আলিফ লায়লা : আরব্য রজনী_পর্ব-৬০


ইংরেজি অনুবাদ : ডঃ জে. সি. মারদ্রুস
বাংলা অনুবাদ : ক্ষিতিশ সরকার
 
পরদিন একশো পচাশিতম রজনীতে সে শুরু করে :
ডগমগ হয়ে উঠলো, দানাশের মুখ চুন। বললো, আমি হেরে গেছি, মাইমুনাহ, তোমারই জিৎ হলো। মেয়েদের ধৈর্য বলে কোন পদার্থ নাই, ছোঃ।
মাইমুনাহ হেসে গড়িয়ে পড়ে।আহা রাজকুমারীর কি দোষ! আমার শাহজাদার মতো অমন সুন্দর সুরৎ দেখলে কোন মেয়ে চরিত্র ঠিক রাখতে পারে, শুনি?
কশাকশকে অনেক সুক্ৰিয়া জানালো মাইমুন্নাহ, তোমার পরামশেই এত বড় তর্কের ফয়সালা হয়ে গেলো। যাক, এবারে তোমরা দুজনে রাজকুমারীকে তার প্রাসাদে আবার শুইয়ে দিয়ে এসো।
দানাশ আর কশকশ পালঙ্কের দিকে এগিয়ে যায়। রাজকুমারী বদর তখন কাম-ক্লেদ মুক্ত জামানের বুকের ওপর দেহখানা এলিয়ে দিয়ে অঘোর ঘুমে অচেতন। দানাশ বন্দরে কাঁধে তুলে নেয়। জানিলা দিয়ে বেরিয়ে নিঃসীম নীল আকাশ পথ ধরে বায়ুবেগে উড়ে চলে তারা চীনের দিকে। অল্পক্ষণের মধ্যে সম্রাট ঘায়ুরে প্রাসাদে যথাস্থানে বদরকে শুইয়ে দিয়ে নিজের নিজের ডেরার পথে পাডি দেয়। তারা।
মাইমুনোহও শাহজাদার গালে একটা চুমু একে দিয়ে নিজের কূপে গিয়ে ঢোকে।
ভোরেই ঘুম ভেঙে যায় কামার আল-জামানের। গত রাতের সব কথাই তার স্মরণে আছে। কিন্তু মেয়েটি কোথায় গেলো। ঘরের এদিক ওদিক সে খুতে থাকে। কিন্তু না, কোথাও নাই। - কি তার বাবার একটা কৌশল? যাইহোক, আজই আব্বাজনকে শাদীর কথা বলবে সে।
দরজা খুলে দেখে প্রহরীরা নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। জামান রাগে ফেটে পড়ে, এই ব্যাটা বান্দরগুলো, তোদের কি নাক ডাকাবার জন্যে রাখা হয়েছে? পাজী বদমাইশ কোথাকার।
শাহজাদার হুঙ্কারে ধড়মড় করে উঠে বসে সকলে। কেউ জলের গামলা কেউ তোয়ালে নিয়ে এসে দাঁড়ায়। হাত-মুখ ধুয়ে রুজু করে নামাজ সেরে নেয়। তারপর কোরান খুলে পাঠ করতে থাকে।
কোরানের কয়েকটা স্তবক পাঠ করে সে উঠে পড়ে। খানসামা এসে নাস্তা সাজিয়ে দেয়। জামান নির্বিকারভাবে জিজ্ঞেস করে, মেয়েটা কোথায় গেছে, সাব্বাব।
মেয়েটা? কোন মেয়েটা হুজুর?
সাব্বাব কিছুই আঁচ করতে পারে না। জামান ক্ষেপে যায়, ন্যাক চৈতন, যেন কিছুই জানে না। যা জিজ্ঞেস করছি সাফ সাফ জবাব দাও।
শাহজাদার কণ্ঠ গর্জে ওঠে। সাকবাবা ভয়ে জড়সড় হয়ে কোরবানীর খাসীর মতো একপাশে জোড় হাতে দাঁড়িয়ে থাকে।
সেই মেয়েটা কোথায়? গতকাল রাতে আমার পালঙ্কে কে তাকে পাঠিয়েছিলো?
