আলিফ লায়লা : আরব্য রজনী_পর্ব-৭০
ইংরেজি অনুবাদ : ডঃ জে. সি. মারদ্রুস
বাংলা অনুবাদ : ক্ষিতিশ সরকার
কোনও এক সময়ে কায়রো শহরে এক সদাশয় সম্রান্ত সওদাগর বাস করতো। শহরের সমস্ত সওদাগররা তাকে খুব মান্য করে চলতো। তার সরলতা সততা বিনম্র ব্যবহার সকলকে মুগ্ধ করেছিলো।
এক জুম্মাবারে নামাজ-এর আগে সে হামামে গিয়ে গোসলাদি সেরে নাপিতের কাছে গিয়ে ক্ষৌরকর্ম সেরে নিলো। মাথা ন্যাড়া করে, গোঁফ চেছে ফেলে সে শাস্ত্ৰাচার পালন করতো সদা সর্বদা। নাপিতের কাছ থেকে আর্যশী নিয়ে মাথামুণ্ডু সব ভালো করে নিরীক্ষণ করে দেখলো, যথারীতি কমানো হয়েছে কিনা। প্রায় সাদা লম্বা দাডির দিকে নজর পড়তে মনটা বড় খারাপ হয়ে যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিষণ্ণ মনে ভাবতে থাকে; বয়স বিকেল হতে চলেছে। এখনও, খুঁজলে কাঁচা দাডিও পাওয়া যাবে অনেক। কিন্তু আরও কিছুকাল পরে, চেষ্টা করেও হয়তো আর কাঁচা দাড়ি খুঁজে বের করা যাবে না। পালিত কেশ বাৰ্দ্ধক্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আর বার্ধক্যই মৃত্যুকে কাছে টেনে আনতে থাকে। সে ভাবে, হায় বেচারী সামস-আল-দিন, দিন ফুরিয়ে এলো, সন্ধ্যা হতে চললো। এখন কবরে শয্যা নিতে হবে। অথচ জীবনে কী তুমি পেলে? সারা জীবন ধরে যদি একটা ছেলে-মেয়েরই মুখ না দেখলে তবে কার জন্যে এই বিত্ত-বৈভব রেখে যাচ্ছে? কে খাবো! মোমের শিখার মতো জ্বলতে জুলতে একদিন তুমি নিঃশেষ হয়ে যাবে। বাস সেখানেই তোমার জমানার ইতি হয়ে গেলো। আর কেউ মনে রাখবে না তোমাকে। কেউ বইবে না তোমার বংশের ধ্বজা।
বেদনা বিধুর চিত্তে সে-দিনের মতো সে মসজিদে নামাজ সারে। তারপরবাড়ি ফিরে আসে। বিবি বসেছিলো তার প্রতীক্ষায়। যথারীতি সে খানা-পিনা বানিয়েছে। এক সঙ্গে বসে দু’জনে খাবে। স্বামীর পায়ের শব্দ পেয়ে সে ছুটে যায়। হাসি মুখে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলে, আজ এত দেরি হলো কেন, গো?
সওদাগর বিবি স্বামীর এই উদাস-বিবাগী কথায় কেমন যেন ঘাবড়ে যায়। বলে, তোমার কী হয়েছে গো, হঠাৎ এইরকম কথাবার্তা বলছে কেন?
সওদাগর বিবি সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে, ওসব নিয়ে মন খারাপ করতে নাই। আল্লাহ যাকে যে ভাবে রাখেন তাতেই সুখী থাকতে হয়। এসো, টেবিলে খানা সাজিয়েছি। হাত মুখ ধুয়ে খাবে চলে।
সওদাগর প্রায় চিৎকার করে ওঠে, আল্লাহর দোহাই, আমাকে বিরক্ত করো না। আমার কোনও ক্ষিদে তেষ্টা নাই। আর তাছাড়া তোমার মতো আঁটকুড়ির হাতে আমি খেতেও চাই না। আজ আমি নিঃসন্তান—সে শুধু তোমার কারণে। শাদীর পর চল্লিশটা বসন্ত বয়ে গেলো। একটা ছেলে বা মেয়ে বিয়াতে পারলে না তুমি। আর একটা বিবি আনবো ঘরে, তাতেও তুমি সব সময় বাদ সেধেছি। আমি নরম প্রকৃতির মানুষ। তোমার বারণ আমি ঠেলতে পারিনি। তুমি বরাবরই আমাকে ধোঁকা দিয়ে এসেছ, ‘আর কিছু দিন সবুর কর, আল্লাহ নিশ্চয়ই মুখ তুলে চাইবেন।’ কিন্তু তুমি জন্মাবধি বন্ধ্যা। আল্লাহ কি করে মুখ তুলে চাইবেন! সব জেনে শুনেও তুমি আমাকে অন্য মেয়ে ঘরে আনতে দিলে না। তোমার কি উচিৎ ছিলো না-আমার মুখে হাসি ফোটানো? তুমি কি নিজে থেকেই বলতে পারতে না—না। আর কোনও আশা নাই, এবার তুমি আর একবার শাদী কর। আজ থেকে কসম খাচ্ছি, তোমার সঙ্গে আর শোব না। সহবাস করবো না। তার চেয়ে বরং লিঙ্গটা কেটে ফেলব। তোমাকে ছুঁতে আমার ঘেন্না হয়। তুমি আর আমার সামনে এসো না। তোমার। মতো বাজা-মেয়ের মুখ দেখলেও পাপ হয়।
সওদাগরের এই অপমানকর কথায় তার বিবি রণমূর্তি ধারণ করলো, মুখ সামলে কথা বলো, বলে দিচ্ছি। নিজের মুরোদে কুলায় না, সব দোষ আমার বাঁধ ঘাড়ে চাপাতে লজ্জা করে না তোমার! তুমি একটা ধ্বজভঙ্গ ক্লীব। আমার জীবনটা ছারখার করে দিয়েছ। একটা দিনের জন্য মিলনের আনন্দ দিতে পোরনি। আজ তুমি আমাকে বাঁজা আঁটকুড়ি বলে গালাগাল দিচ্ছ। কিন্তু কেন আমি বাঁজা, কেন আমি আজ নিঃসন্তান, সে কথা ভেবে দেখেছি কখনও। সে সবই তোমার হীন বীর্যতার কারণে। আমার কোনও দোষ নাই। তোমার যদি ক্ষমতা থাকতো, সন্তান আমি পেটে ধরতাম। মুখে লম্বা লম্বা বাত ছাড়ার আগে নিজের চিকিৎসা কর। শুক্রসঞ্জীবনী দাওয়াই এনে খাও। হয়তো অসুখ সেরেও যেতে পারে। যদি সারে, যদি বীর্যে জীয়ন্ত বীজ বেরোয়, তাহলে দেখে নিও, আমি মা হতে পারি কি না।
বিবির বচনে সওদাগর চুপসে গেলো! আমতা আমতা বললো, হ্যাঁ, তা কথাটা নেহাৎ মিথ্যে বলিনি বোধ হয়! হয়তো আমারই দোষ। মনে হয় আমার বীর্যের তেজ মরে গেছে। তুমি কি জান বিবিজান, তেমন কোনও দাওয়াই কোথাও পাওয়া যায়। কিনা, যা খেলে শরীর চনমান করে ওঠে, এবং বীর্য দৃঢ় হয়?
এই সময়ে রাত্রি শেষ হয়ে আসতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
দুশো একান্নতম রজনীতে আবার সে শুরু করে :
পরদিন সকালে দোকান খোলার সঙ্গে সঙ্গে সওদাগর এক দাওয়াখানায় এসে দাঁড়ালো। তার হাতে একটা চিনে মাটির বাটি—ওষুধ নেবে বলে নিয়ে এসেছে। দোকানের মালিক সালাম আলেকুম জানিয়ে বললো, আজ সকালে আপনিই আমার প্রথম খদের হতে এলেন, কী আমার সৌভাগ্য! তা সওদাগর সাহেব, কী দাওয়াই দেব?
দোকানী সওদাগরের মুখে এ ধরনের কথা শুনবে কল্পনা করতে পারেনি। তার মতো ধর্মানুরাগী ভাব-গভীর ব্যক্তির মুখে একি কথা। না, এই সকলে তিনি রসিকতা করতে এসেছেন? ঠিক আঁচ করতে পারে না সে। যাইহোক, একটা লাগসই জবাব দিতে হবে। দোকানী বলে, ইস, আপনি যদি কালকেও আসতেন, সওদাগর সাহেব। কাল পর্যন্ত অনেকখানি ছিলো, অনেকগুলো খদ্দের এসে সবটুকু নিয়ে গেছে। দাওয়াইটার চাহিদা খুব বেশি। আপনি বরং এক কাজ করুন, পাশের দাওয়াখানায় দেখুন, হয়তো পেয়ে যাবেন।
সওদাগর আর একটা দাওয়াখানায় গেলো। কিন্তু সে-ও ঠিক একই কথা বলে অন্য দোকানে খোঁজ করতে বললো। এই ভাবে এক এক করে বাজারের সব কয়টা দাওয়াখানাতেই সে খোঁজ করলো। কিন্তু সবাই মুচকী হেসে একই কথা বলে বিদায় করলো তাকে।
খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে ব্যর্থ মনে সে তার নিজের দোকানে এসে বসে। কিছুক্ষণ পরে সামসাম নামে এক দালাল এলো তার কাছে। লোকটা মদ গাঁজা ভাঙ্গ আফিং চরস খেয়ে সব সময় চুর হয়ে থাকে। এবং লোচ্চামীতে গুরুদেব। কিন্তু সামস আল-দিনকে সে শ্রদ্ধার চোখে দেখতো। তার সঙ্গে কখনও, ভাড়ামী বা বেলেল্লাপনা কিছু করতো না। তার সদাশয় বিনম্র ব্যবহার-এ সে মুগ্ধ না হয়ে পারতো না। কিন্তু আজকের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে সওদাগরের মেজাজ ঠিক নাই। কেমন যেন তিরিক্ষিভাব, কোনও কথারই ভালো করে জবাব দিচ্ছে না। নিশ্চয়ই কোনও অঘটন ঘটেছে। সামসাম জিজ্ঞেস করে, আজ আমন মন মরা হয়ে বসে আছেন কেন সওদাগর সাহেব?
সওদাগরের কথা শুনে সামসাম অবাক হলো না, মজাও পেলো না। গভীরভাবে বললো, কিছু চিন্তা করবেন না, দাওয়াই আমার বিলক্ষণ জানা আছে। আপনি আমাকে একটি দিনার দিন। আমি মালমসলা কিনে এনে নিজে হাতে বানিয়ে দিচ্ছি।
—ইয়া আল্লা, সওদাগর প্রায় চিৎকার করে ওঠে, তাও কি সম্ভব? আল্লাহর নামে হলফ করে বলছি, তুমি যদি সত্যিই আমাকে সন্তানের বাবা করে তুলতে পার তাহলে তোমার ভাগ্য আমি ফিরিয়ে দেব, শেখ। ঠিক আছে একটা কেন, এই নাও দুটো দিনার দিলাম। মশলা পাতি নিয়ে এসো। বানাও দেখি কেমন সে ধন্বন্তরী দাওয়াই!
এই বলে সামসাম বিদায় নিলো। সওদাগর ভাবলো, লোকটা মদ ভাং খেয়ে আর মেয়ে-মানুষ নিয়েই সারাটা জীবন কাটাচ্ছে। এ ব্যাপারে তার ওপর ভরসা রাখা যায়। নিশ্চয়ই সে আনতাবডি কিছু একটা বানিয়ে দেয় নি। হয়তো কাজ হলেও হতে পারে। আর দেরি না করে সে তক্ষুণিবাড়ি চলে এলো। বিবিকে সব কথা বললো! আগের রাগ সব জল হয়ে গেছে। আবার তারা এক সঙ্গে বসে খানাপিনা করলো। এক শয্যায় রাত কাটালো।
সামস আল-দিন যথাযথভাবে সমস্যামের নির্দেশ মেনে চলতে থাকলো। পায়রার দোপিয়াজী, পাকা পোনার কালিয়া, ভেড়ার অণ্ডকোষ ভজা-প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় এই কয়টি খনাই প্রধান হয়ে উঠলো। তিনদিন পরে সে শোবার দুঘণ্টা আগে একমাত্ৰা দাওয়াই খেলো। বেশ সুস্বাদু। কিছুক্ষণের মধ্যে শরীর গরম হয়ে উঠলো। যেন সে আবার তার হারানো যৌবন ফিরে পেয়েছে। ধী করে বয়সটা তার চল্লিশ বছর কমে গেছে। সেদিন তার বিবি প্রথম বুঝতে পারলো যৌবনের স্বাদ। লোকটা যেন একটা বীর পুরুষ-শোরের মতো, তার শরীরটা থাবার মধ্যে পুরে নিলো। সেই রাতে সওদাগর বিবি সত্যিই সন্তান সম্ভবা হলো। কিন্তু নিঃসংশয় হলো মাস তিনেক বাদে-সে যখন দেখলো, পরপর তিনটি মাস তার মাসিক ধর্ম আর হলো না।
যথা সময়ে সওদাগর বিবি একটি পুত্র-সন্তান প্রসব করলো। ছেলেটি এমন হৃষ্টপুষ্ট চেহারার হলো, ধাই তো দেখে অবাক। বললো, সারা জীবন এই করে আসছি, কিন্তু এমন তাগড়াই বাচ্চা কারো হতে দেখিনি। দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না-সদ্য হয়েছে। মনে হয়, বছরখানেক বয়স হবে।
বৃদ্ধ ধাই আল্লাহর নামগান করতে করতে বাচ্চাকে ধোয়ালো মোছালো। তারপর মায়ের কোলে দিয়ে বললো, ছেলেকে মাই খাইয়ে ঘুম পাডিয়ে দাও। :
সওদাগর বিবি ছেলেকে তুলে ধরে। মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকে সওদাগর। —ইয়া আল্লাহ, কী সুন্দর! যেন আসমানের চাঁদ নেমে এসেছে আমার ঘরে। আর দেখ, বিবিজান, কত বড়টা হয়েছে! আচ্ছা, ছেলের কী নাম রাখবে?
বাচ্চাটার বা উরুতে একটা ছোট্ট তিল দেখে সওদাগর আনন্দে লাফিয়ে ওঠে।—আমরা একে আল। অলদিন আবু সামাত বলে ডাকবো, কেমন?
সেইদিন থেকে আবু সামাতকে আর সকলের সামনে বের করা হলো না। অন্দরের এক নিভৃত কক্ষে রাখা হলো তাকে। আদর যত্নের কোনও ত্রুটি রাখলো না সওদাগর। একটা ছেলের জন্য পাঁচটা বাঁদী চাকরের ব্যবস্থা করা হলো। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে লেখাপড়া শিখতে আরম্ভ করে। নামজাদা মৌলভীর হাতে তার শিক্ষা দীক্ষার ভার দেওয়া হয়। যথা সময়ে সে কোরান এবং নানা বিদ্যায় বিশারদ হয়ে ওঠে। শুধু লেখাপড়া নয় খেলাধূলাতে সে বেশ চৌকস হতে লাগলো। কিন্তু সবই তার এক একা—সবই লোক চক্ষুর আড়ালে—সেই নিভৃত কক্ষে।
এই ভাবে চৌদ্দটা বছর কেটে গেছে। আবু সামাতের গোঁফের রেখা ফুটছে। একদিন চাকর খানা সাজিয়ে দিয়ে চলে গেছে। যাওয়ার আগে ঘরের দরজায় শিকল তুলতে সে ভুলে গিযেছিলো। দরজা খোলা পেয়ে সামাত এক পা এক পা করে ঘরের বাইরে আসে। এই নিভৃত বন্দী জীবন তার আর ভালো লাগে না। সে চায় মুক্ত আলো হাওয়া-মানুষের সাহচর্য।
এঘর ওঘর করতে করতে এক সময় সে চলে আসে তার মা-এর ঘরে। সেখানে তখন তার মা পাড়ার কয়েকটি মেয়ের সঙ্গে খোশ গল্পে মশগুল। মেয়েগুলোও তন্ময় হয়ে গল্প শুনছিলো। হয়তো কারো বেশ-বাস অসংবৃত হয়েও থাকতে পারে। হঠাৎ এক উঠতি বয়সের ছেলেকে ঘরে ঢুকতে দেখে সকলে সম্বিত ফিরে পায়। ক্ষিপ্র হাতে যে যার মতো বোরখা টেনে নিয়ে দেহ মাথা মুণ্ড ঢেকে ফেলে।
—ইয়া আল্লাহ, কী বে-শরাম বে-ইজতের কথা। বলা নাই কওয়া নাই, হুট করে মেয়েদের ঘরে ঢুকে পড়লো!
এই কথা শুনে মেয়েরা নাকাব সরিয়ে দেয়, তাই বলুন। তা এতদিন তো আপনার ছেলেকে দেখিনি কখনও। আপনার মুখে তার কথা শুনিওনি কোনওদিন।
সওদাগর বিবি উঠে গিয়ে ছেলেকে আদর করে চুমু খায়। বলে, বেটা, এখন তোমার ঘরে যাও।
বান্ধবীরা অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়েছে দেখে ছেলেকে তার ঘরে পাঠিয়ে দিলো।-ওর বাবা, ওকে বাইরে বেরুতে দেয় না। বাদ ছেলেদের সঙ্গে মিশে খারাপ হয়ে যেতে পারে, এই তার ভয়। তাই সে একা একাই মানুষ হচ্ছে। ঘরের মধ্যেই তার নাওয়া খাওয়া খেলাধূলা লেখাপড়ার সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। যতদিন না সে বড় হয়-দাড়ি গোঁফ গজায়, ততদিন সে এইভাবেই মানুষ হবে-এই আমাদের ইচ্ছা। ছেলের যা রূপ তাতে ভাই সত্যিই ডর লাগে, হয়তো কোন খারাপ মেয়ের পাল্লায় পড়ে নিজেকে নষ্ট করে ফেলবে। আজই এই প্রথম দেখলাম। সে আমার ঘরে এসে দাঁড়িয়েছিলো। হয়তো ঘরের দরজায় শিকল তুলে দিতে ভুলে গেছে। চাকরগুলো।
সওদাগর বিবির বান্ধবীরা বিদায় নেবার সময় ছেলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বললো, খুব সুন্দর ছেলে হয়েছে। আপনার। চাঁদের মতো দেখতে। আহা-চোখ জুড়িয়ে যায়। আল্লাহ তাকে শতায়ু করে বাঁচিয়ে রাখুন।
কিছুক্ষণ পরে আবু সামাত আবার মা-এর কাছে ফিরে আসে। বাইরের আঙ্গিনায় সে দেখতে পায়, একটা খচ্চরের পিঠে জীন লাগাম পরাচ্ছে চাকরেরা।
-আচ্ছা মা, আবু সামাত প্রশ্ন করে, এই জানোয়ারটাকে ঐভাবে সাজাচ্ছে কেন ওরা?
–খোদা মেহেরবান, তিনি আমাকে সম্রান্ত সওদাগরের ঘরে জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু মা, আমি ঐ ঘরে বন্দী হয়ে আর কতকাল কাটাবো। আমার জীবন হাঁফিয়ে উঠেছে। কাল থেকে আমি বাবার সঙ্গে দোকানে গিয়ে বসবো।
—ঠিক আছে বাবা, অধৈৰ্য হয়ে না, তোমার বাবা ফিরলে আজ সন্ধ্যাবেলা তার সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলবো আমি।
সন্ধ্যাবেল খেতে বসে সওদাগর বিবি কথাটা পেশ করলো, দ্যাখ, ছেলেটা বড় হচ্ছে, এভাবে তাকে আর ঘরে আটকে রাখা ঠিক না। তুমি বরং সঙ্গে করে দোকানে নিয়ে যাও তাকে। নিজের ব্যবসা বাণিজ্য নিজে দেখে শুনে বুঝে নিতে হবে তো।
—কিন্তু আবু সামাতের মা, সওদাগর বলে, তুমি তো জান, চারপাশের মানুষের কি শকুনের দৃষ্টি। ছেলেটা যদি কারো কুনজরে পড়ে!
সওদাগর বিবি বাধা দিয়ে বলে, তাই বলে ছেলেকে তুমি বাইরে বেরুতে দেবে না। সবাই নিজের নিজের ভাগ্য নিয়ে জন্মায়। শিকল দিয়ে বেঁধে খাঁচায় পুরে রাখলেই কি নিয়তির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়? নসীবের লেখা পালটানো যায় না। যা হবার তা হবেই। ও নিয়ে অহেতুক বাড়াবাড়ি করে কোনও ফায়দা নাই। এইভাবে তাকে যদি সবারই কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রোখ তাহলে আখেরে তার কী ভালোটা হবে, শুনি? তুমি বুড়ো হয়েছ। মরতে একদিন হবেই। তোমার মরার পর এই বিশাল ব্যবসা বাণিজ্যের একমাত্র মালিক হবে সে। কিন্তু সারা কইরো শহরে তোমার চেনাজানা বন্ধু-বান্ধব সম-ব্যবসায়ী কেউই তোমার ছেলের সুরৎ দেখেনি। হঠাৎ দুম করে সে যদি তোমার অবর্তমানে দোকানে গিয়ে বসতে চায় কেউ তাকে স্বীকার করবে? তোমার দোকানের কর্মচারীরাও যদি বলে বসে, কে সে, তাকে তারা জানে না, তখন? আর তাছাড়া এত বড় ব্যবসা-কী তার হালচাল, কী তার তারিকা কিছুই তার জানা থাকবে না। কেমন করে সে চালাবে তখন? তুমি বলবে, আমি তো আছি। আমিই সবাইকে বলবো, ‘এই হচ্ছে সওদাগর সামাস অল-দিনের একমাত্র সন্তান—তার ব্যবসার একমাত্র উত্তরাধিকারী। কিন্তু আমার কথা শুনবে কেন তারা? আমি বানিয়েও বলতে পারি। তারা হয়তো অবিশ্বাস করতে পারে-আবু সামাত তোমার ঔরসের সন্তান নয়। তখন? তখন কী হবে? সরকারের ফৌজদার এসে তোমার সমস্ত বিষয় সম্পত্তি আটক করে নিয়ে যাবে। তোমার ছেলে আর আমি তখন কি আঁটি চুসবো? আমি যদি শহরের পাঁচজন সম্ভ্রান্ত লোককে সাক্ষী মানতে যাই– বেহজ্জৎ হয়ে যাবো। তারা বেমালুম বলে দেবে, ‘কই সওদাগর সাহেবের কোনও সন্তানাদি ছিলো বলে তো আমরা শুনিনি কখনও!’ সে-অবস্থায় তাদেরও দোষ দেওয়া যাবে না। সত্যিই তো তারা কখনও শোনেনি তোমার ছেলের কথা। বা চোখেও দেখেনি কখনও?
—খোদা হাফেজ, তুমি ঠিক বলেছ, বিবিজান। আমি কাল থেকে আবু সামাতকে সঙ্গে করে দোকানে নিয়ে যাবো। চেনা জানা সকলের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করিয়ে দেব। নাঃ, তুমি যথার্থ কথা বলেছ। বিষয় সম্পত্তির ব্যাপার! আর আমার শরীর স্বাস্থ্যের কথাও কিছু বলা যায় না। তাছাড়া এখন থেকে কেনা বেচার তরিকাগুলো না শেখালে পরে ব্যবসাই বা চালাবে কি করে?
এমন সময় প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
দুশোচুয়ান্নতম রাতে আবার সে বলতে শুরু করে।
পরদিন সকালে সামস আল-দিন ছেলেকে নিয়ে হামামে গোসল করতে যায়। খুব ভালো করে। স্নানাদি শেষে সম্রান্ত সওদাগরের সাজ-পোশাকে সাজগোজ করে দুজনে। নাস্তা পানি সেরে খচ্চরের পিঠে চাপে সামস আল-দিন, আর ছেলেকে পিছনে বসায়। রাস্তার লোক সামাতকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এমন সুন্দর চেহারা সচরাচর চোখে পড়ে না! যেন একেবারে পূৰ্ণ চাঁদের হাট। কে বটে ছেলেটা-এর আগে তো কখনও দেখিনি। মোট কথা যেই দেখে, প্রশংসায় উচ্ছসিত হয়ে ওঠে।
দোকানের কাছে আসতে সেই মদ ভাঙ্গ আফিঙ চরস খোর বেহেড মাতাল সমস্যামের সঙ্গে দেখা হয়। লোকটা তখন তুরীয় মার্গে বিচরণ করছিলো। সওদাগরের সঙ্গে আবু সামাতকে নামতে দেখে চোখ দুটো কপালের ওপর টেনে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা করে ঠোঁট বাঁকিয়ে এক বিচিত্র অঙ্গভঙ্গী করে বলে, কে বাবা, আসমানের চাঁদ-মাটিতে নেমে এলে?
নিজের কাঁচা রসিকতায় নিজেই সে হাসতে থাকে। কিন্তু কথাটা মাতালের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিতে পারলো না সকলে। চারদিকে চাপা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লো নিমেষে।
প্রধান-সওদাগররা এক জায়গায় জড়ো হয়ে আলোচনায় বসে। ব্যাপারটা বিষদভাবে খতিয়ে দেখতে চায় তারা। সত্যিই তো এতদিন তারা বৃদ্ধ সওদাগর সামস অল দিনের কোনও সন্তানাদির সংবাদ জানে না; আজ হঠাৎ একটা ছেলেকে সঙ্গে এনে নিজের ছেলে বলেই বা পরিচয় দিচ্ছে কেন? তারা সামসামকে ডেকে পাঠালো।
সমবেত সওদাগরের সামনে সামসাম ঠাট্টা বিদ্রািপ ভরা কণ্ঠে বলতে থাকে? আমি আমাদের মাননীয় সভাপতি সাহেবকে ছোট করে দেখতে চাই না। তার মান-ইজত খোয়া যাক, মরে গেলেও তেমন কথা আমার মুখ দিয়ে বেরুবে না। কিন্তু আপনারাই বিচার করুন সাহেব, হঠাৎ একটা চোদ্দ বছরের ছেলেকে তিনি পেলেন কোথায়? আমার মনে হয়, এইরকম একটা অসৎ লোক এই সভার সভাপতি হয়ে থাকার অযোগ্য। তাকে বরখাস্ত করে অন্য কাউকে এই ভার দেওয়া হোক, এই আমার আর্জি।
সামাসামের অকাট্য-যুক্তি কেউ খন্ডন করতে পারলো না। সকলে একবাক্যে স্বীকার করে নিলো, না, এরকম অসৎ-লোককে এইরম দায়িত্বশীল পদে রাখা উচিৎ নয়।
দোকান খোলার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধু বান্ধব এবং সমব্যবসায়ীরা প্রতিদিন এসে শুভেচ্ছা জানিয়ে যায় সামস আল-দিনকে। কিন্তু আজ এতটা বেলা হলো কেউ এদিক মাড়াল না। সামস অল-দিন ভেবে পায় না, হঠাৎ আজ কেন এমন হলো। একজনের পর একজন চেনা লোক দোকানের সামনে দিয়ে সটকে পড়ে। কেউ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে না, কথা বলে না। দালাল সামসামও দোকানের দিকে পিছন ফিরে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু সামস অল দিন আর চুপ করে থাকতে পারে না। বেশ একটু চড়া গলাতেই হাঁক দিলো। ও ভাই সামসাম, এদিকে শোনো না?
—কী ব্যাপার, সামসাম, তোমরা সব পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে কেন? রোজ সকালে সকলে এসে আমাকে ফতিয়াহ শুনিয়ে যায়। আজ কেউ এলো না কেন?
সামসাম কোমরটা ঈষৎ হেলিয়ে সওদাগরের কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলে, আমার কাছে তো আপনার কোনও লুকোচাপা কিছু নাই, সাহেব, আচ্ছা সত্যি করে বলুন তো এই চাঁদের মতো ফুটফুটে সুন্দর ছেলেটাকে আপনি এই দোকানে এনেছেন কী কম্মে? ওকে দিয়ে মাছি তাড়াবেন, তা তো কেউ বিশ্বাস করবে না। মনে রাখবেন সাহেব, ওদের এই নোংরা কথার আমি ভীষণভাবে প্রতিবাদ করেছি। মনে করুন। ঐ এক ঘর ব্যবসাদারের সভায় একমাত্র আমিই ছিলাম। আপনার পক্ষে। আর সবাই আপনার কুৎসায় মেতে উঠেছিলো। আমি ছাড়িনি, বলেছি-ওদের জোর গলায় বলেছি সাহেব, যদি সওদাগর সামস আল-দিন এই বুড়ো বয়সে কোন অল্প বয়সের কচি ছোকরায় আসক্ত হয়ে থাকে–সে খবর সবার আগে আমিই জানবো তো? কারণ কায়রো শহরে যে-সব বুড়ো কতাঁর এই রোগ আছে তার দাওয়াই-পত্ব তো আমিই দিয়ে থাকি। আমি ছাড়া অল্পবয়সের সুন্দর চেহারার লোড়কা জোগাড় করে দেবে কে? আপনি কিছু ভাববেন না। সাহেব, আমি তাদের আচ্ছা করে ঠুকছি। বলেছি, ছেলেটি নিশ্চয়ই তাঁর বিবির কোনও নিকট আত্মীয় হবে। অথবা বাগদাদ কিংবা তাঁতার শহরের কোনও বন্ধু বান্ধবের ছেলেও হতে পারে। তবে আপনার রুচির প্রশংসা না করে উপায় নাই, কর্তা। দারুণ ছেলে জোগাড় করেছেন। আপনি। লাখে একটা মেলে।
এই সময় রজনী অতিক্রান্ত হতে চলেছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments