সাইফুল আরেফীন’র দীর্ঘ কবিতা ভাদ্রের শোকগাঁথা

 
আমাদের আদরের ছোটবোন রীতা, রক্তে গেড়েবসা ক্যান্সারজীবানুর বিরুদ্ধে দশমাস ধরে লড়েছে। সাধ্যের সমস্ত প্রচেষ্টা বুলন্দ করেও ২০ আগস্ট, ভাদ্রের তারিখ আমরা মাথা নত করলাম আরশের হুকুমের প্রতি, আর তার চোখজোড়া বন্ধ হলো জুলুমবিহীন এক মানবিক সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখতে দেখতে। সেই স্বপ্নগুলো এখনও উড়ে বেড়ায় আযানের সুরের সাথে, ইথারে ইথারে, হাজারও বিশ্বাসীচোখের সন্ধানে, যেখানে তারা আবারও আশ্রয় গড়ে নেবে।
           
তোর সমুদ্র বিশাল চোখে স্বপ্ন ছিল-
            সাজানো ডালির মতো সংসার পেয়ে যাবি তুই;
            মহুয়ার থোকা ফূল!
            একদম পরিপাটি, গোছালো, মায়াবী সুখ
            কোথাও রবে না একটুও ভুল।
 
আহা, উদয়াস্ত সংসারব্যস্ত তুই
খুব অনিচ্ছায় ফোন ধরে বলবি,
            না মা, আজ বিকেলেতো আসতেই পারব না,
            আর আমার মেয়েটা কী করছে শোন ...
 
স্বপ্ন চারিনী,
তোর আরও স্বপ্ন ছিলো জানতাম-
কতো গভীর বিশ্বাস নিয়ে তুই ভাবতি:
একদিন আছরের আযান শুনে তোর আঝালা স্বামীটা
হন্তদন্ত বলবে-
            কই দেখতো আমার সেই টুপীটা যেন কোথায় ...?’
ভালোলাগায় পরিপূর্ণ তুই
কপটরাগে গামছা হাতে বলবি-
            কী আউলা-ঝাউলা মানুষ!
            মুখের পানিটাও ভালো মুছতে পার না ...?’
খেজুর আঁটির দাঁত বের করে নির্লিপ্ত সে বলবে-
            ‘... ... আমি তো ইচ্ছ করেই ... ...
 
হাহ! তোর স্বপ্নেরা তোকে সুখের সমুদ্রে টেনে নিয়ে যায়।
তুই স্বপ্ন দেখতি-
 
তোর গোরু-চোখা হতচ্ছাড়ী মেয়েটা চুল ওড়াতে ওড়াতে
এসে বলবে:
            এই দেখ মা- আমি ফার্স্ট হয়েছি।
            আমাকে ফিশিংগেম কিনে দেবে, মা?’
ভীষণ আনন্দে তোর কণ্ঠনালী রোধ হয়ে আসবে;
উথলে ওঠা আনন্দ আর হঠাৎ উচ্ছ্বাসে কী যেন
বলতে গিয়ে তুই খুব মন খারাপ করে ফেলবি;
নিশির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলবি-
            তোর বাবার বেতন হয়নি আজো।
            তবে নিশ্চয় আমি তোকে ফিশিংগেম
            কিনে দেব মা। ... ... কাঁঠালের
            বিচি দিয়ে কাটুয়ার ডাটা রান্না হয়েছে,
            খাবি ... ...?’
 
তোর মেজাজী মেয়ে ওমনি লাফিয়ে দাপিয়ে
বলতে বলতে চলে যাবে-
            না! কিচ্ছু খাব না আমি!
            আর, আমি কোনদিন ফার্স্টও হবো না ...
            কখখনো না।
 
না। অপ্রাপ্তীর দীর্ঘশ্বাস তোকে ছুঁতে পারেনি।
অভিযোগবলে কোন শব্দও কি ছিল তোর
অভিধানে?
ভাড়াবাড়ির টিনের ফুটো চালে
বর্ষার পানি দরদর ঢুকে পড়লে-
তুই চরকা বিছানো চাঁদের বুড়ির মতো
ক্যাথা-কাপড় গুছিয়ে নিয়ে বসে থাকতি
ঘরের এক কোনে;
মরা বৃষ্টি গেলে সেগুলো বিছিয়ে আবার সংসার।
আমি জানি। আমিই জানি
শুধু স্বপ্নের খুঁটি আঁকড়ে
দারুন দূর্যোগেও তুই টিকে যেতিস
বুকের মধ্যে এক লড়াকু বিশ্বাস পুষে-
                        ... একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে ...
                        ... একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে ...
রী তা !
আজ তোর আধবোজা ঘোলাটে চোখের পাতার নীচে
সব স্বপ্ন বুঝি চাপা পড়ে গেলো?
সারাদিনমান খেলা করা সেই
স্বপ্নের ফিরে যাওয়া গোধূলী রঙটুকুও
আর অবশিষ্ট নেই সেখানে।
            আচ্ছা-
            স্বপ্নের ঠিকানা শেষ কোথায়?
            তারও কি তবে মৃত্যু আছে?
নাকি রয়ে যায়- অসীম অনন্তলোকে
অথবা দূর নক্ষত্রের গাঁয়ে,
কিংবা গাংচিলের পিঙ্গল ডানায়,
হিমাংকের খুব নীচে
অথবা বাঁশঝাড়ের হিমতলায় মিথেনের আলেয়া- আলোয়,
কিংবা
সৌরজগতের কোনো এক চলমান গ্রহের কক্ষপথে?
আমার জানা নেই।
আমি জানি না- ‘স্বপ্নের অবিনাশীতাবাদ’-এর
কোন অর্থ আছে কিনা।
 
ঠিক ভাদ্রের পঞ্চম মধ্যাহ্নে ...
যোহরের নামাজ আদায় শেষে
মানুষেরা যখন আবার নিমগ্ন হলো কাজে;
আর মাথার ওপরে খাড়া সূর্যটা
পশ্চিমে হেলে না যেতেই...
            অসহায় তিকরীত নগরীর মতো বিধ্বস্ত
            স্বপ্নশূণ্য তুই নি:সাড় পড়ে। যেনো
কার্বনশূন্য ব্যাটারির নিশ্চল দেয়ালঘড়ির পেণ্ডুলাম।
বিক্ষত-বিধ্বস্ত, জখম-বিকৃত তিকরীতের ময়দান!
যেখানে অসম এক যুদ্ধে-
নির্মমভাবে হেরে গেছে মানবতা;
কেবলি জিতেছেশয়তান
নফস আর কলবের মতো বেশুমার লড়াই হয়েছে।
দশটি মাসের। স্বপ্ন আর মৃত্যুর মাঝে।
অবিরাম,
অবিশ্রাম,
অবশেষে ...
প্রচন্ড লিউকেমিয়ার দ্রোহে তোর সব স্বপ্নেরা
দারুন ক্লান্ত,
            আশাহত,
                        পরাজিত
যেন, পলাশীর প্রান্তরে মাতৃভূমির জন্য লড়াই শেষে
সিরাজের নি:শেষ Íসমর্পন।
 
ব্রাইটন হসপিটাল আর ৭১ সেন্ট্রাল রোডের মাঝেই
যখন চলছিল আমাদের দী-র্ঘ পথ পরিক্রমা,
নিয়তির লাগাম টেনে ধরে বাতাসে হুস্-হুস্ চাবুক চালিয়ে।
যখন আমাদের সমগ্র মধ্যরাতের প্রার্থনা
আর প্রানান্ত কোশেশ এক সাথে রাস্তায় পদাতিক শামিল,
তখনÑ সব ধ্যান ভেঙে দিয়ে,
তাল আর লয় কেটে অসমাস্তরাল করে
তুই বলে বসলি- হঠাৎ-
            মা!
            আমিতো ফাঁসির আসামী, তাই না?
            আর আমি তো জানি,
            ফাঁসির দড়ি পাকানো হলেই তাকে হুকুম জানানো হয়।
            আর আাসামীরা?
            প্রস্তুতি নেয় মঞ্চে যাবার।
            অথচ
            আমার কেমন নিয়তি মা,
            মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে আমি আর কতবেলা অপেক্ষা করব?
            আর কতো প্রস্তুতি আমি নেবো- মা?
            কতো বেলা... কতো- মা?’
 
