আমার দ্বিতীয়বার ইংল্যান্ড সফর_মুহম্মদ মতিউর রহমান : পর্ব-৮

৩০ জুন, মঙ্গলবার
আজ সারাদিন ঘরেই ছিলাম। দুপুরে এখানকার একটি ক্লিনিক থেকে টেলিফোন পেলাম। আগামীকাল জুলাই বিকাল তিনটার সময় ডাক্তারের সঙ্গে আমার Appointment, সেটা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য কল করেছে। কত দায়িত্ব-সচেতন এখানকার লোকজন। আমাদের মত দায়িত্ব-জ্ঞানহীন মানুষদের জন্য বিস্ময়কর বই কি! আমি অবাক হলাম। আমেরিকানদের দায়িত্ববোধ সম্পর্কে আমার মনে শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি হলো।
এখানে সবখানেই একটা শৃংখলা, নিয়মানুবর্তিতা, সময়-জ্ঞান দায়িত্ব-সচেতনতার পরিচয় সুস্পষ্ট। গুণগুলো একজন মানুষকে সাফল্যের উচ্চ স্তরে পৌঁছে দিতে পারে, একটি জাতির সব মানুষ যখন এরূপ শৃংখলা-নিয়মানুবর্তিতা, সময়-জ্ঞান দায়িত্ব সচেতনতার পরিচয় দেয়, তখন সে জাতি সামগ্রিকভাবে অবশ্যই উন্নতি অগ্রগতির মডেলে পরিণত হয়। তবে এজন্য যেমন মানসিক প্রস্তুতি প্রয়োজন, তেমনি বাস্তব, কর্ম-প্রয়াস অপরিহার্য। আমাদের ব্যক্তি জীবনে সমষ্ঠিগত বা জাতীয় জীবনে সে উপলব্ধি কতদিনে আসবে? একথা ঠিক যে সে উপলব্ধি একদিন আসতেই হবে! স্বাধীন জাতি হিসাবে বিশ্বের বুকে মাথা উচু করে দাঁড়াতে হলে এর কোন বিকল্প নেই।
পরাধীন যুগের মানসিকতা, হীনমন্যতা, পরমুখাপেক্ষিতা অলসতা আমাদের সকল সমস্যার মূল। এগুলো বিভিন্নভাবে আমাদের নৈতিকভাবে ধ্বংস করেছে, আমাদের এগিয়ে চলার পথ রুদ্ধ করেছে, আমাদের সীমাহীন দারিদ্রকে উষ্কে দিয়েছে এবং মেরুদন্ডকে দুর্বল করে নতজানু হয়ে চলতে শিখিয়েছে।
ইংল্যান্ডে দেখেছি, সর্বত্র ইতিহাস-ঐতিহ্যকে সমুন্নত করে তা থেকে অনুপ্রেরণা লাভের ঐকান্তিক প্রয়াস। আমেরিকায় দেখলাম, সর্বত্র কর্মচাঞ্চল্য, গতিময়তা নতুনত্বের প্রতি প্রবল আগ্রহ। আর তাই নতুন নতুন আবিষ্কার অভিনব অভিযাত্রা। পুরাতনকে পিছনে ফেলে  ভবিষ্যতের অনন্ত সম্ভাবনাকে মানুষের আয়ত্তের মধ্য নিয়ে আসার  প্রাণান্তকর প্রয়াস। তাই দেখা যায়, আমেরিকা যত বেশি নতুন আবিষ্কার, বিজ্ঞান প্রযুক্তির সদ্ব্যবহারে সাফল্য অর্জন করেছে, অন্যকোন দেশ অতটা পারেনি।
ইতিহাস-ঐতিহ্যের চেতনা মানুষকে আত্ম-সচেতন করে তোলে, আত্ম-মর্যাদাশীল আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে তোলে আর কর্ম-মুখরতা নবসৃষ্টির উম্মাদনা মানুষকে তার মনুষ্যত্বের প্রকৃত মর্যাদা অন্তহীন সম্ভাবনা অবিষ্কারে সাহায্য করে। সে কারণে বর্তমান যুগে ইংল্যান্ড আমেরিকা পৃথিবীর সবচে উন্নত দুটি দেশ।
অন্যদিকে, আমাদের অবস্থা হয়েছে সম্পূর্ণ বিপরীত। ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে আমরা শুধু উদাসীন নই, স্বীয় ইতিহাস-ঐতিহ্যকে বিস্মৃত হতে বসেছি। ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে অনুপ্রেরণা সংগ্রহ করে মানুষ সুন্দরতম ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হয়। আর ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিস্মৃতি মানুষকে স্থবির করে তোলে। আমরা এখন সে স্থবিরতায় ভুগছি। তাই কর্ম-বিমুখতা জীর্ণ-পুরাতনকে ঘিরে আমাদের অক্ষম আত্মতুষ্টি। এটা সামনে চলার ক্ষেত্রে আমাদের এতটুকু সাহায্য করছে না। আমাদের সামনে চলার পথও অনেকটা অস্পষ্ট লক্ষ্যহীন। তাই পরানুপেক্ষিতা পরানুকরণে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। ধরনের স্থবিরতা, লক্ষ্যহীনতা পরানুপেক্ষিতা থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস-ঐতিহ্যের আলোকে সুস্পষ্ট লক্ষ্যপথ নির্ধারণ করে জাতীয় জীবনে গতিময়তা সৃষ্টি করতে হবে। এছাড়া, উন্নতির কোন উপায় নেই।
আমাদের কি কখনো সত্যিকার বোধোদয় হবে না? হবে। নিশ্চয়ই হবে। অতটা নিরাশ হতাশাগ্রস্ত হওয়ার কারণ নেই। তবে বর্তমানে আমরা বিরূপ সময়ের যে পাঁকে পড়েছি, অশুভ ঝঞ্ঝা-বার্তার আবর্তে চক্রাকারে ঘুরপাক খাচ্ছি, তার রেশ কেটে গেলেই আবার আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারবো বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। সে শুভক্ষণ কি খুব বেশি দূরে? প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে আমরা কত তাড়াতাড়ি আত্ম-সংবিত ফিরে পাব, আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে নিজের আত্ম-পরিচয় সন্ধানে যত্নবান হব। যে জাতির সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে, যে ইতিহাসে নানা পট-পরিবর্তন ঘটেছে এবং যে ইতিহাসের অধিকাংশ অধ্যায়গুলো গৌরব-দীপ্তিতে উজ্জ্বলÑ সে জাতি নিশ্চয় একদিন তার ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাবে, ইতিহাস থেকে শিক্ষা অনুপ্রেরণা গ্রহণ করে সে জাতি অবশ্যই একদিন সামনের দিকে অগ্রসর হবে।
গত শতাব্দীতে আমাদের ইতিহাসে দুটি বড় যুগান্তকারী ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। একটি ১৯৪৭ সনের স্বাধীনতা, অন্যটি ১৯৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন সর্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যূদয়। একটি আমাদের ইতিহাসবোধ ঐতিহ্যÑসচেতনতার ফসল। দীর্ঘ ত্যাগ-তিতিক্ষা নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের বিনিময়ে পরাক্রান্ত ইংরাজ ব্রাহ্মণ্য দুষ্ট-চক্রের  কবল থেকে মুক্তি লাভের দুরপনেয় প্রয়াসের অনিবার্য ফল হল ১৯৪৭ এর স্বাধীনতা অর্জন। অন্যদিকে,  পাকিস্তানী শাসকদের বৈষম্যমূলক আচরণ, শোষণ-বঞ্চনা পদানত করে রাখার ঔপনিবেশিক মানসিকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার ঐকান্তিক প্রয়াস থেকে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়। এটা ইতিহাসের ধারাবাহিকতা। ধারাবাহিকতার মধ্যে এক ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে। ১৯৪৭ সনে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা না হলে মুক্তিযুদ্ধ হত না এবং ১৯৭১ সনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের কোন সম্ভাবনাই ছিল না। তাই দুটি ঘটনাই আমাদের জাতির ইতিহাসে অতিশয়  গুরুত্বপূর্ণ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। বিগত সহস্র বছরের ইতিহাস পর্যালোচনার মাধ্যমে এর তাৎপর্য উপলব্ধি করা সম্ভব। একটি হল আমাদের আত্ম-পরিচয়ে উদ্বুদ্ধ হবার প্রয়াস, অন্যটি আমাদের আত্ম বিকাশের সম্ভাবনাকে বাধামুক্ত অবারিত করার সুদীপ্ত বাসনা।
কিন্তু ইতিহাসের কোথায় যেন খানিকটা জট পাকিয়ে গেছে। জট-মুক্তি না ঘটলে আপদ কাটবে না, সুদিন আসবে না, মুক্তির শুভক্ষণ ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে।  তাই জট-মুক্তির দায় আজ সবাইকেই বহন  করতে হবে। ইতিহাসের একটি শিক্ষা হল এই যে, ইতিহাসকে যারা আঁকড়ে ধরে বসে থাকে তারা পিছনে পড়ে থাকে। ইতিহাসকে পিছনে ফেলে তা থেকে অনুপ্রেরণা সংগ্রহ করে যারা সামনে অগ্রসর হয়, তারা নতুন ইতিহাস রচনা করে। আমাদেরকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং নিরন্তর সামনের দিকে অগ্রসর হতে প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
আবার আগের কথায়  ফিরে আসা যাক। গত শতাব্দীর দুটি বড় ঘটনা আমাদের ইতিহাসের সবচে গুরুত্বপূর্ণ দুটি তাৎপর্যবহ ঘটনা। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আমাদের ইতিহাস সুদীর্ঘ। গত শতাব্দীর পূর্বেও আরো অনেক শতাব্দী পাড় হয়ে এসেছি আমরা। ইতিহাসের সুদীর্ঘ যাত্রাপথে আমাদের অনেক গৌরবগাথা রচিত হয়েছে, নতুন নতুন অভিযান অভিযাত্রায় আমাদের অনেক কিছু অর্জন হয়েছে, নব আবিষ্কারের আনন্দে আমরা বিশ্বকে আমাদের অংশীদার করেছি, সর্বোপরি মনুষ্যত্বের গৌরবে উদ্ভাসিত হয়ে আমরা বিশ্ব-সভ্যতায় নতুন আলোকস্তম্ভ নির্মাণ করেছি, বিশ্ব-সভ্যতাকে অন্ধকার যুগের তিমিরাবরণ থেকে উজ্জ্বল আলোর স্তরে নিয়ে আসার প্রয়াস পেয়েছি। আজকের ইউরোপ-আমেরিকার সভ্যতার সূচনা-লগ্নে ইসলাম মুসলমানদের অবদানকে অস্বীকার করবে কে?
তাই হতাশ হবার কারণ নেই। আমাদের ইতিহাসের গভীরে তাকাতে হবে। আমাদের দীর্ঘ লালিত গৌরবময় ঐতিহ্য থেকে অনুপ্রেরণা সংগ্রহ করতে হবে। তাহলেই মুক্তির আনন্দে মনুষ্যত্বের গৌরবে দৃঢ়পথে সামনের দিকে অগ্রসর হবার প্রেরণা সৃষ্টি হবে। আর সেটাই ব্যক্তি জাতির মধ্যে নতুন কর্মস্পৃহা কর্ম-মুখরতার উম্মেষ ঘটাবে। সে শুভক্ষণের প্রতীক্ষায় আর বসে থাকা নয়, যথার্থ পরিকল্পনা নিয়ে কাজে নেমে পড়া এখন সময়ের অপরিহার্য দাবি।
 
১জুলাই বুধবার
আজ আমাদের ক্যানসাস সিটিতে যাবার কথা। সেখানে আমার ছোটছেলে আবিদুর রহমান থাকে। মিজ্যুরী স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে সে ব্যাচেলর ও মাস্টার্স পাশ করেছে, তারপর ক্যানসাস সিটিতে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসাবে চাকরি করে।
আগের দিন রাতেই আমার স্ত্রী সবকিছু গোছগাছ করে রেখেছেন, বাকিটা সকালে ঠিকঠাক করে আমরা দুপুরের মধ্যেই রেডি হয়ে গেলাম। এনাম সাড়ে বারোটার মধ্যেই কাজ থেকে চলে এসেছে, মেয়ে সুমাইয়ার জন্য আমরা অপেক্ষা করছিলাম। সে স্কুল থেকে এল দু’টায়। সুমাইয়া আসার পরই আমরা রওয়ানা হলাম। বিকাল তিনটায় আমার ডাক্তারের সাথে Appointment তাই প্রথমে আমরা সেখানে গেলাম। ডাক্তার দেখালাম। সময়ের আগেই তারা আমার অপেক্ষায় ছিলেন। ৪৫ মিনিট ধরে আমার ডায়াবেটিস সম্পর্কে সবকিছু তন্নতন্ন করে জিজ্ঞাসাবাদের পর ডাক্তার ব্যবস্থা-পত্র দিলেন। আমাদের দেশের ডাক্তারের কথা মনে পড়ল। এত সময় তারা কখনো কোন রোগীর পেছনে ব্যয় করে না। ৪৫ মিনিটে তারা অন্তত দশজন রোগী দেখে বিদায় করে। এখানে ডাক্তার রোগী দেখে রোগ নিরাময়ের জন্য। সেজন্য তারা বিশেষ রোগী নিয়ে গবেষণা করে, রোগীকেও তার রোগ সর্ম্পকে বুঝাবার চেষ্টা করে এবং ঔষধ খাবার সাথে সাথে আরো কী কী করলে রোগ থেকে নিরাময় হওয়া যাবে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত বুঝিয়ে দেয় অর্থ্যাৎ রোগীকে রীতিমত স্বাস্থ্য-সচেতন করে দেয়। এখানকার ডাক্তার আর আমাদের দেশের ডাক্তাদের মধ্যে কত পার্থক্য তা এখানে এসে সহজে উপলব্ধি করলাম।
ডাক্তারের ওখান  থেকে বের হয়ে, আমাদেরকে আবার বিশেষ একটা কাজে বাসায় ফেরত যেতে হল। তারপর যখন ক্যানসাসের দিকে রওয়ানা হলাম তখন ঘড়িতে সোয়া চারটা বাজে। ক্যানসাস যেতে সাড়ে পাঁচ ঘন্টা ড্রাইভ করতে হয়। আমেরিকান হাইওয়েতে চলার আনন্দই অন্যরকম। দীর্ঘ প্রশস্ত পথ। মাঝে মাঝে পথের দু’পাশে রেস্ট হাউজ, সেখানে ইচ্ছামত পায়খানা-পেশাব করা যায়, গোসল করা যায়, খাবার কিনে খাওয়া যায়, ঘর থেকে খাবার নিয়ে সেখানে বসে খাওয়া যায় এমনকি, সেখানে রান্নাবান্না করে পিকনিক করারও ব্যবস্থা রয়েছে। শুধু তাই নয়, বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা রেস্ট হাউজ-এ ছেলেমেয়েদের খেলাধুলার ব্যবস্থাসহ সবুজ বনানী ও সুসজ্জিত ফুল-বীথির পাশ দিয়ে দীর্ঘপথ হেঁটে হাত-পায়ের জড়তা দূর করা যায়। এসবই পথচারীদের পথের ক্লান্তি দূর করা এবং দীর্ঘ পথ-যাত্রাকে আরামপ্রদ করে তোলার জন্য তৈরি করা হয়েছে। আমরা দু’ঘন্টা ড্রাইভ করার পর একটি রেস্ট হাউজে এসে কিছুক্ষণের জন্য যাত্রা বিরতি করলাম। এ রেস্ট হাউজটি এবার National Award  পেয়েছে। সবদিক দিয়ে সুন্দর। সর্বোপরি ঝক্ঝকে সুন্দর-পরিষ্কার এবং পথচারীদের জন্য সর্বাধিক আরামপ্রদ ব্যবস্থাসহ এক অতি প্রয়োজনীয় একটি জনহিতকর স্থাপনা-ধনী-গরীব, দেশী-বিদেশী সকল শ্রেণীর পথ-যাত্রীরাই তা অবরিতভাবে ব্যবহার করে থাকে। আমার নাতি-নাতনি আইয়ান ও জারা দু’জনেই খুব মজা করে রেস্ট হাউজের স্লাইডে চড়ে খেলাধুলা করল এবং মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় সারা এলাকা ঘুরে বেড়াল। আমরাও কিছু নাস্তা-পানি খেয়ে রেস্ট হাউজের সাজানো বাগানের মধ্যে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়িয়ে দেহ-মনের ক্লান্তি দূর করার প্রয়াস পেলাম।
বিকাল সাড়ে নয়টার দিকে আমরা Kansas City-এর Overland Park এলাকায় আমার ছেলে আবিদের বাসায় ঢুকলাম। আবিদ আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। এখানে মাগরিব হয় ৯.২০ মিনিটে। ঘরে ঢুকে আমরা প্রথমে ওযু করে মাগরিবের নামায আদায় করলাম।
 
২ জুলাই, বৃহস্পতিবার
আমরা কয়েকটি সুপার মার্কেটে ঘুরে ফিরে কিছু কেনাকাটা করলাম। এখানকার সুপার মার্কেট মানে এক একটা বড় সড় বাজার। বিশাল এলাকা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বলতে গেলে, প্রায় সবধরনের জিনিসপত্র নিয়েই সুন্দর সুসজ্জিত এক একটি বাজার। সুপার মার্কেটে সাধারণত আমার ছেলেমেয়েরা কেনাকাটা করলেও আমার কাজ হল তাদের সঙ্গ দেয়া। তবে এতে আমার লাভ হল এই যে, কিছু হাঁটাহাঁটি হয় এবং এটা আমার শরীরের জন্য খুবই প্রয়োজন। ডায়বেটিক রোগীদের খাওয়া-দাওয়াসহ বিভিন্ন নিয়মকানুন মেনে চলার সাথে সাথে নিয়মিত হাঁটা অত্যাবশক।
 
৩ জুলাই, জুমাবার
জু’মার নামায পড়ার জন্য আবিদের বাসার কাছে Jhonson County ইসলামিক সেন্টারে গেলাম। একটি পুরনো ভিলা বাড়ি কিনে সেটাকে মসজিদ বানানো হয়েছে। মসজিদের পাশে আরো কয়েক একর জমি কেনা হয়েছে। শীগগিরই এখানে বড় আকারের একটি আধুনিক মসজিদ, ইসলামিক সেন্টার, কোরআন শিক্ষা কেন্দ্র এবং কবরস্থানসহ বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হবে বলে আবিদ আমাকে জানাল। এখানে রমজানে খতম তারাবী পড়া হয়। আবিদ এখানে গত রমজানে খতম তারাবি পড়েছে এবং জু’মার নামায সে নিয়মিত এ মসজিদেই আদায় করে।
আমরা মসজিদে যখন ঢুকি, তখন মিসরীয় ইমাম সাহেব জু’মার খুৎবা দিচ্ছিলেন। রজব মাস, তাই স্বভাবতই তিনি মিরাজ সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। এখানে সব মসজিদেই দেখলাম ইংরাজিতে খুৎবা দেয়া হয়। অবশ্য খুৎবার কিছুু অংশ আরবিতে পেশ করা হয়। মসজিদে প্রায় তিন শো-এর মত নারী-পুরুষ নামায পড়লেন। মুসল্লিদের মধ্যে পাকিস্তানীদের সংখ্যাই বেশি। মসজিদ ম্যানেজমেন্টেও শুনলাম তাদেরই আধিপত্য। মুসল্লীদের মধ্যে আরব, ভারতীয়, বাংলাদেশী ও অন্যান্য দেশের মানুষও রয়েছেন। পরিপূর্ণ স্বস্তি ও মনের আনন্দের সাথে জু’মার নামায আদায় করলাম।
নামায শেষে মসজিদ থেকে বের হয়ে দেখি এনাম আমার ও আবিদের জন্য মসজিদের গেটে অপেক্ষা করছে। তার সাথে একজন প্রবাসী বাংলাদেশী ও তার ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। এনাম আমাকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। তার নাম মিনহাজুল ইসলাম। সে বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ মরহুম এডভোকেট এ.কিউ.এম শফিকুল ইসলামের ছেলে। দীর্ঘকাল যাবৎ সে আমেরিকায় থাকে, স্ত্রী ও ছেলেসহ সে এখন আমেরিকার নাগরিক। Over Land Park-এ বাড়ি কিনে এখন এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে তাকে দেখেছি। তখন আমি সিদ্ধেশ্বরী কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল আর সে সিদ্বেশ্বরী হাইস্কুলের ছাত্র। তাই খুব সহজেই তাকে তুমি বলা শুরু করলাম এবং খুব ভাল লাগল দীঘদিন পর বিদেশে তার সঙ্গে এভাবে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়াতে। আমার জামাই এনামের সাথে তার অনেক দিনের পরিচয়। এনাম প্রথম যখন ক্যানসাস সিটিতে চাকরি নিয়ে আসে, তখন মিনহাজ ও অন্য কয়েকজন বাংলাদেশী তাকে সেখানে অভ্যর্থনা জানায় এবং ‘ক্যানসাস বাংলাদেশ সমিতি’র কর্মকাণ্ডে তাকে শামিল করে নেয়।
বিকালে মিনহাজ টেলিফোন করল পরের দিন তার বাসায় দুপুরে খাবার জন্য। আমরা রাজী হলাম। আছরের নামায পড়ে আমরা Over Land Park এলাকায় গড়ে ওঠা কিছু নতুন দোকানপাট দেখতে গেলাম। এখানকার দোকান বা বাজার মানে শুধু ঠাসাঠাসি করা কিছু দোকানপাট নয়, বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা শপিংমল, পার্ক, ঝর্ণা, রাস্তা-ঘাট, খাবার দোকান ও পণ্যদ্রব্যের বিরাটাকার দোকান। কিছুক্ষণ দোকানে হাঁটাহাঁটি করে বিভিন্ন ধরনের পণ্যদ্রব্য পরখ করে পার্কের লতা-গুল্মের পাশ দিয়ে অসংখ্য ফোটা গোলাপের পাশে ঝর্ণার কাছে পাতা বেঞ্চে বসে পড়লাম। তখন সন্ধ্যা বেলায় পরিচ্ছন্ন আকাশে চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় দিগন্ত আলোকিত হয়েছে। রাতের শুভ্র আলোয় পার্কের নানা রঙের অসংখ্য ফুল যেন হাসছে। সমস্ত ওভারল্যান্ড পার্ক এলাকাটিই যেন সবুজের আভরণে আচ্ছাদিত হয়ে নানা বর্ণের ফুলের শোভায় অপরূপ হয়ে উঠেছে। সমস্ত পৃথিবীটাই যদি এমন সুন্দর হতো! মনে মনে ভাবলাম, আমার মনে ঠিক এ মুহূর্তে যে সুন্দর অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে, তা যদি পৃথিবীর সব মানুষের মধ্যেই সুস্মিত হয়ে উঠতো! তাহলে কত সুন্দরই না হতো এ পৃথিবী ও ফুল-পাখিঘেরা সবুজ মৃত্তিকার উপর বসবাসকারী মানুষের জীবন।
 
৪ জুলাই শনিবার
সকালে আমরা গেলাম ওভারল্যান্ড পার্ক দেখতে। বিশাল এলাকা নিয়ে পার্কটি তৈরি হয়েছে। পার্কের কোথাও উঁচু কোথাও নিচু। অসংখ্য গাছ-গাছালিতে পরিপূর্ণ। উঁচু-নিচু জায়গার মধ্য দিয়ে সবুজ বনানীর পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে সব রাস্তা চলে গেছে। পার্কের মধ্যে কিছুদূর পর পর নির্মিত হয়েছে অনেকগুলো কৃত্রিম জলাশয়। উঁচু স্থান থেকে অসংখ্য ঝর্ণাধারার পানি ছল ছল বেগে বয়ে জলাশয়ের সাথে মিশে যাচ্ছে। সবুজ বনানী, বিচিত্র ফুলের সমাহার, স্নিগ্ধ ঝর্ণাধারা আর জলাশয়ের গভীর কালো জলরাশি-সব মিলিয়ে এক অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মনমুগ্ধকর পরিবেশ। পার্কের ভিতরে যতদূর হেঁটে বেড়ালাম, সবর্ত্রই দেখা গেল একই অবস্থা। মনে হয় যেন এর কোন শেষ নেই। মাঝে মধ্যেই জলাশয়, ঝর্ণাধারা এবং সর্বত্র নানা রঙের ফুল আর অন্তহীন সবুজ উদ্যান। এর মধ্য দিয়ে এঁকে বেঁকে চলে গেছে পাকা সরু রাস্তা। পার্কে পায়ে হাঁটা রাস্তার দু’পাশে খ্যাতনামা শিল্পীদের নানা রকম শিল্পকর্ম ও স্থাপত্য-ভাস্কর্য দর্শনীয়ভাবে স্থাপন করে রাখা হয়েছে- শিল্পীদের পরিচিতিসহ। পার্ক দেখে মনে হল-প্রকৃতির সাধারণ সৌন্দর্যকে এরা নানা অলংকারে বিভূষিত করে এক অপরূপ দৃশ্যপট তৈরি করেছে। আমেরিকানরা প্রকৃতিকে ভালবাসে। নিরাভরণ প্রকৃতির অন্তহীন সৌন্দর্যের মাঝে তারা জীবনের আনন্দ ও তাৎপর্য খুঁজে বেড়ায়। তাই প্রকৃতিকে অধিকতর সৌন্দর্যময় ও দৃষ্টিনন্দন করে তোলার জন্য তাদের প্রাণান্তকর প্রয়াস চোখে পড়ে।
পার্কের মাঝে-মধ্যে ক্লান্ত দর্শকদের বসার ব্যবস্থা আছে। পায়খানা-পেশাবের জন্য যথাস্থানে আছে রেস্টরুম। অতএব, নিশ্চিন্তে মনের আনন্দে যতক্ষণ খুশী ঘুরে বেড়াও-প্রকৃতির অন্তহীন সৌন্দর্যের গভীরে নিজেকে হারিয়ে দাও, মুক্ত বিহঙ্গের মত বন-বনান্তে সবুজ উদ্যানে সর্বত্র ঘুরে বেড়াও। এখানকার গাছ, ফুল কোনটাই নাম-গোত্রহীন নয়, সব গাছ ও ফুলের নাম লেখা আছে-দর্শক ও অনুসন্ধিৎসূদের আগ্রহ ও কৌতূহল নিবারণের জন্য। শিক্ষার্থীদের জন্য তাই এটা এক বিশাল উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকৃতির মধ্যে এসে তারা প্রকৃতিকে জানার সুযোগ পায়। প্রকৃতি-বিজ্ঞান নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তারাও মাঝে মধ্যে আসেন এখানে শিক্ষার্থীদেরকে তাদের জ্ঞানানুসন্ধানে সাহায্য করতে।
পার্কের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। আমার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, জামাই, নাতি-নাতনি সবাই উদ্যানের আঁকাবাঁকা পথ ধরে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি ওদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছি না, আমার বয়স আমাকে প্রতারণা করেছে। আমি বয়সের ভারে কিছুটা ন্যূজ্ব-অবসন্ন। শৈশব-কৈশোরের উচ্ছল আনন্দময় দিনগুলোর কথা মনে হয়ে মন খানিকটা বিষণ্ন হয়ে উঠলো। ওদের আনন্দ দেখে আমার মনেও আনন্দ, কিন্তু আমার মুখের হাসিতে যেন কিছুটা ম্লানিমার ছাপ লেগে আছে।
ক্লান্ত-অবসন্ন দেহে আমি পার্কের রাস্তার পাশে একটি বেঞ্চে বসে পড়লাম। আমাকে বেঞ্চে বসা দেখে অদূরে আমার স্ত্রীও দৌড়ে এসে কুশল জিজ্ঞাসা করল। আমি বললাম, ‘ভাল আছি, তবে বেশ ক্লান্ত।’ আমার কথা শুনে আমার স্ত্রীও বেঞ্চের একপাশে বসে পড়লো। সেও খানিকটা ক্লান্ত। আমরা দুজনেই আর হাঁটতে পারছি না। আমাদের অবস্থা উপলব্ধি করে ছেলেমেয়েরা ও জামাই এগিয়ে এল। বলল, চলুন এবার ফিরে যাই। আমরাও বললাম চল।
সবুজ বনানী ঘেরা পাখির কলকাকলি মুখরিত আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে আমরা ফিরে এলাম পার্কের প্রবেশ-দ্বারে। অদূরে গাড়ি পার্ক করা আছে। গাড়িতে উঠে সীট বেল্ট পরে পেছনে হেলান দিনে বসে শরীরের ক্লান্তি মোচনের প্রয়াস পেলাম।
দুপুরে মিনহাজের বাসায় আমাদের দাওয়াত। সেখানে গেলাম। পথের পাশে বেশ বড় বড় জায়গার উপর খোলামেলা চমৎকার ভিলা বাড়ি। উপর তলায় কয়েকটি বেডরুম, নিচের তলায় ড্রয়িং, ডাইনিং ও রান্নাঘর, গ্রাউন্ডফ্লোরে খেলাধুলার জায়গা, বসার জায়গা, চমৎকার সব পরিপাটি ব্যবস্থা। মিনহাজের ছেলেরা সেখানে ইনডোর খেলাধুলা করে, অতিথি-মেহমান এলে সেখানে থাকে, মিটিং-পার্টি ইত্যাদির আয়োজনও সেখানে স্বচ্ছন্দে করা যায়। মিনহাজ এখানে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে ভাল চাকরি করত। সম্প্রতি বিশ্বমন্দার প্রভাবে চাকরিহীন। এখন অন্য একটি চাকুরি নিয়েছে সে। তার স্ত্রী নীরাও চাকরি করে। স্বামী-স্ত্রী ও তিন ছেলে নিয়ে তাদের পরিপাটি সংসার। বড় ছেলে কলেজে পড়ে, দাদার মতই রাজনীতির নেশাগ্রস্ত। ডেমোক্রেটিক পার্টি করে। ওবামার নির্বাচনী প্রচারনায় সে দিনরাত কাজ করেছে। ২০০৮ সনে রোযার মাসে সেহেরী খেয়ে পকেটে ইফতারির প্যাকেট নিয়ে সে সারাদিন ওবামার পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছে। আজো শুনলাম, পার্টির এক সভায় যোগ দিতে সে সকালেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। মেঝ ছেলে হাইস্কুলে পড়ে। ছোট ছেলে সবেমাত্র স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। স্ত্রী নীরা সামাজিক কাজে উৎসাহী। এখানকার বাংলাদেশ সমিতির সে অন্যতম সহ-সভাপতি। মিনহাজও সমিতির একজন নির্বাহী সদস্য। দু’জনেই প্রবাসী বাংলাদেশীদের খোঁজ-খবর রাখে, তাদের কল্যাণে কাজ করে, বাংলাদেশ নিয়ে ভাবে। যদিও তারা পরিবারের সবাই আমেরিকার নাগরিক, তবু শিকড়ের টানে মাতৃভূমির মায়ায় স্মৃতিকাতর হয়, দেশের কল্যাণে সাধ্যমত নিজেদেরকে উজাড় করে দিতে চায়। এটাই তো সত্যিকারের দেশপ্রেম-যা আজন্ম, পলে পলে, সকলের অগোচরে মনের গভীরে লতানো গাছের মত বেড়ে ওঠে। প্রবাসের অপরিমেয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও বিত্ত-বৈভবের মধ্যেও তা কখনো বিস্মৃত হওয়া যায় না। বরং প্রবাসে থাকলে স্বদেশের কথা আরো বেশি মনে পড়ে এবং অনেক সময় স্মৃতিকাতরতা মনকে বিষাদে ভারাক্রান্ত করে তোলে। অবশ্য পরবর্তী প্রজন্ম, যাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা বিদেশের মাটিতে, তাদের কথা আলাদা।
পরস্পরের মধ্যে পরিচয়ের পালা শেষ হতেই খাবার টেবিলে ডাক পড়ল। আমেরিকান লং গ্রেইন চাল দিয়ে খাসির বিরানি, চিকেন রোস্ট আর চাক চাক করে বেগুন ভাজা। সাথে আছে সালাদ ও চাটনি। মহা তৃপ্তির সাথে খেয়ে আমরা উপলব্ধি করলাম, নীরা একজন পাকা রাঁধুনি-ঢাকাই কাচ্চি বিরানি রান্নায় সে এখনও সিদ্ধহস্ত। আমেরিকার ক্যানসাস সিটিতে বসে ঢাকাই বিরানির চমৎকার স্বাদে আমরা সবাই মোহিত হলাম, সালাদ চাটনি সহকারে তা পেটভরে খেয়ে মহাতৃপ্তি লাভ করলাম।
খেতে খেতে জোহরের ওয়াক্ত হয়ে এল। মিনহাজ বলল, চলেন নিচে নামাযের জায়গা আছে, সেখানে আমরা জামাতে নামায পড়ব। নিচে গিয়ে ওযু করে নামাযে দাঁড়ালাম। বয়সের দিক থেকে আমি সবার মুরব্বী, তাই আমাকে ইমামতি করতে হল। তারপর সটান সোফায় বসে আবার গল্প। ঢাকার রাজনীতি, মগবাজার কাজী অফিস লেনের পুরান গল্প, মিনহাজদের ঐতিহ্যবাহী পরিবারের নানা প্রসঙ্গ ইত্যাদি অনেক বিষয় নিয়ে আলাপ। এরপর বিকালের চা- নাস্তা খেয়ে আবার আমরা গাড়িতে উঠলাম। ওরা সবাই রাস্তায় এসে আমাদেরকে বিদায় জানাল।
মিনহাজদের বাসা থেকে  বেরিয়ে আমরা গেলাম ১২ একর এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা Deanna Rose Farmstead, দেখতে। নানা রকমের গৃহপালিত পশুর প্রদর্শনী। প্রাচীনকালে আমেরিকানদের জীবনযাত্রা অনেকটা এসব গৃহপালিত পশুর উপর নির্ভরশীল ছিল। এক সময় এসব ঘোড়া-গাধা-খচ্চরের পিঠে চড়ে এদেশের লোকজন চলাফেরা করত, মালপত্র বহন করত, এসব হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল-মেষ-মহিষের গোস্তই ছিল তাদের প্রধান খাদ্য। সেসব প্রাচীন স্মৃতি ধরে রাখার জন্যই এসব গৃহপালিত জন্তু-জানোয়ার নিয়ে গড়ে উঠেছে Deanna Rose Farmstead. বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে এখানে এসে তাদের পূর্ব পুরুষদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে অবহিত হতে ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারে।
এখন জীবন বদলে গেছে। আধুনিক বাড়ি-ঘর, রাস্তাঘাট, নানাধরনের আধুনিক গাড়ি, পরিবহন-ব্যবস্থা, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও প্রযুক্তির নিত্য-নতুন অভিনব ব্যবহার ইত্যাদি সবকিছু এখানকার জীবনধারায় নানা পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। আগের চেয়ে জন-বসতিও অনেক বেড়েছে। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য মানুষ এসে এখানে বসতি গড়ে তুলেছে। এখনও আসছে। আমেরিকান জনসংখ্যার তুলনায় আমেরিকান আদিবাসী বা Native American-দের সংখ্যা নিতান্ত নগণ্য। ফ্রি জায়গা-জমি, বাড়ি-ঘর ইত্যাদি নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় তাদের অধিবাস গড়ে তোলা হয়েছে। তাদেরকে কোনরূপ ট্যাক্স দিতে হয় না, সরকার থেকে প্রয়োজনে টাকা-পয়সা দেয়া হয়-অনেকটা স্বাধীন স্বচ্ছন্দ জীবন তাদের। তবে তারা আমেরিকান মূল স্রোতধারা থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন। আমেরিকান বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এখন বহিরাগত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থেকে তারা এসেছে এবং এখনো অবিরত আসছে। কেউ আগে এসেছে, কেউ পরে। যারা যত আগে এসেছে, তারা তত ভাগ্যবান। জোর করে ঘধঃরাব অসবৎরপধহ-দের তাড়িয়ে তারা  আমেরিকার বিশাল বিস্তৃত এলাকা ইচ্ছামত দখল করে বিত্তশালী হয়েছে। তবে পরবর্তীতে যারা এসেছে, নাগরিকত্ব পাবার পর নাগরিক অধিকারের দিক থেকে সবাই সমান- ভোটাধিকার, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি কোন ক্ষেত্রেই আইনের দৃষ্টিতে কোন বৈষম্য নেই। আমেরিকার Constitution-এ তিনটি মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে- Freedom of speach, Freedom to religion, Freedom to change government, তাই বিভিন্ন ভাষা-বর্ণ ও জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা এখানে সমানাধিকারের ভিত্তিতে জীবনযাপন করে। অবশ্য বিভিন্ন ভাষা-বর্ণ জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা এখানে একদিনেই এ বৈষম্যহীন মানবিক সমানাধিকার লাভ করেনি। এর পেছনে রয়েছে এক দীর্ঘ সংগ্রাম-সংঘর্ষময় ইতিহাস।
আমেরিকার এ বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের নিরন্তর সংগ্রাম ও আন্দোলনে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের রয়েছে যুগান্তকারী ঐতিহাসিক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। তিনিই প্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে দাস-প্রথার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ-আইন করে দাস-প্রথার উচ্ছেদ করে তাদেরকে স্বাধীন মানুষের মর্যাদা ও অধিকার প্রদান করেন। কায়েমী স্বার্থবাদীরা তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। সারা আমেরিকায় সে বিদ্রোহের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। আঠার শতকের ষাট দশকের প্রায় অধিকাংশ সময় জুড়ে এ বিদ্রোহ চলে। কখনও তা রক্তাক্ত সংর্ঘষের রূপ নেয়। আব্রাহাম লিংকন শক্ত হাতে সে বিদ্রোহ দমন করে পৃথিবীর ইতিহাসে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল নিদর্শণ স্থাপন  করেন। অবশ্য এজন্য শেষ পর্যন্ত তাঁকে প্রাণ দিতে হয়। নিজের প্রাণের বিনিময়ে তিনি আমেরিকার কৃষ্ণকায়দের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। সারা বিশ্বে সে ভূমিকা প্রশংসিত হয় এবং অধিকার বঞ্চিত মানুষকে তা আশা-আনন্দ ও নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উম্মোচনে উদ্বূদ্ধ করে।
এর আগে আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের কোনই মানবিক অধিকার ছিল না। পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট জীবন যাপন করতো তারা। হোটেলের সামনে সাইনবোর্ড লটকানো থাকত ঃ Beware of Dogs and Blacks. এভাবে নানাভাবে তারা  অবহেলিত, বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার হত। প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ক্রীতদাস প্রথার অবসান ঘটালেন, দাস ও কৃষ্ণাঙ্গের মৌলিক মানবাধিকারের ঘোষণা দিলেন, সামজে সর্বক্ষেত্রে বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে মানুষের অধিকবার ও মর্যাদাকে সমুন্নত করলেন। আমেরিকার ইতিহাসে এটা ছিল এক বিস্ময়কর যুগান্তকারী ঘটনা। মানব-সভ্যতার ইতিহাসেও এটা এক বিস্ময়কর উজ্জ্বল ঘটনা। ইসলামের আর্বিভাবের পরে মানুষের অধিকার ও মর্যদাকে এভাবে আর কেউ কখনো সমুন্নত করার প্রয়াস পায়নি।
কিন্তু তা সত্ত্বেও কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার ও মর্যাদা অত সহজে অর্জিত হয়নি। এজন্য দীর্ঘ সময় লেগেছে। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক পর্যন্তও কৃষ্ণাঙ্গরা পাবলিক বাসে উঠতে পারত, কিন্তু বাসের সিট খালি থাকা সত্ত্বেও সেখানে তাদের বসার অধিকার ছিল না। দাঁড়িয়ে রডে ঝুলে তাদেরকে দীর্ঘ পথ পারি দিতে হতো। কিন্তু তারপর ঘটল এক ঐতিহাসিক ঘটনা। সে ঘটনার পর আমেরিকার মানবাধিকারের ইতিহাস আবার খানিকটা পাল্টে গেল।
Rosa Lousise McCauley Parks  (জন্ম ১ ফেব্রুয়ারি ১৯১৩, মৃত্যু ২৪ অক্টোবর ২০০৬) এক আফ্রিকান-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা, যিনি Rosa Parks নামে বিশেষভাবে পরিচিত, তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের মানবিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁর এ স্মরণীয় ভূমিকার জন্য ইউএস কংগ্রেস পরবর্তীতে তাঁকে ‘Mother of The Modern-Day Civil Rights Movement’ নামে অবিহিত করে। ১৯৫৫ সনের ১ ডিসেম্বর তারিখে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের এ সাহসী নারী কর্মী একদিন মন্টোগোমারি আলাবামা পার্ক এলাকায় বাসে উঠে সোজা একটি সীট দখল করে বসে পড়েন। বাসের ড্রাইভার জেমস ব্লাকস তাঁকে সীট ছেড়ে দিয়ে জনৈক শ্বেতাঙ্গকে সেখানে বসতে দিতে বলেন। কিন্তু তিনি দৃঢ়তার সাথে সীট ছেড়ে দিতে তাঁর অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। ফলে এক হুলুস্থুলু কান্ড বেঁধে যায়। বাসের শ্বেতাঙ্গ যাত্রীরা সবাই এতে বিরক্ত ও রাগান্বিত হয়। জড়ংধ চধৎশং -এর ধৃষ্টতা দেখে সকলে বিস্মিত হয়। কিন্তু তাঁকে সীট থেকে কেউ সরাতে পারে না।
এ ঘটনার আগে আরো এরকম দু’একটি ঘটনা ঘটে। ১৯৪৬ সনে আইরিন মর্গান এবং ১৯৫৫ সনে সারা লুই কিজ নামে দুই কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা যথাক্রমে ইউএস সুপ্রিম কোর্ট ও আন্তরাজ্য বাণিজ্য কমিশন থেকে আন্তরাজ্য বাস ভ্রমণে সীটে বসার অধিকার আদায় করেন। Rosa Parks-এর উপরোক্ত ঘটনার নয় মাস আগে পনের বছর বয়স্কা Claudette Colvin-ও আন্তরাজ্য বাসে উঠে সীট দখল করে বসে। ড্রাইভারের নির্দেশ সত্ত্বেও সে তার সীট ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে কম-বেশি ভূমিকা রাখলেও Rosa Parks- এর উপরোক্ত ঘটনা অত্যাধিক গুরুত্ব লাভ করে।  কারণ বাসে সংঘটিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সংঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে  তোলেন। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে উচ্চ কন্ঠে সবাইকে আহ্বান জানিয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিক অধিকার সম্পর্কে তিনি সকলকে সচেতন করে তোলেন। তাঁর এ আন্দোলনের ফলে Montgomerry Bus Boycott শুরু হয়। সারা আমেরিকায় তাতে সাড়া পড়ে যায়। তাঁর এ প্রতিবাদ ও আন্দোলন আমেরিকার নাগরিক অধিকার অন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রবল গণ-সচেতনতা সৃষ্টি করে। বর্ণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁর এ আন্দোলন আন্তজার্তিক ক্ষেত্রেও আলোড়ন সৃষ্টি করে। আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলনের প্রখ্যাত কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রও তাকে সমর্থন যোগান। ফলে আমেরিকায় জাতীয়ভাবে Rosa Parks বর্ণ-বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ নেত্রী হিসাবে প্রশংসিত হন। Parks তাঁর এ আন্দোলনের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৭৯ সনে Congressional Gold Medal-সহ অনেক সম্মান ও পুরস্কার লাভ করেন।
Rosa Parks-এর আন্দোলনের ফলে আমেরিকার ট্রেন, বাস, প্লেন, হোটেল-রেস্তোরা, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, পাবলিক প্লেস সর্বত্র কৃষ্ণাঙ্গদের সমানাধিকার স্বীকৃত হয়। এখন কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে বিয়ে-শাদী হচ্ছে, সমাজের সর্বস্তরেই সাধারণ-স্বাভাবিক জীবনযাপন  পরিলক্ষিত হয়, এমনকি ২০০৮ সনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বারাক হোসেন ওবামার মত একজন আফ্রিকান-আমেরিকান মুসলিম বংশোদ্ভূত  কালো মানুষ বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন-এটা আমেরিকার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সংযোজন করেছে, যা মাত্র অল্প কিছুদিন আগেও ছিল কল্পনাতীত।
আমেরিকার এ পরিবর্তনশীল সমাজে আধুনিক ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট তাদের অতীতকে স্মরণে রাখার প্রয়াসেই এ ধরনের ঐড়সব ঝঃবধফ জাদুঘর বা অনুরূপ সবকিছু তৈরি করা হয়েছে ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষীস্বরূপ।
৪ জুলাই আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস। সামাজ্যবাদী বৃটিশ বাহিনীর সাথে যুদ্ধে জয়লাভ করে র্জজ ওয়াশিংটন এ দিন আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং তিনি নিজে আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট হন। তিনি ছিলেন একজন সৈনিক। যুদ্ধ করে ইংরাজদের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয়ার পিছনে তাঁর বিরাট অবদান ছিল। সেই থেকে আমেরিকার জনগণ এ দিনটি বিশেষ উৎসব-আনন্দ ও নানারূপ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদ্যাপন করে থাকে। এ উৎসবের একটি বড় অংশ হল রাত্রি বেলায় Fire Work বা আতশবাতি জ্বালানো। প্রায় সব শহরেই, বিশেষত বড় বড় শহরে ধূমধামের সাথে এ উৎসরেবর আয়োজন করা হয়।
আমরা সন্ধ্যার একটু আগেই Fire Work দেখতে গেলাম শহরের একটি নির্দিষ্ট স্থানে। নানা বয়সের অসংখ্য লোক গাড়িতে করে এসেছে Fire Work দেখতে। রাস্তার দু’পাশের ফুটপাত মুহূর্তের মধ্যে উৎসবমুখর হয়ে উঠল মানুষের ভীড়ে। সন্ধ্যা ৯.৩০ মিনিটে Fire Work শুরু হল-একের পর এক নানা বর্ণের আলোকমালা বিকট শব্দে আকাশের দিকে উঠছে। সবাই আনন্দ-চিত্তে আকাশের দিকে তাকিয়ে আলোকমালার বিচিত্র বর্ণ ও দৃশ্য প্রাণভরে অবলোকন করছে। ত্রিশ মিনিট ধরে এ উৎসব চলল। রাত দশটায় Fire Work শেষ হল। সবাই আবার গাড়িতে উঠে ঘরের দিকে ছুটল। আমরাও গাড়িতে উঠলাম। রাস্তায় গাড়ির জট লেগে গেছে। ধীরে-সুস্থে জট অতিক্রম করে আমরা ঘরে ফিরলাম।

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.