জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কবিতা লিখে যেতে চাই ।। বিদ্যুৎ ভৌমিক

কি বলবো বলুন তো ! প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্যেও কখনোসখনো এক অদ্ভুত সময়ের কাছে এসে চুপ করে দাঁড়াই ! একটা জটিল নৈশব্দ্য গুম হয়ে থাকে সমস্ত চারপাশটায় ! কোথাও কিছু পুড়ে ওঠার গন্ধ যেন নামহীন পৃথিবীর মত মনে হয় ! সেই মূহুর্তটা কিভাবে সামনে এসে দাঁড়ায়, আমি নিজেও ঠিক অনুধাবন করতে পারি না সংসারের পরিচিতি বোধের আয়োজন মনকে এবং আমার নামহীন আত্মাকে জড়িয়ে থাকে, তার থেকে মুক্ত হয়ে মন যেন দৌড়ে চলে অন্য এক বোধের জগতে ! সেই বোধের ব্যাপ্তি এতই অপরিসীম যার মধ্যে ভেসে ওঠে দর্পণে জড়ানো সুখ-দুঃখ-দহন-পীড়া-যন্ত্রণা-আড়াম এবং সর্বোপরি পুরানো প্রেম ভালোবাসা ! এই বোধের জগতকি কেবলই স্বপ্নময়, কিম্বা অন্য কিছু ?
                  কিছুদিন আগে কপালে তিনটে ছায়ার মত দাগ
                  লেগেছিল
                  অস্তিত্ব আপৎকালীন বিপর্যয়ে অস্থির
                  তখন সময় নোখের ধুলো ঘেঁটে অবিশ্বাস এবং দুস্তর
                  আঘাতে মৃত্যু নিয়ে দাঁড়িয়ে!
                  এই অবহেলায় গুড়িয়ে যায় ভালো করে না - দেখা
                 প্রতিটা স্বপ্ন, ১২ই সেপ্টেম্বর সিঁড়িভাঙা অঙ্কের
                  মধ্যে ভীষণ গোলমেলে
                  অথচ কবিতার ভেতর - ভেতর অনেক কথা কবেই
                  বলা হয়ে গেছে
                  গতিপথ; আমি পাশ ফিরে বিপরীতে !
                  অবশেষ লাশকাটা ঘরে
    (নির্বাচিত কবিতা, কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া এই কবিতা পংক্তি)
 
সত্যি বলতে কি, আমার কবিতাকে কেউ যদি স্পর্শ করে দেখে, কি পাবে জানিনা তবে মস্ত একটা আকাশকে পেলেও পেতে পারে আমি কেমনভাবে জীবন মৃত্যুর সামনে নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, তার চোখের সামনে সেই ছবিটাও স্পষ্ট হয়ে উঠবে ! এইযে আমি নিজেকে অহর্নিশ বিপন্ন করে, নিজেকে যন্ত্রণার আগুনে- পুড়িয়ে যে সত্যের সন্ধান আমি পেয়েছি, সেই অমোঘ সত্য আমার অনুভূতির তীব্রতায় তাকে সাজিয়ে পাঠক বন্ধুদের কাছে পৌঁছে দিতে পারাই আমার কাজ আমি আদ্যোপান্ত সারাজীবন এই কাজটাই করে যেতে চাই
                       নিঃশব্দ; এই মৃত্যু শয্যায়
                       চোখের পাতাগুলো অন্ধকারুকাজে
                       অতল বিপথে রোজ বৃষ্টিতে ভেজে  !
                       মুখোশের মুখগুলো বিবেকহীন ঝাঁপ দেয়
                       নিরালা শরীরে এবং নেশাতে মাতে কৃষ্ণপক্ষের
                       পারিজাত আলো
                       সময় গর্ভ ফুঁড়ে স্পর্শপ্রমাদ দ্বিতলের জীবাণু নিয়ে
                       উড়ল হাওয়ায়
                       আপাতত বড় হোক আমার বিশ্বাস
                       সমতল কাঁদায় বিখ্যাত গুহাচিত্র দেখিয়ে
                        দিগভ্রমে ডুবু-ডুবু অসমসাহসী; আমার জ্যোৎস্না-
                       অথচ সহস্র রাস্তার নীল রাতগুলো
                       কবে থেকে নিজেরাই অচেনা!
                       প্রথম উপেক্ষা আছে দুর্ভেদ্য চোখে, সে কথা
                       জানেকি মধুশ্রী ? নবীন ডানায় উড়ে রোদ্দুরে পোড়ে
                       তার অলস বিকেল বিস্মৃতির যন্ত্রণা দাগ ফেলে
                       প্রতিদিননতুন কেনা দর্পণে!!
 (কথা না রাখার কথা, কাব্যগ্রন্থ থেকে বিদ্যুৎ ভৌমিকের কবিতা)
 
সেই জীবন যে জীবন অলৌকিক বলে কিছু ছিল না স্বপ্নহীন এক মহানরকের অন্ধকার অবক্ষয়ের মধ্যে নিরন্তর যুদ্ধরত এক জীবন যার সবটাই বাস্তব অলীক এবং মাননীয় আমি মনে করি, কবিতার ভেতরে আমি যেন সবটুকুই অপ্রকৃত অথচ ভীষণভাবে জীবিত আকাশ এখানে কালো, এখানে চরাচর পচা দুর্গন্ধঅভিশপ্ত বর্ণহীন দীন মানুষজন এরই মধ্যে কখনও দু'য়োরানী পৃথিবীকে একটি নতুন জীবনের উপহার দিলেন জন্ম হল ষিশু নামের একজনের! বেথেলহেমের গোয়ালঘরের যীশু না কি সেই তৃতীয় বিশ্বের এক হতভাগ্য শিশুর ! এই সব চিন্তা মাঝেমধ্যে এই মুন্ডুতে কিলবিল করে, কেন করে জানিনা, তবে করে ! ভারতীয় কবিতার সমকালীনতা বলে কিছু নেই কেননা তাদের নিজস্ব কোনো সংকট অনুভূতিতে নেই আমি মনে করি শিল্পকলাতেললিতকলার যে বিয়েনাল, ট্রীয়েনাল হয় তা হয় বিশ্বের তৃতীয় শ্রেণীর ছবি নিয়ে সেই ছবি দেখা এবং দেখে কীভাবে আধুনিক হওয়া যায় তারই চেষ্টা আর কি! রাজনৈতিক নেতাদের যেমন আদর্শের চেতনা চলে গেছে, সেরকম শিল্পী-কবিদের মধ্যেও সৃষ্টির চেতনা প্রায় যেতে বসেছে আরকি! বিদেশে যেমন দেখছি ইন্সটলেশন হচ্ছে এখানেও তা শুরু হয়ে গেছে অজুহাত দেওয়া হচ্ছে প্রযুক্তির জন্য পৃথিবীটা ছোটো হয়ে গেছে যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে ওই উন্নত সাতটা দেশে এখানকার অনুরণন মেলে না কেন
 
আমাদের জীবন তো ইয়োরোপের মতো হয়নি ভারতবর্ষ একটা নোংরা দেশ ইংরেজরা আসার পর আধুনিক হবার সুযোগ ছিল, সেটা আমরা নিইনি ভীষণ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন থেকেছি সত্যিকি, আমাদের কোনো সামাজিক চেতনা তৈরী হয় নিএরই মধ্যে বিদ্যাসাগর, রামমোহন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিৎ ও অমর্ত্য সেন প্রমুখরা কিছু দিয়ে গেছেন এবং দিচ্ছেন কিন্তু এই মানবতার মধ্যে জাতীয়চেতনার অভাব থেকে গেছে এখনওআমারা অবৈজ্ঞানিক ভাবে জীবনযাপন করি এই অবস্থা ভারতে সব সময় ছিল         
 
যাই হোক আপনাদের কাছে একটু ঝেড়ে কাশতে আমার ভালো লাগে কবিতা নিয়ে যে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি, একমাত্র কারণ আপনাদের পাশে পাই বলেই প্রত্যেকদিনই কোনো না কোনো মিডিয়াতে না হয় পত্র পত্রিকায় আমার সাক্ষাৎকার দিতে হয়এক কথায় কি চিরে ভেজে বলুন ? সত্যিই বলতে কি, একটা ভালো কবিতা লেখার পর যখন পাঠকদের উচ্ছাস দেখি, তখন মনে হয়হ্যাঁ কিছু হয়েছে  ! সব শেষ একটা কবিতা দিচ্ছি এই লেখাটা পড়ে মতামত দেবেন বন্ধু
           বস্তুতঃ এই নদীর দেশে কবিতা নাকি অভাগীর ছায়া
           তাই সূর্যালোক থেকে চতুর রঙের এক পুরুষ এসে
           জলচৌকিতে দাঁড়ায়
           এসব দর্পণে একান্তে দেখছিল নীল মাছি !
           ওই অবাক দর্শনটুকু ওর চোখের জ্বালায় অঘোর হিমে
           এক আকাশ আগুন সাজিয়েছে
           বস্তুতঃ আপাময় ওই ঢেউয়ের ভেতর অপ্রস্তুত ঘেমে
            উঠেছিল কৃষ্ণকোকিল !
           সঠিক বিন্যাসে নিপাট বিজ্ঞাপন দেখায় অবাধ্য বিষক্রিয়া
           তাই জাদুদন্ড ঠেকিয়ে মৃত্যু এসে নিঃশব্দে আবিষ্কার করে
            পরবর্তী রহস্য
            চরিত্র নিয়ে ধুন্ধুমার ওই বোকাবাক্সে
            এই দেশে রক্তের রঙ লাল হোলো কিভাবে,
           বলুন পিতামহ ? বস্তুতঃ এই নদীর সঙ্গে অষ্টাদশী নারীর
            অথবা ওই কবিতার সঙ্গে একপাত্র বিদেশী ধেনো;
            চমৎকার কম্বিনেশন  ! বেঢপ লজ্জায় পোশাক পরে
            এদেশের গাছ-পাখি-উদ্ভিন্না পতঙ্গজাতি
            বস্তুতঃ পথের নির্দেশ হাড়কাটা গলি; নয়তো বারদুয়ারী!
(কাব্যগ্রন্থ> কথা না রাখার কথা, থেকে কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক )

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.