হেরে যাওয়া হীনমন্য চেহারার নিরাশা ঠেলে
চকিতে পাল্টা ঠনঠন উত্তর:
            আমরা পেরে যাবো মা, ঠিক পেরে যাবো।
            কোনও ভয় নেই, এইতো আর টা দিন ...’
 
সেই টা দিনের প্রায় প্রতিদিন বেলা-অবেলায়
আমাদের ফিরে আসা নির্দিষ্ট সেই হাসপাতালের তেতলায়,
বাঁ হাতের ফিমেল ওয়ার্ডে।
সাথে রাশি রাশি গান-কবিতা আর নানান হাসি-কৌতুক-গল্প।
উন্মুখ হয়ে থাকা তুই
কখনও কখনও হাসির দমকে ভড়ং গলায় বলতি-
            মাগো, ছুড়াদের তাড়াওতো!
            উরা কি           আমার হাসাতি হাসাতিই মাইরে ফ্যালবে?’
প্রত্যুত্তর আমাদের তাড়িয়ে শোনাতো-
            আচ্ছা যা... কাল কখন আসবি?’
তিনি তো প্রত্যুত্তরই জানতেন।
কারণ, তিনি এক সর্বংসহা মা।
আর তিনি তো কেবল বুকের ওপরে দুহাতে আগলে আছেন
টাল-মাটাল এক অসম্ভব পাহাড়।
সেই নিরস্ত্র-সাহসী একাকী যোদ্ধার কাছে কেনো তুই প্রশ্ন করিস-
            মাগো,
            চিকিৎসকেরাও যে আমার মতোনই মানুষ!
            মানুষ সীমাবদ্ধ।
            সীমাবদ্ধতা- মানুষ।
            আর, মানুষের হাসি-কান্নার সেই মালিক!
            হায়!
            সেই যদি তোমাদের প্রার্থনা মেনে না নেয়?’
 
হায়! শ্রাবণের অঝোর ধারা পেরিয়ে
ভাদ্রের এক নরক দুপুরে
তুই জানিয়ে দিলি: ‘বি ... দা ... য়।
 
হায়! দশমাস গর্ভবাস শেষে জঠরের বাইরে
নারীর যে নাড়ী-ছেঁড়া চিৎকার
তার অনেকগুন যন্ত্রণায়
দশটি মাস শিয়রে বসে থাকা
গর্ভধারিনিীর কলিজাছেঁচা আর্তচিৎকারে
কঁকিয়ে উঠল ভাদ্রের রুদ্ধ বাতাস!
সমগ্র প্রচেষ্টা আর প্রার্থনার শব্দাবলী
বুমেরাং আঘাতে বেজে উঠল
আমাদের বিশ্বাস বাস্তবতার দেয়ালে।
আমরা ঋজু হলাম অস্ফুটে- প্রভু, ক্ষমা করে দাও ... প্রভু!
 
রীতা!
সংসার অনাস্বাদিতা
সুখ অনাঘ্রাতা
আর বিদীর্ণ কষ্টের নিস্পেষিতা গন্তব্য
সেই সফেদ ঝর্ণার কলরোল
আর শীতল ছায়া-বৃক্ষের এক নিশ্চিত সবুজ বাগানে;
কেননা তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
আর আমরা, নাস্তিক নই।
গাঢ় সবুজ সেই বাগানের প্রবেশ পথে দিগন্ত বি¯তৃত
আলোক সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে, রীতা
তুই কি আমাদের দিকে ফিরে বলবি-
            তুগার আমি অনেক কষ্ট দিইলাম।
            আয় আমার সাতে- এই সবুজ বাগানে-
            যদ্দিন খুশী- যিরাম ইচ্ছে- সগলেই-
            থাকপি- আয়- আয়- আয়’?
 
            [শুরু ২৮ জুলাই, শেষ ২৭ আগস্ট ২০০৭]

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.