দয়াময় এলাহির অভিপ্রেত কার্যে বাধা দিতে সাধ্য কার? কার ক্ষমতা তাঁহার বিধানের বিপর্যয় করে? ভ্রাতৃদ্বয় সারানিশা ত্রস্তপদে হাঁটিয়া বড়ই ক্লান্ত হইলেন। জ্যেষ্ঠ বলিলেন, "ভাই, বহু দূরে আসিয়াছি। 'কুফা' হইতে বহুদূর কুদ্সীয়া নগর-এই সেই কুদ্সীয়া।" রাত্রি প্রভাত হইয়া আসিল। একটু স্থির হইয়া বসিতেই ঊষার আলোকে চতুর্দিক নয়নফলকে প্রতিফলিত হইতে লাগিল। ভ্রাতৃদ্বয় এখনো নির্ভয়ে বসিয়া আছেন, প্রকৃতির কল্যাণে, ঘটনার চক্রে কী সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটিয়াছে, তাহার কিছুই জানিতে পারেন নাই। অদৃষ্টলিপি খণ্ডাইতে মানুষের সাধ্য কী? ভ্রাতৃদ্বয় সারাটি রাত্রি ত্রস্ত পদে হাঁটিয়াছেন -সত্য। মনে মনে স্থির করিয়াছেন, বহু দূরে আসিয়া পড়িয়াছি। এস্থলে আর আবদুল্লাহ্ জেয়াদের ভয়ে ভাবিতে হইবে না। হা অদৃষ্ট! তাঁহাদের ধারণা-ভাবনা সম্পূর্ণ ভুল। কুদ্সীয়ার পথ ভুলিয়া সারাটি রাত্রি কুফা নগরের মধ্যেই ঘুরিয়াছেন। এদিকে রাত্রিও প্রভাত হইল। চক্ষের ধাঁধা ছুটিয়া গেল। প্রাণ চমকিয়া উঠিল। জ্যেষ্ঠ বলিলেন, "ভাই আমাদের কপাল মন্দ! হায়! হায়! কী করিলাম! প্রাণপণে পরিশ্রম করিয়া সারারাত হাঁটিলাম, কি কপাল! এই তো সেই, আমাদিগকে যে স্থানে রাখিয়া কুদ্সীয়ার পথ দেখাইয়া গিয়াছেন-এ তো সেই স্থান।" কনিষ্ঠ ভ্রাতাও চমকিয়া উঠিয়া বলিলেন, "হাঁ ভাই! ঠিক কথা! যে স্থান হইতে তিনি বিদায় হইয়াছিলেন, এ তো সেই পথ-সেই পথপার্শ্বের দৃশ্য।"
ঘটিয়াছেও তাহাই। কারাধ্যক্ষ মস্কুর যে স্থানে তাঁহাদিগকে রাখিয়া চলিয়া গিয়াছেন, সারানিশা ঘুরিয়া প্রভাতে আবার সেই স্থানেই আসিয়াছেন।
ভ্রাতৃদ্বয় সেই সময় আকুলপ্রাণে বলিতে লাগিলেন-মোহাম্মদ জ্যেষ্ঠ, এব্রাহিম কনিষ্ঠ, জ্যেষ্ঠ বলিতেছেন, "ভাই এখন উপায়? প্রাণের ভাই এব্রাহিম! এবার আর বাঁচিবার উপায় নাই! এখন উপায়? একবার নয়, দুইবার এইরূপ ভুল! আর আশা কী? ভ্রাতঃ! এইবারে রাজা জেয়াদ আমাদিগকে জীবন্ত ছাড়িবে না।"
এব্রাহিম বলিলেন, "নিরাশ হইয়া এই স্থানে বসিয়া থাকা কথাই নহে। সূর্যোদয় না হইতেই আমরা প্রকাশ্য পথ ছাড়িয়া সম্মুখের ঐ খোরমা প্রভৃতি ফলের বাগানমধ্যে লুকাইয়া থাকি! কোন প্রকারে দিনটা কাটাইতে পারিলেই বোধ হয় বাঁচিতে পারিব। সন্ধ্যা ঘোর হইলে আমরা মদিনার পথ ধরিব।"
মোহাম্মদ বলিল, "ভাই! তবে উঠ, আর বিলম্ব নাই।"
কনিষ্ঠের হস্ত ধরিয়া অতি ত্রস্তপদে নিকটস্থ খোরমার বাগানে যাইয়া দেখিলেন, ছোট-বড় বহু বৃক্ষপূরিত বিস্তৃত ফলের বাগান; বাগানের মধ্যে জলের নহর বহিয়া যাইতেছে। ভ্রাতৃদ্বয় এগাছ-সেগাছ সন্ধান করিয়া নহরের ধারের পুরাতন একটি বৃক্ষের কোটরে দুইদেহ জড়সড়ভাবে এক করিয়া সাধ্যানুসারে আত্মগোপন করিলেন; কিন্তু একদিকে যে ফাঁক রহিল, সেদিকে তাঁহাদের দৃষ্টি পড়িল না। যে সকল বৃক্ষের ছায়া নহরের জলে পড়িয়া ভাসিতেছিল, মৃদুমন্দ বায়ু-আঘাতে ছায়াসকল কখন কাঁপিতেছে, কখনো ক্ষুদ্র-বৃহৎ আকার ধারণ করিয়া জলের মধ্যে যেন ছুটিয়া যাইতেছে। জলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গ সহিত বৃক্ষসকলের ছায়াও হেলিয়া দুলিয়া ছুটাছুটি করিতেছে। ভ্রাতৃদ্বয় যে বৃক্ষকোটরে গায় গায় মিশিয়া বসিয়াছেন, কোটরে প্রবেশ অংশের স্থান অনাবৃত থাকায় তাঁহাদের ছায়া জলে পতিত হইয়া, বৃক্ষচ্ছায়া সহিত কম্পিত, সঙ্কুচিত, প্রশস্ত, স্থূল, সূক্ষ্ম, দীর্ঘ আকারে নানাপ্রকার আকার ধারণ করিতেছিল!
বাগানের এক পার্শ্বে ভদ্রলোকের আবাসস্থান। সেই ভদ্রলোকের বাটীর পরিচারিকা নহরের জল লইতে আসিয়া জলে ঢেউ দিয়া কলসী পূর্ণ করিতে করিতে হঠাৎ বৃক্ষচ্ছায়ার প্রতি তাহার দৃষ্টি পড়িল। বৃক্ষকোটরের ছায়ার মধ্যে অন্য একপ্রকার ছায়া দেখিয়া পরিচারিকা কলসী জলে ডুবাইয়া চিন্তা করিতে লাগিল। বৃক্ষকোটরে কিসের ছায়া-দিব্বি দুটো জোড়া মানুষের মত বোধ হইতেছে। কান, ঘাড়, পিঠ স্পষ্ট দেখা যাইতেছে, -এ কী ব্যাপার! কিছুই স্থির করিতে পারিল না। জলপূর্ণ কলসী ডাঙ্গায় রাখিয়া যে বৃক্ষের ছায়ামধ্যে ঐ অপরূপ ছায়া দেখা যাইতেছিল, এক পা দুই পা করিয়া সেই বৃক্ষের নিকটে যাইয়া দেখে যে, দুইটি বালক উভয়ে উভয়কে জড়াইয়া ধরিয়া একদেহ আকার রহিয়াছে। পরিচারিকা বালকদ্বয়ের অবস্থা দেখিয়া অন্তরে আঘাতপ্রাপ্ত হইল, হৃদয়ে ব্যথা লাগিল। মুখে বলিল,-"আহা! আহা! তোমরা কাহার কোলের ধন? বাছারে! দুইজনে এরূপভাবে এই পুরাতন বৃক্ষের কোটরে লুকাইয়া রহিয়াছ কেন, বাবা? আমাকে দেখিয়া এত ভয় করিতেছ কেন বাপ? আহা বাছা! তোমাদের কি প্রাণের মায়া নেই? ওরে বাপধন! ঐ কোটরে সাপ-বিচ্ছুর অভাব নাই! কার ভয়ে তোরা এভাবে গলাগলি ধরিয়া নীরবে কাঁদিতেছিস্। বাপধন! বল, আমার নিকটে মনের কথা বল, কোন ভয় নাই। বাবা, তোরা আমার পেটের সন্তানতুল্য। দুইখানি মুখ যেন দুইখানি চাঁদের একখানি চাঁদ! বাবা! তোরা কি দুইটি ভাই? মুখের গড়ন, হাতের পিঠের গঠন দেখিয়া তাহাই বোধ হইতেছে। তোরা দুইটি ভাই কি এক মায়ের পেটে জন্মিয়াছিস্ বাপ? কোন্ দুঃখিনীর সন্তান তোরা? বল বাবা-শীঘ্র বল। কার ভয়ে তোরা লুকিয়ে আছিস্?"
ভ্রাতৃদ্বয়ের মুখে কোন কথা নাই। দুই ভাই আরো হাত আঁটিয়া গলাগলি ধরিয়া মাথা নীচু করিয়া রহিলেন।
পরিচারিকা নিকটে যাইয়া মৃদু মৃদু স্বরে সজল চক্ষে বলিতে লাগিল,-"হাঁ বাবা! তোরা কি সেই মদিনার মহাবীর মোস্লেমের নয়নের পুত্তলি-হৃদয়ের ধন-জোড়া মাণিক? তাই বুঝি হবে! তাহা না হইলে এত রূপ 'কুফার' কোন ছেলের নাই, আহা! আহা! যেন দুটি ননীর পুতুল, সোনার চাঁদ, জোড়া মাণিক। বাবা! তোদের কোন ভয় নাই, আমি-আমি অতি সাবধানে রাখিব। রাজবাড়ীর ঢেডরা শুনিয়াছি। সেজন্য কোন ভয় করি না। আমি তোদের কথা কাহার নিকটেও বলিব না। তোরা আমার পেটের সন্তান, আয় বাবা! আমার অঞ্চলের মধ্যে আয়, প্রাণের মাঝে রাখব।"
ভ্রাতৃদ্বয় কোটর হইতে সজলনয়নে বাহির হইয়া পরিচারিকার সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন। দয়াবতী বালকদ্বয়কে গাত্রবস্ত্রের আবরণে ঢাকিয়া আপন কর্ত্রীর নিকট লইয়া গেল।
বালকদ্বয়ের কথা কুফানগরে গোপন নাই। দ্বারে দ্বারে ঢেডরা দেওয়া হইয়াছে-ধরিয়া দিতে পারিলেই সহস্র মোহর পুরস্কার, আশ্রয় দিলে আশ্রয়দাতার প্রাণ তখনই শূলের অগ্রভাগে সংহার,-তাহাতে দ্বিতীয় আদেশের অপেক্ষা নাই। গৃহকর্ত্রী এ সকল জানা সত্ত্বেও দুই ভায়ের মস্তকে চুমা দিয়া অঞ্চল দ্বারা তাহাদের চুজল মুছাইয়া বলিতে লাগিলেন,-"বাবা! তোরা 'এতিম!' তোদের প্রতি যে দয়া করিবে, তাহার ভাল ভিন্ন মন্দ কখনোই হইবে না। আয় বাবা, আয়! আমি তোদের মা, মায়ের কোল থেকে কেউ নিতে পারবে না। তোদের এই মায়ের প্রাণ দেহ থাকিতে তোদের দুইজনকে নিতে পারবে না। আয়! তোদিগকে খুব নির্জন গৃহে নিয়ে রাখি। আর কিছু খাও বাবা! খোদা তোদের রক্ষক।" গৃহিণী দুই ভ্রাতাকে বিশেষ যত্নে এক নির্জন গৃহে রাখিলেন।বিছানা পাতিয়া দিয়া কিছু আহার করাইলেন। প্রাণের ভয়ে ক্ষুধা-তৃষ্ণা থাকিলেও খায় কে? গৃহকর্ত্রী আপন পেটের সন্তানের অনিচ্ছায় যেমন মুখে তুলিয়া তুলিয়া আহার করান, সেইরূপ খাদ্যসামগ্রী হাতে তুলিয়া ভ্রাতৃদ্বয়ের মুখে দিতে লাগিলেন। আহার শেষ হইলে বলিলেন, "বাবা! তোমরা কথাবার্তা বলিয়ো না, চুপ করিয়া এই বিছানায় শুইয়া ঘুমাও। পুনঃ আহারের সময় উপস্থিত হইলে আমি আসিয়া তোমাদিগকে জাগাইয়া খাওয়াইব। তোমরা ঘুমাও, সারারাত জানিয়াছ, আর কত হাঁটাই হাঁটিয়াছ-ঘুমাও, কোন চিন্তা করিয়ো না।"
যে বাড়ির কর্ত্রী দয়াবতী, পরিচারিকাগণও তাঁহারই অনুরূপ প্রায় দেখা যায়। বালকদ্বয়ের কথা কর্ত্রী আর পরিচারিকা ভিন্ন কেহই জানিতে পারিল না।
বাটীর কর্তার নাম হারেস। কর্তা বাটীতে ছিলেন না। কার্যবশতঃ প্রত্যূষেই নগরমধ্যে গমন করিয়াছিলেন। দিন গত করিয়া রাত্রি এক প্রহরের পর আধমরার মত হইয়া বাটীতে আসিলেন। গৃহিণী বিলম্বের কারণ জিজ্ঞাসা করিলে কর্তা বলিলেন, "সে কথা আর কী বলিব। আমার কপাল মন্দ, আমার চক্ষে পড়িবে কেন? সারাটি দিন আর এই রাত্রির এক প্রহর পর্যন্ত কত গলি-পথ, কত বড় বড় রাস্তায়, দোধারী ঘরের কোণের আড়ালের মধ্যে, কত ভাঙ্গা বাড়ির বাহিরে-ভিতরে, কত স্থানে খুঁজিলাম। আমার এ-পোড়া অদৃষ্টে তাহা ঘটিবে কেন? আমি হতভাগ্য, চিরকাল দুঃখ-কষ্টের সহিত আমার ঘনিষ্ঠতা, আত্মীয়তা-আমার চক্ষে পড়িবে কেন? অনটন আমার অঙ্গের ভূষণ, অলক্ষ্মী আমার সংসার ঘিরিয়া বসিয়াছে, শয়তান আমার হিতৈষী বন্ধু সাজিয়াছে, আমি দেখা পাইব কেন? আমার চক্ষে পড়িবে কেন? এত পরিশ্রম বৃথা হইল। সারাটি দিন উপবাস, না খেয়ে কত স্থানেই যে ঘুরিয়াছি দুঃখের কথা কি বলিব? হায় হায়! আমার কপাল! একজনের চক্ষে অবশ্যই পড়িবে, লালে লাল হইবে।"
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments