আরে ও রিক্সা ওয়ালা তুই ধীরে ধীরে চালা ।। চন্দ্রশিলা ছন্দা

উদ্বেলিত ভারত সাগরের প্রভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠা বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ কিংবা অকারণ টিপটিপ বৃষ্টি শেষে মন কেমন করা মেঘলা দুপুরে রিক্সা ভ্রমণ ছিল আমার খুব প্রিয় একটি সখ। বিয়ের পরপর সংসার শুরু হলো বগুড়ায়। অপরিচিত নতুন শহর। কোথাও বেড়াতে যাবো এমন কেউ ছিলো না। তখন অফিস শেষে প্রায়ই আমরা স্বামী-স্ত্রী রিক্সায় ঘন্টা চুক্তি করে ঘুরতাম। কখনো শহরের ভেতরেই ওলিগলি চিনে রাখার প্রয়োজনে। কখনো শহরের বাইরে হাইওয়ের দিকে একটু নিরিবিলিতে প্রেমের স্বাদ নিতে। তখন ত্রিশ টাকায় একঘন্টা প্রচুর ঘোরা যেতো। রিক্সা ঘোরার সুবিধা হলো খোলা আকাশটা নিজের মত করে উপভোগ করা যায়। মাথার উপর উপুড় আকাশে মেঘদের দল বেঁধে ছুটে চলা। কিংবা মধ্য আকাশে নিসঙ্গ চিলের অলস ডানায় মন হারিয়ে কবিতার উপাদান প্রাপ্তি বাড়তি মাত্রা যোগ করতো। যেতে যেতে পথের ধারে বেশ লাগতো ঘাসদের সবুজ হয়ে ওঠা দেখতে। নবজাতক পাতায় প্রাণোবন্ত শাখা প্রশাখা। বুকের ভেতরে জমাট বেঁধে থাকা গুমোট কালো মেঘটা মিশে যেতো এই সব দৃশ্যে, বাতাসে। সেই ১৯৯১ এর ধারাবাহিকতা নতুন করে চালু করেছিলাম ঢাকায় এসে। সেই পুরাতন সমস্যা! বেড়ানোর জায়গা নেই। আত্মিয়র বাসায় বাচ্চারা যেতে খুব একটা পছন্দ করে না। তখন আবার শুরু করলাম রিক্সায় ঘন্টা চুক্তি। এক রিক্সায় ছেলে মেয়ে আর আমি একসাথে কখনো ভাসানটেক হয়ে সি এম এইচ, ক্যান্টনমেন্ট মসজিদ চত্তরে। কখনো শাহীন স্কুলের দিকের রাস্তায়। হালকা শীতের পড়ন্ত বিকেলে রিক্সায় দুষ্টুমি করতে করতে পাখিদের কূজনে মন উধাও হয়ে যেতো! কী যে মধুময় সেই পাখিদের ঘরে ফেরার উল্লাস! এতো পাখি, এতো কিচিমিচি আমি জীবনে কখনো কোন গ্রামেও শুনিনি। শুধু ওই কূজনের লোভে এক-দুই দিন পর পরেই চলে যেতাম তিন মা ছেলে। একদিন এক পাগলাটে বান্ধবী লাবনীর সাথে রকম ঘন্টা চুক্তি করে স্বর্ণালী হয়ে সৈনিক ক্লাবের রাস্তা দিয়ে কচুক্ষেতে আসবো বলে দুজনে ঘুরতে বের হলাম। আমরা কিন্তু বেশ ভীষণ গল্পেই মগ্ন। এরই মাঝে হঠাৎ লাবনী রিক্সাওয়ালাকে বলে বসলো, ভাই তুমি গান গায়তে পারো? একটা গান শোনাও তো। রিক্সাওয়ালা কি মজা পেলো আল্লাই জানে, সে জিদ করে বসলো কম করে দুটো গান শোনাবে সে। কারন প্রথম গানে গলা খোলে না। আমার তো বিরক্ত এবং ভয় দুটোই করতে লাগলো। কারন কিছু দূর পর পরেই আর্মিদের ব্যারাক। ক্যান্টিন। ওদিকে রিক্সা ওয়ালা গান শুরু করে দিয়েছে। ক্যান্টনমেন্ট এরিয়ার পরিষ্কার ঝকঝকে শুনশান আভিজাত্যপূর্ণ রাস্তায় দুজন সুন্দরী যাত্রীকে নিয়ে রিক্সাওয়ালা প্যাডেল মারছে আর হাপিয়ে হাপিয়ে গান গায়ছেসে এক অদ্ভুরে দৃশ্য! কোন আর্মি যদি রিক্সা থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরুকরে দেয় তখন কি বলবো এই চিন্তায় লাবনীর উপর আমার সাংঘাতিক রাগ হচ্ছিলো! আবার সব মিলিয়ে বিষয়টা এতো হাস্যকর যে, হাসি কন্ট্রোল করাও কঠিন হয়ে পড়েছিলো। পরে একটা ক্যান্টিনে চা খাবার বাহানায় চুক্তি ভেঙে রিক্সা বিদায় করে অন্য আর একটি রিক্সা নিয়ে যন্ত্রনা মুক্ত হলাম।
রিক্সা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান যানবাহনই বলা যায়। বলা যায় এটা আমাদের সংস্কৃতির একটা ঐতিহ্যবাহী অংশ হয়ে গেছে। কত গান, কত চলচ্চিত্রে রিক্সাওয়ালার চরিত্র এসেছে। যদিও এটা কিছুটা অমানবিক মনে হয় আমার কাছে। আর এই অমানবিক অনূভূতিটা আমি প্রথম অনুভব করি ১৯৯৮ সালে কলকাতা গিয়ে। কলকাতা নিউমার্কেটের আশেপাশে প্রচুর রিক্সা। কিন্তু ওই রিক্সা গুলো দুই চাকার। রিক্সাওয়ালা প্যাডেলে চাপ দিয়ে চালিয়ে নেয় না। দৌড়ে কিংবা দ্রুত হেঁটে হেঁটে টেনে নিয়ে যায়। এটা আমার কাছে এতোটা অমানবিক লেগেছিলো যে মানুষ মানুষকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমি উঠতে পারিনি ওই রিক্সায়। পায়ে হেঁটে নিউমার্কেট থেকে মুসলিম ইন্সিটিটিউটের হোটেলে এসেছিলাম। অনেক পরে জিজ্ঞাসা করে জেনেছি, ওরা ওদের ওই পায়ে হেঁটে টেনে বয়ে চলা রিক্সা বা টাঙার ঐতিহ্য রক্ষার জন্য নাকি আন্দলোনও করেছে। সরকার একবার এটা তুলেই দিতে চেয়েছিলো। পারেনি। সেই টাঙাওয়ালা যখন মধুর করে বললো, দিদি মানবতার কারনে যদি আপনার মত কেউ- আমাদের রিক্সায় না ওঠেন, তাহলে আমরা তো না খেয়ে মারা যাবো। মানবতার বিপর্যয় সেখানে আরো বেশি হবে দিদি। কথাটা শুনে চোখে পানি এসে গেলেও তখন উঠেছি শেষমেস। আর এখনো প্রতিদিন মেয়ের স্কুলে যাওয়া আসার সময় খুব দর কষাকষি করে রিক্সায় উঠি বটে, কিন্তু কি এক অদৃশ্য অদ্ভুত মায়ায় ভাড়ার থেকে দু-পাঁচ টাকা বেশি না দিলে খচখচ করে মনটা। তবে এখন ঢাকার রাস্তার যা বেহাল অবস্হা! এখন আনন্দের বদলে ভীষণ কষ্ট হয় ভাঙা রাস্তায় রিক্সা ঘুরতে। তাই আর ঘন্টা চুক্তি করে বহুদিন যাওয়া হয় না কোথাও।

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.