠ করে, মুগ্ধ করে’।
সাহিত্যের ঘোর লাগা মান্নান সৈয়দ আপাদমস্তক একজন নিবেদিত সাহিত্যকর্মী ছিলেন। তবে মোটেও আত্মভোলা ছিলেন না। তিনি নিজের উপর গবেষণা করতেন। বলতেন- ‘নিজের লেখা, নিজের উপর লেখা সব গুছিয়ে যত্ন করে রাখবেন। কাজে লাগবে। আপনি আমাকে নিয়ে যা যা লিখেছেন, তা আমাকে দিবেন। আমি সব সংগ্রহ করছি। জীবননান্দকে নিয়ে আপনার লেখা একটি কবিতায় আমার নাম আছে, সেটিও চাই’।
সূচিপত্রের ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮ সংখ্যায় কবিদেরকে দিয়ে নিজের সদ্য প্রকাশিত বইয়ের উপর আত্মসমালোচনামূলক লেখা ছাপি। বিষয়টি মান্নান ভাই খুব মজা পেয়েছিলে এবং ‘মাছ সিরিজ’ বইটি নিয়ে লিখেছিলেন- “১৯৮৪ সালে বেরিয়েছিল আমারা শেষ একক কবিতা গ্রন্থ ‘মাছ সিরিজ’।… এক শরতে লিখেছিলাম এই কবিতাগুচ্ছের অধিকাংশ; আর এক শরতে লিখছি এই কবিতাগুলো সম্পর্কে।… কবিতা আমি কখনো ঠিক একটানা লিখিনি। হঠাৎ আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে একটানা কিছু দিন লিখতে লিখতে স্বপ্নকল্পনার এমন এক জগতে প্রবেশ করি যে নিজেরই ভয় লাগে এ কোথায় যাচ্ছি! রাজপথ ছেড়ে গলি থেকে কোন, উপ-গলির ভেতর। এদিকে আমার উচ্ছ্বসিত আবেগ কিছুদিন পরেই থিতিয়ে আসে। কবিতা তখন আপনিই ছেড়ে যায়। আমার কবিতাগুলি এরকমভাবেই এক-একটি ঋতুপরিসরে লেখা। হয় কি, কবিতা লিখছি না কবিতা লিখছি না, তারপর হঠাৎ একদিন জোয়ারের মতো এসে পড়ে কবিতা, আমাকে প্রায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ক’টা দিন বা সপ্তা বা মাস কেটে যায় একটা ঘোরের ভেতর। তারপর আবার যে-আমি-সেই’...
এই মান্নান সৈয়দ, সেই মান্নান সৈয়দ- যিনি সাহিত্যের ঘন ঘোরে রাজপথ ছেড়ে গলি, উপ-গলি পেরিয়ে হারিয়ে যেতেন অচেনা এক জগতে। আর এখন হারিয়ে গেছেন আরেক অজানার দেশে*।
(জন্ম : আগস্ট ০৩, ১৯৪৩ ।। মৃত্যু: সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১০)
১]*
'কাছের মানুষ দূরের মানুষ' গ্রন্থ থেকে।
২] আমাদের 'তবু কেউ কারো নই' অনুষ্ঠানে (১৯৮৫) ছবিতে কবি ইমরান নূর, নাসিমা সুলতানা, আবদুল মান্নান সৈয়দ এবং সৈয়দ আলী আহসান। আজ আর এঁরা কেউ বেঁচে নেই।
বর্তমানে মুদ্রণ যত সহজ, সেই সময় আমরা হ্যান্ড কম্পোজ, গেলি প্রুফ, কাঠের ব্লক, লেটার প্রেসে বহু কষ্ট করে, ধৈর্য ধরে রাতদিন পরিশ্রম করে কখনো পরনো ঢাকায় বুলবুল চৌধুরীর প্রেসে বা তাহেরবাগ লেনে কিংবা হাতিরপুরের গলি অথবা আজিমপুরের ছাপড়া মসজিদের কাছাকাছি কোথাও পত্রিকার কাজ করতাম।
এভাবেই সত্তর দশকের আনওয়ার আহমদ, হারুন হাবীব, আবিদ আজাদ, ফারুক মাহমুদ, শহিদুজ্জামান ফিরোজ, আশরাফ আহমদ, হালিম আজাদ, সলিমুল্লাহ খান, তুষার-লালন-মুজাহিদ-সেলিম, আবু সাইদ জুবেরী, আহমদ বশীর, হারুন রশিদ, তসলিমা নাসরিনেরা শিল্পতরু, নতুন কবিতা, স্বকাল, প্রাক্সিস জার্নাল, তারুণ্য, সিম্ফনী, ঢেউ, রূপম-কিছুধ্বনি সম্পাদনা করতেন। তাঁদের অনেকেই ‘চারিত্র’র সম্পাদক মান্নান সৈয়দকে ঘিরে গ্রীনরোডে প্রতি শুক্রবার সকাল থেকে মধ্য দুপুর পর্যন্ত আড্ডা যোগ দিতেন। প্রথমে মান্নান সৈয়দকে তাঁর বড় ভাইয়ের ওষুধের দোকানে, পরে ভোজনবিলাস চায়ের দোকানে আমাদের দীর্ঘ আড্ডা চলতো। তাঁর করতলে মহাদেশ, তাঁর হাতে শুদ্ধতম কবি, তিনি দশ দিগন্তের দ্রষ্টা । আমরা মুগ্ধ হয়ে পড়তাম আর আড্ডায় শোনতাম- কলকাতার কথা, অপ্রকাশিত জীবনানন্দ দাশের গল্প, বুদ্ধদেব বসুর কবিতা। কিংবা পাকিস্তান আমলে অর্থাৎ ১৯৬৮ সালে আইয়ূব সরকার সমকামের অভিযোগে কি ভাবে নিষিদ্ধ হলো- তাঁর গল্পগ্রন্থ- ‘সত্যের মত বদমাশ’।
আমাদের সেই স্মৃতিময় আড্ডার সময় লিখছেন- ‘কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড’। ভিন্ন মেজাজের মজার মজার কবিতা। তরতাজা কবিতাগুলো আড্ডায় পড়ে শোনাতেন। তাঁর এক বইয়ের কবিতা থেকে আরেক বইয়ের কবিতার সম্পূর্ণ পৃথক। ফলে ‘জ্যোৎস্না রৌদ্রের চিকিৎসা’, ‘ও সংবেদন ও জলতরঙ্গ’, ‘ কবিতাগুচ্ছ’, ‘মাছ সিরিজ’, ‘পরাবাস্তব কবিতা’র ধারায় কোনো মিল নেই। গবেষণায় নিমগ্ন মান্নান সৈয়দের কবিতাও ছিলো স্বতন্ত্র স্বাদ। আমি তাঁর ‘কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড’ নিয়ে একটি আলোচনা লিখলাম আমার সম্পাদনায় ‘প্রচ্ছদে’। লেখাটি পড়ে ‘পরাবাস্তব কবিতা’ নিয়ে লেখার জন্য একটি বই দিয়ে বললেন, রিভিউটা লিখে আমাকে দিবেন।
পরের সাপ্তাহিক আড্ডায় আলোচনাটা দিলাম। তিনি চায়ে চুমুক দিতে দিয়েই পড়ে শেষ করে হো হো করে হাসলেন। হাসির অর্থ থেকে বোঝা গেলো লেখাটি পছন্দ করেছেন। কিন্তু খুবই একটি ‘অপছন্দের’ কাজ করে বসলেন মান্নান ভাই। লেখাটি ছাপতে দিলেন তাঁর প্রিয় ছাত্র সাজ্জাদ হোসাইন খানের কাছে, দৈনিক সংগ্রামে! যার জন্য আমি সারা জীবনের জন্য বিব্রত হয়ে আছি। কারণ, অই কাগজটিতে জীবনে আমার একটি লেখাই ছাপা হয়েছে- ‘মান্নান সৈয়দের সুরলিজম কবিতা’।
এই নিয়ে মান্নান ভাইয়ের সাথে অনেক দিন কথা বন্ধ ছিলো। শুধু একবার নয়, অনেক বার তাঁর সাথে আমার ঝগড়া হয়েছে, কথা বন্ধ হয়েছে। আর এ সব মান-অভিমান, রাগ-অনুরাগ ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে নয়; সম্পূর্ণ সাহিত্য সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে। আজ তার রগ চটা আচরণের কয়েকটি চিত্র উপস্থাপন করতে চাই।
সিনে সাপ্তাহিক চিত্রালী আর সাপ্তাহিক পূর্বানীতে দু’টো লেখা জন্য মান্নান ভাই আমার সাথে বেশ কয়েক বছর কথা বলেন নি। ফারুখ ফয়সলের অনুরোধে শামসুর রাহমানের ‘অধুনা’ এবং মান্নান সৈয়দের ‘চারিত্র’ নিয়ে লিখলাম। ম্যাকাপের সময় ফারুখ ফয়সল খুঁজে পাননি মান্নান ভাইয়ের ছবি। তাই ‘অধুনা’র প্রচ্ছদের পাশে রাহমান ভাইয়ের ছবি ছাপা হলেও ‘চারিত্রে’র পাশের বক্সে সেখানে তাঁর ছবি যাবার কথা ছিলো, সেটা কালোকালির ব্রাশ টেনে দিয়েছিলেন!
আর পূর্বাণীতে শেখ আব্দুর রহমান ছাপলেন- মুক্তধারা থেকে প্রকাশিত ‘মান্নান সৈয়দের শ্রেষ্ঠ কবিতা’র আলোচনা। বইটির সবুজ রঙের প্রচ্ছদে মান্নান ভাইয়ের নাম জিংকের ব্লকে ভুল ছিলো, আব্দুল মন্নান সৈয়দ। আর বইয়ের শেষে তাঁর পরিচিতিতেও ছিলো এক অদ্ভূত মুদ্রণ প্রমাদ। যা অর্থের আকাশ-পাতাল বদলিয়ে দিয়েছিলো। সত্যের মত বদমাশ, হয়েছিলো- ‘সত্যের মাতা বদমাশ’! এই মুদ্রণত্রুটি তুলে ধরার জন্য এমন খ্যাপা খ্যাপলেন যে, ক’বছর পর পুরানা পল্টনস্থ তৎকালীন ভোরের কাগজের অফিসে সাহিত্য সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফের কক্ষে দেখা। আমরা দু’জন বসে আছি। দু’তিন বার জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন আছেন মান্নান ভাই?’ অনেক্কখণ পর বললেন, আরো পাঁচ বছর পর আপনার সাথে কথা হবে। কারণ, আপনারা শামসুর রাহমানের ছবি ছাপবেন আর মান্নান সৈয়দকে ব্ল্যাক করে ‘ব্ল্যাক লিষ্ট’ করবেন। তা তো হতে পারেনা!
পরে আবার আমাদের সম্পর্ক ভালো হলে প্রায়ই আজিজ সুপার মার্কেটে ‘পাঠক সমাবেশে’ এলেই মাঝে মাঝে আমার কার্যালয়ে আসতেন, আড্ডা দিতেন। পরে কুমিল্লা থেকে প্রদত্ত ২০০২ সালে অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার দিলে তিনি খুশি হয়ে বললেন, আমি কলকাতা ছাড়া পৃথিবীর কোথাও যাইনি। আপনার তো আন্তর্জাতিক যোগাযোগ আছে, আমাকে একবার লন্ডন নিউ ইয়্যূর্ক পাঠানোর ব্যবস্থা করেন, ঘুরে আসি।
২০০৪ সালে আমি লন্ডনে গিয়ে ‘নজরুল পরিষদে’র সাথে আলাপ করে পরবর্তী ১১ জ্যৈষ্ঠের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে মান্নান ভাইকে ঠিক করে নিমন্ত্রণ, নজরুলের ছবি সম্বলিত টিশার্ট, পুরনো ব্রুশিয়ার নিয়ে আসি। মান্নান ভাই তখল নজরুল ইনিষ্ট্রিটিউটের নির্বাহী পরিচালক। খবরটা পেয়ে তিনি বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কিন্তু নিজের কারণে আর যেতে পারেননি। কারণ, কিছু দিন পর ‘নজরুল পরিষদের’ পক্ষে লন্ডন থেকে আনুষ্ঠানিক নিমন্ত্রণ নিয়ে এসে মান্নান ভাইয়ের অফিস এবং বাসায় বার বার ফোন করেছিলেন। অফিসে ফোন ধরেন নি, ব্যস্ততা আর অচেনা ব্যক্তি হিসেবে আর বাসায় ফোন করলে তিনি কখনো লিখছেন, কখনো ঘুমুচ্ছেন। পরে ‘নজরুল পরিষদের’ সেই ব্যক্তি রাগ করে তাঁকে বাদ দিয়ে সম্ভবত আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদকে নিয়ে যান।
অনেকদিন পর মান্নান ভাইকে এই ঘটনা বললে, তিনি খুব হতাশ হন!
পরে মান্নান ভাইয়ের সাথে এতো খাতির হয় যে, সর্বশেষ প্রেমে পরা মেয়েটিকে নিয়ে লেখা খড়সা কবিতা পড়ে শোনাতেন, তার গল্প করতেন আর প্রাণ খুলে খুব সুখের হাসি হাসতেন। তখন আমি ঢাকায়। আমার ‘নীড়ে নিরুদ্দেশে’ দ্বিতীয় মুদণ হবে শোনে বললেন- ‘দাঁড়ান, আমি একটা ভূমিকা লিখে দিচ্ছি’। পাঠক সমাবেশের দোতলা অফিসে বসে লিখে দিলেন দু’পাতার অপূর্ব ভূমিকা। যাতে প্রশংসা করতে বিন্দুমাত্র কর্পণ্য করেননি।
আজ থেকে সাতাশ-আটাশ বছর আগে, ১৯৮৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর নাসিমা সুলতানা আর আমার যৌথ কাব্যগ্রন্থ ‘তবু কেউ কারো নই’এর প্রকাশনা উৎসবে মান্নান ভাই বলেছিলেন-‘সত্তর দশকের শেষ দিকে যে ক’জন কবি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, তাদের মধ্যে নাসিমা ও দুলাল অন্যতম। দুলালের কবিতায় সময় ও সমাজের চিত্র চমৎকার। শৈল্পিক নান্দনিকতায় পাঠককে আকৃষ্ঠ করে, মুগ্ধ করে’।
সাহিত্যের ঘোর লাগা মান্নান সৈয়দ আপাদমস্তক একজন নিবেদিত সাহিত্যকর্মী ছিলেন। তবে মোটেও আত্মভোলা ছিলেন না। তিনি নিজের উপর গবেষণা করতেন। বলতেন- ‘নিজের লেখা, নিজের উপর লেখা সব গুছিয়ে যত্ন করে রাখবেন। কাজে লাগবে। আপনি আমাকে নিয়ে যা যা লিখেছেন, তা আমাকে দিবেন। আমি সব সংগ্রহ করছি। জীবননান্দকে নিয়ে আপনার লেখা একটি কবিতায় আমার নাম আছে, সেটিও চাই’।
সূচিপত্রের ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮ সংখ্যায় কবিদেরকে দিয়ে নিজের সদ্য প্রকাশিত বইয়ের উপর আত্মসমালোচনামূলক লেখা ছাপি। বিষয়টি মান্নান ভাই খুব মজা পেয়েছিলে এবং ‘মাছ সিরিজ’ বইটি নিয়ে লিখেছিলেন- “১৯৮৪ সালে বেরিয়েছিল আমারা শেষ একক কবিতা গ্রন্থ ‘মাছ সিরিজ’।… এক শরতে লিখেছিলাম এই কবিতাগুচ্ছের অধিকাংশ; আর এক শরতে লিখছি এই কবিতাগুলো সম্পর্কে।… কবিতা আমি কখনো ঠিক একটানা লিখিনি। হঠাৎ আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে একটানা কিছু দিন লিখতে লিখতে স্বপ্নকল্পনার এমন এক জগতে প্রবেশ করি যে নিজেরই ভয় লাগে এ কোথায় যাচ্ছি! রাজপথ ছেড়ে গলি থেকে কোন, উপ-গলির ভেতর। এদিকে আমার উচ্ছ্বসিত আবেগ কিছুদিন পরেই থিতিয়ে আসে। কবিতা তখন আপনিই ছেড়ে যায়। আমার কবিতাগুলি এরকমভাবেই এক-একটি ঋতুপরিসরে লেখা। হয় কি, কবিতা লিখছি না কবিতা লিখছি না, তারপর হঠাৎ একদিন জোয়ারের মতো এসে পড়ে কবিতা, আমাকে প্রায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ক’টা দিন বা সপ্তা বা মাস কেটে যায় একটা ঘোরের ভেতর। তারপর আবার যে-আমি-সেই’...
এই মান্নান সৈয়দ, সেই মান্নান সৈয়দ- যিনি সাহিত্যের ঘন ঘোরে রাজপথ ছেড়ে গলি, উপ-গলি পেরিয়ে হারিয়ে যেতেন অচেনা এক জগতে। আর এখন হারিয়ে গেছেন আরেক অজানার দেশে*।
(জন্ম : আগস্ট ০৩, ১৯৪৩ ।। মৃত্যু: সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১০)
২] আমাদের 'তবু কেউ কারো নই' অনুষ্ঠানে (১৯৮৫) ছবিতে কবি ইমরান নূর, নাসিমা সুলতানা, আবদুল মান্নান সৈয়দ এবং সৈয়দ আলী আহসান। আজ আর এঁরা কেউ বেঁচে নেই।
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Facebook: facebook.com/samoiki
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments