আহমদ বাসির স্মরণে ।। মুহম্মদ মতিউর রহমান
মাত্র
চল্লিশ বছরের এক প্রতিভাবান, সম্ভাবনাময় যুবক। অফুরন্ত প্রাণশক্তি, অদম্য সাহস ও প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত এক টগবগে যুবক। ঈমানী-শক্তিতে বলীয়ান এক দুঃসাহসিক অভিযাত্রী। কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, বক্তা, সংগঠক, সম্পাদক, সমাজকর্মী ইত্যাদি নানা গুণের মিশেলে গড়া এক অমিত সম্ভাবনাময় যুবক। কিন্তু সম্ভাবনার কুঁড়ি প্রষ্ফুটিত হওয়ার আগেই অকস্মাৎ অকালে ঝরে পড়লো। তার এ ঝরে পড়া অযুত প্রাণে গভীর শোকের ছায়া বিস্তার করেছে। বেদনায় বিহ্বল সকলে। মহান রাহমানুর রাহীম জান্নাতের আ’লা মোকামে তাকে পরম শান্তিতে রাখুন।
আহমদ
বাসিরের সাথে আমার পরিচয় প্রায় আড়াই দশককাল আগে। তখন রাজধানী ঢাকা শহরে প্রায় প্রতিদিন সাহিত্য-সংস্কৃতির জমজমাট আসর বসতো। আজ এখানে, তো কাল ওখানে। নবীন-প্রবীণ অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক কর্মীর প্রাণের মেলা বসতো। প্রাণ খুলে কেউ স্বরচিত কবিতা পড়তো, কেউ আবৃত্তি, কেউ আলোচনা করতো, কেউ গলা খুলে গান গাইতো। আড্ডায় বসেই অনেকে কবিতা লিখতো, ঘরে ফিরেও সাহিত্য-চর্চার প্রবল তাড়না অনুভব করতো। সে উত্তাল দিনগুলোতেই বিভিন্ন সাহিত্যের আড্ডায়, আহমদ বাসিরের সাথে আমার পরিচয়। বাসির তখন এক কিশোর বালক। তার স্বরচিত কবিতা পাঠ, আবৃত্তি ও আলোচনা শুনে আমি তার প্রতি মুগ্ধ ও আকৃষ্ট হই। তার ক্ষুরধার ব্যক্তিত্ব, চমৎকার বাচনভঙ্গি, সুন্দর আবৃত্তি, উদ্দীপনাময় যুক্তিপূর্ণ আলোচনা ইত্যাদি সবকিছু সহজেই সকলকে আকৃষ্ট করতো।
আমার
মনে পড়ে, ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একটি আদর্শভিত্তিক সাহিত্য সংগঠন করে সাহিত্য-সভার আয়োজন করতাম। আমাদের উদ্দেশ্যে ছিল সুস্থ সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা করা এবং অন্যদেরকে এতে উদ্বুদ্ধ করা। আব্দুল মান্নান তালিব, আমি, শাহ আব্দুল হান্নান, নুরুল আলম রইসী, এ.কে.এম নাজির আহমদ, ইউসুফ আলী, মোসলেম আলী, সালেহ উদ্দিন জহুরী, সে সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলাম। অসংখ্য নবীন-প্রবীণদের নিয়ে ষাটের দশক জুড়ে সাহিত্য-সভা, সেমিনার ইত্যাদি নানা অনুষ্ঠান করেছি। তারপর আমি দীর্ঘকাল বিদেশে ছিলাম। বিদেশেও আমার কাজের ফাঁকে বাংলাদেশ স্কুল প্রতিষ্ঠা, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠন, বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠান উদ্যাপন, দেশী এবং প্রবাসী বাংলাদেশী কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে সাহিত্য সভা, সম্মেলন, পুস্তক প্রদর্শনী ইত্যাদির ব্যবস্থা করেছি।
দীর্ঘ
বিশ বছর পর দেশে ফিরে এসে দেখি, ষাটের দশকে আমরা যে চারাগাছ রোপণ করেছিলাম, তা দিনে দিনে পত্র-পুষ্প-পল্লবে সুশোভিত হয়ে উঠেছে। আব্দুল মান্নান তালিবের নেতৃত্বে ‘বাংলা সাহিত্য পরিষদ’, মাহবুবুল হকের নেতৃত্বে ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর কালচার’, কবি মতিউর রহমান মল্লিকের নেতৃত্বে ‘সাইমুম’, ‘প্রত্যাশা প্রাঙ্গণ’, নাজির আহমদ ও কবি মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে ‘মাসিক কলম’, ‘পৃথিবী’ তথা ‘বাংলাদেশ সংস্কৃতি কেন্দ্র’ ইত্যাদি নানা সংগঠন। এ যেন বিচিত্র বর্ণ-গন্ধময় এক বর্ণাঢ্য কানন।
অলিরা
যেমন ফুলের সুঘ্রাণ খোঁজে, আমি তেমনি সব কাননে ঘুরে ঘুরে বিচিত্র ফুলের সুঘ্রাণ নিতে লাগলাম। তখন এসব অনুষ্ঠানে নিয়মিত আসতেন মনীষী দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, সৈয়দ আলী আহসান, ড. সৈয়দ আলী আশরাফ, অধ্যাপক শাহেদ আলী, ড. আসকার ইবনে শাইখ, সানাউল্লাহ্ নূরী, মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্, কবি আব্দুস সাত্তার, কবি আল মাহমুদ, শাহাবুদ্দিন আহমদ, কবি আব্দুল মান্নান সৈয়দসহ অনেক জ্ঞানী-গুণী মানুষ। প্রতিভাবান তরুণদের আনাগোনা ছিল অধিক। তারা অনেকেই সাহিত্যচর্চা করে এখন খ্যাতিমান হয়েছেন। তবে এখানে যাঁদের নাম উল্লেখ করলাম, তাঁরা একে একে সকলেই এ নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। আব্দুল মান্নান তালিব বিদায় নিয়েছেন ২০১১ সালে। তরুণদের মধ্যেও কবি গোলাম মোহাম্মদ, কবি মতিউর রহমান মল্লিক চলে গেছেন। সম্প্রতি ১৯ নভেম্বর, ২০২০ তারিখে আহমদ বাসিরও বিদায় নিয়ে চলে গেল।
আহমদ
বাসির ছিল এক লড়াকু সৈনিক। যতদুর জানি, সে একজন অবস্থাপন্ন পরিবারে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও শুধুমাত্র সাহিত্য-সংস্কৃতি করার সংকল্প নিয়ে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নানা প্রতিকূল অবস্থা, অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্ট ও দারিদ্র্যের সাথে প্রাণপণ সংগ্রাম করে জীবন কাটিয়েছে। বিশ্বাসে স্থিতধী, সংকল্পে অটল এবং লক্ষ্যে পৌঁছবার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে অনেকটা নীরবে, নিভৃতে, নিঃসঙ্গ, নিঃসম্বল অবস্থায় সে জীবন অতিবাহিত করেছে। নিজে দারিদ্রাবস্থায় জীবন কাটানোর ফলে দরিদ্র-অসহায় সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অসহায়ত্বের বিষয় সে উপলব্ধি করতো এবং তাদের পাশে দাঁড়িয়ে কিছু একটা করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছে। তার চেষ্টা কতটা সার্থক ও ফলবতী হয়েছে, জানি না। কিন্তু তার স্বপ্ন-প্রত্যাশা ও সংকল্পের দৃঢ়তা নিশ্চয়ই রাহমানুর রাহীমের নিকট কবুল হয়েছে এবং অন্যদের জন্য তা অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
আহমদ
বাসির এক তরুণ-প্রতিভাবান যুবক। তার বিশ্বাস ছিল প্রগাঢ়। সে এক সুন্দর, শান্তিপূর্ণ, কল্যাণময় সমাজের স্বপ্ন দেখতো। তার সে স্বপ্ন পূরণের যোগ্য করে তোলার জন্য সে নিজেকে যথাসাধ্য গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। প্রচুর লেখাপড়া করতো, সব বিষয়ে ছিল তার আগ্রহ। আধুনিক দৃষ্টিতে যুক্তিপূর্ণভাবে সবকিছুর সুন্দর সমাধান খুঁজে বের করার ঐকান্তিক প্রবণতা ছিল তার মধ্যে। সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মনন চর্চার ক্ষেত্র ছিল তার জগত। সে জগতে সে ছিল একজন অত্যন্ত সৃষ্টিশীল মানুষ। লেখা, বক্তৃতা, সংগঠন ও সেবার মাধ্যমে সে তার ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছার প্রাণপণ চেষ্টায় নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এমন একজন নিঃস্বার্থ, নীরব ও আদর্শবাদী কর্মীর অকালে বিদায় গ্রহণ নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য এক অপরিসীম মর্মবেদনার কারণ।
আহমদ
বাসির এক স্বপ্নের জগতে বসবাস করতো। সৃষ্টিশীল প্রতিভাবানদের সকলেরই একটা স্বপ্ন থাকে। সে স্বপ্ন একান্ত ব্যক্তিগত। কিন্তু সংবেদনশীল প্রতিভাবানদের স্বপ্ন ব্যক্তিকে নয়, দেশ-জাতি ও সমাজকে নিয়ে, শুধু বর্তমানকে নিয়ে নয়, ভবিষ্যত নিয়েও। আহমদ বাসিরের এমনই এক স্বপ্ন ছিল। হয়তো তার স্বপ্ন ছিল তার জীবনের চেয়েও বড় ও মহৎ। সে স্বপ্নের চূড়া সে স্পর্শ করে যে পারে নি, তা অধরাই রয়ে গেছে। তার আকাশস্পর্শী স্বপ্নের রঙিন জগতে নিঃসঙ্গ বসবাস করে সম্ভবত সে সন্তুষ্টই ছিল। সে যা করতে পারতো, তা সে সম্পন্ন করে যেতে পারেনি। সেজন্য আমরা যেমন নিদারুণ কষ্ট বোধ করছি, যদি তার আরাধ্য কাজ আমরা সবাই সম্মিলিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি, তার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করতে পারি, তাহলে তার আত্মা নিঃসন্দেহে শান্তি পাবে।
আল্লাহ
তার মাগফিরাত দান করুন, তার পরিবার-স্বজনদের প্রতি জানাই আন্তরিক সমবেদনা। আমিন।
আহমদ বাসিরের ইন্তিকালের খবর শুনে মনটা খুব ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। মনের সে অনুভূতি ব্যক্ত করে সেদিন তাকে উদ্দেশ্য করে যে কবিতাটি রচনা করেছি, তা এই:
আহমদ
বাসির স্মরণে
শোক-গীতি
পুষ্পিত কাননে গোলাপ, চামেলি, জুঁই, গন্ধরাজের বর্ণিল উৎসবে
শুভ্র বেলীর কমনীয় কান্তি আমাকে মুগ্ধ করে
গাঢ় সবুজের অন্তরালে শুভ্র পুষ্পের কোমল ফোটে
সে ফুলের বর্ণ-সুষমা জোসনার আলো হয়ে জ্বলে।
নিষ্প্রভ আকাশের নীচে সবুজ কানন জুড়ে
পুষ্পকলিরা ফোটে নিবিড় অন্ধকারে
গন্ধ-বিধুর ধূপ হয়ে রাতের কিনারে
সুগন্ধি ছড়ায় বাতাসে বনে-বনান্তরে।
পুষ্পের সৌরভ ভেসে আসে ক্রমে
বারান্দায়, জানালায়, শার্শিতে, বিছানায়, অলিন্দে
চাঁদ জেগে রয়, জোসনারা আলোর মশাল জ্বালে
ফুলের সৌরভ প্রাণ উন্মনা করে।
ক্লান্ত পৃথিবী ঘুমায় ধানসিঁড়ি নদীর তীরে
ফসলের মাঠ নীরব, নিথর পড়ে থাকে
চরাচরে শংকাকুল বিহঙ্গেরা আশ্রয় খোঁজে নীড়ে
পরিশ্রান্ত পথিক ঘরে ফেরে দিন শেষে।
অপরূপ স্নিগ্ধতায় ফুল ফোটে নিশিরাতে
শুভ্রতায় সমুজ্জ্বল, সুঘ্রাণ বিলায় অকাতরে
তুমি ফুলের শ্রভ্রতা, সতেজতা, আর কমনীয় কান্তি লয়ে
প্রাণের অনিঃশেষ সৌরভ বিলিয়ে গেছো অকৃপণ হাতে।
তুমি ফুলের মত বর্ণ-গন্ধময়, চাঁদের মত স্নিগ্ধতা লয়ে
জোসনার মত কিরণ ছড়াতে সকলের প্রাণে
তুমি আলোকপ্রাপ্ত, আলোর দেশের অভিযাত্রী হলে শেষে
আলোয় আলোময় হয়ে সুগন্ধি ছড়াও আকাশ খিলানে।
বনানী:
১৯.১১.২০
আহমদ বাসিরের ইন্তিকালের খবর শুনে মনটা খুব ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। মনের সে অনুভূতি ব্যক্ত করে সেদিন তাকে উদ্দেশ্য করে যে কবিতাটি রচনা করেছি, তা এই:
শোক-গীতি
পুষ্পিত কাননে গোলাপ, চামেলি, জুঁই, গন্ধরাজের বর্ণিল উৎসবে
শুভ্র বেলীর কমনীয় কান্তি আমাকে মুগ্ধ করে
গাঢ় সবুজের অন্তরালে শুভ্র পুষ্পের কোমল ফোটে
সে ফুলের বর্ণ-সুষমা জোসনার আলো হয়ে জ্বলে।
নিষ্প্রভ আকাশের নীচে সবুজ কানন জুড়ে
পুষ্পকলিরা ফোটে নিবিড় অন্ধকারে
গন্ধ-বিধুর ধূপ হয়ে রাতের কিনারে
সুগন্ধি ছড়ায় বাতাসে বনে-বনান্তরে।
পুষ্পের সৌরভ ভেসে আসে ক্রমে
বারান্দায়, জানালায়, শার্শিতে, বিছানায়, অলিন্দে
চাঁদ জেগে রয়, জোসনারা আলোর মশাল জ্বালে
ফুলের সৌরভ প্রাণ উন্মনা করে।
ক্লান্ত পৃথিবী ঘুমায় ধানসিঁড়ি নদীর তীরে
ফসলের মাঠ নীরব, নিথর পড়ে থাকে
চরাচরে শংকাকুল বিহঙ্গেরা আশ্রয় খোঁজে নীড়ে
পরিশ্রান্ত পথিক ঘরে ফেরে দিন শেষে।
অপরূপ স্নিগ্ধতায় ফুল ফোটে নিশিরাতে
শুভ্রতায় সমুজ্জ্বল, সুঘ্রাণ বিলায় অকাতরে
তুমি ফুলের শ্রভ্রতা, সতেজতা, আর কমনীয় কান্তি লয়ে
প্রাণের অনিঃশেষ সৌরভ বিলিয়ে গেছো অকৃপণ হাতে।
তুমি ফুলের মত বর্ণ-গন্ধময়, চাঁদের মত স্নিগ্ধতা লয়ে
জোসনার মত কিরণ ছড়াতে সকলের প্রাণে
তুমি আলোকপ্রাপ্ত, আলোর দেশের অভিযাত্রী হলে শেষে
আলোয় আলোময় হয়ে সুগন্ধি ছড়াও আকাশ খিলানে।
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments