আলিফ লায়লা : আরব্য রজনী_পর্ব-৬৩
ইংরেজি অনুবাদ : ডঃ জে. সি. মারদ্রুস
বাংলা অনুবাদ : ক্ষিতিশ সরকার
দুশো
চারতম
রজনী
:
আবার
সে
শুরু
করে
: চিঠির
বয়ান
এই
রকম
: খালিদানের বাদশাহ
শাহরিমানের পুত্র
কামার
আল-জামান-এর এই
পত্র
মহামান্য সম্রাট
ঘায়ুরের কন্যা
রাজকুমারী বদর-এর উদ্দেশ্যে লিখিত
হচ্ছে
:
তুমি
তো
জানো
না
প্রিয়া,
কী
ব্যথা
মরমে
নিয়া
আমি
দিন
কটাইতেছি। প্রতিনিয়ত তুষানলে দগ্ধ
হইতেছি। তোমার
আদর্শন
আমাকে
উন্মাদ
করিয়াছে। আমার
কলমে
এমন
কোন
ভাষা
নাই
তোমার
বিরহে
আমি
কাতর-লোকে বলে আমার
মস্তিষ্ক বিকৃতি
ঘটিয়াছে। কিন্তু
কি
করিয়া
তাঁহাদের বুঝাই,
জীবনে
ইহার
চাইতে
বড়
সত্য
আর
কিছুই
নাই।
সেই
রাত্রে
তোমার
হাতে
আমি
একটি
হীরার
আংটি
পরাইয়া
দিয়াছিলাম। এবং
তুমিও
আমার
হাতে
পরাইয়া
দিয়াছিল এই
পান্নার আংটিটাি। দেখো,
চিনিতে
পারো
কি
না।
আমার
হৃদয়
অশান্ত
সমুদ্রের মতো
অস্থির
হইয়া
উঠিয়াছে। কবে
দেখা
পাইবো।
কবে
হইবে
আমাদের
মধুর
মিলন।
ইতি–
কামার আল-জামান
পুনঃ—শহরের প্রবেশদ্বারের পাশে বড় সরাইখানায় আমি উঠিয়াছি। আংটিটা পুরে খোজার হাতে দিয়ে বললো, তোমার রাজকুমারীকে দিয়ে এসো।
বাইরে পর্দার এপারে দাঁড়িয়ে জামান শুনতে পেলো, খোজাটা বলছে, মালকিন, পর্দার এপারে দাঁড়িয়ে আছেন এক জ্যোতিষী। তিনি বলেছেন, আপনাকে সামনে না দেখেই তিনি আপনার ব্যামো সারিয়ে পারবেন। এই নিন, উনি আপনাকে খুলে দেখতে বলেছেন।
বদর-এর আর তাঁর সয় না। ক্ষিপ্রহাতে চিঠিখানা খুলে ফেলে। আংটিটা দেখেই সে চমকে ওঠে। এই তো সেই আংটি। —তার ভালোবাসার হাতে সে পরিয়েছিলো। বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করতে থাকে। তবে কি আল্লাহ এতদিনে মুখ তুলে চাইলেন। চিঠিখানা পড়তে থাকে। হঠাৎ সে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। এবার বুঝি সে সব সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে যাবে। পর্দা ঠেলে সে বাইরে আসে। সামনেই দাঁড়িয়েছিলো জামান। এক মুহূর্তে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে-তারপরই কাঁপিয়ে পড়ে ওর বুকে। দু’হাতে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। এতকাল কোথায় ছিলে, সোনা। এত কষ্ট কি করে দিতে পারলে।
জামানের চোখ দুটিও জলে ভরে আসে। বদরের মাথায় কপালে হাত বুলাতে থাকে। —আমিও তো সেই একই কথা বলতে পারি সোনা। তুমিই সেই রাতে কোথায় উধাও হয়ে গেলে?
গভীর
আলিঙ্গনে আবদ্ধ
হয়ে
দুজনে
দু’জনকে চুম্বন করতে
থাকে।
কোন
দিকে
ভ্রূক্ষেপ নাই।
যেন
সব
বাধাবন্ধনহীন এক
জোড়া
কপোত-কপোতী। .
খোজা
ছুটে
গিয়ে
সম্রাটকে খবর
দেয়,
রাজকুমারী সাফসম্রাট ঘায়ুর
অজানা
আশঙ্কায় সিংহাসন ছেড়ে
দাঁড়িয়ে পড়েন।
—কী, কী হয়েছে? রাজকুমারী সাফ কি রে?
