নিখোঁজ সংবাদ ।। অর্ণব আশিক

 
সন্ধ্যার একটু পরই মোবাইলটা বেঁজে উঠলো আজাদকে পাওয়া যাচ্ছেনা। ওর বউ ঝুনুই ফোনটা করলো। ঝুনুর আসল নামটা সকলের আদরের ঝুনু ডাকের আড়ালে হারিয়ে গেছে বহুদিন।
আজাদ তার বাবার বড় ছেলে। একটু সরল এবং কিছুটা মুখচোরা স্বভাব। কারো সাতে পাচে নেই। সরলতার কারনে পড়ালেখাও তেমন হয়নি। এসএসসি পাশের পর বাবার সাথেই থাকে বা বলতে হয় তার বাবা বুঝেশুনেই তার এই সরল ছেলেটিকে নিজের কাছেই রেখেছেন।
ঝুনুর ফোন কলটায় একটু বিস্মিতই হলো আজাদের মেজ দুলাভাই। আজাদতো রাত করে বাইরে থাকার কথা না? ওর তেমন কোন বন্ধু নেই, আড্ডা দেয়না, পান সিগারেট বিড়ি খায়না, মদ তো প্রশ্নই আসেনা। এত রাত অবধি বাইরে থাকবে কেন? বিকাশে টাকা তুলতে গিয়েছে একটু সময়ের জন্য। তেমন বেশি টাকাও না যে ছিনতাই হতে পারে বা তাকে ছিনতাই করতে পারে। রাজনীতি নিয়ে আজাদের কোন দর্শনও নেই। আসলে রাজনীতি বুঝার মত মসনুষই না আজাদ। তার মা এর মামা রাজনীতি করতেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টের বিষয় এটুকুই। সে কোনদিন ভোট দিয়েছে এমন সন্দেহের ভাবনাটাও আজাদের দুলাভাইর মনে দোলা দেয়। তবুও আজাদের কোন খোঁজ নেই সন্ধ্যার পর থেকে।
বাবা বৃদ্ধ পচানব্বই এর মত বয়স, দারুন শিক্ষিত মেধাবী। এক সময় শিক্ষক ছিলেন, পরে শিক্ষা বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা। এখনো হাটা চলা করতে পারেন, নিজের কাজ প্রায়শই নিজে করেন। আজাদকে নিয়ে হাট বাজার জমিজমা দেখেন। তার ফোনটা আরো বিচলিত করে আজাদের দুলাভাইকে। রাত তখন এগারটা ছুঁই ছুঁই শশুড়ের ফোনটা এলো।
"আজাদ এখনো ঘরে ফিরেনি। তার দুশ্চিন্তা হচ্ছে"
 দেশ একটি সংকটময় অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। আজাদের দুলাভাই জাকির সাহেবের অন্তত তাই মনে হয়। শ্রমিকরা কাজ হারাচ্ছে, বেকার যুবকদের কাজের ক্ষেত্র ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে, যা বেকার যুবকদের বিপথগামী করছে দিনদিন। রাস্তাঘাটে ছিনতাই রাহাজানি লেগেই আছে। অন্যদিকে চাষিরা ফসলের সঠিক মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মহাজনের কারসাজিতে। সরকার সব দেখেও উদাসীন। সরকারী দলভুক্ত লোক ছাড়া কাজ পাচ্ছেনা কেউ। পরিবেশ বিপন্ন, মানুষের সহ্য সীমারেখা ছাড়িয়ে যাচ্ছে সবকিছু।
কিন্তু আজাদতো এসবের কিছুতেই নেই। তাহলে সে কোথায় গেল। জাকির সাহেব তার চেনা জানা কয়েকজনকে ফোন করে বিষয়টা নিয়ে আলোচনাও করলেন। সকলের একই মত আজাদ কোথায় যাবে।
ঝুনু থানা থকে ফোন করে জানালো সে থানায় গিয়েছে বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনকে জানাতে। শীতের মধ্যরাত প্রায়, মেয়েটিকে নিয়েও জাকির সাহেবের মনে চিন্তার অগ্নি ঘুরপাক খেতে লাগলো। একাএকা মেয়েটি কি করতে পারে। পুরুষ লোক বলতে তার সাথেতো কেউ নেই। আজকাল হঠাৎ হঠাৎই ছেলে বুড়ারা হারিয়ে যাচ্ছে। কোন হদিস মিলছে না।
আজাদকে নিয়ে চিন্তার স্রোতটা বেড়েই চললো জাকির সাহেবের। গতকাল নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে আজ সজাল পর্যন্ত কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। কোথাও থেকে টিলিফোনও না। আজাদ এমন মানুষ নয় যে না বলে কোথাও চলে যাবে। আর আত্নহত্যা করার মত মানুষও সে না। মানে আত্মহত্যা করতে হলে মনের যে জোর থাকা দরকার তার তা নেই। যে কিনা একটা সামান্য ইনজেকশন দিতে ভয় পায় সে আত্নহত্যার মত সাংঘাতিক কাজ করতে পারেনা। তাহলে সে গেলো কোথায়।
আজাদকে নিয়ে কিছুটা সমস্যা বাসায় হতো, সে সন্ধ্যার পর চা খেয়ে একটু বের হতো। এটা তার নিত্য দিনের অভ্যাস ছিল। বাসার পাশে বিএম কলেজ। কলেজের মাঠে যেয়ে ঠায় বসে থাকে চুপচাপ। কি ভাবে বহু চেষ্টা করেও বের করা যায়নি। জানতে চাইলে সে বরাবারই চুপকরে থেকেছে। বাসায় এসে নিজ বিছানায় চুপচাপ শুয়ে শুয়ে বাবা মা এবং বউয়ের কথা শুনতো। কিন্তু কিছু বলতো না। অবশ্য না বলার বিষয়টি তার সব কিছুতেই ছিল। কোন কিছুতে জবাব দিতনা। তবে সে পান, সিগারেট বা কোন  প্রকার নেশায় অভ্যস্ত ছিলনা এটা বুঝা যেত। কিন্তু তাকে নিয়ে প্রশ্নটা সংসারে ছিলই। সে সন্ধ্যার পর যায় কোথায়?
জাকির সাহেবের মনে আবার আত্মহত্যার বিষয়টা নাড়া দিতে লাগলো। কেননা একসময়  বয়সে তার মধ্যেও আত্নহত্যা করার একটা বাসনা তৈরী হয়েছিল। তখন সদ্য এমএ পাশ করেছে, চাকরি খোঁজছে, চাকরি নেই কোথাও। বাবার কাছে হাতও পাততে পারছেনা হাত খরচের টাকার জন্য। শীতের সময় তখন। পাড়ায় বেডমিন্টন খেলার ধুম। কিন্তু খেলতে হলে একটা রেকেট দরকার আর ফেদার কেনার টাকার অংশিদার হতে হবে। সাথে খেলার জন্য ক্যাডস গেঞ্জি দরকার। অথচ টাকা নেই। সম্মানের ইজ্জতের প্রশ্ন৷ অবস্থা সঙ্গিন, সে আত্নহত্যার মত একটা নিয়ে ফেললো। কিন্তু কাজটা করবে কি করে। ভাবলো গলায় ফাঁস লাগিয়ে গাছের ডালে ঝুলে পড়বে। পরে ভাবলো ওরে বাব্বাহ!  তার গলা গাছের ডালে ঝুলছে ভাবতেই তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। একবার ভাবলো রাস্তায় এক্সিডেন্ট করে আত্মহত্যা করবে। কিন্তু সাহসটা তাকে এসব কিছুই করতে দিলনা। আজাদতো তার থেকেও নরম মনের মানুষ। তার দ্বারা আত্নহত্যার মত এত সাংঘাতিক কাজ সম্ভব নয়।
"বাবা তুমি কি একবার এদিকে আসতে পারবে? তোমার শশুড় তো অস্থির হয়ে গেছে, বউমাও তেমনি। আমি সামলাতে পারছিনা।"
জাকির সাহেবের শাশুড়ির দেয়া সংবাদটি তাকে আরো জটিলতায় ফেলে দিল।
"মা আমি আগামীকাল সকালেই পৌছে যাবো। আপনারা টেনশন করবেন না।"
কথাটা বলেছে ঠিকই কিন্তু টেনশনটা তারই হচ্ছে এখন। আজাদ যেতে পারে কোথায়?
অনেকের মত পুলিশের উপর তেমন ভরসা নেই জাকির সাহেবেরও। সেটা নানা কারণে। সব পুলিশ যে খারাপ সেটা সে ভাবেনা। কিন্তু তাদের কিছু লোকের আচরণ সাধারণ মসনুষকে এমনটা ভাবতে বাধ্য করেছে। আজাদের স্ত্রীর কথায় সে ধারনাটার পালে আরো একটু হাওয়া দিল।
থানায় অভিযোগ জানাতে গেলে ঝুনুকে নানা প্রশ্নে বিব্রত করা হয়েছে। তদন্তের খাতিরে প্রশ্ন করতেই পারে, কিন্তু একজন নারীর সদ্য নিখোঁজ হওয়া স্বামীকে নিয়ে তাকে বিব্রত করা হয়তো সঠিক নয়। তবুও পুলিশের কাছে যাওটাই শ্রেয় এবং উত্তম ভেবে সকালে পৌছেই জাকির সাহেব থানার উদ্দেশ্য রওয়ানা হলো।
দুটো রুটি আর কিছু সবজি দিতে দিতে তার শাশুড়ি বললো,
"বাবা তুমি কি একাই যাবে? আমার ভয় হচ্ছে।"
"ভয়ের কোন কারণ নেই, আমি শুধু থানার ইনচার্জের সাথে আলাপ করবো বিষয়টি নিয়ে। আমিও তো দীর্ঘদিন পর এলাম। নতুন থানা হয়েছে সম্প্রতি, আমি লোকেশনটি চিনে নিবো।"
"দুলাভাই আমি কি আপনার সাথে যাবো?"
ঝুনুর যাওয়ার আগ্রহ আছে জাকির সাহেব জানে, কিন্তু তাকে নিয়ে যেতে জাকির সাহেবের মন সায় দিলনা।
শশুড়ের রুমে যাবে ভাবতে যেয়ে শুনতে পেলো শশুড়ের ঘর থেকে হালকা রবীন্দ্র সঙ্গীতের আওয়াজ আসছে। বাঙ্গালী আজো সুখে বা দুঃখে রবীন্দ্রনাথকেই আশ্রয় করে।
শশুড় লোকটি অসাধারণ!  ছেলে নিখোঁজ দু'দিন। পরিস্থিতিতে সবাই রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে পারেনা।
শুনছেন
"ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা
প্রভু, তোমার পানে, তোমার পানে, তোমার পানে।
যায় যেন মোর সকল গভীর আশা
প্রভু, তোমার কানে, তোমার কানে, তোমার কানে।
চিত্ত মম যখন যেথায় থাকে
সাড়া যেন দেয় সে তোমার ডাকে
যত বাধা সব টুটে যায় যেন
প্রভু, তোমার টানে, তোমার টানে, তোমার টানে।"
 সাগর সেনের অসাধারণ গায়কি ঢং। শশুড় মশাই চোখ মুদে বসে আছেন, চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে, তিনি ঝরঝর করে কাঁদছেন। জাকির সাহেব চুপ করে দাড়িয়ে থাকলেন।
 বাবা? আমি জাকির।
কোন সাড়াশব্দ নেই। সাগর সেন গেয়ে চলছেন... জাকির সাহেব দেখলেন তার শশুড়ের ঠোঁট নড়ছে, অস্পষ্ট উচ্চারণ" বাহিরের এই ভিক্ষাভরা থালি
এবার যেন নি:শেষে হয় খালি
অন্তর মোর গোপনে যায় ভরে
প্রভু, তোমার দানে, তোমার দানে, তোমার দানে।
হে বন্ধু মোর, হে অন্তরতর
জীবনে যা-কিছু সুন্দর
সকলি আজ বেজে উঠুক সুরে
প্রভু, তোমার গানে, তোমার গানে, তোমার গানে।"
গান শোন্তে শোন্তে জাকির সাহেব ভাবছে গান শোনা তারও নিত্য দিনের অভ্যাস। বাসায় ঘুম থেকে প্রায়শই গানের শব্দে ঘুম ভাঙে৷ তার বউ খুব ভোরে উঠে নামাজ পড়ে। এরপরই সে রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনে। মেয়েরাও পেয়েছে এই অভ্যাস। যদিও দুটি মেয়েই তাদের কবিতা ভক্ত। দু'জনই আবৃত্তি করে। ওদের মা বলে বাবার মত কবিতা আর আবৃত্তি নিয়ে থাকলে জীবনে কিছুই করতে পারবেনা।
সঞ্চারীতে আসতেই কারেন্ট চলে গেলো, গান বন্ধ হলো, শশুড় মশাই চোখ খোললেন। তার চোখে পড়লো জাকির সাহেবকে। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু বিব্রত হয়ে বলেলেন,  কখন এলে বাবা, বোস দাঁড়িয়ে কেন?
আপনি গান শুনছিলেন বাবা, তাই ভাবলাম দাঁড়িয়ে থেকে আমিও একটু শুনি।
জাকির সাহেবের শশুড় উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, তুমি কি থানায় যাবে এখন? ওরা নাকি বউমার সাথে ভালো আচরণ করেনি। তুমি একটু দেখ বাবা। ছেলেটা যে কেথায় গেলো? বিকাশের টাকা তুলে আমার ঔষধ আর একটু স্যুপ নিয়ে আসবে বলেছিল। আমি তার আশায় বসে ছিলাম। সেদিন থেকে কিছু খাইনি৷ আসলে খেতে পারিনা। ছেলেটা রাতে আমার সাথেই প্রতিদিন রাতে ভাত খেতো। কি থেকে কি হলো, জানিনা।
জাকির সাহেব শশুড়ের মুখের দিকে চয়ে আছেন, দেখলেন চোখের জল এখনো লেগে আছে গালে, চোখের পাপড়িতে। চোখদুটি জ্বলছে দপদপ করে।
আমি যাই বাবা, থানার ইনচার্জের সাথে কথা বলবো। দেখি ওনারা কি করেন। সব বিষয়ে পুলিশ প্রাশাসনই উত্তম।
এসো, সাবধানে যেয়ো।
আপনার জন্য একটা বই এনেছি, মা- কাছে আছে। স্রষ্টার ইতিহাস।
আমি তাহলে যাই। বলে জাকির সাহেব এক পা বাড়িয়েছেন, দেখলেন শশুড়ের দুচোখ বেয়ে নেমে এসেছে অশ্রু ধারা। তিনি চলে এলেন নিরবে।
থানার পথে জাকির সাহেবের মনে একটা বিষয় এলো আসলে দেশের পরিস্থিতিতে কারই বা কি করার আছে। পুলিশও তো নিজের কাজটি ঠিকমতো করতে পারেনা, উপরের চাপ, রাজনৈতিক চাপ, দলের চাপ।
 
রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন অনেকক্ষণ, রোদ্দুর যেন তাকে পুড়িয়ে দিবে। দরদর করে ঘামছেন। 'স্যার কেমন আছেন।'
সম্বোধনটি শুনে জাকির সাহেবকে একটু বিচলিত বিস্মিত হলেন। চমকে উঠে বললেন
'আপনাকে তো চিনতে পারলামনা।'?
এমন সম্বোধনে তো তাকে এখানে কেউ ডাকার কথা না। স্মৃতি হাতরাতে হাতরাতেও জাকির সাহেব মেয়েটিকে চিনতে পারলেন না। তবে মেয়েটির আড়ষ্টতাহীন কথায় মনে হলো মেয়েটি তাকে ভালো করে চিনে। মেয়েটি আগের মতো স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
'আমি আপনার ছাত্র ছিলাম। কিন্তু আপনি এখানে কেন?'
জাকির সাহেব জড়তা কাটিয়ে বললো' তুমি আমাকে চেনো?
'আমাকে আপনি চিনতে পারবেন না স্যার, আমি আপনার ছাত্রী ছিলাম। আমার নাম মৌরী। মৌ বলেই সবাই ডাকে। এখন চাকরির সূত্রে এখানে আছি।'
'তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে না তো?
 
মাথাটা নিচু করে নিজেকে একটু সামলে সে বললো,  "আমাকে আপনার চিনতে না পারাটাই স্বাভাবিক। আমি ক্লাসে খুব ভালো ছাত্র ছিলাম না। কিন্তু আপনার কবিতার ভক্ত ছিলাম। আপনার ক্লাস কখনো মিস করিনি। আমাদের পরীক্ষার আগে আগে আপনি ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে চলে গেলেন। আজ আপনাকে দেখে আপনাকে চিনতে আমার ভুল হয়নি। আপনি কেমন আছেন।'
জাকির সাহেব একটু অতীতাশ্রয়ী হয়ে তার অধ্যাপনা জীবনের দুটি বছরের মধ্যে ঢুবে গেলেন। মেয়েটিকে কোথায় খুঁজে পেলেন না।
'স্যার আপনি কোথায় যাবেন?'
 
জাকির সাহেবের হঠাৎ করেই মনে পড়লো।  এতো   সেই মেয়েটি , যে আমাকে বলেছিল, স্যার একদিন পূর্ণিমা রাতে আমাদের বাড়ি আসবেন। আমাদের বাড়ির পাশে নদী আছে, রাতের জোছনায় নদীটি অসম্ভব মায়াবী মনে হয়, আপনার ভালো লাগবে। আমি আপনাকে নদীর কান্না শোনাবো সেই জোছনায়।
মেয়েটিকে কেমন পাগল পাগল মনে হয়েছিল সেদিন। বলেছিলেন, যাবো একদিন। নদী আমাকে টানে প্রবল।
"আপনি কি কোন বিষয় নিয়ে চিন্তিত? "
জাকির সাহেব আমতা আমতা করে বললেন, ' আসলে আমাদের একটা ক্রাইসিস যাচ্ছে। সব সংসার বা সব মানুষের জীবনে মাঝে মাঝে অনাহুত ক্রাইসিস চলে আসে। আমি স্থানীয় থানায় যাবো একটি কাজে। আমার শালা গত তিনদিন যাবৎ নিখোঁজ। '
'আমার গাড়িতে উঠুন। আমি পৌছে দিব।'
জাকির সাহেব আরো আড়ষ্ট হলেন।
'আমি চিনে নিব, তোমাকে কষ্ট করতে হবেনা'
গাড়ি চলছে। রাস্তায় সাংঘাতিক জ্যাম। এক সময় ছোট শহর ছিল এই বরিশাল। কেউ কেউ ভেনিস বলতো এর রূপে পাগল হয়ে। এই শহরের ভিতর দিয়ে উত্তর দক্ষিণ আড়াআড়ি অনেকগুলি ছোট খাল এক সময় প্রবাহিত ছিল। শহরের ভিতর দিয়ে এই খালগুলিতে নৌকা চলাচল করতো। জোয়ারভাটার পানিতে শহর পরিস্কার হতো। শহর চকচক করতো।
শহর এখন বিভাগীয় শহর। তবে রাস্তাঘাট আহামরি কিছু হয়নি। ঘিঞ্জি, এবড়োখেবড়ো, এখানে-ওখানে আবর্জনা, দেয়ালে বিশ্রী রাজনৈতিক দেয়াল লিখন, সব মিলিয়ে গা-ছাড়া দেহাতি ভাব।
কবি জীবনানন্দ শহরকেই ভালো বেসেছিলেন। বিএম কলেজে পড়েছেন, অধ্যাপনা করেছেন। তার বহু বিখ্যাত কবিতা শহরেই রচিত। আবার এই শহরের পাশেই চারণ কবি মুকুন্দ দাসের আখড়া।
গাড় হঠাৎ থেমে যাওয়ায় গাড়ির ঝাকুনিতে জাকির সাহেবের চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়। দেখলেন একটা মিষ্টির দোকানের সামনে গাড়ি দাড়িয়েছে। শষীর মিষ্টির দোকান। এক সময় স্কুল পালিয়ে দোকানের রস মালাই আর গজা খেতে আসতেন। দই চিড়াও খুব বিখ্যাত ছিল দোকানের।
মেয়েটি নেমে কিছু মিষ্টি নিল। সরুগলি। তার মধ্যে রাজ্যের গাড়ি পার্ক করা। পাশেই একটা কোচিং সেন্টার। সব বড় লোকের বৌরা আসেন ছেলে মেয়েদের নিয়ে। এক ফ্যাশন এখন।
ফুটপাত বলে কিছু নেই। দোকান আর গাড়িতে দখল হয়ে আছে। শহরেও এখন টাকাওয়ালা মানুষের অভাব নেই। এক সময় একটি কি দুটি গাড়ি ছিল।
মিনিট পনের চলার পর গাড়িটি বড় রাস্তায় উঠলো। সি এণ্ড বি রোড। একটু চওড়াই। রাস্তায় ভিড় আছে, কিন্তু জ্যাম নেই, গাড়ি কোথাও আটকাচ্ছে না।
জাকির সাহেব দেখলো মেয়েটি তার মাথায় ক্যাপটি ঠিক করে নিল এবং পোষাকটি টেনেটুনে দেখলো। মুখে কেমন একটা ভারিক্কি ভাব।
"স্যার আমরা এসে গেছি।"
গাড়ি একটু বামদিকে ঘুরে বড় একটি পোর্চের নীচে দাড়ালো। সামনে লেখা বিমানবন্দর থানা।
জাকির সাহেবের হঠাৎ করেই জীবনানন্দের ' উপেক্ষার শীত' গল্পের কয়েকটি লাইন  মনে পড়ে গেলো।" আমাদের জীবনের  যা দরকার তা মেটাতে হব, প্রকৃত দরকারগুলো এত কম বোধ করি আমি যে দু-একটা সত্যি সত্যিই যখন অনুভব করি তখন নিজের মজ্জাগত সমস্ত কুঁড়েমি উদাসীনতাকে অগ্রাহ্য করার মতো জোর পাই।"
মেয়েটির ডাকে জাকির সাহেব গাড়ি থেকে নামলেন।
তিনিও কি আজ সব উদাসীনতাকে উপেক্ষা অগ্রাহ্য করতে পারবেন?
পোর্চ থেকে বারান্দায় উঠে হাটতে যেয়ে জাকির সাহেবের মনে ভিন্ন একটি অনুভুতি কাজ করতে শুরু করেছে। এটা কি মেয়েটির বাংলো না অফিস?  দুই পাশে দারুনভাবে টব সাজানো, বাহারি সব মানি প্লান্ট আর ক্যাকটাস। ঝকঝকে পরিস্কার মেঝে। দেয়ালগুলিও মুগ্ধ করার মতো পরিচ্ছন্ন। করিডোরে মাঝে মাঝে ময়লার বাস্কেট রাখা। নিরবতা বিরাজমান সর্বত্র।
"আসুন স্যার। এটাই লোকাল থানা, এটাই আমার অফিস।
আমিই থানার দায়িত্বে আছি।"
জাকির সাহেব কিছুটা বিব্রতভাবে ভাবে বললেন। "বুঝতে পেরেছি। আমি কি তোমাকে কোন সমস্যায় ফেলেছি?"
"সেটা নয় স্যার।
আপনার ক্রাইসিসটা আমার সাথে একটু শেয়ার করুন"আমাদের জীবনে কতরকম বিতিকিচ্ছিরিো প্রবলেম যে আসে তা জবে না ঢুকলে বুঝতে পারতাম না। মানুষের মনের গোপন কুঠুরিতে নানা সমস্যা বন্দী হয়, কেউ মেলে ধরে কেউ ধরে না, আবার কেউ বাধ্য হয়েই মেলে ধরে। মৌরী নিজের মনেই ভাবতে থাকে।
"আমার বড় শালা গত তিনদিন ধরে মিসিং। কোথাও পাওয়া যাচ্ছেনা। তার নাম আজাদ।"
হা, রকম একটা কেইস নিয়ে আমার অফিসাররা গত দুদিন ধরে খাটছে। কিন্তু কোন কুল কিনারা করতে পারছে না।
আমরা সম্ভাব্য সব ক্লুগুলি নিয়েই এগুচ্ছি।
ওনার স্ত্রী এসেছিলেন শুনেছি। আমি ছুটিতে ছিলাম। কিন্তু বিষয়টি আমাকে জানানো হয়েছে।
স্যার উনি নিজে থেকে কোথাও চলে যান নি তো? মানে কোন ফ্যামিলি ক্রাইসিস নাতো?
মৌরী ভাবতে থাকে। মাঝে মাঝে মানুষের মনে এমন কিছু ঘটে, মানুষ তা এড়াতে পারে না।
কলেজে যেয়ে যেদিন শুনতে পেলাম আপনি কলেজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছেন, আমার মনেও সেদিন এমন একটা ভাবনা এসেছিল। তা কউকে কোনদিন বলতে পারিনি।
"আমার জানা মতে ওরা স্বামী স্ত্রী একটি মেয়ে নিয়ে ভালোই ছিল।"
ভালতো আমিও ছিলাম স্যার। কলেজে যেতাম শুধু আপনার ক্লাস করতে, আপনার কথা শুনতে। কিন্তু হঠাৎই একদিন আপনি কোথায় চলে গেলেন। আপনার শালা আজাদের মত।
কলেজ থেকে ফিরে কিছু খাইনি সেদিন। সন্ধ্যার পর বিছানা ছেড়ে। কাছের নদীর ঘাটে চলে গিয়েছিলাম। শীতের সময়। নদীতে জল ছিলনা তেমন। সাপের মতো একেবেঁকে পড়ে ছিল নদীটা। জোছনা মাখানো নদীর বুকে পড়ে থাকা বালিগুলি চিকচিক করছিল।
আমি মুগ্ধ হয়ে নদীর অবর্ণনীয় শোভা দেখেছিলাম বুকে কষ্ট নিয়ে। কাউকে বলতে পারিনি নদীটির মতো আমিও আপনাকে ভালোবাসি। কথাগুলি মনে মনে ভাবতে যেয়ে মৌরী খেই হারিয়ে ফেলে। নিজের সমগ্রতা নিয়ে নিজের ফেলে আসা স্মৃতিকে জাপটে ধরে। মনে হয় শীতরাতের সেই কুয়াশার অবয়ব চিড়ে স্মৃতির ভেজা ভেজা আলো তার বুকে নতুন একটা স্পন্দন তুলছে। তবে কি এই হারিয়ে যাওয়ারও একটা কার্যকারণ থাকে?
পৃথিবীতে কত মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে এভাবে প্রতিদিন। আমরা কে কার খোঁজ রাখি।
আজাদের খোঁজ নেই। তার স্ত্রী সন্তান বাবা-মা অত্মিয়রা খুঁজছে তাকে। আমিও খুঁজবো।
আপনাকে যেমন খুঁজেছি বছরের পর বছর।
খোঁজ ছিলনা আপনারও।
মৌরীর মনে সেই শীত রাতের নদীটি হঠাৎ যেন ভর করলো। নদীর বুকে গলে গলে পড়ছিল জোছনার মায়াবী আলো। মৌরীর বুকের ব্যথার মতো চুঁইয়ে নামছিল চাঁদের সেই আলো। একটা অভিমানি বুকে বারবার বেঁজে উঠছিল একটি স্বর দূর হতে আরো দূরে যেয়ো নাকো আর।
আমি তবে এখন যাই মৌরী। তুমি তো সবই জানো। আমার বলার কিছু নেই।
মুহুর্তের মধ্যে মৌরীর অন্যমনস্ক ভাবটা কেটে গেলো। নিজেকে একটু সামলিয়ে বললো" ড্রাইভার আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে। কয়দিন থাকবেন।"
"আরো দুদিন থাকবো। আমি তবে আসি।"
মৌরী উঠে এলো জাকির সাহেবকে এগিয়ে দিতে।
নিজেই গাড়ির দরজা খুলে জাকির সাহেবকে উঠতে বললো। ড্রাইভার কে বললো "স্যারকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে এসো।"
"আবার কবে দেখা হবে? সময় করে একবার আসবেন, আর আসার আগে ফোন দিবেন।"
মনে মনে বললো আপনিতো নিখোজ সংবাদই ছিলেন আমার কাছে। জীবনতো কাটিয়ে দিলাম একা একাই। এখন আর দেখা হলেই বা কী।
গাড়িটি ধোঁয়া উড়িয়ে চলে গেলো। মৌরী সে দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো, আপনি আমার মধ্যেই ছিলেন, আছেন থাকবেনও।
আপনার শালা হারিয়ে গেলেও তিনি থাকবেন তার স্ত্রী কন্যা বা বাবা মায়ের বুকে।
জাকির সাহেব গাড়িতে উঠে আবার ভাবনায় ডুবে গেলেন, আজাদ যেতে পারে কোথায়? আজাদের মুখমন্ডলটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। বাসায় যেয়ে শশুড় শাশুড়ি বা আজাদের স্ত্রী কন্যাকে কি জবাব দিবে। নাকি শুধুই চুপ থাকবে। আজাদও তো কথার তেমন একটা জবাব দিত না। চুপচাপই থাকতো।
আজাদ নিখোঁজ এটাই সত্য এখন। তার নিখোঁজ সংবাদই বাতাসের কানে ফিসফিসিয়ে ঘুরে। তার স্ত্রী বুকে প্রতিমুহুর্তে আঘাত করে, মেয়ের বুক চীড়ে নেমে আসে দীর্ঘশ্বাস, অশ্রুসিক্ত হয়।

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.