আমার দ্বিতীয়বার ইংল্যান্ড সফর_মুহম্মদ মতিউর রহমান : পর্ব-১১
২০ জুলাই, সোমবার
কিছু কেনাকাটা করার জন্য আমরা গেলাম এখানকার বিখ্যাত Oak Park Mall-এ। Oak Park এলাকায় বিশাল জায়গার উপর গড়ে উঠেছে Oak Park Mall-আমরা ঘুরে ঘুরে সব দেখলাম এবং কিছু প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করলাম। প্রত্যেকটা দোকানেই Summer Sale এর মহড়া চলছে। পঁচিশ থেকে সত্তর পার্সেন্ট পর্যন্ত প্রত্যেকটি মালের উপর ছাড়। এদেশে গ্রীষ্মকালে শীতের পোষাক-আশাক চলে না, আবার শীত মওসুমে গ্রীষ্মকালের পোষাক অনুপযোগী। শীত ও গ্রীষ্মের পার্থক্যটা অনেক বেশি। শীতকালে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রিরও অনেক নিচে নেমে যায়। বরফ পড়তে থাকে, তুষারপাত ঘটে। তখন কয়েক প্রস্ত গরম কাপড় না পরলে বাইরে যাওয়া যায় না। ঘরেও ইলেকট্রিক হিটার জ্বালিয়ে রাখতে হয়, নইলে শুধু লেপ-কম্পলে শীত যায় না। গাছপালা পাতাশূন্য হয়ে পড়ে। দেখলে মনে হয়, সব মরে গেছে। কিন্তু বসন্তের আগমনে প্রকৃতি বদলাতে থাকে। গাছে গাছে নানা বর্ণের বিচিত্র ফুলের সমাহার ঘটে। গ্রীষ্মকালে এ দৃশ্য আরো প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। সারা বনভূমি, গাছপালা ঘন সবুজের চাদর পড়ে অপরূপ হয়ে ওঠে। শীতকালের পোষাকের আবর্জনা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে মানুষ তখন হাল্কা-পাতলা হয়। পুরুষেরা অনেকেই তখন হাফ প্যান্ট, সান্ডো পরে ঘুরে বেড়ায় আর মেয়েরা স্বল্পতম পোষাক পরে বুক পিঠ-উরু প্রায় নগ্ন করে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ায়।
ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে তাই দোকনে পোষাক-সামগ্রিও সম্পূর্ণ বদলে যায়। ফলে শীতকালের শেষের দিকে ডরহঃবৎ ংধষব এবং গ্রীষ্মের শেষে ঝঁসসবৎ ংধষব. শীতের শেষে শীতকালীন পোষাক সব দোকান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে এবং গ্রীষ্মের শেষেও তেমনি গ্রীষ্মের পোষাক সরিয়ে ফেলতে হবে। তাই স্বল্প মূল্যে সব বিক্রি করে দোকান খালি করার মহোৎসব।
এখানে প্রত্যেকটি দোকানে ঢোকার সাথে সাথে ঝধষবংমরৎষ বা ঝধষবংসধহ অত্যন্ত বিনয়ের সাথে প্রথমে হাসিমুখে আপনাকে স্বাগত জানাবে। তারপর জিজ্ঞাসা করবে- আপনার পছন্দমত জিনিস বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি? তার সৌজন্যপূর্ণ আময়িক ব্যবহারে আপনি মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না। আবার দোকান ঘুরে ফিরে কিছু কিনেন অথবা না কেনেন দোকান থেকে বের হবার সময় যথারীতি এড়ড়ফহরমযঃ বা এড়ড়ফফধু বলতে তারা কখনও ভোলে না। দোকানে যেকোন মাল কিনে একমাসের মধ্যে আপনি তা আবার ফেরত দিতে পারেন। দোকানী বিনা বাক্যব্যয়ে তা গ্রহণ করে টাকা ফেরৎ দিবে। আমাদের দেশে ক্রয়কৃত মাল ফেরৎ দিতে গেলে প্রথমত দোকানী তা নিতেই চায় না, কোন ক্ষেত্রে ফেরৎ নিলেও টাকা ফেরৎ না দিয়ে সেই মূল্যের অন্যমাল নিতে বলে এবং অনেক ক্ষেত্রে সে মালের দাম একটু বেশিই রাখে। কিন্তু এখানে সম্পূর্ণ অন্যরকম অবস্থা। প্রথমে দোকানী আপনাকে টাকা ফেরৎ দিবে, তারপর আপনার ইচ্ছা হলে সে দোকান থেকে অন্য মাল নেবেন, না হলে নেবেন না। সর্বোতভাবে খরিদ্দারকে খুশী রাখাই এখানকার ব্যবসায়ের মূলনীতি। দোকানীদের সৌজন্যবোধ ও ব্যবহার এত চমৎকার যে, তাতে ক্রেতাদের খুশী না হয়ে উপায় নেই।
আমরা ঙধশ চধৎশ গধষষ- থেকে কিছু কেনাকাটা করে গেলাম ঞযব এৎবধঃ গধষষ নামক আরেকটি মলে। এটাও একটি বিশাল মল। শুনলাম, এখানে নাকি জিনিসপত্র অপেক্ষাকৃত সস্তা মূল্যে বিক্রি হয়। ২০০৬ সনে যখন আমি ও আমার স্ত্রী আমেরিকা এসেছিলাম, তখনও এখান থেকে অনেক বাজার করেছি। তাই এবারও এলাম এবং দেখেশুনে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় সওদা করলাম। বিশাল মলের ভিতরে ঢুকলে মনে হয়, এর কোন শেষ নেই। মলের মাত্র সামান্য অংশ ঘুরতেই আমাদের সময় শেষ হয়ে এল। মাগরিবের ওয়াক্ত হয়েছে গেছে। বাসায় ফিরতে আরো দেরী হবে। তাই গাড়িতে বসেই স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে জামাতে নামায আদায় করলাম।
২১ জুলাই, মঙ্গলবার
এখানকার রাস্তা-ঘাট এত সুন্দর, প্রশস্ত ও নিখুঁত যে, যান চলাচলে কোনই অসুবিধা হয় না। সবাই ট্রাফিক আইন মেনে চলে তাই দুর্ঘটনা খুব কম হয়। অন্তত আমার চোখে আজ পর্যন্ত পড়েনি। কোথাও কোন ট্রাফিক পুলিশ নেই। কিন্তু ট্রাফিক আইন কেউ অমান্য করে না। এখানকার সামাজিক শৃংখলাবোধ এর একটি কারণ হলেও সবচে বড় কারণ সম্ভবত এই যে, প্রত্যোকটি রাস্তায় ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা এমনভাবে ফিট করা আছে যে, কেউ কোন রকম নিয়ম ভঙ্গ করার সাথে সাথে তা রেকর্ড হয়ে যায় এবং তাকে জরিমানা দিতে হয়। সে ভয়েই মূলত কেউ নিয়ম ভঙ্গ করে না।
সে কারণে হাজার হাজার ট্রাফিক পুলিশ নিয়োগের ঝামেলা এবং বিপুল পরিমাণ অর্থব্যয় থেকে সরকার রক্ষা পায়। অথচ ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করলে সেজন্য সবাইকে খেসারত দিতে হয় এবং তা যথারীতি রাজকোষে জমা দিতে হয়। আমাদের দেশে হাজার হাজার ট্রাফিক পুলিশ নিয়োগে একদিকে যেমন কোটি কোটি টাকা খরচ হয়, অন্যদিকে শীত-বর্ষা-গ্রীষ্মে রোদে পুরে, বৃষ্টিতে ভিজে, কনকনে শীতে কাঁপতে কাঁপতে কত কষ্ট করে পুলিশকে ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কর্তব্য পালন করতে হয়। তারপরেও অধিকাংশ লোকেই আইন মান্য করছে না-তারা কেউ পুলিশের চোখ ফাঁকি দিচ্ছে, প্রভাবশালী বা বড়লোক গাড়ির মালিকদের প্রতি পুলিশ চোখ মেলে তাকাচ্ছেও না এবং বাস-চালক, ট্যাক্সি ড্রাইভার ও ছুঁচকে দু’চারজন যারা ধরা পড়ছে, তারাও ট্রাফিক পুলিশের হাতে সামান্য কিছু টাকা তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে পার পেয়ে যাচ্ছে। মনে হয় যেন পুলিশই রাজা-পুলিশকে নজরানা দিয়ে খুশী রাখতে পারলে সাত খুন মাপ। ফলে দেশে ট্রাফিক আইন থাকলেও তা কেউ মানছে না, রাস্তা-ঘাটে সর্বত্র একটা বিশৃংখল অবস্থা। ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করার জন্য যেখানে জরিমানা হওয়া উচিত এবং তা যথারীতি রাজকোষে জমা হওয়া কর্তব্য, সেখানে জরিমানার টাকা পুলিশের পকেটে জমা হচ্ছে। তাতে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে, জণগণের ভোগান্তি বাড়ছে।
আইন যখন কোন বিশেষ ব্যক্তি, শ্রেণী, দল বা গোষ্ঠির হাতে চলে যায়, তখন আর আইনের শাসন থাকে না। সুশাসনের বদলে তখন শুরু হয় কুশাসন। আইনের শাসনের যথাযথ কার্যকারিতা না থাকলে দেশে স্বৈরাচার কায়েম হয়, সন্ত্রাস ও বিশৃংখলার উদ্ভব ঘটে। এ অবস্থায় সমাজের সব শ্রেণীর মানুষকেই দূর্ভোগ পোহাতে হয়। এ দুর্ভোগের শুরুটা সাধারণভাবে কিন্তু তার বিস্তার কীভাবে, সমাজের কতটা গভীরে প্রবেশ করে তা অনুসন্ধান করতে রীতিমত গবেষণার প্রয়োজন হয় এবং নিরসনের উপায় ও পদ্ধতি আবিষ্কারে অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়েও কোন কুল-কিনারা পাওয়া যায় না। আমাদের দেশের অবস্থা এখন অনেকটা এরকমই। সমাজের যেখানে যে বসে আছে, সে নিজেকে সেখানকার প্রভু মনে করছে। মন্ত্রী-উজিররা মনে করেন, দেশের প্রকৃত ক্ষমতা তাদেরই হাতে-তারা যেভাবে খুশি দেশ চালাবেন, আইনের চাকা ঘুরাবেন। মন্ত্রী-উজিরদের স্থাবক-উমেদাররা মনে করেন, মন্ত্রী-উজিরদের তো আমরাই ক্ষমতার মসনদে বসিয়েছি, অতএব সবকিছু এখন আমাদের হুকুম মতই চলবে, আমাদের কথায় প্রশাসন চলবে, হালুয়া-রুটিতে একচেটিয়া অধিকার আমাদেরই। প্রশাসন কর্মকর্তারা ভাবেন, মন্ত্রী-উজিররা একবার একদল আসেন, আরেকবার আরেক দল, কিন্তু আমরা পার্মানেন্ট, আমাদের সরায় কে? তাছাড়া মন্ত্রী-উজিররা তো কেবল বক্তৃতা-বিবৃতি-মিটিং সিটিং করেই খালাস। প্রকৃত কাজের কাজী তো আমরাই। অতএব, আমলাদের মর্জিমত ফাইল নড়াচড়া করে। আর এ কথা কে না জানে যে, ফাইল নিজে থেকে কখনো চলে না, কড়কড়ে নোটের বান্ডিলের তাগদে তা নড়াচড়া করে এবং বড়কর্তা থেকে মেজকর্তা, সেজকর্তা, ছোটকর্তা সকলকেই সে চকচকে নোটের ঝলক কমবেশি সকলকেই পরখ করার সুযোগ পায়। এমনকি, পিয়ন-চাপরাশিরাও সে নিয়ামত থেকে বাদ যায়না, বকশিশের নামে অথবা খুশী করার নামে তারাও সে নজর-নিয়াজের ভাগী হয়।
আমেরিকায় রাস্তায় পুলিশ দেখা না গেলেও যেকোন দুর্ঘটনা বা আপাতকালে মুহূর্তের মধ্যে একাধিক টহল পুলিশের গাড়ি এসে হাজির হয়। দুর্ঘটনা-কবলিত মানুষ, গাড়ি বা ঘটনার উপযুক্ত তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে তারা ত্বরিৎ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তাই যাত্রীরা মোটামুটি নিরাপদেই রাস্তায় চলাচল করে।
অবশ্য কিছু কিছু ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। সকল যান চলাচলের ব্যবস্থা রিমোট কন্টোলের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলেও এখানে কেউ কেউ যে আইন অমান্য করে না, তা নয়। যারা অতিরিক্ত মদ খেয়ে গাড়ি চালায় তারা অনেক সময় এ ধরনের বেআইনি কাজ করে এবং তাদের উপযুক্ত সাজাও হয়। অপরাধ অনুযায়ী জরিমানা, এমনকি, লাইসেন্সও বাতিল হয়। গাড়ির ধাক্কায় কোন পথচারী আহত হলে চালকের দোষ তাতে কতটুকু তা বিচার করা হয়না- তাকে সারা জীবন আহত ব্যক্তির ভরণ-পোষণ, চিকিৎসা খরচ ইত্যাদি বহন করতে হয়। আর গাড়ির ধাক্কা লেগে কারো মৃত্যু হলে, মৃত ব্যক্তির পরিবারের আজীবন ভরণ-পোষণ ও চিকিৎসার দায়িত্ব দুর্ঘটনা সংঘটনকারীকে বহন করতে হয়। সে কারণে এখানে ড্রাইভাররা খুব সাবধানে গাড়ি চালায়। সামনে কোন পথচারী দেখলে, দশ হাত দূরে থাকতেই ড্রাইভার গাড়ি থামায়। পথচারী নিরাপদে পথ পাড়ি না দেয়া পর্যন্ত গাড়ি অপেক্ষা করে।
২২ জুলাই, বুধবার
ক্যানসাস ও মিজোরী-দু’টি পাশাপাশি স্টেটের বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে ক্যানসাস সিটি । সমগ্র ক্যানসাস সিটিকে বলা হয় গ্রেটার ক্যানসাস। এটা একটি প্রাচীন নগরী। অনেক প্রাচীন ঐতিহ্য ও ইতিহাস ধারণ করে আছে এ শহর। এ ঐতিহ্যে ও ইতিহাসের অনেক স্মরণীয় স্মৃতি ধারণ করে আছে এখানকার বিভিন্ন মিউজিয়াম। এসব মিউজিয়ামের মধ্যে কয়েকটি সম্পর্কে নিচে একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া হলো:
১। The Nelson – Atkins Museum of Art. এটা সম্পর্কে আগেই বলেছি।
২। Arabia Steamboat Museum : এটা সম্পর্কেও আগে উল্লেখ করা হয়েছে।
৩। American Jazz Museum-এ E 18th Street অবস্থিত। আমেরিকায় সাধারণভাবে জাজ সংগীত অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিশেষত ক্যানসাসের প্রখ্যাত কয়েকজন জাজ বাদকের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জাজ সঙ্গীত আমেরিকায় বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জনে অবদান রাখে। এদের মধ্যে প্রধান কয়েকজন হলেন বেনি মোটেন , কাউন্ট বেসি , চার্লি পার্কার প্রমুখ। ক্যানসাসের এ নিজস্ব সঙ্গীত শিল্পের ঐতিহ্য ধরে রাখার উদ্দেশ্যে এ মিউজিয়ামের প্রতিষ্ঠা।
৪। National WWI Museum: 100 W 26th Street-এ লিবার্টি মেমোরিয়ালে অবস্থিত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং তার পরিণতি বিষয়ক আমেরিকার একমাত্র মিউজিয়াম।
৫। Kansas City Museum: 3218 Gladstone Bvd. - এ অবস্থিত।
৬। Harry S. Truman Library and Museum: দেলাওয়ার স্ট্রীটে অবস্থিত আমেরিকার ৩৩তম প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান এ লাইব্রেরিটি প্রতিষ্ঠা করেন। ট্রুম্যান ও তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী বেস এখানেই সমাহিত হন। ক্যানসাসে জন্মগ্রহণকারী এ প্রেসিডেন্টের সময়ই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং তিনিই জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোম বিস্ফোরণের আদেশ দেন। তাঁর সময়কার অন্য আরেকটি ঐতিহাসিক ঘটনা হলো, ১৯৪৮ সনে তাঁর নেতৃত্বেই আমেরিকা বৃটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়ার উদ্যোগে মধ্যপ্রাচ্যের আরব ভূখন্ডে দুষ্টক্ষত হিসাবে অবৈধ ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা হয়।
৭। Harry S Truman Home : ২১৯ দেলাওয়ার স্ট্রীটে অবস্থিত। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময় বাদে জীবনের বাকি সময় ট্রুম্যান এ বাড়িতে বসবাস করেছেন। ভিক্টোরিয়ান যুগের এ বাড়িটি এখন একটি বিশেষ দর্শণীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া, এ বাড়ির সাথে রোমান্টিক প্রেমের অক্ষয় স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আসলে যে বাড়িটিকে এখন দর্শনার্থীদের জন্য উম্মুক্ত রাখা হয়েছে, তা ট্রুম্যানের নয়, বরং তাঁর স্ত্রী বেসের বাড়ি। এ বাড়ির পাশেই রয়েছে ট্রুম্যানের বাড়ি। পাশাপাশি দুই বাড়ির দু’জন তরুণ-তরুণী ছোটবেলা থেকে একসাথেই বেড়ে ওঠে। বয়ঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দু’জনের মধ্যে গভীর প্রেমের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। তারপর পরিণয়। বেস ধনী পিতার একমাত্র আদরের দুলালী। তাই বিয়ের পর ট্রুম্যানের আজীবনের স্থায়ী ঠিকানা হলো এ বাড়িটি। এ বাড়িতে ট্রুম্যান দম্পতির শোবার খাটসহ তাঁদের ব্যবহার্য প্রতিটি জিনিস সযত্নে সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।
দর্শনার্থীদের জন্য এছাড়া National Frontier Museum, Negro Leagues Baseball Museum, Strawberry Hill Museam, Thomas Hart Benton Home and Museum, Toy and Miniature Museum, Union Station and Science City Museum ইত্যাদি আরো কয়েকটি মিউজিয়াম রয়েছে। স্থানীয় ও অস্থানীয় অসংখ্য দর্শনার্থী সারা বছর এসব মিউজিয়াম দেখার জন্য ভীড় জমায়।
উপরে উল্লেখিত মিউজিয়ামগুলোতে ক্যানসাসের প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে যেমন ধারণ করা হয়েছে, তেমনি এখানে সব বয়সের মানুষের জন্য কিছু না কিছু শিক্ষণীয় ও কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়ও স্থান পেয়েছে। মূলত সারা পৃথিবীর সব মিউজিয়ামেই একাধারে যেমন মানুষের কৌতুহল নিবারণ করে তেমনি ইতিহাস-ঐতিহ্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা দিতে সাহায্য করে। এসব কারণে সব দেশেই বিশেষত সভ্য ও উন্নত দেশসমূহে অসংখ্য মিউজিয়াম নির্মিত হয়েছে ও সযত্নে সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। ক্যানসাস সিটি মিউজিয়াম ও কলাকেন্দ্রের সংখ্যার দিক দিয়ে সমগ্র আমেরিকায় ২৫তম স্থানের অধিকারী। এটা এ শহরের ঐতিহ্য-উন্নতি ও সভ্যতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন।
এছাড়া, ক্যানসাসের কয়েকটি পার্ক ও চিড়িয়াখানাও বিশেষ দশর্ণীয় স্থান। সারা বছর এসব স্থানে অসংখ্য দর্শনার্থী এসে ভীড় জমায়। এগুলোর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো ঃ
১. এক হাজার একর জমির উপর গড়ে ওঠা চড়বিষষ এধৎফবহং. এখানকার শিল্পসম্মত সারিবদ্ধ সবুজ বীথি, দীর্ঘ পায়ে চলা আঁকাবাঁকা পথ, সুদৃশ্য বিভিন্ন কৃত্রিম হ্রদ, নানা বর্ণের অজস্র ফুলের মনোমুগ্ধকর শোভা এবং নানা ধরনের শিল্পকর্মের প্রদর্শনী শিল্পানুরাগী, দর্শনার্থীদেরকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করে।
2. Loose Park,
3. Words of Fun & Occans Fun,
4. Kansas city Zoo,
5. Deanna Rose Farmstead ইত্যাদি।
এছাড়া এলাকা ভিত্তিক আরো অনেক পার্ক নির্মিত হয়েছে। সারা ক্যানসাস সিটিকেই মনে হয় একটি পার্কের নগরী। সবুজ বৃক্ষ-লতা ও সুদৃশ্য বনানীঘেরা এ শহরটি প্রকৃতি-প্রেমিক সৌন্দর্য-পিয়াসী সকল মানুষের জন্য একটি আর্কষণীয় স্থান, অন্তত আমার দৃষ্টিতে শহরটিকে সে রকমই মনে হয়েছে। এখানে শহুরে কোলাহল, জনতার ভীড়, যান্ত্রিকতা ইত্যাদি কোন কিছুই জীবনকে বিরক্তিকর করে তুলে না। এখানে সবকিছুই যেন সহজ-স্বাভাবিক, প্রাণময় ও জীবনানন্দে মুখর। প্রকৃতির সাথে মানুষের এক গভীর আত্মীয়তা যেন এখানে জীবনে ছন্দ ও নানন্দিকতা সৃষ্টি করেছে। ক্যানসাস সিটির এ এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্য, যা আমাকে মুগ্ধ করেছে।
ভ্রমণকারীদের জন্য ক্যানসাস শহর ও শহরতলীতে ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের প্রায় ৮৮টি হোটেল-মোটেল রয়েছে। কেনা-কাটার জন্য এখানে রয়েছে অনেকগুলো বড় বড় দোকান ও মল। আমেরিকায় বিত্তবানদের নগরী হিসাবে ক্যানসাসের যেমন খ্যাতি আছে, তেমনি মোটা মানুষের শহর হিসাবেও এর স্থান এক নম্বরে। কথায় কথায় এসে গেলো বলে বলছি, মেদভূড়ি আমেরিকানদের জন্য একটি বড় সমস্যা। এখানকার অধিকাংশ মানুষই মোটা। মেদভূড়ি কমানোর জন্য তাদের কোশেশের অন্ত নেই। তা সত্ত্বেও অনেকের মেদবহুল শরীর এত বিসদৃশ যে, তা দেখতে অস্বাভাবিক মনে হয়। মোটাত্বের দিক থেকে ক্যানসাস নগরীর অধিবাসীরা আমেরিকার মধ্যে এক নম্বরে আছে।
Kansas City, The city of Fountain বলে পরিচিত। প্রসঙ্গত ইতঃপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, ইতালীর রোম নগরীর পরই এখানে সর্বোচ্চ সংখ্যক কৃত্রিম ঋড়ঁহঃধরহ বা ঝর্ণা নির্মিত হয়েছে। তাই আমেরিকায় ক্যানসাস The city of Fountain নামে খ্যাতি বা পরিচিতি লাভ করেছে।
ক্যানসাস স্ট্রেট অন্য আরেকটি কারণে আমেরিকার বিশেষ খ্যাতি পেয়েছে। এখানকার গরুর গোশ্তের যথেষ্ট খ্যাতি আছে। ক্যানসাস সমতল ভূমির দেশ হওয়াতে এখানে অসংখ্য গরু-ঘোড়া-মেষ ইত্যাদি বিভিন্ন জাতের গৃহপালিত পশু প্রতিপালিত হয়। আমেরিকার অন্য যেকোন রাজ্যের তুলনায় এখানে সর্বাধিক পরিমাণ গরুর গোশত উৎপাদিত হয়ে থাকে। ক্যানসাস ছাড়াও অন্যান্য রাজ্যে ক্যাসাসের গরুর গোশ্ত সরবরাহ করা হয়।
২৩ জুলাই বৃহস্পতিবার
আমেরিকায় যেসব সঙ্গীতের প্রচলন ও জনপ্রিয়তা রয়েছে, তার মধ্যে জাজ, পপ, ব্যান্ড ইত্যাদিই প্রধান। এসব সঙ্গীতে আমেরিকার কালো আদমীদের প্রাধান্য সর্বত্র। আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায় প্রধানত আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত। আমেরিকার ঊধৎষু ঝবঃঃষবৎং অর্থাৎ বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশ থেকে আগত শ্বেতাঙ্গরা আমেরিকায় এসে জোর-জবরদস্তিমূলকভাবে আমেরিকার আদিবাসীদেরকে তাদের জায়গা-জমি থেকে উচ্ছেদ করে তাদের খুশীমত বসতি স্থাপন করেছে। যে যতটা পারে আমিরকার বিরান ভূমি দখল করে নিয়েছে। কিন্তু তখন তাদের হাজার হাজার একর জমি চাষাবাদ করার জন্য লোকজন ছিল না। ফলে তারা জোটবদ্ধ হয়ে আফ্রিকা থেকে হাজার হাজার কালো আদমীকে জোর করে ধরে এনে তাদেরকে দিয়ে জমি চাষ ও অন্যান্য যাবতীয় কাজে লাগায়। আফ্রিকা থেকে জবরদস্তিমূলকভাবে তাদের ধরে এনে নানারূপ দৈহিক নির্যাতন করে গাদাগাদীভাবে জাহাজের খাঁচায় আবদ্ধ করে দীর্ঘ সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় নিয়ে আসা হতো। এভাবে নির্যাতন করে হাতপা বেঁধে জাহাজে তুলে নিয়ে আসায় পথেই অনেকে মৃত্যবরণ করত। আমেরিকায় নিয়ে আসার পরও প্রথমদিকে তাদের হাতে-পায়ে শৃংখল পরিয়ে দৈহিক নির্যাতনের মাধ্যমে বশ মানিয়ে তাদেরকে বিভিন্ন কাজ করতে বাধ্য করা হতো। আমেরিকার ইতিহাসে দাসপ্রথাকে এক কলঙ্কময় অধ্যায় বলা হয়। মানব-ইতিহাসে এমন বর্বরতা ও নৃশংসতার দ্বিতীয় কোন নজীর নেই। তাই গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের জন্য উচ্চকন্ঠ আমেরিকা আজ যতই সভ্য দেশ হিসাবে বড়াই করুক না কেন, তার অতীত ইতিহাস অতিশয় কলংকজনক। ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও মানবাধিকার লংঘনে এবং নিরীহ-নিরপরাধ মানুষের উপর অমানবিক নিষ্ঠুর নির্যাতনের ইতিহাসে আমেরিকার কোন জুড়ি নেই।
সে যাইহোক, আমেরিকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সভ্যতা ও প্রগতির মূলে রয়েছে আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের রক্ত, ঘাম, ও প্রাণান্ত পরিশ্রম। ক্রীতদাসদের প্রাণান্তকর পরিশ্রমের বিনিময়েই আমেরিকার সমৃদ্ধি ঘটেছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেয়। আমেরিকার সে কলংকময় ইতিহাস ও নির্মম আত্মগ্লানি মোচনের জন্য প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সেজন্য ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এ বিষয়ে ইতঃপূর্বে সংক্ষেপে আলোচনা করেছি। ঊনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে আমেরিকায় দাশ প্রথা বিলোপের পর ধীরে ধীরে সেদেশের ইতিহাস পাল্টে গেছে। ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে নানা সংগ্রাম ও আন্দোলনের মাধ্যমে কৃষ্ণাঙ্গরা বর্তমানে নাগরিক সমধিকার লাভ করেছে। আমেরিকার পরিবর্তিত সমাজ-ব্যবস্থায় এখন কালো আদমীদের সে রক্ত-ঘাম ও শ্রমের মূল্য পরিশোধের পালা শুরু হয়েছে। এমনকি, ২০০৮ সনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে আফ্রিকান-বংশোদ্ভূত বারাক হোসেন ওবামা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে ববিত হয়েছেন। ওবামার বাবা ছিলেন কেনিয়ান কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম। তিনি আমেরিকার বিখ্যাত হার্বাড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় এক শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান মহিলাকে বিয়ে করেন। সে মিশ্র বর্ণের দম্পতির সন্তান হলেন ওবামা। কিন্তু তাঁর স্ত্রী মিশেল- যিনি একজন নামকরা আইনজীবী- তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান ক্রীতদাস। তিনি এখন আমেরিকার ফাস্ট লেডি। বিখ্যাত কৃষ্ণাঙ্গ পপ সঙ্গীত-শিল্পী মাইকেল জ্যাকসনকেও আমেরিকা ‘পপ সম্রাট’ নামে ভূষিত করে তার জন্য গর্ব অনুভব করে।
আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদেরকে একসময় শ্বেতাঙ্গ ভূস্বামীদের জমি চাষ, পশুপালন ও নানা গৃহ-কর্মে নিয়োজিত করা হতো। তাদের উপর চরম দুর্ব্যবহার করা হতো এমনকি, অবাধ্যদের অভুক্ত রেখে কাজ করতে বাধ্য করা হতো। এককথায় তারা পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট ও চরম মানবেতর জীবন-যাপন করতো। এ হতভাগ্য কৃষ্ণাঙ্গ দাসেরা যখন মাঠে চাষ করতো অথবা পশুর মত পানি ও সর্ব রকম ভারী বোঝা বহন করত, তখন শ্রম-ক্লান্ত এসব মানুষ প্রাণ খুলে গলা ছেড়ে গান গেয়ে তাদের দৈহিক কষ্ট ও মনের দুঃখ লাঘব করার প্রয়াস পেতো। যেসব গানে বেদনা ও বিষাদের নিবিড় আর্তি ঝরে পড়তো। মূলত সেসব গান ছিল তাদের হতভাগ্য, দুর্দশাগ্রস্ত জীবনের রুবিরাক্ত হৃদয়ের সকরুণ অভিব্যক্তি। এভাবেই কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে সঙ্গীতের এক জীবনধর্মী ঐতিহ্যের সূত্রপাত। আমেরিকার ঐতিহ্যবাহী পপ সঙ্গীত, জাজ ও ব্যান্ড সঙ্গীতে এখন কৃষ্ণাঙ্গদেরই আধিপত্য।
আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায় দীর্ঘকাল ধরে শোষণ-বঞ্চনা, নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে। সে জন্য তাদের মধ্যে সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে যাবার এবং নিজেদের যোগ্যতা ও প্রতিভা বিকাশের এক প্রবল মানবিক তাগিদ রয়েছে। এ কারণে তারা আজ অনেকটা সংঘবদ্ধ এবং রাজনীতিসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই সাহস ও দৃঢ়তার সাথে অনেক দুরূহ পথ অতিক্রম করে চলেছে। ২০০৮ সনের নির্বাচনে আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বিপুল সংখ্যক ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। ভবিষ্যতে আমেরিকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গদের যথাযথ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আমার বিশ্বাস। বিশেষত প্রতিভার দিক দিয়ে সেখানে কৃষ্ণাঙ্গদেরকে অবহেলা করা বা পিছনে ফেলে রাখার কোন অবকাশ আছে বলে মনে হয় না।
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments