আলিফ লায়লা : আরব্য রজনী_পর্ব-৬৪
রাজকুমারী বন্দর সম্রাটের কথায় বিচলিত বোধ করে। অনেকক্ষণ মুখে কোনও কথা সরে না। হাত পা হিম হয়ে আসতে থাকে। বুকের মধ্যে ঢ়িব ঢ়িব করতে থাকে। তখনকার সেই শীতশীত হিমেল হাওয়ার দিনেও সে ঘেমে নেয়ে ওঠে। হাড়ে কাঁপুনি ধরে। মনে মনে ভাবে, এখন যদি তাকে বলি, আমি রাজকুমারী বন্দরকে শাদী করেছি, আমার পক্ষে তার এ প্রস্তাব আর গ্রহণ করা সম্ভব না, তখন তিনি নিশ্চয়ই বলবেন, মুসলমান ধর্মশাস্ত্রে নির্দেশ আছে—একজন পুরুষ এক সঙ্গে চারটি বিবি রাখতে পারে। বদর যদি তার প্রথমা হয়, হায়াৎ না হয় হবে দ্বিতীয়া বেগম। তাতে কি অসুবিধা? আর যদি আসল কথা তাকে খুলে বলা যায়, আমি ছদ্মবেশী কামার। অল-জামান। আসলে আমিই রাজকুমারী বন্দর। তখন এই বৃদ্ধ বয়সেও সম্রাটের কামনা বাসনা চেগে উঠবে। তিনি বলবেন, তাহলে আর তোমাকে ছাড়িছি না, সুন্দরী। তুমি হবে আমার পিয়ারের বেগম। আমি হবো তব মালঞ্চের মালাকির। কামের ব্যাপারে বুড়োদের ঘাড়ে ভীমরতি চেপে বসে। আর আমি যদি কামার আল-জামানের ছদ্মবেশেই তার কন্যার পাণিগ্রহণে অক্ষমতা জানিয়ে তাকে প্রত্যাখান করে চলে যাই তবে, এই মুহূর্তেই যত সব স্নেহ ভালোবাসা পলকে প্রচণ্ড আক্ৰোশে ফেটে পড়বে। হয়তো বা এমনও হতে পারে, তার রাজধানী ত্যাগ করার সঙ্গেই সঙ্গেই তিনি আমাকে হত্যা করার জন্য ষড়যন্ত্র করবেন। সুতরাং নানা পস্থা, এই অবস্থায় তার প্রসত আবে আপাতত রাজি হওয়া ছাড়া উপায় নাই। এরপর নিয়তি আমাকে নিয়ে যে-খেলা খেলবে তাই খেলতে হবে। কে বলতে পারে! কারভাগ্যে কি লেখা আছে। সেই বিধি লিপি কেউ কি খণ্ডাতে পারে! সুতরাং ও নিয়ে আর দুর্ভাবনা করে কোনও লাভ নাই। যা হবার তাই ঘটবে। এতে মানুষের কোনও হাত নেই।
বদর মাথা তুলে সম্রাট আরমানুসের দিকে তাকালো। মুখে সলজ্জ স্নিগ্ধ হাসির আভাস। সম্রাট বুঝলেন, শাহজাদা স্বভাবসুলভ ভব্যতায় এই কথার সোজাসুজি জবাব দিতে কুষ্ঠাবোধ করছে। বিনয় বিনম্র কণ্ঠে সে বলতে পারে, এসব ব্যাপারে আমার আর নিজের কি মতামত থাকতে পারে। তাছাড়া, আপনি আমার বাবার পরম বন্ধু। আপনার ইচ্ছা আমার পিতার আদেশতুল্য। আমি তা অপূর্ণ রাখতে পারি না।
বদরের কথায় আনন্দে নেচে ওঠেন আরমানুসু, এই তো সুলতান শাহরিমানের পুত্রের মতো কথা। তাঁর শিক্ষাদীক্ষার কায়দাই আলাদা। তোমাকে যেভাবে তিনি গড়ে তুলেছেন তার নজির মেলা ভার। আজকালিকার দিনে তোমার মতো আচার ব্যবহার আদব কায়দা আমি খুব কম ছেলের মধ্যেই দেখছি, বাবা।
সম্রাট আর ধৈর্য ধরতে পারেন না। তৎক্ষণাৎ দরবার-এ সভা ডাকা হলো। শহরের গণ্যমান্যরা এসে জড়ো হলো। মন্ত্রী, পারিষদ এবং সেনাপতিদের সামনে তিনি ঘোষণা করলেন, খালিদানের বাদশাহ শাহরিমানের একমাত্র পুত্র কামার আল-জামানের সঙ্গে আমার একমাত্র কন্যা হায়াৎ আল নাফুসের বিবাহ আজ সন্ধ্যায় সম্পন্ন হবে। এই দরবারের উপস্থিত নাফুসের বিবাহ আজ সন্ধ্যায় সম্পন্ন হবে। এই দরবারের উপস্থিত থেকে পাত্বপাত্রীর শুভকামনা করতে আহ্বান জানাচ্ছি।
দরবারকক্ষ করতালি-মুখরিত হয়ে উঠলো, সম্রাট আরমানুসের দ্বিতীয় ঘোষণা : আমি বৃদ্ধ হয়েছি, এখন অবসর গ্রহণ করে ঈশ্বরের উপাসনা করে দিন কাটাতে চাই। তাই মনস্থ করেছি, এখন থেকে এই সিংহাসনের অধিকারী হবে। আমার জামাতা কামার আল-জামান। আপনারা আমার প্রতি এতকাল যে আনুগত্য দেখিয়েছেন, আমি আশা করবো, আমাদের এই নতুন সম্রাট-এর প্রতি সেরূপ আনুগত্য এবং মর্যাদা প্রদৰ্শন করবেন।
এবার ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হলো দরবার মহল। সবারই চোখে বিস্ময়—মুহূর্তে আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠলো অভ্যাগতরা। করতালী ধ্বনিতে ফেটে পড়লো দরবার কক্ষ। জনে জনে এসে শাহজাদাকে আতর গোলাপ জল আর ফুল মালা দিয়ে বরণ করতে লাগলো।
রাজধানীতে সেদিন সে কি সমারোহ। খানাপিনা, নাচ গান হৈ হাল্লায় সবাই মাতোয়ারা হয়ে উঠলো। ধনী দরিদ্র সবার কাছেই সেদিন রাজপ্রাসাদের দ্বার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিলো। যে যা পারলো-খেলো। সবাই মুগ্ধ। দু’হাত তুলে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাতে থাকে সকলে—তারা যেন সুখে থাকে, শতায় হয়। শহরের সেরা কাজীকে ডেকে শাদীনামা লেখানো হলো। সেইদিন সন্ধ্যাবেলায় যথারীতি আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দুজনের শাদী হয়ে গেলো। কামার আল-জামানের ছদ্মবেশে বদর হলো হায়াৎ অল নাফুসের নকল স্বামী।
হায়াৎ অল নাফুসকে বদরের শয্যাকক্ষে পৌঁছে দিয়ে এলেন। এ দেশের এ-ই প্রচলিত রীতি। বদর এগিয়ে এসে পাত্রীকে সাদরে বরণ করে নিলো। তার কুসুমের মতো পেলাব একখানা হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বসালো পুস্পপালঙ্কে-নিজেও বসলো তার পাশে। মুখের নাকাবি উঠিয়ে শুভদৃষ্টি বিনিময় করে নিলো। এ-ও প্রচলিত রীতি।
মেয়েটির মুখ আনত, চোখ নিমীলিত। বদর দেখলো, মেয়েটির মুখে এক অজানা আশঙ্কা। চোখে মুখে কোনও হাসি আনন্দের ছাপ নাই, —যেন পাণ্ডু বিবর্ণ। বদর মৃদু কণ্ঠে সোহাগ মাখিয়ে বলে, কই, মুখ তোলো, চেয়ে দেখো—আমি তোমার মতো এত রূপসী না হতে পারি। তবে হত-কুৎসিত নই।
এবার হায়াৎ চোখ মেলে তাকায়। বদরের রূপের তুলনায় তার নিজের রূপ নগণ্য মনে হয়। এমন বেহেস্তের রূপে সে রূপবান, অথচ কত বিনয়—বলে কিনা, তার মতে রূপ নাকি তার নাই? খুশিতে ডগমগ হয়ে ওঠে সে। আনন্দে নেচে ওঠে। হৃদয়। মনে মনে তার শঙ্কা ছিলো, না জানি তার স্বামী দেখতে কেমন হবে। হয়তো কোনও বুড়ো হাবড়ার হাতেই তুলে দেবেন তার বাবা। কিন্তু না, সে আশঙ্কা তার কেটে গেছে। এরকম সুন্দর স্বামী সে পাবে তাও অবশ্য আশা করতে পারেনি।
এমন সময় রাত্রি শেষ হয়ে যাচ্ছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
পরদিন দুশো দশতম রজনীর মধ্যভাগে আবার সে শুরু করে :
বদর তার একখানা হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে আদর করে। এতক্ষণ ভীত চকিত হরিণীর মতো গুটিয়ে রেখেছিলো। না জানি তাকে তার স্বামীর পছন্দ হয়েছে কিনা। এবার সে কিছুটা সাহস পায়। বদর আরও কাছে সরে এসে হায়াৎকে চুমু খায়। হায়াতের সারা দেহ পুলকে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। এক অভূতপূর্ব উত্তেজনায় চঞ্চল হয়ে ওঠে দেহমন। চুম্বনের স্বাদ যে-এমন সে এই প্রথম বুঝলো। খুব ভালো লাগলো। সে ভালোলাগা কোনও ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। একতরফা বদরের চুম্বন সে প্রাণভরে আস্বাদ করলো। কিন্তু প্রতিদানে সে তাকে ফিরিয়ে দিতে পারলো না একটা। ইচ্ছে হয়েছিলো, কিন্তু দুস্তর লজ্জা এসে তাকে নিরস্ত করে দিলো।
আলতো করে দু’হাত ধরে হায়াৎকে সে বিছানায় শুইয়ে দিলো। কপালে ঠোঁটে, গালে, গ্ৰীবায় স্তনে চুমুতে চুমুতে ভরে দিলো বন্দর। সারা গায়ে হাত বুলিয়ে আদর-সোহাগ করতে থাকলো। এক সময়ে সে দেখলো, হায়াৎ ঘুমিয়ে পড়েছে। মুখে তার পরম প্রশান্তি। বদরও এক পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
সকালে ঘুম ভাঙতেই হামামে ঢুকে নিজেকে তৈরি করে নিলো বন্দর। আজ থেকে তার দরবারে বসতে হবে। তার হাতেই শাসন দণ্ড তুলে দিয়েছেন সম্রাট আরমানুস। যথাসময়ে সে সুলতানি গান্তীর্য নিয়ে দরবারে আসে। মন্ত্রী ছুটে এসে তাকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে গিয়ে সিংহাসনে বসায়। দরবারে উপস্থিত আমীর অমাত্য সেনাপতিরা আভূমি আনত হয়ে তাকে অভিবাদন জানায়। বদর সকলকে নিজের নিজের আসন গ্রহণ করতে বলে। তারপর শুরু হয়। দরবারের কাজকর্ম।
দরবারের মন্ত্রী আমীর অমোত্যরা দেখে মুগ্ধ হয়, শাহজাদা কি অদ্ভুত দক্ষতার সঙ্গে সব কাজ কত স্বল্প সময়ে চটপট সমাধা করে দিলো। বদর বললো, আদালতের বিচার পদ্ধতির সংস্কার করতে হবে। অপরাধীকে শুধুমাত্র শাস্তি দিলেই সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কেন মানুষ অপরাধ করে, কারণ অনুসন্ধান করে তার প্রতিকার করতে হবে। অপরাধীকে শাস্তি অবশ্যই দিতে হবে। কিন্তু সেই শাস্তির বিধান দেওয়ার সময় বিচারকের হৃদয় ব্যথায় মথিত হবে-এই-ই হওয়া উচিৎ। বিচারে সন্দেহের অবকাশ থাকলে কারো প্ৰাণদণ্ড হবে না। মনে রাখতে হবে, দেশের প্রতিটি মানুষ তার প্রজা। প্রজা যদি অবিনয়ী, উদ্ধত, স্বৈরাচারী হয়ে পড়ে তার জন্য মূলত প্রশাসনই দায়ী।
এদিকে আরমানুস তার মহারানীকে সঙ্গে নিয়ে কন্যা হায়াৎ আল-নাফুসের মহলে এসে উপস্থিত হন। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে আদর করে মা জিজ্ঞেস করেন, হ্যারে বর পছন্দ হয়েছে তো?
মা জিজ্ঞেস করেন, শুধু এই! আর কিছু করেনি?
—দূর বোকা মেয়ে, সে কথা জিজ্ঞেস করিনি!
মা-বাবা দুজনে চোখে চোখে কি যেন কথা বলে? হায়াৎ বুঝতে পারে না। চিন্তিত মুখে তারা দুজনে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
দরবারের কাজকর্ম সেরে বদর হায়াতের কাছে আসে। হায়াৎ-এর মনে তখন মা-এর ঐসব হেঁয়ালিভরা প্রশ্নগুলো তোলপাড় করছিলো। বদর কাছে এসে হায়াতের ঘাড়ে হাত রাখে, কী ভাবছো, হায়াৎ?
হায়াতের অন্যমনস্কতা কেটে যায়। বদর জিজ্ঞেস করে, বাবা মা দেখা করতে এসেছিলেন?
-কী জিজ্ঞেস করলেন তারা?
বদর এক এক করে হায়াতের সব সাজপোশাক খুলে দু’হাতে চ্যাংদোলা করে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিলো। খুব আলতো ভাবে সে তার গালে একটা ছোট্ট চুমু একে দেয়। জিজ্ঞেস করে পুরুষ মানুষকে খুব ভালো লাগে তোমার?
-সে আবার কী?
হায়াৎকে জড়িয়ে ধরে চুমায় চুমায় ভরে দেয়। হায়াৎ সারা দেহে কি এক রোমাঞ্চ অনুভব করে। উত্তেজনায় কেঁপে উঠতে থাকে। বদর তার গায়ে মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে দেয়।
একসময় তারা দুজনেই কখন ঘুমিয়ে পড়ে।
প্রভাত সমাগত দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
দুশো এগারতম রাত্রে আবার কাহিনী শুরু হয় :
আরমানুস বলে, এখনও তুমি শুয়ে আছে—দেখছি, মা। সারা রাতে কি অনেক ধকল হইতে হয়েছে?
মহারানী জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু তোমার রাতের সেই তোয়ালেটা কোথায়, দেখি। খুব কি রক্ত করেছিলো?
মহারানী বলেন, অতি উত্তেজিত হও না। ঠাণ্ডা মাথায় ভালো করে আগে ভেবে দেখো সব। তার হাত থেকে সিংহাসন কেড়ে নিয়ে দেশ থেকে তাডিয়ে দিলে তার পরিণাম কি হবে ভেবে দেখেছি?
দরবারের কাজ শেষ করে রাত্রে আবার হায়াতের কাছে আসে বদর। গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ রেখে হায়াৎকে সে আদর সোহাগ করতে থাকে। হায়াতের চোখে জল দেখে সে অবাক হয়, কী ব্যাপার, কাঁদছো কেন হায়াৎ? আসতে আমার দেরি হয়েছে বলে?
বদর হাসে, কী আমার গোস্তাকি?
—আমার অনিষ্ট হলে তোমার খুব কষ্ট হবে?
বদর মনে মনে বলে, এই মওক, এখন হায়াৎকে যা বোঝানো যাবে তাই বুঝবে, যা বলা যাবে। তাই সে করবে। মহব্বতের মায়া জালে সে এখন আবদ্ধ। হায়াৎকে আরও নিবিড়ভাবে কাছে টেনে নিয়ে বদর বলে, শোনো, নয়ন তারা, তুমি যেমন আমাকে ভালোবাস, আমি তার কিছু অধিক তোমাকে ভালোবেসেছি। এ ভালোবাসার মধ্যে কোনও গলদ নাই, এ-কথা তো মান?
বদর বলে, আমি একটা কথা বলবো হায়াৎ?
বদর বলে তোমার সঙ্গে যদি আমার ভাই-বোনের সম্পর্ক হয়—তুমি কি দুঃখ পাবে?
বদর এবার আরও এক ধাপ এগোয়, আচ্ছা, হায়াৎ সুন্দরী, ধর, আমি যদি তোমার ভাই না। হয়ে বোন হই? তখন তুমি আমাকে কিভাবে নেবে? তখনও কি তুমি আমাকে এমনিভাবেই ভালোবাসতে পারবে?
বদর ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে বলে, হায়াৎ, তোমাকে একটা মজার জিনিস দেখাবো। কিন্তু তার আগে তোমাকে কসম খেয়ে বলতে হবে, কাউকে সে-কথা বলবে না।
হায়াৎ অবাক হয়, ওমা, এতে সন্দেহ অবিশ্বাসের কি আছে। আমি তো আগেই বলেছি, তোমার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা। তুমি যা বলবে তাই আমি করবো। তুমি যা বারণ করবে তা আমি বলবো কেন? তবু যখন বলছো, কসম খেয়েই বলছি, কাউকে বলবো না-হলো তো।
বদর আর একটা দীর্ঘ চুম্বন একে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। এক এক করে নিজের দেহ থেকে সব সাজ-পোশাক খুলতে থাকে। হায়াৎ বিস্ময় বিস্ফারিত চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে। নিজের সুডৌল স্তন দুটি দু’হাতের থাকায় পুরে বদর হাসতে হাসতে বলে, কী, কী দেখছে? ভাবছো, আমি কি মহা ধড়িবাজ শয়তান? না?
পালঙ্কে উঠে এসে হায়াতের পাশে বসে কামার আল-জামানের সঙ্গে তার প্রথম রাত্রির মিলন থেকে শুরু করে তাঁবু থেকে রহস্যজনক অন্তর্ধান পর্যন্ত আদ্যোপোন্ত সব কাহিনীই সবিস্তারে বলে গেলো।
কিশোরী হায়াৎ মুগ্ধ বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে বদরের বুকে মাথা রাখে। বদর ওর কপালে হাত বুলাতে বুলাতে বলে, নিয়তির কি নির্মম পরিহাস, বোন। আবার কবে–কামার আল-জামানকে ফিরে পাবো, কে জানে। তবে এ বিশ্বাস আছে, আমাদের অন্তরের বন্ধন কেউ ছিঁড়তে পারবে না। একদিন না একদিন তার সঙ্গে আমাদের মিলন হবেই। তাঁর কাছে সদাসর্বদা প্রার্থনা জানাচ্ছি। সে যেন সত্বর। ফিরে আসে। আমার মনের কি বাসনা জান বোন? জামান-এর হবে তুমি দ্বিতীয়া বেগম। আমরা দুই বোন এক সাথে সারাটা জীবন কাটাবো, এই আমার একান্ত ইচ্ছা!
–সে ভার আমার। আমার কথা সে ফেলতে পারবে না। তাছাড়া তোমার মতো রূপসী মেয়েই বা কটা মেলে। তোমাকে পেলে সে খুব খুশিই হবে।
আহ্লাদে আটখানা হয়ে পড়ে হায়াৎ। বদরের নগ্ন দেহখানা নিয়ে খেলা শুরু করে। এবার আর কোনও জড়তা নাই, নিজেই বদরকে চুমু খায়। হাতের মুঠিতে তার সুগঠিত স্তন দুটি পিষ্ট হতে থাকে। হায়াৎ বলে, আচ্ছা দিদি তোমার দুটো তো বেশ বড় বড়। আমার দুটো এত ছোট ছোট কেন?
বদরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঙ্গে সে তার নিজের দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মিলিয়ে মিলিয়ে দেখতে থাকে। হায়াৎ বলে, জান দিদি, আমি আমার দাসীবাদীদের কাছে অনেকবার জানতে চেয়েছি, শরীরের কোন অঙ্গটা কী জন্যে তৈরি, তা সে বেটিরা আমার কথার সোজাসুজি কোনও জবাব দেয়নি। সব সময়ই আকারে ইঙ্গিতে কি সব বোঝাতে চেয়েছে। সেগুলো আমার মাথায় ঢোকেনি। তুমি আমাকে সব বুঝিয়ে দাও তো, কোন অঙ্গটা কি দরকারে লাগে? একদিন একটা মজার ঘটনা ঘটেছিলো। আমি হামামে গোসল করছি, গায়ে সাবান মাখিয়ে দিচ্ছে আমার এক বাদী। তাকে আমি চেপে ধরলাম, আজ তোমাকে বলতেই হবে, আমার শরীরের এই সব অঙ্গগুলো, কী দরকারে লাগে। তা সে বেচারী ভয়ে লজ্জায় কোনও জবাব দিতে পারে না। রাগি না রাগি না, কিন্তু রাগলে আমি আর মানুষ থাকি না। বাঁদরী আমার কথার জবাব দিচ্ছে না দেখে আমার জেদ চেপে গেলো। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে চিৎকার করতে লাগলাম, বল শিগ্গির, বলতেই হবে তোকে। চুপ করে থাকলে আমি ছাড়বো না।
আমার চিৎকারে সারা মহলে তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো। মা ছুটে এলেন, কী? কী হয়েছে? আমন চেঁচাচ্ছো কেন?
তারপর থেকে আমি আর কখনও কাউকে জিজ্ঞেস করতে সাহস করিনি।
বদর বললো, ঠিক আছে, তোমাকে আমি সব শিখিয়ে দিচ্ছি, কোনটা কি কাজে দরকার হয়।
বাকী রাতটুকু বন্দর তাকে কামসূত্রের প্রতিটি স্তর বিষদভাবে বুঝিয়ে দিতে থাকে। এক সময়ে ভোর হয়ে আসে। হায়াৎ উৎকণ্ঠিতভাবে বলে, কিন্তু দিদি সকাল হলে মা বাবা আসবেন। মা আমার তোয়ালে দেখতে চাইবেন। কি হবে?
মহলের এক পাশে পাখীর খাঁচা ছিলো। বদর উঠে গিয়ে একটা পাখী বের করে নিয়ে এসে হামামে গেলো। একটুক্ষণ পরে খানিকটা খুন এনে বললো, এসো, তোমার দুই জংঘায় খানিকটা লাগিয়ে দিই। আর একটা তোয়ালে দাও। মাখিয়ে রাখি। কাল সকালে যখন মা দেখতে চাইবেন। এই রক্তমাখা তোয়ালেটা তাকে বের করে দেখিয়ে দিও! তোমাকে যদি পরীক্ষা করতে চান, দেখতে পাবেন তোমার জংঘায় শুকনো রক্তের ছোপ। বাস, কেল্লা ফতে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়বেন তিনি। খুব বেশি আনন্দ বা দুঃখ হলে মানুষ তার বিচক্ষণতা হারিয়ে ফেলে। এ ক্ষেত্রেও তাই হবে। তোমার জংঘায় রক্তের দাগ দেখার সঙ্গে সঙ্গে তিনি খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠবেন। আর তোমাকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখবেন না।
হায়াৎ বলে, কিন্তু এ সবের কি দরকার? পাখীর রক্ত না লাগিয়ে আমার শরীরের রক্ত তো তুমিই বের করে দিতে পোর, দিদি।
–পারি, কিন্তু দেব না। ওটা কামার আল-জামানের সম্পত্তি। ওখানে আমি হাত লাগাবো না।
পরদিন সকালে বদর যথারীতি কামার আল-জামানের ছদ্মবেশে আবার দরবারে চলে যায়। সম্রাট আরমানুস আর মহারানী এসে হাজির হন হায়াতের মহলে। রাগে ক্ষোভে সাপের মত ফুঁসতে থাকেন সম্রাট। আজ একটা হেস্তনেস্ত তিনি করবেনই। এভাবে মেয়ের জীবনটা তিনি নষ্ট হতে দেবেন না। কিন্তু পলকেই সব রাগ জল হয়ে গেলো। তাঁর। হায়াৎ রক্তমাখা তোয়ালেখানা বের করে মা-কে দেখালো। মা দেখলেন, মেয়ের জংঘায় উরুতে শুকনো রক্তের দাগ।
-ওগো শুনছো, মহারানী আনন্দে চিৎকার করে ওঠেন, আমাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে। জামাই আজ মেয়েকে গ্রহণ করেছে।
সারা প্রাসাদে আনন্দের হিল্লোল বইতে লাগলো। শুভ সংবাদ মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়লো শহরময়। নাচ-গান হৈ-হাল্লায় মেতে উঠলো সকলে। সম্রাট ঘোষণা করলেন, আজ ছুটির দিন, দরবার দপ্তর সব বন্ধ থাকবে। আজ শুধু খানাপিনা আর আমোদ-আহাদ করে কাটাবে সকলে।
রাজকুমারীর রক্তমাখা তোয়ালে নিয়ে জাঁকজমক করে শোভাযাত্রা বেরুলো। শহরের নানা পথ-পরিক্রম করে বিকেল নাগাদ আবার প্রাসাদে এলো। উটের বাচ্চ কাটা হলো, অসংখ্য ভেড়া পোড়ানো হলো। ইতির জনের আজ অবাধ নিমন্ত্রণ। গরীব দুঃখীরা পেটপুরে খেয়ে দুহাত তুলে প্রার্থনা জানিয়ে গেলো, রাজকুমারী যেন চাঁদের মতো সুন্দর পুত্র লাভ করে।
প্রতিদিন যথাসময়ে দরবারে গিয়ে বসে বন্দর। দারুণ বিচক্ষণতার সঙ্গে শাসন কাজ চালাতে থাকে। তার ন্যায়বিচারে প্রজারা খুব খুশি। প্রজাদের শুভেচ্ছা আর ভালোবাসায় তার মন ভরে ওঠে। কিন্তু এত উল্লাস আনন্দের মধ্যেও একটি চিন্তাই তাকে কুরে কুরে খেতে থাকে। কামার অলজামান কবে আসবে? তার নয়নের মণি, তার বুকের কলিজা কোথায় চলে গেলো। সকলের অলক্ষ্যে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
খালিদানে ফিরতে হলে জাহাজ পথে যেতে হবে। আর সব জাহাজই এই এবানী দ্বীপে নোঙর করে। বদর বন্দর সর্দারকে জানিয়ে রেখেছে, যদি কোনও জাহাজ খালিদানের দিকে যেতে থাকে; খুব ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে সে যেন তাকে জানায়।
এদিকে শাহজাদা কামার আল-জামান সেই বৃদ্ধ মালীর ছোট্ট বাড়িতে বসে বসে দিন গোনে। কবে খালিদানের জাহাজ আসবে। কবে সে দেশে পৌঁছবে, তার প্রাণপ্রতিমা বদরকে বুকে পাবে।
আর খালিদানে-শোকার্ত সুলতান শাহরিমান তখন মৃত্যু পথযাত্রী। এবার তিনি সব আশা পরিত্যাগ করেছেন। তার পুত্র কামার-আল-জামান আর বেঁচে নাই। সমস্ত আরব দুনিয়ার প্রতিটি সালতানিয়তে-প্রতিটি শহরে বন্দরে, গঞ্জে গ্রামে তিনি লোক পাঠিয়েছেন। কিন্তু কেউই কোনও খবর আনতে পারেনি। তাই অবশেষে সুলতান শাহরিমানের হুকুমে সারা দেশব্যাপী শোকদিবস পালন করা হলো। পুত্রের স্মৃতির উদ্দেশে তৈরি করা হলো একটা সুউচ্চ মিনার। এই মিনারের একটি স্বল্পপরিসর কামরায় কাটতে লাগলো তার বিষাদ বিষণ্ণ জীবনের শেষের দিনগুলো।
বৃদ্ধ মালীর অন্তরঙ্গ সাহচর্য সত্ত্বেও কামার আল-জামান বিষাদে দিন কাটায়। মালী রোজই সমুদ্র তীরে যায়। যদি কোনও খালিদানের জাহাজ এসে ভিড়ে। কিন্তু শহরটা পশ্চিমীর আক্রমণে বিধ্বংস্ত হওয়ার পর থেকে ভয়ে আর এপথ মাড়ায় না কেউ। তবুমালী আশা ছাড়ে না। নিশ্চয়ই কোনও না কোনও জাহাজ একদিন আসবেই।
একদিন বিকালে, মালী তখন সমুদ্র তীরে গেছে, কামার আল-জামান জানলার ধারে বসে বাগানের দিকে তাকিয়ে নিবিষ্ট মনে তার অতীতের সুখস্মৃতি রোমন্থন করছিলো। এমন সময় পাখীর ঝটপটানীতে সে সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখলো, দুটো পাখীতে প্রচণ্ড লড়াই বেঁধেছে। একটি আর একটিকে পাখারবাড়ি মেরে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে। ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে গায়ের পালক ছিঁড়ে খুঁড়ে দিচ্ছে। এই ভাবে কিছুক্ষণ লড়াই চলার পর একটি পাখী ঝুপ করে নিচে পড়ে গেলো। জামান ছুটে গিয়ে পাখীটাকে হাতে তুলে নেয়। কিন্তু না, সব শেষ হয়ে গেছে। ওপরে তাকিয়ে দেখলো, অন্য পাখীটা উড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। পাখীটাকে মাটিতে নামিয়ে রেখে আবার সে এসে জানলার ধারে বসে। একটু পরে দেখলো, আরও দুটো পাখী উড়ে এসে মৃত পাখীটার পাশে বসলো। ওদের ভাষা বুঝতে পারে না জামান, তবে এটা বেশ পরিষ্কার বুঝতে পারলো, শোকে তারা মুহ্যমান। অনেকক্ষণ ধরে তারা পাখীটার পাশে চুপচাপ বসে রইলো। তারপর ঠোঁট দিয়ে মাটি ঠুকরে ঠুকরে একটা গর্ত খুঁড়লো। মরা পাখীটাকে টেনে এনে গর্তের মধ্যে রেখে মাটি চাপা দিয়ে আবার তারা উড়ে চলে গেলো।
কিছুক্ষণ কেটে গেছে। আবার একটা বিকট চেঁচামেচির শব্দে জামানের তন্ময়ত কেটে যায়। সেই পাখী দুটা ঐ খুনী পাখীটাকে তাড়া করতে করতে বাগানের ভিতরে নিয়ে এসেছে। পাখীটা পালাতে চেষ্টা করছে, কিন্তু ওদের দুজনের সাড়াশী আক্রমণে তা সম্ভব হচ্ছে না। একটি সামনে থেকে অন্যটি পিছন থেকে পাখার ঝাপটা মারতে মারতে এক সময় মাটিতে ফেলে দিলো তাকে। তারপর খুনী পাখীটার মৃতদেহটা টানতে টানতে নিয়ে এলো তারা সেই নিহত পাখীটার কবরের পাশে। দুটিতে মিলে ধারালো ঠোঁট দিয়ে চিলে ফেললো তার পেট।
বেরিয়ে পড়লো নাডিভুড়ি। তারপর ওরা উড়ে চলে গেলো।
এই সময় রাত্ৰি শেষ হয়ে আসছে দেখে শাহবাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments