আলিফ লায়লা : আরব্য রজনী_পর্ব-৫৯

ইংরেজি অনুবাদ : ডঃ জে. সি. মারদ্রুস
বাংলা অনুবাদ : ক্ষিতিশ সরকার
 
পরদিন একশো তিরাশিতম রজনী :
রজনীর মধ্যভাগে আবার কাহিনী শুরু হয়। মাইমুনোহ লাফিয়ে ওঠে, ওঃ, কি চমৎকার বুদ্ধি তোমার কশকশ। দানাশও হেঁড়ে গলায় বাহবা দিতে থাকে, বেড়ে-মজার। এই বলে আবার সে মাছি হয়ে উড়ে গিয়ে বসলো কামার আল-জামানের ঘাড়ে। কুটুস করে দিলো একটা কামড়। কামড়ের যন্ত্রণায় সে সারা শরীর বঁকিয়ে ছটফট করে ওঠে। ঘাড়ের কাছে, যেখানটা জ্বালা করছিলো, হাত বুলিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করে। কিন্তু ততক্ষণে কি দানাশ সেখানে বসে থাকার পাত্র। শাহজাদা উঠে পড়বে আশঙ্কায় মাইমুন্নাহ আর কশকশও অদৃশ্য হয়ে হাওয়ায় মিশে গিয়েছিলো।
এরপরের ঘটনাগুলো বড় মজার :
কামার আল-জামানের চোখে তখন ঢুলু ঢুলু ঘুম। হাতখানা ঘাড়ের কাছে কিছুক্ষণ বুলিয়ে আলতোভাবে নামিয়ে বিছানার ওপর রাখতে যায়। কিন্তু পাশে শূন্য শয্যা ছিলো না। রাজকুমারী বদরের কুসুমাদপি কোমল বিবস্ত্রা দেহখানি এলিয়ে পড়েছিলো সেখানে। হাতখানা নামিয়ে রাখতে গিয়ে রাখলে সে বদরের কবোষ্ণ উরুর খাজে।
এবার তার ঘুম ছুটে গেলো। একবার চোখ মেলে বদরকে দেখেই সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো। হয়তো বা সে ভুল দেখলো, কিংবা খোয়াব-এর খোয়াডি কাটছে না! চোখ বন্ধ করেই হাতটা আস্তে আস্তে চালিয়ে অনুভব করতে থাকলোসত্যিই কোনও রক্তমাংসের কোনও মেয়ে তার পাশে শুয়ে আছে, কিনা। নাঃ, ভুল সে করেনি। খোয়াবও দেখছে না। এই তো মাখনের মতো মোলায়েম কি নরম তার উরুর মাংস। প্ৰাণ ভরে জোরে শ্বাস টানলো সে। আঃ, কী সুন্দর খুশবু? মেয়েটার গা থেকে সেই সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিলো ঘরময়। অজানা অপরূপা। তার নিরাবরণ নগ্ন নিরুপম রূপের দিকে চেয়ে চেয়ে এক অভূতপূর্ব অনাস্বাদিত পুলকে জামানের দেহমান শিহরিত হয়ে উঠতে থাকে।
একটি মেয়ে তার পাশে তায় আবার সম্পূর্ণ উলঙ্গ। দৃশ্য দেখাও পাপ। কিন্তু কৌতূহল এমনই বস্তু তাকে জোর করে বেশিক্ষণ চেপে রাখা যায় না। তেরছা চোখে চুরিয়ে চুরিয়ে তার সারা শরীর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলো। যতই দেখে ততই মুগ্ধ হয়। দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেন সুনিপুণ শিল্পীর হাতে গড়া। কোনও খুঁত নাই। সুঠাম সুন্দর এক শিল্প মূর্তি। কামার অল-জামান ভেবে পায় না তার এই রূপ কিসের সঙ্গে তুলনা করা যায়। হীরা চুনি পান্না? না, তারা সবাই এর জেল্লার কাছে ত্ৰিয়মান হয়ে যাবে। তবে কি পারস্যের লালগুলাব-যার সুবাসে দিল মদির হয়ে ওঠে। কিন্তু না, তাও গ্রাহ্য হয় না। নারীর রূপেরর আকর্ষণে আশ্যমানের তারা ধরায় ধরা দিতে পারে। পর্বত নতজানু হয়ে বলতে পারে, ওগো, সুন্দরী আমার মাথা নত করে দাও তোমার পদ্মরাঙা পায়ে। আবার সমুদ্রও হয়তো আছড়ে পড়ে মিনতি জানাবে, গণ্ডুষ ভরিয়া পান কর দেবী, আমি তব অন্তরে লুকায়ে রহিত চিরকাল।
উত্তেজনায় সারা শরীর ঘেমে ওঠে। জামানের। গা থেকে মাথা অবধি বদরের আগাগোড়া দেহখানার উপরে হাত বুলাতে থাকে সে। কি যে ভালো লাগে তার-কি করে বোঝাবে সে কথা। আনন্দ শুধু অনুভবের-প্রকাশের নয়। কামার আল-জামানের জীবনে অভিজ্ঞতা এই প্রথম। তাদের সমাজে নারী অসূর্যস্পশ্যা। পরপুরুষ পরনারীর মুখই দেখতে পায় না। তায় আবার নিরাবরণ সারা দেহ। জামানের দেহে সবে যৌবনের জোয়ার আসতে শুরু করেছে কিছুদিন থেকে। এতদিন তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে এডিয়ে চলছিলো, আজ, এই মুহূর্তে, বুঝি সকল বাধা ছাপিয়ে সে উপছে পড়তে চায়। নিজেকে নির্মম নিষ্ঠুর পীড়নে পীডিত করতে থাকলে হয়তো বা বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। তখন হয়তো আর সংযত-সংহত থাকার সব বাঁধই উৎখাত হয়ে যাবে।
তাই আর দেরি নয়। এবার সময় সমাগত। দেহ যা চায় মনও যখন তাই চায় তাতে আর বাধা দিতে নাই। জামান হাত বুলাতে থাকে ওর গালে ঠোঁটে, ওর গ্ৰীবা ঘাড়ে বুকে স্তনে।
অসহ্য এক যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে জমান। বদরের বুকের সঙ্গে মুখ ঘষকে থাকে। চাঁপাকলির মতো স্তনাধার ঠোঁটের ঘর্ষণেই পলকে রক্তাভ হয়ে ওঠে।
হঠাৎ জামানের খেয়াল হয়, ওর গায়ের শেমিজ গেলো কোথায়। এপোশ ওপোশ ঘুরিয়ে দেখতে থাকে। না, কোথাও নাই। আর মেয়েটাই বা কি রকম! এমন ওলোট পালোট করাতেও তায় ঘুম ভাঙছে না। জামান কি করে জানবে দানাশ তাকে যাদু করে রেখেছে। এখন তার শরীর নিয়ে দলাইমলাই করলেও ঘুম তার ভাঙবে না।
কামার আল-জামান বৃথাই চেষ্টা করে তার ঘুম ভাঙানোর। যতই তাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে ততই সে কামনায় উত্তেজিত হয়ে ওঠে। বদরের অধীরে অধর রাখে। দীর্ঘ চুম্বনে চুষতে থাকে। কিন্তু তবু তার সাড়া নাই। পরপর তিনবার চুম্বনে চুম্বনে ঠোঁটে রক্ত ঝরিয়ে দেয়। কিন্তু না, সে জাগে না। এবার জামান ওকে নাড়া দিয়ে ডাকে, সোনা-সোনা, চেয়ে দেখো, তোমার সামনে কে। ওঠ, সাড়া দাও। তুমি আমার দিল, কলিজা সব কেড়ে নিয়েছে, সুন্দরী। একবার চোখ মেলে তাকাও, দেখো, আমি শাহজাদা কামার আল-জামান-তোমার কাছে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে এসেছি।
কিন্তু কে সাড়া দেবে। দানাশের মায়াবলে সে তখন অসাড়া অচৈতন্য। জামান বলে, আমার গোস্তাকি মাফ করো সুন্দরী। আমি আর নিজেকে রাখতে পারছি না। আমি চেয়েছিলাম, আমার ডাকে তুমি সাড়া দেবে। জেগে উঠবে। আমি বড় তৃষ্ণার্ত, আমার স্বইচ্ছায় সুধা পান করাবে। কিন্তু তুমি ঘুমে বিভোর। আমি তোমার ঘুম ভাঙাতে পারলাম না। এদিকে যৌবন জুরে জরুজর আমি। কামবানে বিদ্ধ এক তৃষ্ণার্ত কপোত। আর তুমি সেই মদালসা নারী ঘুমে অচৈতন্য। ক্ষমা করো সোনা, সাধ্য নাই ধৈর্য ধরি, তাই চুরি করে নিতে হলো তোমার সদ্যাফোটা যৌবনের প্রথম কদম ফুল।
মাইমুনাহ, দানাশ আর কশকশ অলক্ষ্যে সবই প্রত্যক্ষ করছিলো।
এইসময় রাত্ৰি শেষ হয়ে আসতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে। শারিয়ার বলে, যাঃ বাকবা, ভালো জায়গায় রাতটা কাবার হয়ে গেলো
পরদিন সন্ধ্যা হতে না হতে বাদশাহ শারিয়ার এসে হাজির হয়। শাহরাজাদ বুঝতে পারে। সুলতান কোন আফিঙের নেশায় ছটফট করছে। শারিয়ার কিছু বলার আগেই সে বলে, জাঁহাপনা আমার শরীরটা এখন ভালো লাগছে না। যদি মঞ্জর করেন। তবে প্রথম রাতটা একটু ঘুমিয়ে শরীরটা একটু চাঙ্গা করে নিই। তারপর আবার শুরু করবো কাহিনী।
শারিয়ার বলে, গল্প তো রোজই শুনছি শাহরাজাদ, শরীরটাই তো আগে। এসো এখন শুয়ে পড়ি। তারপর মেজাজ ভালো লাগলে, সে পরে দেখা যাবে।
শাহরাজাদের শরীর ভালোই ছিলো। শারিয়ারকে একটু বাজিয়ে দেখে নিলো মাত্র। সেই রাতেই দ্বিতীয় প্রহরে আবার সে শুরু করে :
বদর চিৎ হয়ে এলিয়ে শুয়েছিলো। কামকাতর জামান দুহাত দিয়ে ওর দেহখানা বুকে নিয়ে জাপটে ধরতে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়তেই সে থমকে গেলো। এতক্ষণের সব ধাঁধা নিমেষে জলের মতো সহজ সরল পরিষ্কার হয়ে গেলো। বুঝতে আর তার বাকি রইলো নাএসব তার বাবার কারসাজি। তা না হলে এই কয়েদখানায় এতগুলো পাহারার চোখে ধুলো দিয়ে এই বন্ধ ঘরের মধ্যে -মেয়ে এখানে এলো কি করে? বাবা চান, জামান শাদী করে সংসার হোক। কিন্তু জামান নারী বিদ্বেষী। তার মনের এই বিদ্বেষ ভােব কাটাবার জন্যে তিনি এই ফন্দী এটেছেন। কোনও জানলার ফুটোয় চোখ রেখে নিশ্চয়ই সব লক্ষ্য করছেন। কাল সকালে টিটকিরি দিয়ে বলবেন, জামান, মুখে তো অনেক বড় বড় বাত আওড়াও। নারী নরকের দ্বার। স্ত্রীলোকের চরিত্র স্বয়ং খোদাতালাও জানেন না। দুনিয়ার তাবৎ অনিষ্টের মূল এই মেয়ে জাত। কিন্তু বাপজান, কাল রাতে সেই দোজকের কীট নিয়ে কি খেলায় মেতেছিলে? তখন সে কথার কী জবাব দেব আমি? বড়মুখ করে আদর্শের কথাবার্তা বলা তো আমার খতম হয়ে যাবে। জীবনে আর তার সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবো না কোনও দিন। না না, হতে পারে না। আব্বাজানের এই ফাঁদে আমি কিছুতেই পা দেব না। তিনি আমাকে মিথ্যেবাদী ভণ্ড ভাববেন, হতে পারে না।
সাপের উদ্যত ছোবল থেকে আত্মরক্ষার জন্য মানুষ যেভাবে ছিটকে সরে যায় কামার অল-জামানের অবস্থাও ঠিক সেই রকম হলো। এক লাফে সে পালঙ্ক থেকে নেমে ঘরের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালো। আজকের রাতটা সে কোন রকমে সংযম রক্ষা করে চলবে। জামান ভাবে, কাল বাবার কাছে সোজাসুজি প্রস্তাব পেশ করবো, এই মেয়ের সঙ্গে যদি তিনি শাদী দিতে চান আমার কোনও আপত্তি নাই। ছেলের সুমতি হয়েছে দেখে বাবা নিশ্চয়ই খুশি হয়ে শাদী দিয়ে দেবেন। তারপর তো সে আমারই হবে। তখন তাকে নিয়ে আমি যা- করি না কেন তিনি আডি পাততে আসবেন না। বরং আহ্লাদে আটখানা হবেন।
এতক্ষণ মাইমুনাহর মুখখানা কালো হয়ে গিয়েছিলো। তার শাহজাদা এত কামকাতর। একটা মেয়ে-চেনা নাই জানা নাই, যেহেতু সে তার পালঙ্কে শুয়ে আছে আমনি সে তার রূপে ঢলে পড়লো? ছি, ছি, লজ্জায় মাথা কাটা গেলো? বাদশাহর ছেলের রুচি প্রবৃত্তি বলে কি কিছু নাই। একটা মেয়ের ন্যাংটো শরীর দেখেই জিভে জল এসে গেলো?
যাই হোক, শেষ মুহূর্তে মাইমুনাহর ইজ্জৎ বাঁচিয়েছে শাহজাদা। এবার সে সম্বিত ফিরে পেয়েছে। বাদশাহ শাহরিমানের একমাত্র পুত্র সে। এই বিশাল সলতানিয়তের সে- হবে সুলতান। যে-সে কথা নাকি?
আনন্দে ধেই ধেই করে নাচতে থাকে মাইমুন্নাহ। কামার আল-জামান ধীর পায়ে পালঙ্কের পাশে দাঁড়ায়। আলতোভাবে একটু ছোট্ট চুম্বন একে দেয় বদরের গালে। নিজের হাত থেকে মহামূল্যবান একটা হীরের আংটি খুলে পরিয়ে দেয় বদরের আঙুলে। সেইক্ষণে মনে মনে সে তাকে বেগম বলে গ্রহণ করে নেয়। আজ থেকে সে তার স্ত্রী। সহধর্মিনী। এই আংটি তার সাক্ষী।
এরপর জামান বদর-এর দিকে পিছন ফিরে শুয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমে গলে গেলো। এইবার মাইমুনাহ ধরলো মাছির রূপ। শো করে উড়ে গিয়ে বদরের উরুতে বসিয়ে দিলো এক কামড়। ঘুমের ঘোরেই কঁকিয়ে ওঠে সে। কিন্তু মাইমুনাহ ছাড়বার পাত্রী নয়। রাজকুমারীর ওপর রাগে তার সারা শরীর রিরি করে জুলছে। পায়ের তালুতে, নাভিকুণ্ডলীতে বাহুমূলে কামডিয়ে কামডিয়ে শেষ করতে লাগলো। রাজকুমারী যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে চোখ মেলে তাকালো। কিন্তু একি? নিজের চোখকে নিজেই সে বিশ্বাস করতে পারে না। বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে। দুহাত দিয়ে চোখ দুটোরগড়ে নেয়। সে কি স্বপ্ন দেখছে? কিন্তু না, স্বপ্ন তো নয়। তন্ময় হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে সে জামানের অর্ধনগ্ন দেহ। বাঃ কি সুন্দর! এত রূপ। কখনও পুরুষের হয়? কিন্তু এখানে সে এল কি করে? খোজাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এই অন্দরমহলে তো পুরুষের প্রবেশ সম্ভব না। তবে কি তার বাবারই এই কারসাজি? বিয়ে করবে না বলে সে পণ করে বসে আছে। সে জন্যেই কি তার বাবা এই রূপবানকে পাঠিয়েছে? তা এমন সুন্দর সুপুরুষ দুনিয়াতে আছে জানলে কি সে না করতো। এমন ছেলে পেলে কি কোনও মেয়ে নিজেকে ঠিক রাখতে পারে।
বদর আরও কাছে সরে আসে জামানের। যতই দেখতে থাকে ততই সে বিহ্বল হয়ে পড়ে। মুখখানা নামিয়ে এনে জামানকে একটু চুমু খায়। মনে মনে ঠিক করে, কাল সকালেই সে বাবাকে বলবে, না, তার আর কোনও অমত নাই। এই ছেলেকেই সে বিয়ে করবে। বাবাও খুশি হবে, তারও জীবন আনন্দে ভরে উঠবে। বদর ভাবে, এমন পাত্র থাকবে বাবা কেন সব হত কুৎসিত বুড়ো-হাবড়া রাজা বাদশাহদের নিয়ে আসতো। বাবা যদি অনেক আগে একে নিয়ে আসতো। তাহলে তো কোনও আপত্তিই করতো না সে! যাইহোক, আর দেরি নয়, কালই সে বিয়েতে মত দেবে।
জামানের একখানা হাত তুলে নিয়ে বুক চেপে ধরে। ফিসফিস করে ডাকে, এইশুনছো, চোখ মেলে দেখো, আমি বন্দর। তোমার রূপে আমি পাগল হয়ে গেছি। ওঠ, সোনা, আমাকে আদর করো। তোমার বুকে আমি মাথা রেখে আমার দেহমান সঁপে দিয়ে জীবন সার্থক করি। ওঠ, আর ঘুমিও না।
কিন্তু জামানের ঘুম ভাঙবে কি করে? মাইমুনাহ তো তাকে যাদু করে রেখেছে। বদর সে কথা জানে না। এবার বেশ জোরে জোরেই নাড়া দিতে থাকে। ভাবে ঘুম তার ভেঙে গেছে। কিন্তু চোখ মেলে তাকাচ্ছে না, ঘাপটি মেরে পড়ে আছে। পায়ের তলায়, বগলে সুড়সুডি দিতে দিতে ডাকে, আমি যে আর সইতে পারছি না সোনা, এভাবে আর কত কষ্ট দেবে? ওঠ, আমার ঠোঁট শুকিয়ে গেছে, বুকের মধ্যে উথাল পাথাল করছে, আমাকে আদর করো, চুমু খাও! চোখ খোলো, আমার এই ভরা যৌবনের রূপে দেশ-বিদেশের কত রাজা-বাদশাহরা পাগল। আমি তাদের দিকে ফিরেও তাকাইনি। শুধু তোমার জন্যেই অতি সযত্নে সঙ্গোপনে লালন করেছি আমার এই কুমারী দেহখানা। তিল তিল করে আজ সে তিলোত্তম হয়ে উঠেছে। আজ পর্যন্ত কোন পুরুষ আমাকে স্পর্শ করেনি। তোমার জন্যই আমি এতকাল প্রতীক্ষা করেছিলাম। আজ তুমি এসেছে, তোমার হাতেই এই দেহ, মন সপো দিয়ে আমি ধন্য হতে চাই। আমার মল্লিকা বনে যখন প্রথম কলি ধরতে শুরু করেছে তখন থেকেই কত ভ্বমরের আনাগোনা, কিন্তু ফুলের মধু শুধুমাত্র তোমার জন্যে সযত্নে রক্ষা করে এসেছি। তুমি গ্রহণ করে তৃপ্ত হলে আমিও তৃপ্তি পাবো। আর দেরি করো না, সোনা, এই মধুযামিনী শেষ হতে চলেছে। ওঠ, আজকে রাতে আমাদের মধুর মিলনস্মৃতির পটে শুকতারা মতো উজ্জ্বল হয়ে জুলবে চিরকাল।
কিন্তু কে সাড়া দেবে? জামান তখন ঘুম অসাড়। এদিকে বদরের দেহে উত্তেজনা ক্রমশই বাড়ে। বাঁ নাকের নিঃশ্বাস প্রশ্বাস দ্রুততর হয়। বুকের মধ্যে সমুদ্রের ঢেউ আছাড়ি খেয়ে পড়তে থাকে। সারা শরীরে সে এক তুফানের তোলপাড়। শান্ত স্নিগ্ধ চোখের তারারা কামবানে হয়ে ওঠে চঞ্চল। আর সারা মুখে কে যেন মাখিয়ে দিয়েছে আবীর। কপালে জমে উঠেছে বিন্দু বিন্দু স্বেদ। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না বন্দর। জামানের বুকের ওপর লুটিয়ে পড়ে। দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরে অধরে দংশন করে। ঠোঁটে রক্ত ঝরে; কিন্তু জামান ঘুমে অচেতন। কোন সাড়া নাই। ওর সারা শরীরের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গে হাত বুলিয়ে স্পর্শ সুখ অনুভব করতে থাকে বন্দর। এই অনুভবের কি যে আনন্দ, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না! ধন-দৌলত দিয়ে অনেক সুখ-সম্পদ কেনা যায় কিন্তু এই মুহূর্তের এই অনুভব কোনও মূল্যের বিনিময়েই আহরণ করা যায় না।
হঠাৎ নতুন এক আবিষ্কারের আনন্দে বদরের বুকে তোলপাড় শুরু হয়। জামানের দেহের জাগ্রত হয়ে ওঠে। বদর ভাবে এবার নিশ্চয়ই সে জেগে উঠবে, চোখ খুলবে। কিন্তু না, জামানের শরীর সাড়া দিলেও ঘুম তার ভাঙে না। বদর ক্ষুব্ধ হয়, নিজের উপরই রাগ হয়। তারই দোষ! ব্যাপারে একেবারেই সে আনাড়ী। তাই সে জামানকে জাগাতে পারছে না। অথচ নিজেকেই সে আর ঠিক রাখতে পারছে না। জামানকে জড়িয়ে ধরে সে শুয়ে পড়ে। গালে ঠোঁটে ঘাড়ে বুকে চুমুতে চুমুতে ভরে দিতে থাকে। তারপর কোথা দিয়ে কি হয়ে যায় কিছুই বুঝতে পারে না বদর। কে যেন জোর করে তুলে জামানের দেহের ওপর তাকে বসিয়ে দেয়। দুহাত দিয়ে জামানের দেহটা জাপটে ধরে। তারপর সে কি ঝড়ের প্রচণ্ড তাণ্ডব। বন্দরের সারা শরীর ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের ঢেউ-এর মতো উত্থাল পাথাল হতে থাকে। অস্ফুট আর্তনাদ করে ওঠে বন্দর, বাঁচাও বাঁচাও, আমি শেষ হয়ে গেলাম
এই সময় রজনী অতিক্রান্ত হতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.