এই সেদিন ১২ মার্চ সকালে বাসা থেকে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেরোতে হবে। ততক্ষণে শুয়ে পড়েছি। রাত একটা থেকে দুটোর মাঝামাঝি সময়ে দরজার কলিংবেল বেজে উঠলো। খুলে দেখি খোকন। ঘরে ঢুকে বললো, আপা, কাল ভোরে রওনা হবেন তাই ভাবলাম পত্রিকা অফিস থেকে ফেরার পথে এখনি আপনাকে সালাম করে যাই।
বললাম, কিছু খেয়ে যাও ! ও বললো, না আপা। ড্রাইভারকেও তো ছাড়তে হবে!’ হতবিহ্বল আমি স্তূপ থেকে ওকে নতুন কেনা একটা বই ধরিয়ে দিই। বলি, তাহলে এটা তুমি নিয়ে যাও।
কেউ লিফটে না ওঠা পর্যন্ত আমি কখনো দরজা বন্ধ করি না। সেদিনও ওর কেয়ারটেকারদের ডেকে খোলা লিফটে ও ঢুকে গেলে তবেই আমি দরজা বন্ধ করলাম। সেদিন এই এটুকুমাত্র দেখা এই দুই হাজার বিশের মার্চের ১১ তারিখ দিনগত রাতে এবং ওই হলো শেষ দেখা !
৯৪/৯৫এর দিকে ফকিরাপুল এক অসমাপ্ত ভবনের পাঁচতলায় ‘অনুপ্রাস’ নামক সংগঠনের অনুষ্ঠানে ক’দিন কবিতা পড়তে গেছি। দেখতাম, লিকলিকে, কৈশরোত্তীর্ণ এক লাজুক তরুণ আমার কাছ ঘেঁষে চলে। বারবার আমার চোখের দিকে তাকায়। কিন্তু সে তরুণকে অভিব্যক্তিতে তখনো তরুণের মতো মনে হয় না। মনেহয় রোদেলা আলোর এক ঝলমলে বালক। বালকটি ‘দৈনিক মিল্লাত’ এবং ‘দৈনিক হককথা’য় পার্ট টাইম কাজ করে। অল্পদিন আগে বাবাকে হারিয়ে ঢাকায় ঢুকেছে বড় পরিসরে পত্রিকায় কাজ করতে। বিধবা মায়ের পাঁচ সন্তানের ভেতর বড় সে।
ফকিরাপুলে একইরকমভাবে কদিনই দেখছি তাকে অনুষ্ঠান শেষে আমি যখন সিঁড়ি বেয়ে নামি, সে আমার সাথে সাথে নামে। একদিন রিকশায় উঠেছি, দেখি বালকটি হাস্যোজ্জ্বল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে পাশে দাঁড়ানো। বললাম, তুমি আমার সাথে আমার বাসায় যাবে ? আর বলতে হয়নি, এটুকুতেই উঠে আমার পাশে বসলো।
আমি লেখক হওয়ার জন্য লিখিনি। ছেলেমেয়ের ফেলে দেয়া কাগজের সদ্ব্যবহার করতে করতে কখন নিজের অজান্তেই লেখকদের ভিড়ে মিলেছি। তাই বেশ দেরিতেই ছিল আমার শুরুটা। আমার ছেলেমেয়েরা একেবারে পিঠোপিঠি। বড়টা তখন নটর ডেম কলেজে পড়ে। খোকন সেদিন এসে কখন আমার ছেলেমেয়েদের ভিড়ে মিশে গেছে। তারপর থেকে কোনো অনুষ্ঠানে দেখা হলে, দেখা যেত, সেখান থেকে দেয়া আমার খাবারটি আমি খেয়ে ফেলেছি। কিন্তু খোকনের প্যাকেটটি খোকন লুকিয়ে বয়ে এনে একটু একটু করে আমার ছেলেমেয়েদের ভেতর ভাগ করে দিয়েছে! তারপর থেকে ক্রমে খোকন আমার ছেলেমেয়েদের ছাড়াও তাদের সবার স-ব বন্ধু-বান্ধবের দায়িত্ববান ‘খোকন মামা’ হয়ে গেছে! আর এরি ভেতর পরম স্নেহময় মামাটি একদিন এসে আমাকে সালাম করে জানালো, আপা, আমি সাংবাদিকতায় মাস্টার্স করেছি!’ এবং আরো পরে সেই খোকন যখন পিতা হলো, পিতা হিসাবেও সে অসাধারণত্বের পরিচয় দিয়েছে।
তারপর আরো পরে একদিন একজনকে বুক চিতিয়ে চ্যালেন্জ করে বলেছিল, আমার আপাকে কেউ কিছু বলতে হলে আমার লাশের ওপর দিয়ে বলতে হবে।’
এই আমাকে নিজেদের চেয়ে ক্ষুদ্র-অনর্থ মনে হওয়াতে, আমার নিজের কত রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজন আমার জীবন থেকে চিটাধানের মতো উড়ে চলে গেছে। কিন্তু সোনার ধানের মতো আমার জীবনে যে মানুষটি পরম ভরসা ও সতীর্থ হয়ে থেকেছে, সে আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ ছিল না। তার জন্য আমি কিছুই করিনি ! করতে হয়নি! বা পারিনি ! !
যখন মাত্র মোবাইল ফোনের প্রচলন শুরু হলো। আমি এমনি বলেছিলাম, ছবি তোলা যায়, আমার এমন একটা মোবাইল দরকার। কথাটা আমি এমনি মুখ ফসকে বলেছি। কদিনের ভেতর রীনা, আমার ছোটবোন শারমিন সুলতানা রীনা এসে বললো, এটা খোকন তোমাকে কিনে দিলো। তখনো কিন্তু খোকন বড় সাংবাদিক হয়ে ওঠেনি !
আমাকে কারো সাথে, বা কেউ আমার সাথে ভাব জমাতে চাইলে, আর খোকন তা টের পেলে, নারী হোক, পুরুষ হোক, তার সম্পর্কে খোকন আমাকে বলতো, আপা, উনি কিন্তু এমন...।’ খোকন কথা কম বলতো। কিন্তু যা বলতো তীরের মতো! অসাধারণ ছিল ওর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা! আমি বলি, কত কতবার লিখেছিও, আমার লেখালেখি আমাকে যা দিয়েছে, এর মধ্যে উত্তম পুরস্কার এই হুমায়ুন কবির খোকন ! লেখালেখিতে না এলে ওকে আমি পেতাম না। আর কেউ যদি বলে, খোকন দীলতাজের ভগ্নিপতি, আমি সত্যিই লজ্জা পাই। বরং খোকন আমার ছোটভাই, এই কথাটি উচ্চারণ করতে আমার বুক সাহস ও গৌরবে ভরে যায়। শুধু খোকন নয়, ওর সব ভাইবোন আলম, হৃদয়, ডালিম, মনিরও আমি ওরই মতো আপা।
যখন যেখানে গেছি, সেখানকার প্রতিনিধি আমাকে খুঁজে বের করে বলতেন, খোকন ভাই বলেছেন আপনার খোঁজ নিতে।’ তাই এখন তার শূন্যতায় তাদের মায়ের জায়গায় দাঁড়িয়ে সে ভারেও আমি তলিয়ে যাচ্ছি! এতদিনের সব দান ও আগলে রাখার প্রতিশোধ খোকন আমাকে এভাবে নিতে পারে, এ আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি!
যার ঘর করেছি, আমার জন্য তার স্ত্রী হিসাবে কটু শাসন কখনোই নয়, বরং আমার প্রতি ছিল তার ষোলো আনার ওপর বত্রিশ আনা আস্থা- নির্ভরতা ও ব্যাপক প্রশ্রয়ও। যা একজন শিল্পসাধকের জন্য অনিবার্যভাবে দরকার। আর সেই অঢের সুতোর ঘুড়ির মতো উল্লম্ফ এই আমি মানুষটির পাশে ছোট্ট টিলার মতো কেউ এসে ধীরে ধীরে পাহাড় হয়ে এতদিন ঘিরে ছিল!
নিজের ছাড়াও অন্যের যে কোনো বিষয়ে প্রয়োজনটা শুধু খোকনের কান পর্যন্ত পৌঁছুতে পারলে আমি নিশ্চিত !
পরশু হঠাৎ মেলবোর্ন সময় রাত সোয়া বারোটার দিকে বাংলাদেশ থেকে আমার ছোট মেয়ে ফোন করে। আমার ছেলেমেয়েদের সাথে এরকম হুটহাট করে আমার কখনো কথা হয় না। বরং একই ঘরে থেকেও প্রয়োজনীয় কথাটি তাদের মেসেন্জারে লিখি। তাই ভীতকন্ঠে মেয়েকে বললাম, ভাল আছো তো ? ছোটমেয়ে বললো, আমরা ভাল। কিন্তু খোকন মামাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে...।’ আমি মনে জোর এনে ভাবলাম, ও নিশ্চয় ভাল হয়ে ফিরবে। মৃত্যুর মুখ থেকে হলেও খোকন ফিরবে না, এটা ভাববার সাহস আমার নেই !
কিন্তু একটু পরে দেখি আমার সিথানে আমার দুই ছেলে দাঁড়ানো। বললো, খোকন মামা মারা গেছে !’ যেন দিক বিদীর্ণ করা বজ্রপাত আমার মাথায় পড়লো! একটু পর বৌমাও সেখানে চলে এলো। সবাই মিলে আহাজারি করতে করতে আরেকটা শঙ্কা প্রকট হতে লাগলো। পরিবারের যারা খোকনের পাশে ছিল, তারা তো ঝুঁকিতে ধুকছে! বাড়িটি নাকি লকডাউন করে রেখেছে। কিন্তু ভাবছি, শারমিন আর ওদের ছেলে আবীর, যারা খোকনের সাথে শেষ পর্যন্ত ছিল, হাসপাতাল তাদের পুরো টেস্ট না করে কেন বাসায় আসতে দিলো? আমি ভুলে যাই, এই মর্মান্তিক খবরটি কুইন্সল্যান্ডে থাকা আমার বড় মেয়েকে দিতে হবে। পরে খবরটি সে জানতে পেরে বললো, আম্মা, বুকটা খালি খালি লাগছে ...।’
হায় রে বাংলাদেশ, আর কত খোকনের জন্য কাঁদাবি তুই ? জানি কোনো কোনো উন্নত দেশে করোনায় মৃতের সংখা আরো বেশি। কিন্তু এত স্ববিরোধিতা, এত স্বেচ্চাচারিতা, অপরিনামদর্শীতা ও অমানবিকতার নজির বুঝি আর কোথাও নেই!
আল্লাহ্, তুমি শারমিনের সাথে জগতের সব মানুষের মুসিবত দূর করে দাও !
খোকনকে দাও সেরা বেহেস্তে স্থান।
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments