আমার দ্বিতীয়বার ইংল্যান্ড সফর_মুহম্মদ মতিউর রহমান : পর্ব-৭
২৭ জুন, শনিবার
সকালে আমরা এখানকার বিখ্যাত হেন্রি ডুরালি জু’দেখতে যাব। কিন্তু ৯টায় বের হবার কথা থাকলেও পারা গেল না। আমার ঔষধের প্রয়োজন ছিল। আবিদ ঔষধ আনার জন্য দোকানে গেল। ঔষধ এনে, সবকিছু ঠিকঠাক করে বের হতে ১১টা বেজে গেল। যখন জু’তে গিয়ে পৌঁছলাম, তখন দেখি শত শত গাড়ি আর হাজার হাজার লোকের লাইন লেগে গেছে। ছুটির দিনে দূর-দূরান্ত থেকে সকলে পরিবার-পরিজন নিয়ে চিড়িয়াখানা দেখতে এসেছে। এত ভীড়, কিন্তু কোথাও কোন হইচই নেই। শান্ত, নিরিবিলি, শৃংখলাবদ্ধ সবকিছু। আমরা টিকিট কেটে চিড়িয়াখানায় ঢুকলাম।
এখানে এক আজব জগত বানিয়ে রেখেছে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। এক বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে চিড়িয়াখানা। আমরা প্রথমে ঢুকলাম আমাজান ফরেস্টে। আমেরিকার সবচে বড় নদীর নাম আমাজান। ঘন জঙ্গলপূর্ণ আমাজানের বিচিত্র জীব-বৈচিত্র্য এখানে কৃত্রিমভাবে ধরে রাখা হয়েছে। আমাজানসহ এশিয়া-আফ্রিকার বিভিন্ন জঙ্গলের দৃশ্য, নানা প্রাণী ও পরিবেশ এখানে বাস্তবসম্মতভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল আমরা যেন আমাজানের দুর্গম জঙ্গলাকীর্ণ অন্ধকার পথ দিয়ে চলছি। এ দৃশ্য ও অভিজ্ঞতা মনে রাখার মত।
এখান থেকে বের হয়ে আমরা গেলাম পেঙ্গুইন দেখতে। কত রকমের অসংখ্য পেঙ্গুইন। দেখতে দেখতে চোখ জুড়িয়ে যায়। দুনিয়ার নানা দেশের নানা জাতের অসংখ্য পেঙ্গুইন দেখার সৌভাগ্য এখানে না এলে কখনো হতো?
এরপর আমরা ট্রামে করে চিড়িয়াখানার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। হেঁটে হেঁটে তো আর এত বড় এলাকা দেখা সম্ভব নয়! নানা রকমের পশু-পাখির বিচিত্র সমাহার। সব চিড়িয়াখানাতেই যেরকম থাকে। কিন্তু এটা একটু ব্যতিক্রম এদিক থেকে যে এখানকার জীব-বৈচিত্র্য সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশে নির্মাণের কৌশল অতিশয় বিজ্ঞানসম্মত ও মনোমুগ্ধকর। মাঝে মাঝে পাহাড়ের উঁচু টিলা, আবার পাহাড়ের নিচে গভীর খাদ, কোথাও পানি, কোথাও বনভূমি প্রকৃতির বিচিত্র রূপ ও পরিবেশে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক কৃত্রিম প্রাকৃতিক অবস্থা বিভিন্ন রকমের পশু-পাখি, জীব-জন্তু দৃশ্যমান করে রাখা হয়েছে।
ট্রাম-ভ্রমণের পর আমরা ঢুকলাম এক্যুরিয়াম দেখতে। কত রকমের অসংখ্য মাছ। দেখতে দেখতে হয়রান হবার মত অবস্থা। পানির নিচে যে এত বিচিত্র ধরণের মাছ ও প্রাণী বসবাস করে তা আগে কখনো দেখার সুযোগ হয়নি। মাছেরও যে এত জাত ও প্রকার থাকতে পারে তাও কি কখনো চিন্তা করেছি! অসীম করুণাময় মহান আল্লাহ কত বিচিত্র সবকিছু দুনিয়ায় সৃষ্টি করেছেন, তা ভাবলেও অবাক হতে হয়।
এরপর আমরা ডেজার্ট (মরুভূমি) এলাকায় ঢুকলাম। মরুভূমির কথা আমরা শুনেছি, স্বচক্ষে কখনো দেখিনি। সেটা দেখার অভিজ্ঞতা। তাছাড়া, মরুভূমির গাছ-পালা, মরুভূমিতে বসবাসকারী অসংখ্য পশুপাখি, জীবজন্তু ইত্যাদি দেখে মনের কৌতূহল নিবৃত্ত হল।
চিড়িয়াখানা দেখে মনে হল, এত বয়স হল, কিন্তু দুনিয়ার আর কতটুকুই বা দেখার সুযোগ ও সৌভাগ্য হয়েছে। কোন মানুষের পক্ষেই হয়ত দুনিয়ার সবকিছু দেখার সুযোগ হয় না। মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর বিশাল সৃষ্টি-জগতে অসংখ্য পশু-পাখি-প্রাণী ও জীবজন্তু পয়েদা করেছেন, সেসব কিছুর পরিচয় জানা ও দেখা যে কোন মানুষের পক্ষেই প্রায় অসম্ভব। চিড়িয়াখানা অন্তত এ বিশাল সৃষ্টি-জগতে উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় ধারণ করে কৌতূহলী মানুষের দেখার ও জানার সাধ কিছুটা হলেও নিবৃত করে থাকে। তাই এখানে এসে যতটুকু দেখার সুযোগ পেলাম তাই বা কম কী !
চিড়িয়াখানা দেখে আমরা ফিরে গেলাম হোটেলে। খাওয়া-দাওয়া সেরে কিছুক্ষণ বিশ্র্রাম নিলাম। তারপর রাত্রিতে শহরে একটা চক্কর দেয়া হলো। হোটেলে এসে আবার ঘুম। পরের দিন আমরা আবার সিডার র্যাপিডস্ ফিরে যাব।
২৮ জুন, রবিবার
সকালে উঠে আমরা ছুটির আমেজে হোটেল স্যুটে সবাই মিলে গল্প-গুজবে মশগুল হলাম। দুপুর একটার মধ্যে হোটেল ছাড়তে হবে। যথাসময়ে আমরা হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। প্রথমে একটি বড় মলে ঢুকলাম খাবার জন্য। এখানকার মল মানে একটি আস্ত বাজার। বিশাল এলাকা নিয়ে যাবতীয় পণ্য-সামগ্রি বেচা-কেনার আয়োজন। আমরা মলের ভিতর দিয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে খাবারের দোকানের সামনে গেলাম। একসঙ্গে বহুলোকের বসার ব্যবস্থা। বিভিন্ন বয়সের মেয়ে-পুরুষ সবাই আরামে বসে খাচ্ছে। গল্প করছে। আমরা একটি নিরিবিলি জায়গা দেখে বসে পড়লাম। এনাম আর আবিদ গিয়ে চাইনিজ খাবার নিয়ে এল। ফ্রায়েড রাইস, ভেজিটেবল ও চিংড়ি। আমাদের দেশের চাইনীজের মত অতটা সুস্বাদু মনে হল না। তবে মোটামুটি তৃপ্তির সাথেই খেলাম। সন্ধ্যার আগে আর খাবার পাওয়া যাবে না। তাই পেট ভরে খেলাম।
পথ চলতে চলতে রাস্তার দু’পাশে মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী দেখতে লাগলাম। সারা মাঠজুড়ে ভুট্টার আবাদ হয়েছে। ভুট্টার কচি সবুজ পাতায় ছেয়ে গেছে প্রান্তর। ভুট্টা এখানকার প্রধান ফসল। যতদূর দৃষ্টি যায় কেবলই ভুট্টার সবুজ সমারোহ। আমেরিকার এসব এলাকায় অর্থাৎ মধ্য আমেরিকায় হয়ত ভুট্টা ছাড়া অন্য কিছুর আবাদ হয় না। এক এক এলাকায় একেক ফসলের আবাদ। তাছাড়া, এসব এলাকায় দেখলাম বছরে মাত্র একবারই আবাদ হয়। অন্য সময় মাঠ খালি পড়ে থাকে। এত অজস্র জমি, মাত্র বছরে একবার আবাদ করলেই যা ফসল হয় তা দিয়ে আমেরিকার জনগণ সারা বছর খেয়ে-দেয়ে উদ্বৃত্ত ফসল বিদেশে রপ্তানী করে। ভুট্টা এখানে এখন শুধু মানুষের খাবার নয়, জীবজন্তুর খাবার হিসাবে ও জ্বালানি উৎপাদনের কাজেও পর্যাপ্ত ভুট্টা ব্যবহৃত হয়।
ধীরে ধীরে আমরা নেব্রাসকা রাজ্যের সীমানা অতিক্রম করে আইওয়া রাজ্যের সীমানার মধ্যে এসে পড়লাম। ওমাহা শহরে দু’দিন বসবাসের অভিজ্ঞতা এখন শুধুমাত্র আমাদের স্মৃতিতে ধারণ করার বিষয়। ওমাহা শহরে আমরা মাত্র দু’দিন ছিলাম। এত অল্প সময়ে শহরের সবকিছু দেখা ও জানা সম্ভব নয়। শুনেছি ওমাহা শহর নাকি তিনটি জিনিসের জন্য বিখ্যাত। প্রথমটি হল ঃ ওমাহাগ্রীল বা গোশতের সুস্বাদু রোস্ট। সেটা আমরা সযত্নে বর্জন করেছি। কারণ অনেকগুলো হোটেলই এমনকি এখানকার ইন্ডিয়ান হোটেলেও হালাল খাদ্য পরিবেশন করে না। সেজন্য গত দু’দিন আমাদেরকে সর্বদা সবজি ও মাছের উপর নির্ভর করতে হয়েছে। তাই ওমাহগ্রীলের খ্যাতি পরখ করার সুযোগ আমাদের হয়নি। ওমাহার দ্বিতীয় খ্যাতির কারণ এখানে পৃথিবীর সর্বাধিক ধনী ব্যক্তি ওয়ারেন বাফেট বাস করেন। ওমাহা শহরের প্রায় অর্ধেকই নাকি তার। ওয়ারেন বাফেট একজন শিক্ষক। বিভিন্ন কলেজে তিনি এখনও মাঝে মধ্যে ক্লাস নেন। শিক্ষার্থীরা তার ক্লাসে যোগদানের জন্য ভীড় জমায়। তার লেকচার, ব্যক্তিগত স্টাইল সবকিছুই শিক্ষার্থীগণ অনুসরণ করার চেষ্টা করে। মূলত স্টক মার্কেটের ব্যবসা করে তিনি সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনী ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও খুব সাদামাটা জীবন যাপন করেন এবং বিভিন্ন জনহিতকর কাজে উদার হস্তে দাত-খয়রাত করে থাকেন। বছরে একবার তিনি একটা ডিনার পার্টির আয়োজন করেন। তাতে টিকিট কিনে যোগদান করতে হয়। টিকিটের কোন নিদিষ্ট মূল্য নেই, কে কত বেশি মূল্য দিয়ে টিকিট কিনতে পারে, তার প্রতিযোগিতা হয়। এভাবে টিকিট বিক্রি করে তা থেকে সংগৃহীত সব টাকা জনহিতকর কাজে ব্যয় করা হয়। গত বছর নাকি জনৈক বিত্তশালী ব্যক্তি ২.১ বিলিয়ন অর্থ্যাৎ দু’শো দশ কোটি ডলারের টিকিট কিনে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে বসে নৈশভোজে অংশগ্রহণের বিরল সৌভাগ্য অর্জন করেন। পৃথিবীর সে মহান ও সদাশয় ধনী ব্যক্তিটির দর্শন আমরা পাইনি। কিন্তু তাঁর নামে খ্যাত ওমাহা শহরটি ঘুরে-ফিরে দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে। ওমাহা শহরের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হলো এখানে ট্যাক্সের হার অন্যান্য শহরের তুলনায় কম। সেজন্য আমেরিকার বিভিন্ন বড় বড় ব্যাংক, বীমা ও সওদাগরী কোম্পানীর হেড অফিস এখানে স্থাপন করা হয়েছে। তার ফলে এ শহরে একটি বিরাট ক্যাপিটাল মার্কেট গড়ে উঠেছে। এ ক্যাপিটাল মার্কেটের টাকায় এখানে বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। এর দ্বারা সার্বিকভাবে এখানে বসবাসকারী লোকেরা উপকৃত হয়েছে।
২৯ জুন, সোমবার
আজ সারাদিন ঘরেই শুয়ে-বসে কাটালাম। সারাদিন জামাই এনাম ও মেয়ে সুমাইয়া বাইরে কাজে-কর্মে ব্যস্ত থাকে। নাতনি জারা ও নাতি আইয়ানও মায়ের সাথে ভোর ছয়টায় স্কুলে যায়, আসে তিনটায়। এ সময় আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে তিনতলা বিশাল ভিলা পাহারা দেই। ইচ্ছামত খাই-দাই, গল্প করি আর ঘুমাই। অবশ্য বাড়ি পাহারা দেয়ার কথাটা একটু বাড়িয়ে বললাম। কারণ এখানে কারো বাড়ি কাউকে পাহারা দিতে হয় না। সকলেই নিরাপদ। চোর-ডাকাতের কোন অস্তিত্ব নেই। কেউ তো বেকার নেই, সকলেই কোন না কোন কাজে ব্যস্ত। তাছাড়া, যারা সাময়িকভাবে বেকার হয় তারাও বেকার-ভাতা পায়। আর বেকার-ভাতা যা পায়, তা দিয়ে স্বচ্ছন্দে সংসার চলে। তাই অনেক কর্ম-বিমুখ অলস ব্যক্তি ইচ্ছে করেই বেকার হয়। অবশ্য তাদের সংখ্যা অতিশয় নগণ্য। সকলেই কাজ করে খায়, কাজের প্রতি নিষ্ঠা আছে, কাজে ফাঁকি দেয়ার স্বভাব তেমন একটা চোখে পড়ে না। মোটকথা এরা পরিশ্রমী জাতি। পরিশ্রম করে বলেই এরা কেউ দরিদ্র নয়। প্রত্যেকের ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও শ্রমের সার্বিক যোগফল জাতীয় উন্নয়নের মূল সোপান।
চোর-ডাকাত না থাকার বড় কারণ ক্ষুধা ও দারিদ্রের অনুপস্থিতি। মানুষ তাদের গাড়ি রাস্তায় রেখে সবাই নিশ্চিন্তে ঘুমায়। অবশ্য কারো কারো গাড়ি রাখার গ্যারেজ আছে, কিন্তু অধিকাংশ লোকই তাদের গাড়ি রাস্তার পাশে বা বাইরে পার্ক করে রাখে। অন্যের জিনিসের প্রতি কারো ভ্রুক্ষেপ নেই, যার যার মত সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। তাছাড়া, দেশের আইন-শৃংখলা এরকম যে, কোথাও কোন চুরি-চামারীর ঘটনা ঘটলে তা সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়ে এবং অপরাধীকে তার জন্য উপযুক্ত শাস্তি ভোগ করতে হয়।
সন্ধ্যা সাতটায় জারা ক্যারাতে শিখতে যায়। প্রতিদিন এনাম তাকে নিয়ে যায়। কিন্তু আজ এনাম অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকায় সে তাকে নিয়ে যেতে পারবে না। তাই সুমাইয়া তাকে নিয়ে যাবে। সঙ্গে আমি আর আমার স্ত্রীও গেলাম। এক ঘন্টার ক্যারাতে ট্রেনিং। অনেকগুলো ছেলেমেয়ে একসঙ্গে শেখে। আমরা পুরা একঘন্টা সেখানে বসে ক্যারাতে ট্রেনিং দেখে জারাকে নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম।
সকালে আমরা এখানকার বিখ্যাত হেন্রি ডুরালি জু’দেখতে যাব। কিন্তু ৯টায় বের হবার কথা থাকলেও পারা গেল না। আমার ঔষধের প্রয়োজন ছিল। আবিদ ঔষধ আনার জন্য দোকানে গেল। ঔষধ এনে, সবকিছু ঠিকঠাক করে বের হতে ১১টা বেজে গেল। যখন জু’তে গিয়ে পৌঁছলাম, তখন দেখি শত শত গাড়ি আর হাজার হাজার লোকের লাইন লেগে গেছে। ছুটির দিনে দূর-দূরান্ত থেকে সকলে পরিবার-পরিজন নিয়ে চিড়িয়াখানা দেখতে এসেছে। এত ভীড়, কিন্তু কোথাও কোন হইচই নেই। শান্ত, নিরিবিলি, শৃংখলাবদ্ধ সবকিছু। আমরা টিকিট কেটে চিড়িয়াখানায় ঢুকলাম।
এখানে এক আজব জগত বানিয়ে রেখেছে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। এক বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে চিড়িয়াখানা। আমরা প্রথমে ঢুকলাম আমাজান ফরেস্টে। আমেরিকার সবচে বড় নদীর নাম আমাজান। ঘন জঙ্গলপূর্ণ আমাজানের বিচিত্র জীব-বৈচিত্র্য এখানে কৃত্রিমভাবে ধরে রাখা হয়েছে। আমাজানসহ এশিয়া-আফ্রিকার বিভিন্ন জঙ্গলের দৃশ্য, নানা প্রাণী ও পরিবেশ এখানে বাস্তবসম্মতভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল আমরা যেন আমাজানের দুর্গম জঙ্গলাকীর্ণ অন্ধকার পথ দিয়ে চলছি। এ দৃশ্য ও অভিজ্ঞতা মনে রাখার মত।
এখান থেকে বের হয়ে আমরা গেলাম পেঙ্গুইন দেখতে। কত রকমের অসংখ্য পেঙ্গুইন। দেখতে দেখতে চোখ জুড়িয়ে যায়। দুনিয়ার নানা দেশের নানা জাতের অসংখ্য পেঙ্গুইন দেখার সৌভাগ্য এখানে না এলে কখনো হতো?
ট্রাম-ভ্রমণের পর আমরা ঢুকলাম এক্যুরিয়াম দেখতে। কত রকমের অসংখ্য মাছ। দেখতে দেখতে হয়রান হবার মত অবস্থা। পানির নিচে যে এত বিচিত্র ধরণের মাছ ও প্রাণী বসবাস করে তা আগে কখনো দেখার সুযোগ হয়নি। মাছেরও যে এত জাত ও প্রকার থাকতে পারে তাও কি কখনো চিন্তা করেছি! অসীম করুণাময় মহান আল্লাহ কত বিচিত্র সবকিছু দুনিয়ায় সৃষ্টি করেছেন, তা ভাবলেও অবাক হতে হয়।
এরপর আমরা ডেজার্ট (মরুভূমি) এলাকায় ঢুকলাম। মরুভূমির কথা আমরা শুনেছি, স্বচক্ষে কখনো দেখিনি। সেটা দেখার অভিজ্ঞতা। তাছাড়া, মরুভূমির গাছ-পালা, মরুভূমিতে বসবাসকারী অসংখ্য পশুপাখি, জীবজন্তু ইত্যাদি দেখে মনের কৌতূহল নিবৃত্ত হল।
চিড়িয়াখানা দেখে মনে হল, এত বয়স হল, কিন্তু দুনিয়ার আর কতটুকুই বা দেখার সুযোগ ও সৌভাগ্য হয়েছে। কোন মানুষের পক্ষেই হয়ত দুনিয়ার সবকিছু দেখার সুযোগ হয় না। মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর বিশাল সৃষ্টি-জগতে অসংখ্য পশু-পাখি-প্রাণী ও জীবজন্তু পয়েদা করেছেন, সেসব কিছুর পরিচয় জানা ও দেখা যে কোন মানুষের পক্ষেই প্রায় অসম্ভব। চিড়িয়াখানা অন্তত এ বিশাল সৃষ্টি-জগতে উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় ধারণ করে কৌতূহলী মানুষের দেখার ও জানার সাধ কিছুটা হলেও নিবৃত করে থাকে। তাই এখানে এসে যতটুকু দেখার সুযোগ পেলাম তাই বা কম কী !
সকালে উঠে আমরা ছুটির আমেজে হোটেল স্যুটে সবাই মিলে গল্প-গুজবে মশগুল হলাম। দুপুর একটার মধ্যে হোটেল ছাড়তে হবে। যথাসময়ে আমরা হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। প্রথমে একটি বড় মলে ঢুকলাম খাবার জন্য। এখানকার মল মানে একটি আস্ত বাজার। বিশাল এলাকা নিয়ে যাবতীয় পণ্য-সামগ্রি বেচা-কেনার আয়োজন। আমরা মলের ভিতর দিয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে খাবারের দোকানের সামনে গেলাম। একসঙ্গে বহুলোকের বসার ব্যবস্থা। বিভিন্ন বয়সের মেয়ে-পুরুষ সবাই আরামে বসে খাচ্ছে। গল্প করছে। আমরা একটি নিরিবিলি জায়গা দেখে বসে পড়লাম। এনাম আর আবিদ গিয়ে চাইনিজ খাবার নিয়ে এল। ফ্রায়েড রাইস, ভেজিটেবল ও চিংড়ি। আমাদের দেশের চাইনীজের মত অতটা সুস্বাদু মনে হল না। তবে মোটামুটি তৃপ্তির সাথেই খেলাম। সন্ধ্যার আগে আর খাবার পাওয়া যাবে না। তাই পেট ভরে খেলাম।
পথ চলতে চলতে রাস্তার দু’পাশে মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী দেখতে লাগলাম। সারা মাঠজুড়ে ভুট্টার আবাদ হয়েছে। ভুট্টার কচি সবুজ পাতায় ছেয়ে গেছে প্রান্তর। ভুট্টা এখানকার প্রধান ফসল। যতদূর দৃষ্টি যায় কেবলই ভুট্টার সবুজ সমারোহ। আমেরিকার এসব এলাকায় অর্থাৎ মধ্য আমেরিকায় হয়ত ভুট্টা ছাড়া অন্য কিছুর আবাদ হয় না। এক এক এলাকায় একেক ফসলের আবাদ। তাছাড়া, এসব এলাকায় দেখলাম বছরে মাত্র একবারই আবাদ হয়। অন্য সময় মাঠ খালি পড়ে থাকে। এত অজস্র জমি, মাত্র বছরে একবার আবাদ করলেই যা ফসল হয় তা দিয়ে আমেরিকার জনগণ সারা বছর খেয়ে-দেয়ে উদ্বৃত্ত ফসল বিদেশে রপ্তানী করে। ভুট্টা এখানে এখন শুধু মানুষের খাবার নয়, জীবজন্তুর খাবার হিসাবে ও জ্বালানি উৎপাদনের কাজেও পর্যাপ্ত ভুট্টা ব্যবহৃত হয়।
ধীরে ধীরে আমরা নেব্রাসকা রাজ্যের সীমানা অতিক্রম করে আইওয়া রাজ্যের সীমানার মধ্যে এসে পড়লাম। ওমাহা শহরে দু’দিন বসবাসের অভিজ্ঞতা এখন শুধুমাত্র আমাদের স্মৃতিতে ধারণ করার বিষয়। ওমাহা শহরে আমরা মাত্র দু’দিন ছিলাম। এত অল্প সময়ে শহরের সবকিছু দেখা ও জানা সম্ভব নয়। শুনেছি ওমাহা শহর নাকি তিনটি জিনিসের জন্য বিখ্যাত। প্রথমটি হল ঃ ওমাহাগ্রীল বা গোশতের সুস্বাদু রোস্ট। সেটা আমরা সযত্নে বর্জন করেছি। কারণ অনেকগুলো হোটেলই এমনকি এখানকার ইন্ডিয়ান হোটেলেও হালাল খাদ্য পরিবেশন করে না। সেজন্য গত দু’দিন আমাদেরকে সর্বদা সবজি ও মাছের উপর নির্ভর করতে হয়েছে। তাই ওমাহগ্রীলের খ্যাতি পরখ করার সুযোগ আমাদের হয়নি। ওমাহার দ্বিতীয় খ্যাতির কারণ এখানে পৃথিবীর সর্বাধিক ধনী ব্যক্তি ওয়ারেন বাফেট বাস করেন। ওমাহা শহরের প্রায় অর্ধেকই নাকি তার। ওয়ারেন বাফেট একজন শিক্ষক। বিভিন্ন কলেজে তিনি এখনও মাঝে মধ্যে ক্লাস নেন। শিক্ষার্থীরা তার ক্লাসে যোগদানের জন্য ভীড় জমায়। তার লেকচার, ব্যক্তিগত স্টাইল সবকিছুই শিক্ষার্থীগণ অনুসরণ করার চেষ্টা করে। মূলত স্টক মার্কেটের ব্যবসা করে তিনি সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনী ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও খুব সাদামাটা জীবন যাপন করেন এবং বিভিন্ন জনহিতকর কাজে উদার হস্তে দাত-খয়রাত করে থাকেন। বছরে একবার তিনি একটা ডিনার পার্টির আয়োজন করেন। তাতে টিকিট কিনে যোগদান করতে হয়। টিকিটের কোন নিদিষ্ট মূল্য নেই, কে কত বেশি মূল্য দিয়ে টিকিট কিনতে পারে, তার প্রতিযোগিতা হয়। এভাবে টিকিট বিক্রি করে তা থেকে সংগৃহীত সব টাকা জনহিতকর কাজে ব্যয় করা হয়। গত বছর নাকি জনৈক বিত্তশালী ব্যক্তি ২.১ বিলিয়ন অর্থ্যাৎ দু’শো দশ কোটি ডলারের টিকিট কিনে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে বসে নৈশভোজে অংশগ্রহণের বিরল সৌভাগ্য অর্জন করেন। পৃথিবীর সে মহান ও সদাশয় ধনী ব্যক্তিটির দর্শন আমরা পাইনি। কিন্তু তাঁর নামে খ্যাত ওমাহা শহরটি ঘুরে-ফিরে দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে। ওমাহা শহরের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হলো এখানে ট্যাক্সের হার অন্যান্য শহরের তুলনায় কম। সেজন্য আমেরিকার বিভিন্ন বড় বড় ব্যাংক, বীমা ও সওদাগরী কোম্পানীর হেড অফিস এখানে স্থাপন করা হয়েছে। তার ফলে এ শহরে একটি বিরাট ক্যাপিটাল মার্কেট গড়ে উঠেছে। এ ক্যাপিটাল মার্কেটের টাকায় এখানে বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। এর দ্বারা সার্বিকভাবে এখানে বসবাসকারী লোকেরা উপকৃত হয়েছে।
আজ সারাদিন ঘরেই শুয়ে-বসে কাটালাম। সারাদিন জামাই এনাম ও মেয়ে সুমাইয়া বাইরে কাজে-কর্মে ব্যস্ত থাকে। নাতনি জারা ও নাতি আইয়ানও মায়ের সাথে ভোর ছয়টায় স্কুলে যায়, আসে তিনটায়। এ সময় আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে তিনতলা বিশাল ভিলা পাহারা দেই। ইচ্ছামত খাই-দাই, গল্প করি আর ঘুমাই। অবশ্য বাড়ি পাহারা দেয়ার কথাটা একটু বাড়িয়ে বললাম। কারণ এখানে কারো বাড়ি কাউকে পাহারা দিতে হয় না। সকলেই নিরাপদ। চোর-ডাকাতের কোন অস্তিত্ব নেই। কেউ তো বেকার নেই, সকলেই কোন না কোন কাজে ব্যস্ত। তাছাড়া, যারা সাময়িকভাবে বেকার হয় তারাও বেকার-ভাতা পায়। আর বেকার-ভাতা যা পায়, তা দিয়ে স্বচ্ছন্দে সংসার চলে। তাই অনেক কর্ম-বিমুখ অলস ব্যক্তি ইচ্ছে করেই বেকার হয়। অবশ্য তাদের সংখ্যা অতিশয় নগণ্য। সকলেই কাজ করে খায়, কাজের প্রতি নিষ্ঠা আছে, কাজে ফাঁকি দেয়ার স্বভাব তেমন একটা চোখে পড়ে না। মোটকথা এরা পরিশ্রমী জাতি। পরিশ্রম করে বলেই এরা কেউ দরিদ্র নয়। প্রত্যেকের ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও শ্রমের সার্বিক যোগফল জাতীয় উন্নয়নের মূল সোপান।
চোর-ডাকাত না থাকার বড় কারণ ক্ষুধা ও দারিদ্রের অনুপস্থিতি। মানুষ তাদের গাড়ি রাস্তায় রেখে সবাই নিশ্চিন্তে ঘুমায়। অবশ্য কারো কারো গাড়ি রাখার গ্যারেজ আছে, কিন্তু অধিকাংশ লোকই তাদের গাড়ি রাস্তার পাশে বা বাইরে পার্ক করে রাখে। অন্যের জিনিসের প্রতি কারো ভ্রুক্ষেপ নেই, যার যার মত সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। তাছাড়া, দেশের আইন-শৃংখলা এরকম যে, কোথাও কোন চুরি-চামারীর ঘটনা ঘটলে তা সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়ে এবং অপরাধীকে তার জন্য উপযুক্ত শাস্তি ভোগ করতে হয়।
সন্ধ্যা সাতটায় জারা ক্যারাতে শিখতে যায়। প্রতিদিন এনাম তাকে নিয়ে যায়। কিন্তু আজ এনাম অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকায় সে তাকে নিয়ে যেতে পারবে না। তাই সুমাইয়া তাকে নিয়ে যাবে। সঙ্গে আমি আর আমার স্ত্রীও গেলাম। এক ঘন্টার ক্যারাতে ট্রেনিং। অনেকগুলো ছেলেমেয়ে একসঙ্গে শেখে। আমরা পুরা একঘন্টা সেখানে বসে ক্যারাতে ট্রেনিং দেখে জারাকে নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম।
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Facebook: facebook.com/samoiki
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments