বিষাদ সিন্ধু : মীর মশাররফ হোসেন_মহরম পর্ব : ২৬তম প্রবাহ


দয়াময়
এলা­হির অভি­প্রেত কা­র্যে বা­ধা দি­তে সা­ধ্য কার? কার ক্ষ­­তা তাঁহার বি­ধা­নের বি­­র্যয় করে? ভ্রা­তৃ­দ্বয় সা­রা­নি­শা ত্র­স্ত­­দে হাঁটিয়া বড়ই ক্লা­ন্ত হই­লেন। জ্যে­ষ্ঠ বলি­লেন, "ভাই, বহু দূরে আসিয়াছি। 'কু­ফা' হই­তে বহুদূর কু­দ্সীয়া নগর-এই সেই কু­দ্সীয়া।" রা­ত্রি প্র­ভাত হইয়া আসিল। এক­টু স্থির হইয়া বসি­তেই ঊষার আলো­কে চতু­র্দিক নয়নফ­­কে প্র­তি­­লিত হই­তে লা­গিল। ভ্রা­তৃ­দ্বয় এখ­নো নি­র্ভয়ে বসিয়া আছেন, প্র­কৃ­তির কল্যা­ণে, ঘট­নার চক্রে কী সা­­ঘা­তিক ব্যা­পার ঘটিয়াছে, তা­হার কি­ছুই জা­নি­তে পা­রেন নাই। অদৃ­ষ্ট­লি­পি খণ্ডা­­তে মা­নু­ষের সা­ধ্য কী? ভ্রা­তৃ­দ্বয় সা­রা­টি রা­ত্রি ত্র­স্ত পদে হাঁটিয়াছেন -সত্য। মনে মনে স্থির করিয়াছেন, বহু দূরে আসিয়া পড়িয়াছি। এস্থ­লে আর আব­দু­ল্লা­হ্ জেয়াদের ভয়ে ভা­বি­তে হই­বে না। হা অদৃ­ষ্ট! তাঁহা­দের ধা­­ণা-ভা­­না সম্পূর্ণ ভুল। কু­দ্সীয়ার পথ ভু­লিয়া সা­রা­টি রা­ত্রি কু­ফা নগ­রের মধ্যেই ঘু­রিয়াছেন। এদি­কে রা­ত্রিও প্র­ভাত হইল। চক্ষের ধাঁধা ছু­টিয়া গেল। প্রাণ চম­কিয়া উঠিল। জ্যে­ষ্ঠ বলি­লেন, "ভাই আমা­দের কপাল মন্দ! হায়! হায়! কী করি­লাম! প্রা­­­ণে পরি­শ্রম করিয়া সা­রা­রাত হাঁটি­লাম, কি কপাল! এই তো সেই, আমা­দি­­কে যে স্থা­নে রা­খিয়া কু­দ্সীয়ার পথ দে­খাইয়া গিয়াছেন- তো সেই স্থান।" কনি­ষ্ঠ ভ্রা­তাও চম­কিয়া উঠিয়া বলি­লেন, "হাঁ ভাই! ঠিক কথা! যে স্থান হই­তে তি­নি বি­দায় হইয়াছি­লেন, তো সেই পথ-সেই পথ­পা­র্শ্বের দৃ­শ্য।"
ঘটিয়াছেও তা­হাই। কা­রা­ধ্য­ক্ষ মস্কুর যে স্থা­নে তাঁহা­দি­­কে রা­খিয়া চলিয়া গিয়াছেন, সা­রা­নি­শা ঘু­রিয়া প্র­ভা­তে আবার সেই স্থা­নেই আসিয়াছেন
ভ্রা­তৃ­দ্বয় সেই সময় আকু­­প্রা­ণে বলি­তে লা­গি­লেন-মো­হা­ম্মদ জ্যে­ষ্ঠ, এব্রা­হিম কনি­ষ্ঠ, জ্যে­ষ্ঠ বলি­তে­ছেন, "ভাই এখন উপায়? প্রা­ণের ভাই এব্রা­হিম! এবার আর বাঁচি­বার উপায় নাই! এখন উপায়? এক­বার নয়, দু­­বার এইরূপ ভুল! আর আশা কী? ভ্রা­তঃ! এই­বা­রে রা­জা জেয়াদ আমা­দি­­কে জী­­ন্ত ছাড়িবে না।"
এব্রা­হিম বলি­লেন, "নি­রাশ হইয়া এই স্থা­নে বসিয়া থা­কা কথাই নহে। সূর্যে­াদয় না হই­তেই আম­রা প্র­কা­শ্য পথ ছাড়িয়া সম্মু­খের খো­­মা প্র­ভৃ­তি ফলের বা­গা­­­ধ্যে লু­কাইয়া থা­কি! কোন প্র­কা­রে দি­­টা কা­টা­­তে পা­রি­লেই বোধ হয় বাঁচি­তে পা­রিব। সন্ধ্যা ঘোর হই­লে আম­রা মদি­নার পথ ধরিব।"
মো­হা­ম্মদ বলিল, "ভাই! তবে উঠ, আর বি­­ম্ব নাই।"
কনি­ষ্ঠের হস্ত ধরিয়া অতি ত্র­স্ত­­দে নি­­­স্থ খো­­মার বা­গা­নে যাইয়া দে­খি­লেন, ছোট-বড় বহু বৃ­ক্ষপূরিত বি­স্তৃত ফলের বা­গান; বা­গা­নের মধ্যে জলের নহর বহিয়া যা­­তে­ছে। ভ্রা­তৃ­দ্বয় এগাছ-সে­গাছ সন্ধান করিয়া নহ­রের ধা­রের পু­রা­তন এক­টি বৃ­ক্ষের কো­­রে দু­­দেহ জড়সড়ভা­বে এক করিয়া সা­ধ্যা­নু­সা­রে আত্ম­গো­পন করি­লেন; কি­ন্তু এক­দি­কে যে ফাঁক রহিল, সে­দি­কে তাঁহা­দের দৃ­ষ্টি পড়িল না। যে সকল বৃ­ক্ষের ছায়া নহ­রের জলে পড়িয়া ভা­সি­তে­ছিল, মৃ­দু­­ন্দ বায়ু-আঘা­তে ছায়াস­কল কখন কাঁপি­তে­ছে, কখ­নো ক্ষু­দ্র-বৃহৎ আকার ধা­রণ করিয়া জলের মধ্যে যেন ছু­টিয়া যা­­তে­ছে। জলের ক্ষু­দ্র ক্ষু­দ্র তর­ঙ্গ সহিত বৃ­ক্ষ­­­লের ছায়াও হে­লিয়া দু­লিয়া ছু­টা­ছু­টি করি­তে­ছে। ভ্রা­তৃ­দ্বয় যে বৃ­ক্ষ­কো­­রে গায় গায় মি­শিয়া বসিয়াছেন, কো­­রে প্র­বেশ অং­শের স্থান অনা­বৃত থা­কায় তাঁহা­দের ছায়া জলে পতিত হইয়া, বৃ­ক্ষ­চ্ছায়া সহিত কম্পিত, সঙ্কু­চিত, প্র­­স্ত, স্থূল, সূক্ষ্ম, দী­র্ঘ আকা­রে না­না­প্র­কার আকার ধা­রণ করি­তে­ছিল!
বা­গা­নের এক পা­র্শ্বে ভদ্র­লো­কের আবা­­স্থান। সেই ভদ্র­লো­কের বা­টীর পরি­চা­রি­কা নহ­রের জল লই­তে আসিয়া জলে ঢেউ দিয়া কল­সী পূর্ণ করি­তে করি­তে হঠাৎ বৃ­ক্ষ­চ্ছায়ার প্র­তি তা­হার দৃ­ষ্টি পড়িল। বৃ­ক্ষ­কো­­রের ছায়ার মধ্যে অন্য এক­প্র­কার ছায়া দে­খিয়া পরি­চা­রি­কা কল­সী জলে ডু­বাইয়া চি­ন্তা করি­তে লা­গিল। বৃ­ক্ষ­কো­­রে কি­সের ছায়া-দি­ব্বি দু­টো জোড়া মা­নু­ষের মত বোধ হই­তে­ছে। কান, ঘাড়, পিঠ স্প­ষ্ট দে­খা যা­­তে­ছে, - কী ব্যা­পার! কি­ছুই স্থির করি­তে পা­রিল না। জলপূর্ণ কল­সী ডা­ঙ্গায় রা­খিয়া যে বৃ­ক্ষের ছায়াম­ধ্যে অপরূপ ছায়া দে­খা যা­­তে­ছিল, এক পা দুই পা করিয়া সেই বৃ­ক্ষের নি­­টে যাইয়া দে­খে যে, দু­­টি বা­লক উভয়ে উভয়কে জড়াইয়া ধরিয়া এক­দেহ আকার রহিয়াছে। পরি­চা­রি­কা বা­­­দ্বয়ের অব­স্থা দে­খিয়া অন্ত­রে আঘা­­প্রা­প্ত হইল, হৃদয়ে ব্য­থা লা­গিল। মু­খে বলিল,-"আহা! আহা! তো­­রা কা­হার কো­লের ধন? বা­ছা­রে! দু­­­নে এরূপভা­বে এই পু­রা­তন বৃ­ক্ষের কো­­রে লু­কাইয়া রহিয়াছ কেন, বা­বা? আমা­কে দে­খিয়া এত ভয় করি­তেছ কেন বাপ? আহা বা­ছা! তো­মা­দের কি প্রা­ণের মায়া নেই? ওরে বা­­ধন! কো­­রে সাপ-বি­চ্ছুর অভাব নাই! কার ভয়ে তো­রা এভা­বে গলা­­লি ধরিয়া নী­­বে কাঁদি­তে­ছি­স্। বা­­ধন! বল, আমার নি­­টে মনের কথা বল, কোন ভয় নাই। বা­বা, তো­রা আমার পে­টের সন্তা­­তু­ল্য। দু­­খা­নি মুখ যেন দু­­খা­নি চাঁদের এক­খা­নি চাঁদ! বা­বা! তো­রা কি দু­­টি ভাই? মু­খের গড়ন, হা­তের পি­ঠের গঠন দে­খিয়া তা­হাই বোধ হই­তে­ছে। তো­রা দু­­টি ভাই কি এক মায়ের পে­টে জন্মিয়াছি­স্ বাপ? কো­ন্ দু­­খি­নীর সন্তান তো­রা? বল বা­বা-শী­ঘ্র বল। কার ভয়ে তো­রা লু­কিয়ে আছি­স্?"
ভ্রা­তৃ­দ্বয়ের মু­খে কোন কথা নাই। দুই ভাই আরো হাত আঁটিয়া গলা­­লি ধরিয়া মা­থা নী­চু করিয়া রহি­লেন
পরি­চা­রি­কা নি­­টে যাইয়া মৃ­দু মৃ­দু স্ব­রে সজল চক্ষে বলি­তে লা­গিল,-"হাঁ বা­বা! তো­রা কি সেই মদি­নার মহা­বীর মো­স্লে­মের নয়নের পু­ত্ত­লি-হৃদয়ের ধন-জোড়া মা­ণিক? তাই বু­ঝি হবে! তা­হা না হই­লে এত রূপ 'কু­ফার' কোন ছে­লের নাই, আহা! আহা! যেন দু­টি ননীর পু­তুল, সো­নার চাঁদ, জোড়া মা­ণিক। বা­বা! তো­দের কোন ভয় নাই, আমি-আমি অতি সা­­ধা­নে রা­খিব। রা­­বাড়ীর ঢে­­রা শু­নিয়াছি। সে­­ন্য কোন ভয় করি না। আমি তো­দের কথা কা­হার নি­­টেও বলিব না। তো­রা আমার পে­টের সন্তান, আয় বা­বা! আমার অঞ্চ­লের মধ্যে আয়, প্রা­ণের মা­ঝে রা­খব।"
ভ্রা­তৃ­দ্বয় কো­টর হই­তে সজ­লনয়নে বা­হির হইয়া পরি­চা­রি­কার সঙ্গে সঙ্গে চলি­লেন। দয়াব­তী বা­­­দ্বয়কে গা­ত্র­­স্ত্রের আব­­ণে ঢা­কিয়া আপন কর্ত্রীর নি­কট লইয়া গেল
বা­­­দ্বয়ের কথা কু­ফা­­­রে গো­পন নাই। দ্বা­রে দ্বা­রে ঢে­­রা দেওয়া হইয়াছে-ধরিয়া দি­তে পা­রি­লেই সহ­স্র মো­হর পু­­স্কার, আশ্রয় দি­লে আশ্রয়দা­তার প্রাণ তখ­নই শূলের অগ্র­ভা­গে সং­হার,-তা­হা­তে দ্বি­তীয় আদে­শের অপে­ক্ষা নাই। গৃ­­­র্ত্রী সকল জা­না সত্ত্বেও দুই ভায়ের মস্ত­কে চু­মা দিয়া অঞ্চল দ্বা­রা তা­হা­দের চু­জল মু­ছাইয়া বলি­তে লা­গি­লেন,-"বা­বা! তো­রা 'এতিম!' তো­দের প্র­তি যে দয়া করি­বে, তা­হার ভাল ভি­ন্ন মন্দ কখ­নোই হই­বে না। আয় বা­বা, আয়! আমি তো­দের মা, মায়ের কোল থে­কে কেউ নি­তে পা­­বে না। তো­দের এই মায়ের প্রাণ দেহ থা­কি­তে তো­দের দু­­­­কে নি­তে পা­­বে না। আয়! তো­দি­­কে খুব নি­র্জন গৃ­হে নিয়ে রা­খি। আর কি­ছু খাও বা­বা! খো­দা তো­দের রক্ষক।" গৃ­হি­ণী দুই ভ্রা­তা­কে বি­শেষ যত্নে এক নি­র্জন গৃ­হে রা­খি­লেন।বি­ছা­না পা­তিয়া দিয়া কি­ছু আহার করা­­লেন। প্রা­ণের ভয়ে ক্ষু­ধা-তৃ­ষ্ণা থা­কি­লেও খায় কে? গৃ­­­র্ত্রী আপন পে­টের সন্তা­নের অনি­চ্ছায় যে­মন মু­খে তু­লিয়া তু­লিয়া আহার করান, সে­ইরূপ খা­দ্য­সা­­গ্রী হা­তে তু­লিয়া ভ্রা­তৃ­দ্বয়ের মু­খে দি­তে লা­গি­লেন। আহার শেষ হই­লে বলি­লেন, "বা­বা! তো­­রা কথা­বা­র্তা বলিয়ো না, চুপ করিয়া এই বি­ছা­নায় শুইয়া ঘু­মাও। পু­নঃ আহা­রের সময় উপ­স্থিত হই­লে আমি আসিয়া তো­মা­দি­­কে জা­গাইয়া খাওয়াইব। তো­­রা ঘু­মাও, সা­রা­রাত জা­নিয়াছ, আর কত হাঁটাই হাঁটিয়াছ-ঘু­মাও, কোন চি­ন্তা করিয়ো না।"
যে বাড়ির কর্ত্রী দয়াব­তী, পরি­চা­রি­কা­গণও তাঁহা­রই অনুরূপ প্রায় দে­খা যায়। বা­­­দ্বয়ের কথা কর্ত্রী আর পরি­চা­রি­কা ভি­ন্ন কে­হই জা­নি­তে পা­রিল না
বা­টীর কর্তার নাম হা­রেস। কর্তা বা­টী­তে ছি­লেন না। কা­র্য­­­তঃ প্র­ত্যূষেই নগ­­­ধ্যে গমন করিয়াছি­লেন। দিন গত করিয়া রা­ত্রি এক প্র­­রের পর আধ­­রার মত হইয়া বা­টী­তে আসি­লেন। গৃ­হি­ণী বি­­ম্বের কা­রণ জি­জ্ঞা­সা করি­লে কর্তা বলি­লেন, "সে কথা আর কী বলিব। আমার কপাল মন্দ, আমার চক্ষে পড়িবে কেন? সা­রা­টি দিন আর এই রা­ত্রির এক প্র­হর পর্য­ন্ত কত গলি-পথ, কত বড় বড় রা­স্তায়, দো­ধা­রী ঘরের কো­ণের আড়ালের মধ্যে, কত ভা­ঙ্গা বাড়ির বা­হি­রে-ভি­­রে, কত স্থা­নে খুঁজি­লাম। আমার -পোড়া অদৃ­ষ্টে তা­হা ঘটি­বে কেন? আমি হত­ভা­গ্য, চি­­কাল দু­ঃখ-কষ্টের সহিত আমার ঘনি­ষ্ঠ­তা, আত্মীয়তা-আমার চক্ষে পড়িবে কেন? অন­টন আমার অঙ্গের ভূষণ, অল­ক্ষ্মী আমার সং­সার ঘি­রিয়া বসিয়াছে, শয়তান আমার হিতৈষী বন্ধু সা­জিয়াছে, আমি দে­খা পা­ইব কেন? আমার চক্ষে পড়িবে কেন? এত পরি­শ্রম বৃ­থা হইল। সা­রা­টি দিন উপ­বাস, না খেয়ে কত স্থা­নেই যে ঘু­রিয়াছি দু­­খের কথা কি বলিব? হায় হায়! আমার কপাল! এক­­নের চক্ষে অব­শ্যই পড়িবে, লা­লে লাল হই­বে।"

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.