সাব্বাব কাঁপতে কাঁপতে বলে, খোদা কসম, আমি কোনও লেড়কীকে তল্লাটে দেখিনি, হুজুর। আর তাছাড়া আমি তো দরজার সামনে আড়াআডি হয়ে শুয়েছিলাম। আমাকে ডিঙিয়ে ঘরে ঢুকবে কার সাধ্যি!
জামান এবার ক্ষেপে বোম হয়ে যায়।দেখো সাব্বাব, তুমি ভুলে যেও না। আমি শাহজাদা কামার আল-জামান, তোমার রসিকতার পাত্র নই। হতে পারো তুমি আমার বাবার বিশ্বস্ত নোকর। কিন্তু তাই বলে আমার সঙ্গে ধোঁকাবাজি করবে। সে আমি বরদাস্ত করবো না। এখন বলছি ভালোয় ভালোয় বলো সে কোথায়। না হলে কিন্তু আমার মাথায় খুন চেপে যাবে। তখন তোমার কোনও বাবা তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। আমি বুঝেছি তারা তোমাকে শিখিয়ে পড়িয়ে রেখেছে। কিন্তু তাতে তুমি নিস্তার পাবে না। সাব্বাব। সত্যি কথা তোমাকে বলতেই হবে।
লোকটা এবার দুহাত উপরে তুলে আল্লাহর উদ্দেশ্যে বলতে থাকে, খোদা, তুমি সাক্ষী, আমি কি শাহজাদার সঙ্গে মস্করা করছি? আপনি বিশ্বাস করুন হুজুর, আপনি কি যে বলছেন আমি কিছুই আন্দাজ করতে পারছি না।
-ওরে ভণ্ড, শয়তান, দিকে আয়।
সাব্বাবা ভয়ে ভয়ে শাহজাদার কাছে এগিয়ে যায়। প্রচণ্ড এক ঘুষি মেরে মেঝের ওপর ফেলে দেয়, এখনও বল, নইলে তোকে আস্ত রাখবো না।
সাব্বাব বলে, আমি কিছু জানি না হুজুর, কি করে বলবো? জামান ক্যাঁক করে একটা লাথি বসিয়ে দেয় ওর পেটে। বেচারা। এমনভাবে কঁকিয়ে ওঠে মনে হলো বোধ হয় পিলেটিলে ফেটে গেলো। জামান বলে চলে, তোকে কুয়োর জলে ডোবাবো। এই শীতের ঠাণ্ডা জলে কেমন আরাম বুঝবি।
কোমরে একগাছি রশি বেঁধে কুয়োর নিচে নামিয়ে চুবিয়ে দেয় ওকে। বেচারা সাব্বাব জলের মধ্যে খাবি খেতে থাকে। দোহাই হুজুর, বাঁচান, মরে যাবো।
কিন্তু জামান-এর অবস্থা তখন ক্ষেপ কুকুরের মতো। বারবার ওকে জলের মধ্যে চুবাতে থাকে। সে কোথায়। না হলে তোকে আমি আর তুলবো না।
সাকবাব ভাবলো শাহজাদা তাকে মেরেই ফেলবে। মরিয়া হয়ে চিৎকার করতে লাগলো, আপনি আগে আগে আমাকে ওপরে তুলুন, হুজুর, তারপর আমি সব বলছি।
হুম, সোজা পথে এসো।
এবার জামান ওকে ওপরে তুলে আনলো। বুড়ো সাব্বাব তখন ঠক ঠক করে কাঁপছে। সারা শরীরের এখানে ওখানে ছড়ে গেছে। কুয়োর পাটেবাড়ি খেয়ে দুটো দাঁত ভেঙে গেছে। নাকটা কেটে গিয়ে গলগল করে রক্ত ঝরিছে। কামার আল-জামান কেমন আড়ষ্ট হয়ে যায়। রাগটা কিছুটা প্রশমিত হয়ে আসে।
যাও, জামাকাপড় ছেড়ে ওষুধপত্র লাগিয়ে এসো।
শাহজাদার সামনে থেকে সে প্রায় ছুটে পালায়। আর কোথাও না গিয়ে সোজা সুলতানের সামনে হাজির হয়। সেই সময় সুলতান শাহরিমান উজিরকে বলছিলেন, কাল সারাটা রাত বড় খারাপ কেটেছে উজির। এক ফোটা ঘুমাতে পারিনি। খালি এদিক থেকে ওদিক পায়চারী করে বেডিয়েছি। বারবার একটা কথাই মনের মধ্যে নাড়া দিয়েছে, আমার কলিজা-জামান, না জানি কত কষ্টে, পোড়ো প্রাসাদের নোংরা ঘরে রাত কাটাচ্ছে। কিছুতেই মনকে প্রবোধ দিতে পারিনি।
উজির বলে, আপনাকে তো আমি বলে গিয়েছিলাম, জাঁহাপনা, কোনও দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনার প্রাসাদে যে সুখে তিনি থাকেন তার চেয়ে কম আরামে তাকে রাখা হয়নি।
এই সময় সাকবাব এসে সুলতানের পায়ের কাছে আছাড় খেয়ে পড়ে। জাঁহাপনা সর্বনাশ হয়ে গেছে।
সুলতান এবং উজির দুজনেই চমকে ওঠেন। কেন, কী হয়েছে, সাব্বাব?
জী হুজুর, শাহজাদার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
মাথা খারাপ হয়ে গেছে? কি করে বুঝলে।
জাঁহাপনা, সাব্বাব কাঁদতে কাঁদতে বলে, সকলে ঘুম থেকে উঠেই শাহজাদা হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, কাল রাতে আমার পালঙ্কে যে মেয়েটা শুয়েছিলো সে কোথায় গেলো? আমি যতই বলি এখানে কোন মেয়ে আসেনি-আসতে পারে না, ততই তিনি আমার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। আমি জেনেও তার কাছে ছুপিয়ে রাখছি মনে করে আমাকে মেরে পাট পাট করে দিয়েছেন তিনি। কোমরে দড়ি বেঁধে কুয়োর পানিতে নাকানি চোবানি খাইয়েছেন। এই দেখুন হুজুর আমার দুখানা দাঁত ভেঙে গেছে। নাকটা কেটে চৌচির হয়ে গেছে।
সুলতান ভাবেন, তার আশঙ্কাই ঠিক হয়েছে। না জানি বাছা আমার কত কষ্ট পেয়েছে। উজিরের দিকে তাকিয়ে গর্জে ওঠেন। তিনি, তোমার মৌৎ এগিয়ে আসছে, উজির। তুমি একটা বদমাইশ শয়তান, কুকুর। তোমার দাওয়াই-এর ব্যবস্থা আমি করছি। তোমার বন্দ পরামর্শেই আমি তাকে আজ কয়েদ করেছি। নাও এখন মেহেরবানী করে গতিরখানা নড়াও। দেখো গিয়ে, বাছার আমার কি দশা হলো। চটপট খবর দেবে। আমি-বেশিক্ষণ ধৈর্য রাখতে পারবো না।
উজির আর কোনও কথাটি না বলে হন হন করে পোড়ো-প্রাসাদের চিলেকোঠার ঘরের দিকে ছোটে। পিছনে পিছনে অনুসরণ করে সাব্বাব। কোনও দিকে না তাকিয়ে উজির সোজা গিয়ে ঢোকে জামানের কামরায়। জামান তখন তন্ময় হয়ে কোরান পাঠ করছিলো। চোখ মুখ শান্ত, প্রসন্ন।
এইসময় রাত্রি শেষ হয়ে যাচ্ছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
জামানের পাশে গিয়ে উজির বলে, হতচ্ছাড়া সাব্বাবের কথা শুনে আমাদের প্রাণ তো খাঁচা ছাড়া। শয়তানের জাসু মিথ্যেবাদী কোথাকার! কি সব যা তা কথা বানিয়ে বলে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলো। যাক, বাবা তোমাকে দেখি স্বস্তি পেলাম।
জামান মৃদু মৃদু হাসে। কেন, কি বলেছে সে?
সে তোমাকে বলতে পারবো না বেটা। বড় খারাপ কথা।
তা শুনি না, কি এমন খারাপ, কি এমন মিথ্যে কথা সে বলেছে?
ব্যাটা বলে কি-তোমার নাকি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তুমি নাকি বলেছে, তোমার ঘরে কে এক মেয়ে এসেছিলো। সকালে তাকে দেখতে না পেয়ে সাব্বাবকে মারধোর করেছেযত্ত সব আজগুবি কথা?
আজগুবি হতে যাবে কেন? সবই তোমাদের ষড়যন্ত্র। আমি তোমাকে এখনও সাবধান! করে দিচ্ছি উজির, আমার সঙ্গে এইসব চালাকি বন্ধ করো। না হলে খুব খারাপ হবে। মেয়েটাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে এখনও সাফসাফ বাতাও না হলে তোমার কপালে অনেক দুখ আছে। আমি বুঝতে পেরেছি, আব্বাজানের সঙ্গে তোমরা স্যাট করে এইসব তামাশা করে যাচ্ছে। কিন্তু আমি আর এক দণ্ডও এসব বরদাস্ত করবো না। সাব্বাব-এর কপালে যা জুটেছে তোমার বরাতে তার চেয়েও খারাপ জুটবে।
উজির হতভম্ব হয়ে যায়। খোদা হাফেজ, বেটা তুমি এসব কথা বলছ কেন? কি হয়েছে তোমার? আমার মনে হচ্ছে রাতে তোমার ভালো ঘুম হয়নি।তাই এই সব আজগুবি স্বপ্ন দেখেছে। চারদিকে কড়া পাহারা, এটি কে আসতে পারে তোমার ঘরেআর যদি এলেই তো সে গেলো : কোথায়? ওসব নিয়ে মাথা খারাপ করো না বাবা, ঘুমের ঘোরে ওরকম খোয়াব দেখা যায়। মাথা ঠাণ্ডা করো, এসব কথা বললে লোকে যে পাগল বলবে?
জামান গর্জে ওঠে, পাগল বলবে, কেন পাগলামীর কি করেছি আমি। পাগল যদি হই, তোমাদের মতো বেল্লিক শয়তানদের কারসাজিতেই হবো। কেন, আমি কি তাকে আমার এই চোখ দিয়ে দেখিনি? এই হাত দিয়ে তার শরীর স্পর্শ করিনি? তার দেহের খুশবু, আমি নাকে শুকিনি? কিকি বলতে চাও তোমরা? আমি কি বুঝি না, সবই তোমাদের ইতরামী।
উজির হাসতে থাকে। কি যেন বলতে যায় কিন্তু তার আগেই জামানের প্রচণ্ড একটা ঘুষি এসে লাগে তার মুখে। বেচারী উজির টাল সামলাতে না পেরেছিটকে গিয়ে পড়ে মেঝের উপর।
বদমাইশ, নচ্ছার, এখনও যদি জানে বাঁচতে চাস, বল সে কোথায়? উজিরের সাদা দাডির গোছা একহাতে ধরে অন্য হাতে বেদম পেটাতে থাকে জামান। বৃদ্ধ উজির নিজেকে ছাড়াবার বৃথাই চেষ্টা করে।আমার সঙ্গে শয়তানী করে পর পাবে না। এখনও বলছি কোথায় তাকে লুকিয়ে রেখেছে, বলে? না হলে, ইহজন্মের সাধ তোমার ঘুচিয়ে দেব আজ।
এক নাগাড়ে বেদম প্রহার করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠে জামান। বৃদ্ধকে মেঝের ওপর ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। যত্ত সব শয়তানের পাল্লায় পড়েছি। এরা আমাকে পাগল, না করে ছাড়বে না?
উজির ভাবলো, শাহজাদার হাত থেকে রেহাই পাওয়া দুষ্কর। মাথাটা ওর একদম খারাপ হয়ে গেছে। অবস্থায় কিছু বোঝাতে যাওয়া বোকামি। তাতে আরও সে ক্ষেপে যাবে। শেষে হয়তো বদ্ধ উন্মাদ হয়েও যেতে পারে।
বাবা, তা হলে তোমাকে সত্যি কথাই বলি, উজির এক ফন্দী এটে বলতে থাকে, আমি তোমার বাবার মাইনে করা নোকর। তার নুন খাই, তাই তার অনুগত হয়ে কাজ করা আমার কর্তব্য। তুমি যে আমার ওপর এত ক্ষিপ্ত হয়েছে তার অবশ্য সঙ্গত কারণ আছে, আমি মানি। কিন্তু বাবা, আমি তো আজ্ঞাবহ দাস মাত্র, তোমার বাবা যা হুকুম করেছেন তার বাইরে আমি কি করতে পারি। যে-মেয়েটিকে কাল রাতে তুমি তোমার ঘরে দেখেছিলে, তোমার বাবার কথামতো, আমিই তাকে তোমার ঘরে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু ব্যাপারটা তিনি গোপন রাখতে বলেছিলেন। তারও অবশ্য কারণ আছে। তিনি বুঝতে চেয়েছিলেন, মেয়েটি তোমাকে কতখানি মুগ্ধ করতে পেরেছে। তোমাকে কষ্ট দেওয়া বা ধোঁকাবাজি করা তার উদ্দেশ্য নয়। তিনি যদি জানয়তে পারেন, মেয়েটিকে তোমার পছন্দ হয়েছে, তা হলে খুশি হয়ে শাদী দিয়ে দেবেন। তুমি শাদী করে সংসারী হও, এই তো তার একান্ত ইচ্ছা। আর সেইটে জানিবার জন্যই তিনি আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়েছেন। আমার আর বুঝতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না বাবা, মেয়েটি তোমাকে মুগ্ধ করেছে। তুমি তাকে আপন করে নিতে চাও। বেশ তো কোনও অসুবিধা নাই, এতো মহা আনন্দের কথা। সুলতানও এই- চান, আজই এক্ষুণি আমি তার কাছে সব বিবরণ জানাচ্ছি। তুমি নিশ্চিন্ত থাকে, মেয়ের সঙ্গেই তিনি তোমার শাদী দিয়ে দেবেন।
এই ওষুধে কাজ হলো। জামান রাগত ভাবেই উজিরকে তাড়া মারে, জলদি যাও আব্বাজানের কাছে। এক্ষুণি তার কাছ থেকে কথা নিয়ে এসো। আমি তোমার জন্যে দাঁড়িয়ে রইলাম।
উজির আর তিলমাত্র অপেক্ষা না করে ঘর থেকে বেরিয়ে সটান সুলতানের প্রাসাদে চলে আসে। আসার আগে সাব্বাবকে ইশারা করে নজরে নজরে রাখতে, যেন ছুটে কোথাও বেরিয়ে না যায়।
মাথার টুপি ছিটকে কোথায় পড়ে গেছে, এলোমেলো, দাডির কিছু ছিড়ে-উপড়ে গেছে, সাজপোশাক দুমড়ে-কুঁচকে একশা। ঝোড়ো কাকের মতো চেহারা নিয়ে উজির গিয়ে হাজির হয় সুলতানের সামনে! সুলতান অবাক হয়ে উজিরের আপাদমস্তক দেখতে থাকেন।কী ব্যাপার? কী হয়েছে, উজির? তোমার দশা কে করলো? মাথার টুপি কোথায়? মনে হচ্ছে, সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটেছে!
-আমার আর এমন কি হয়েছে জাঁহাপনা? এর চেয়ে হাজার গুণ মারাত্মক ব্যাপার হয়েছে আপনার পুত্র জামানের।
কি রকম?
একেবারে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে সে।
উন্মাদ। বলো কি উজির? এই একটা রাতের মধ্যে এমন মারাত্মক ব্যাপার ঘটে গেছে।হায় হায়, একি হলো আমার। কেন, আমি তোমার মতো একটা উলুকের কথায় নেচে উঠলাম। কি করে বুঝলে, সে পাগল হয়ে গেছে?
তার আবোল-তাবোল কথাবার্তায় হুজুর। তার ধারণা গতকাল রাতে আমি আর আপনি যুক্তি করে তার ঘরে একটা মেয়েকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। মেয়েটি নাকি সারারাত তার শয্যাতেই ছিলো। তাকে তার বেশ মনেও ধরেছে। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে তাকে ঘরে দেখতে না পেয়ে প্রথমে সাকবাব-এর ওপর হাম্বিতম্বি করে। কিন্তু সে বেচারী কি বলবে, শেষে তাকে বেদম প্রহার করে কুয়োর জলে চুবিয়ে দেয়। তারপর আমি গেলাম। আমাকে দেখেই সে রেগে কঁই। তার ধারণা, নাটের গুরু আমি। আমার পরামর্শেই মেয়েটিকে সকাল হবার আগেই ঘর থেকে সরিয়ে কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে। তাই, আমার বরাতেও কিছু সিন্নি জুটে গেলো।
সুলতান রাগে ফেটে পড়েন, আর তোমার কি হয়েছে, উজির, আমি তোমাকে ক্রুশে গেঁথে মিনারের মাথায় ঝুলিয়ে রাখবো। আমার একমাত্র সন্তান, জানের কলিজা, তার যদি কোনও অনিষ্ট হয় তার জন্য তুমিই একমাত্র দায়ী। আমি রেহাই দেব না। এখন চলো, আমি নিজে তাকে একবার দেখি।
হন হন করে পোড়ো প্রাসাদের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন সুলতান। পায়ে পায়ে উজির। কামার আল-জামানের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই অত্যন্ত শান্ত বিনয়ী সুবোধ ছেলের মতো সে এগিয়ে এসে বাবার হাতে চুম্বন করে অবনত মস্তকে করজোড়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
সুলতান সস্নেহে জামানকে বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে, চোখে, গালে চুমু খেলেন।
তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে, বেটা, চলো, পালঙ্কে বসা যাক।
সুলতান নিজে বসলেন, জামান বাবার কাছে একাসনে বসতে ইতস্ততঃ করছিলো, হাতে ধরে পুত্রকেও পাশে বসালেন। দাঁত কড়মড় করে উজিরের দিকে অগ্নিবান হেনে বললেন, উজির, তুমি যে কত বড় একটা মিথ্যেবাদী তা নিজের চোখেই একবার দেখো, আমার হীরের টুকরো ছেলে, কত নম্র, কত ভদ্র, বিনয়ী, আর তুমি বলে কিনাসে যাক তোমার ব্যবস্থা আমি পরে করছি।
জামানের দিকে ফিরে মুখে মধু ঢেলে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, বেটা, আজ যেন কি বার?
জামান বললো, আজ শনিবার আব্ববাজান?
কাল কি বার বাবা?
কেন, কালি রবিবার?
জামান অবাক হয়। হঠাৎ আব্বাজান আজ এই ধরনের প্রশ্ন করছেন কেন? মনে পড়ে খুব ছোটবেলায় যখন সে সবে প্রথম ভাগ পড়ছে, রাতে শুয়ে শুয়ে বাবা তাকে এই ধরনের নানা প্রশ্ন করে বুদ্ধির পরীক্ষা করতেন। কিন্তু আজ কেন এই সব প্রশ্ন? হঠাৎ সে বুঝতে পারে। উজিরটা তাঁকে বুঝিয়েছে, তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। জামানের মুখে মৃদুহাসির রেখা ফুটে ওঠে। বলে, পরশু সোমবার, তরঙ্গু মঙ্গল, তারপর দিন বুধ, তারপর দিন বৃহস্পতিবার। আর তারপর দিন শুক্র, আমাদের নামাজের দিন পবিত্র জুম্মাবার।
সুলতানের মুখে গর্বের হাসি; উজিরের দিকে কটাক্ষ হেনে বলেন, শুনলে উজির, এর পরেও তোমার কোনও সংশয় আছে?
এই সময় রাত্রি শেষ হয়। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
একশো অষ্টাশিতম রজনীতে আবার সে শুরু করে :
সুলতান আবার জামানকে প্রশ্ন করেন, আচ্ছা বেটা, আরবী হিসাবে এটা কোন মাস?
জেলকদ, পরের মাস জেলহিজ্জা, পরে মহরম, শসার, পরে রবিউল আউয়ল, রবিয়স্বাসি, তারপর জামাদ আউয়ল, জামাদ শ্বাসি, রজব, শ্বাবন, রমজান, শ্বওয়াল।
সুলতান আনন্দের চোটে উজিরের গালে ছোট্ট একটা ঠোনা মারেন, দুনিয়াতে যদি বদ্ধ পাগল কেউ থাকেসে তুমি নিজে। বাহাত্তর পেরিয়ে গেছে, এবার তোমার ভীমরতি ধরেছে। শাহ-দরবার তোমার জায়গা নয় উজির। এবার মক্কা-মদিনায় গিয়ে আল্লাহর নাম গান করো।
এরপর সুলতান কামার আল-জামানের দিকে চেয়ে বলেন, বেটা তোমার নামে এই বেহেড উজিরটা কি সব যা-তা বলেছে, জানো? তুমি নাকি বান্দরমুখো কালো কুৎসিত হতচ্ছাড়া সাব্বাব আর এই বাহাতুরে বুড়ো উজিরটাকে বলেছে, গতকাল রাতে তোমার ঘরে নাকি একটা খুবসুরৎ লেড়কী ঢুকেছিলো। এবং তাকে নিয়েই তুমি সারারাত কাটিয়েছে। সকালবেলায় তাকে দেখতে না পেয়ে তুমি নাকি সাব্বাব-এর ওপর চোটপাট করেছে, মারধোর করেছে, কুয়োর জলে চুবিয়েছে। শুধু সাব্বাব নয় উজিরকেও নাকি তুমি এই কারণে পিটিয়েছে। এমন সব ডাহা মিথ্যেবাদী ওরা-আমি ওদের এমন সাজা দেব, বুঝতে পারবে হাড়ে হাড়ে।
কামার আল-জামানের মন বিষিয়ে ওঠে। আব্বাজান এই ব্যাপারটা নিয়ে অনেক লেবু কচলাকাচলি হয়ে গেছে। এই ধরনের তামাশা আর আমার ভালো লাগছে না। এত দিন। আপনি খারাপ ধারণা ছিলো, সেজন্য আজ আমি লজ্জিত। দোহাই আব্ববাজান, আপনি আমাকে যথেষ্ট শিক্ষা দিয়েছেন, আর কষ্ট দেবেন না। আমি আর আপনার অবাধ্য হবে না। গতকাল রাতে যে মেয়েটিকে আপনি আমার বিছানায় পাঠিয়েছিলেন তাকে দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। আপনি আমাকে মেয়ের সঙ্গে শাদীর ব্যবস্থা করুন, আমি আজই তাকে শাদী করতে চাই। তাকে দেখা অবধি আমি অস্থির হয়ে পড়েছি। এক মুহূর্ত তার আদর্শন আর সইতে পারছি না। সে আমার সারা দিল জুড়ে বসেছে। তাকে ছাড়া আমি আর একটা দিনও বাঁচতে পারবো না। মেয়েদের সম্বন্ধে যে সব উক্তি আমি করেছি, সেজন্য লজ্জিত, অনুতপ্ত। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন আব্ববাজান। আর দেরি করবেন না, আজই শাদীর ব্যবস্থা করুন।
ছেলের এসিব কথা শুনে সুলতান চিৎকার করে ওঠেন, ইয়া আল্লাহ, একি করলে তুমি! আমার একটিামাত্র ছেলে, সবোধন নীলমনি, তার একি দশা করলে? আমি বাঁচবো কি নিয়ে?
ছেলেকে উদ্দেশ্য করে সুলতান বলতে থাকেন, খোদা তোমার মঙ্গল করবেন। বাবা। তিনি তোমার উন্মাদ দশা নিশ্চয়ই কাটিয়ে দেবেন। জীবনে সজ্ঞানে আমি কোনও অন্যায় করিনি। তবে কোন পাপে আমি এত বড় শাস্তি ভোগ করবো? নিশ্চয়ই তোমার ঘাড়ে কোন শয়তান ভর করেছে। তিনি রক্ষা করবেন তা থেকে। কাল রাতে কি তোমার খানাটা খুব বেশি হয়ে গিয়েছিলো। গুরুপাক জিনিস পেটে পড়েছিলো বোধ হয়। তাই হজম হয়নি। রাতে বদহজম হলে এই রকম বিদঘুটে খোয়াব দেখে অনেকে। যাই হোক আমার ধারণা তোমার এই মাথার গোলমালটা নেহাতই সাময়িক। মন থেকে রাতের স্বপ্নের ব্যাপারটা একেবারে মুছে ফেলো। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। যাই হোক, আমি কথা দিচ্ছি, আর তোমার ওপর কোনও জোর জুলুম করবো না। তোমার ইচ্ছে হয়। বিয়ে শাদী করবে, না ইচ্ছে হয় করবে না। দরকার নাই আমার নাতির মুখ দেখে। ছেলেকে খুইয়ে আমি নাতি পেতে চাই না। ভবিষ্যতে আমি আর নিজে থেকে কখনও শাদীর কথা বলবো না, বাবা। শুধু তুমি নিজেকে একটু শান্ত করো।
কামার আল-জামান প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, আপনাকে আমি দুনিয়ার সব থেকে বেশি ভালোবাসি, ভক্তি করি। আপনিও আমাকে এই কথা বলছেন, আব্বাজান। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। তবুও আপনি আল্লাহর নামে কসম খেয়ে আর একবার বলুন, গতকাল রাতে আমার শয্যায় যে মেয়েটি গিয়েছিলো, সে সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন না। তারপর আমি প্রমাণ দেব, কালরাতে আমার ঘরে কোনও মেয়ে এসেছিলো কি না।
সুলতান বললে, আল্লাহর নামে কসম খেয়ে বলছি, বাবা রকম কোনও কাজ আমি করিনি।
জামান তখন বললো, গতকাল শেষরাত্রে যখন আমার ঘুম ভেঙে যায়। সেই দুটি সময় আমি আধা, ঘুমন্ত অবস্থায় বেশ বুঝতে পারছিলাম একটি মেয়ে আমার শরীরের ওপরে উথালি পাথাল করছে। তখন আমার এমন অবস্থা নয় যে ঘুম থেকে উঠে পড়ে। যাই হোক সকাল বেলায় যখন ঘুম ভাঙলো দেখি আমার তলপেটের নিচে বেশ খানিকটা রক্ত জমাট বেঁধে আছে। আপনার বিশ্বাস না হয় হামামে চলুন দেখবেন, আমি পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলেছি। এখনও সেখানে সেই রক্ত দেখতে পাবেন। তা ছাড়াও, এই দেখুন আমার হাতের এই আংটিটা। এটা নিশ্চয়ই আমার হাতে আগে কখনও দেখেন নি। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখুন, আংটিটা কোনও মেয়ের হাতের। আর আমার এই আঙুলে যে হীরের আংটিটা ছিলো সেটা নাই।
সুলতান বললেন, তোমার কথা আমি মানছি, কিন্তু এই প্রমাণই তো যথেষ্ট নয়। এতেও যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়।
এই সময় রাত্রি শেষ হতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
একশো নব্বইতিম রজনীতে আবার গল্প শুরু হয় :
সুলতান বললেন, ঠিক আছে, দাঁড়াও হামামে গিয়ে আমি নিজের চোখে দেখে আসি। সুলতান হামামে ঢুকে অবাক হয়ে গেলেন। যে জলের গামলায় জামান হাত মুখ ধুয়েছে তার মধ্যে ডেলা ডেলা রক্তের ছিট। সারা জলট রক্তে লাল হয়ে আছে।
হুম, গভীর ভাবে সুলতান অস্ফুট স্বগতোক্তি করেন, মনে হচ্ছে, লড়াকু মেয়েটা বেশ তাগড়াই। এখন বুঝতে পারছি, ওই উল্লুক উজিরটারই এই কাণ্ড।
ছেলের কাছে ফিরে এসে বলেন, হাঁ, খুব চিন্তার ব্যাপার!
আর একটিও কথা বললেন না। সুলতান। ঠায় বসে বসে ভাবতে লাগলেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক এইভাবে কাটে। তারপর উজিরের দিকে তাকিয়ে হুঙ্কার ছাড়েন। তিনি। সব তোমার শয়তানী-উজির। তুমিই কাল রাতে কোনও মেয়েকে পাঠিয়েছিলে ঘরে।

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.