—আজ্ঞে রাজকুমারীর মাথাটা
সাফ
হয়ে
গেছে।
আর
কোনও
অসুখ
নাই।
সব
সেরে
গেছে।
ঘায়ুর বিশ্বাস করতে পারে না। —কী সব যা তা বলছিস?
–না-আজ্ঞে,
নিজে
চোখে
দেখে
এলাম।
রাজকুমারী জ্যোতিষী সাহেবকে জড়িয়ে
ধরে
চুমু
খাচ্ছেন।
—বলিস কি রে?
–হ্যাঁ, হুজুর,
সত্যি
সত্যিই। বিশ্বাস না
হয়
চলুন,
নিজের
চোখেই
দেখবেন।
সম্রাট আর তিলমাত্র ধৈর্য ধরতে পারেন না। মাথার মুকুট পরতে ভুলে গেলেন। পায়ের জুতা ওখানেই পড়ে রইলো। খালি পায়ে খালি মাথায় ছুটলেন হারেমে। দেখলেন, সত্যিই বদর, আগের মতো হাসি খুশি সুস্থ হয়ে গেছে। মেয়ের কপালে চুম্বন করে বললেন, যাক, এতদিনে আমার দুঃখের দিন শেষ হলো।
কামার আল-জামানকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি অসাধ্য সাধন করেছ বাবা। আমার সব দিয়েও তোমার ঋণ শোধ করতে পারবো না। এখন বলে কে তুমি?
জামান
বলে,
খালিদানের বাদশাহ
শাহরিমান আমার
বাবা।
আমার
নাম
কামার
আল-জামান। এরপর আদ্যোপোন্ত সমস্ত
কাহিনী
শোনালো
তাকে।
সম্রাট বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে শুনলেন সেই অদ্ভূত কাহিনী। শুধু মুখে বলতে পারলেন, তাজ্জব ব্যাপার! এ কাহিনী সোনার অক্ষরে লিখে রাখা দরকার।
দরবারের সেরা কলমচীকে ডেকে বললেন, শাহজাদার এই কাহিনী যত্ন করে লিখে রেখে দাও। আগামী দিনের মানুষ এ কাহিনী পাঠ করে অনেক শিক্ষা লাভ করতে পারবে।
শহরের প্রধান কাজীকে ডাকা হলো। খাঁটি মুসলমান প্রথায় শাদীনামা তৈরি হয়ে গেলো। আনন্দ উৎসবমুখর হয়ে উঠলো সারা প্রাসাদ, সারা শহর। আলোর মালায় সাজানো হলো প্রাসাদ, ইমারৎ। খানাপিনা, নাচ গান হৈ-হাল্লায় মাতোয়ারা হয়ে উঠলো সকলে। লাহরের এবং দরবারে সম্রান্ত আমির ওমরাহ সওদাগর সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা এসে নব দম্পতির সুখ সুনিবিড় দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন কামনা করে শুভেচ্ছা জানিয়ে গেলো।
দীর্ঘকালের প্রতীক্ষার অবসান হলো, আবার ফিরে এলো সেই মধুযামিনী। বদর আর কামার অল-জামান সুখের সায়রে গা ভাসিয়ে দিলো। এতদিন পরে তারা প্ৰাণ ভরে হাসলো, গাইলো, খানা পিনা করলো, আর গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে নিশ্চিন্ত আরামে ঘুমালো।
ভোরের দিকে জামান স্বপ্ন দেখলো, তা বাবা সুলতান শাহরিমান সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। কেঁদে কেঁদে তার দু’চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। বলছেন, জামান, বেটা, তোমার শোকে আমি আজ মৃত্যুপথ যাত্রী। একটি বার এসো বাবা, যাবার আগে একবার প্রাণ ভরে দেখে যাই। তুমি ছাড়া জীবন আমার মরুভূমি হয়ে গেছে। কি হবে আমার এই অতুল ঐশ্বর্য, এই বিশাল সলতানিয়ত দিয়ে? একটি বার এসো বাবা।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো। বাবার বিষাদ বিষণ্ণ করুন মুখখানাই বারবার চোখের সামনে ভূক্ত থাকলো। এক অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করে ওঠে জামান। তার আর্তনাদ বদর জোগে \3CQ
—কী হলো,
সোনা?
শরীর
খারাপ
করছে?
মাথা
ধরেছে?
টিপে
দেব।
ভিনিগার লাগিয়ে
বেঁধে
দেব?
এক্ষুণি কমে
যাবে।
জামান কঁকিয়ে ওঠে, না।
—তবে? তবে কি তোমার পেটে দরদ হচ্ছে? মৌরির তেল মালিশ করে দেব পেটে?
জামান
ছটফট
করে
ওঠে,
না
না
ওসব
কিছু
না।
—তবে কি তোমার বদহজম হয়েছে। একটু জোয়ানের আরেক খাবে? কিংবা এক গেলাস গোলাপ জলের শরবৎ?
জামান
বলে,
না,
সোনা
সে
জন্যেও
না।
এই সময় রাত্রি শেষ হতে চলেছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিমে চুপ করে বসে থাকে।
দুশো ছয়তম রজনীতে আবার সে গল্প শুরু করে :
কামার
আল-জামান বলে, কালই
আমরা
দেশে
রওনা
হয়ে
যাবো।
খুব
একটা
খারাপ
স্বপ্ন
দেখলাম। বাবা
শোকে
তাপে
একেবারে শুকিয়ে
গেছেন।
আমার
শিয়রে
দাঁড়িয়ে বললেন,
জামান,
একটিবার আমার
কাছে
এসো।
তোমাকে
না
দেখে
আমি
মরতেও
পারছি
না।
তার
চোখে
দেখলাম
জল!
আমি
আর
কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছি
না,
সোনা।
কালই
আমাদের
রওনা
হতে
হবে।
তোমার
কি
মাত?
—আমার আবার
কি
মত?
তোমার
মতই
আমার
মত।
তোমার
পথই
আমার
পথ।
তুমি
যা
বলবে
তাই
হবে।
চলো,
দেশেই
যাই।
তোমাকে
না
দেখে
বাবার
অবস্থা
যে
কি-তা তো আমিও
বুঝতে
পারছি।
কাল
সকলে
আমি
বাবাকে
বলবো,
তিনি
সানন্দে সব
ব্যবস্থা করে
দেবেন।
খুব ভোরো বদর প্রধান খোজাকে পাঠালো সম্রাটের কাছে। ঘায়ুর তাকে দেখেই শঙ্কিত হলেন, আবার এই সক্কালবেলায় কী দুঃসংবাদ বয়ে নিয়ে এলি বাঁদর।
-আজ্ঞে রাজকুমারী আপনার সঙ্গে দুটো কথা কইতে চান। খুব দরকারী।
—দাঁড়া, আমি আমার মুকুট আর জুতো পরে নিই।
বদরের হারেমে এসে ঘায়ুর বললেন, কাল রাতে কি এক গাদা লঙ্কার ঝাল খেয়েছিলি, মা? এই সাত সকলে তোমাদের ঘুম ভাঙলো কি করে? কী ব্যাপার? কেন ডেকেছো?
—না বাবা,
ওসব
কিছু
না,
বদর
বলে,
আজ
আমরা
দেশে
রওনা
হয়ে
যাবো।
তাই
তোমার
অনুমতি
চাই।
—এ তো বড় সুখের কথা, মা। স্বামীর সঙ্গে শ্বশুর ঘরে যাবে, এর চেয়ে আনন্দের কথা আর কি হতে পারে? তবে একটা কথা মা, তুমিও তো আমার একমাত্র সন্তান, জীবনে কোনও একটা দিন চোখের আড়াল করিনি। আমার কষ্টটাও নিশ্চয়ই বুঝবে। তাই বলছি, একটা বছর পরে একবার আমার কাছে ফিরে এসো।
বদর বাবার হাতে চুমু খেয়ে বলে, এ তুমি কি বলছে, বাবা, তোমাকে না দেখে কি আমিই থাকতে পারবো? যত তাড়াতাডি হয় আমি তোমাকে দেখতে আসবো।
সকাল থেকে সাজ সাজ রাব পড়ে গেলো। রাজকুমারী বদর যাবে শ্বশুরবাড়ি। গাধা খচ্চর উটের পিঠে বোঝাই হতে থাকলো সাজ-সামগ্ৰী। সম্রাট ঘায়ুর নানা মূল্যবান দুষ্প্রাপ্য উপহার উপটৌকনে ভরে দিলেন। সেই সঙ্গে দিলেন অমূল্য ধন-দৌলত হীরা-জহরৎ। জিনিস পত্র বাঁধা ছাঁদা করতেই দুপুর গড়িয়ে গেলো। সম্রাট সাশ্রনয়নে বিদায় দিলেন কন্যা জামাতাকে। কামার অল-জামান আর বদর-এর চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়লো।
কিন্তু শহর ছাড়িয়ে প্রান্তরের পথে যেতে না যেতেই চোখের জল শুকিয়ে গেলো। আনন্দে উদ্দাম হয়ে উঠলো দুজনে। তারপর চলা আর চলা।
এইভাবে তিরিশটা দিন পথ চলার পর একটা ঘন সবুজ শস্যক্ষেত্রের পাশে এসে ওরা আস্তানা গাড়লো। এইখানে কয়েকটা দিন বিশ্রাম করবে তারা। কাছেই নদী আছে, সুতরাং জলের কষ্ট হবে না। খুঁজে পেতে খেজুর গাছের ছায়ায় তাঁবু গাড়া হলো! বন্দরের শরীরে এত ধকল হইবে কি করে। ফুলের ঘায়ে যে মেয়ে মূৰ্ছা যায়, সে কি না একটানা এতটা পথ উটের পিঠে এসেছে। যদিও হাওদায় মখমলের গদি ছিলো। তবুও উটের দুলকি চালের দুলনিতে সারা শরীর ব্যথায় টন টন করছে। সামান্য একটু কিছু মুখে দিয়ে তীবুর ভিতরে সে টান ট্রান হয়ে শুয়ে পড়লো। শোয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমে গলে গেলো বন্দর। কামার আল-জামান সঙ্গের অনুচরদের বললো, তোমাদের তীবুগুলো একটু দূরে খাটাও। রাজকুমারী বড় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়েছেন। তোমাদের হট্টগোলে তার নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
তাঁবুর ভিতরে ঢুকে জামান দেখে, একটা কঁচুলী আর পাতলা ফিনফিনে একটা মসুল-এর তৈরি রেশমী-সেমিজ পরে বদর ঘুমে অচেতন। মাঝে মাঝে একটা হালকা হাওয়া এসে সেমিজটা ওপরের দিকে উড়িয়ে দিয়ে পালাচ্ছে। জামানের চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। একটি মাসের অতৃপ্ত কামনা দেহ কুরে কুরে খেতে থাকে। পাশে বসে বদরের সারা দেহে হাত বুলাতে থাকে জামান। দেহ, মন উত্তপ হতে থাকে। হঠাৎ কোমরে শক্ত মতো কি একটা হাতে ঠেকে। একটা অচেনা পাথর। নিশ্চয়ই মহামূল্যবান। তা না হলে বদর কেন শরীরে ধারণ করবে। হয়তো এর কোনও দৈব ক্ষমতা আছে। তার পাতানো ভাই মারজাবন দিয়ে থাকবে হয়তো বা। হয়তো এর গুণে অনেক বিপদ আপদ কেটে যায়—
আলগোছে পাথরটাকো খুলে নিয়ে তীবুর বাইরে চলে এলো জামান। পরীক্ষা করে দেখবে, চিনতে পারে কি না। পাথরটার চারটে মুখ। কি সব আঁকিবুকি কাটা আছে চারপাশে। কিছুই বোধগম্য হয় না। তবে দেখে বোঝা যায়, পাথরটা কোনও মন্ত্রপুত।
পাথরটা হাতে নিয়ে একমনে নিরীক্ষণ করছিলো সে। এমন সময় একটা পাখি শো করে নেমে এসে, ছোঁ। মেরে ছিনিয়ে নিয়ে নিমেষে উধাও হয়ে গেলো।
এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
দুশো সাততম রজনীতে আবার শুরু করে :
পাখিটা
উড়তে
উড়তে
গিয়ে
বসে
অনেক
দূরের
এক
বিশাল
ঝাঁকড়া
গাছের
ডালে।
দূরে
হলেও
জামান
দেখতে
পায়,
শয়তান
পাখিটা
তারই
দিকে
তাকিয়ে
তাকিয়ে
ঘাড়
দোলাচ্ছে।
কিছুক্ষণের জন্য সে হতভম্ব হয়ে পড়ে। এমন যে একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারে তার মাথাতেই আসেনি। কিন্তু এখন উপায় কি হবে। রাজকুমারী জেগে যখন দেখতে তার পাথরটা নাই তখন সে তাকে কি বলে সান্ত্বনা দেবে। পাথরটা নিশ্চয়ই তার প্রাণাধিক প্রিয়।
একটা পাথরের ঢ়িল কুড়িয়ে নিয়ে ছুটে যায় গাছটার দিকে। প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে ছুঁড়ে মারে। কিন্তু তার আগেই পাখিটা উড়ে পালায়। পালিয়ে কিন্তু বেশি দূর যায় না। আর একটু দূরের একটা গাছের ডালে গিয়ে বসে। আর একটা ঢ়িল নিয়ে জামান ওকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। কিন্তু পাখিটা মহা ধডিবাজ। ঢ়িল মারার মুহূর্তেই সে শো করে উড়ে যায়। গিয়ে বসে আর একটা গাছের ডালে। জামানের মাথায় খুন চেপে যায়। যে ভাবেই হোক, পাখিটাকে মেরে ফিরে পেতেই হবে পাথরটা। পাখিটাও বড় সেয়ানা। বারবারই এমন একটা দূরত্ব রেখে কোনও একটা গাছের ডালে বসছে, যেখান থেকে পাথরটা স্পষ্ট দেখা যায়—এবং জামানের মনে আশা জাগে, হয়তো সে এবার তাকে ধরাশায়ী করতে পারবে। কিন্তু না, তাড়া করতে করতে অনেক বাগ বাগিচা পার হয়ে যায়। মারতে আর পারে না কিছুতেই।
গাছপালা ছাড়িয়ে পাখিটা গিয়ে বসে কাছেরই একটা পাহাড়ের চূড়ায়। জামান মরিয়া হয়ে উঠেছে। কোনও দিকে তার ভ্রূক্ষেপ নাই। পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠে যায়। পাথর ছুঁড়ে মারে পাখিটাকে। পাখিটাও টুক করে উড়ে গিয়ে বসে আর একটা চূড়ায়। এইভাবে পাহাড়ের কন্দরে উপত্যকায় পাখিটার পিছনে পিছনে ছুটে হয়রান হয়ে পড়ে।
কয়েক ঘণ্টা কেটে গেলো। সূর্য গেলো পাটে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো। ঘেমে নেয়ে একশা হয়ে গেছে সে। এখন কি করে বদরের সামনে দাঁড়াবে। কী জবাবদিহি সে করবে? হয়তো এমনও হতে পারে, তার এই অমূল্য রত্নটার শোকে সে অসুস্থও হয়ে পড়তে পারে।
ক্রমশঃ অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে থাকে। কামার আল-জামান ভাবে, এই অবস্থায় এই দুৰ্গম গিরি পর্বত অতিক্রম করে তাঁবুতে ফেরা সঙ্গত হবে না। অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনাই বেশি। তা ছাড়া হিংস্ব জন্তু জানোয়ারদের ভয়ও তাকে শঙ্কিত করে তোলে।
সামনের একটা গাছের ডালে বসে পাখিটা পাখা ঝাপটায়। সেই অন্ধকুরেও জামান দেখতে পায় পাখির ঠোঁটে পাথরটা ধক ধিক করে জুলছে। দারুণ আক্ৰোশে ফেটে পড়ে সে। পাথরের টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে ছুঁড়ে মারে। পাখিটা বিশ্ৰী বিদঘুটে একটা আওয়াজ তুলে উড়ে গিয়ে আর একটা গাছের ডালে বসে। জামান তখন উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন দুৰ্গম গিরি পথ ভেঙে পাখিটাকে তাড়া করতে থাকে। কিন্তু বৃথাই সে চেষ্টা। এক সময় ক্লান্ত অবসন্ন দেহটাকে আর টানতে পারে না। একটা পাথরের টিলার উপর বসে পড়ে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে।
পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে দেখে সেই টিলোটার উপরই শুয়ে তার অঘোর ঘুমে রাত কেটে গেছে। পাখিটার ডানা ঝাপটানিতে আবার সে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। মরিয়া হয়ে জামান ওর পিছু পিছু ধাওয়া করে। পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারতে থাকে। কিন্তু পাখিটা তার নাগালের বাইরে অথচ আশেপাশেই এগাছ ও গাছ লাফিয়ে উড়ে বসে।
জামানের তখন রোখি চেপে বসেছে। যে ভাবেই হোক পাখিটাকে ঘায়েল করে পাথরটা পেতে হবে। কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। পাখিটা একটু একটু করে উড়তে উড়তে আরও অনেকটা পথ তাকে প্রলুব্ধ করে নিয়ে যায়।
সারাটা দিন পাখিটার পিছনে ধাওয়া করতে করতে আবার সন্ধ্যা নেমে আসতে থাকে। জামান ক্লান্ত দেহে বসে পড়ে। দুটো দিন দানা পানি পেটে পড়েনি। তৃষ্ণায় ছাতি ২ ফেটে যাচ্ছে। ক্ষিদেয় পেট জুলছে। এবার সে এদিক ওদিক এগোতেই দেখতে থাকে, কোথাও খাবার কিছু সংগ্বহ করা যায়। কিনা। একটু এগোতেই কয়েকটা আপেল আর চেরী গাছ দেখতে পেলো। সামনে একটা ঝরনা। গোটাকয়েক আপেল আর চেরী ফল পেড়ে গোগ্রাসে খেলো। তারপর আঁজলা করে ঝরনার জল খেয়ে পাশেই একটা জায়গায় শুয়ে পড়লো। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘুম।
দুটো দিন দুটো রাত পার হয়ে গেছে। তিন দিনের দিন সকাল বেলায় চোখ খুলেই আবার সেই দৃশ্য। সামনের একটা চেরী গাছের ডালে পাখিটা বসে ডানা ঝাপটাচ্ছে। আবার শুরু হলো পাখি সংহারের প্রচেষ্টা। সে দিনও জামান-এর সব চেষ্টা বিফল হলো। কোনও ক্রমেই সে তাকে কব্জা করতে পারে না। অথচ তারই নাকের ডগা দিয়ে শো করে উড়ে গিয়ে অন্য এক গাছের ডালে অথবা গিরিচূড়ায় বসে। জামানও নাছোড়বান্দা-পাখিটাকে তাক করে করে অজস্র অগুন্তি ঢিল ছুঁড়তে থাকে। কিন্তু পাখিটা এমনই ওস্তাদ তার সব নিশানাকেই অবলীলাক্রমে পাশ কাটিয়ে দিতে পারে। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে থাকে। গিরি পর্বতমালা পেরিয়ে এবার সে সমতলভূমিতে এসে পড়ে। চাষীরা যাব। ভুট্টার ক্ষেতে কাজ করে চলেছে। পাখিটা উড়তে গিয়ে বসে কোনও খেজুর গাছের মাথায়। জামান মাটির ঢ়িল তুলে তাক করে মারে। কিন্তু পাখিটা টুক করে উড়ে গিয়ে আরও একটু দূরে আর একটা গাছের ডালে বসে।
জামানের মাথায় তখন খুন চেপে গেছে। ঐটুকু পাখির এই রকম বেয়াদপি সুলতান শাহরিমানের পুত্র হয়ে কিছুতেই সে বরদাস্ত করতে পারে না। মনে হয়, একবার যদি তাকে হাতের মুঠোয় পায়, তাহলে ওর এই ফাজিল চালাকি হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দেবে। কিন্তু হাতের মুঠোয় সে আর এলো না। বরং শাহজাদা জামানকে নাকে দড়ি দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে এসে ফেলল, এক সমুদ্রের ধারে। একটা আখরোটের গাছের ডালে বসে অদ্ভুত উল্লাসের আওয়াজ করতে লাগলো। সে। জামানের সারা শরীর খর রৌদ্রতাপে ঝলসে গেছে। দরদরি করে ঘাম ঝরছে। দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁফ ধরে গেছে। তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। চোখে সর্ষে ফুল দেখতে। তবু ক্ষোভ আক্ৰোশে জুলতেই থাকে। প্রায় অবসন্ন দেহে একটা মাটির ডেলা তুলে ঈশুনিয়ে প্রাণপণে ছুঁড়ে মারে। পাখিটা ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে আকাশে ওড়ে। জামানের মাথার ওপরে চক্রাকারে কয়েকটা পাক দেয়। জামান আর একটা ঢ়িল হাতে তুলে নেয়। কিন্তু ততক্ষণে পাখিটা অদৃশ্য হয়ে যায়।
জামানের সব আশা ভরসার ইতি হয়ে গেলো। এবার সে মাটির ওপরে থাপ করে বসে পড়ে। চোখে ফেলে জল আসে। এত প্রচেষ্টা সব ব্যর্থ হয়ে গেলো। এখন সে কি করবে? কিছুই ভাবতে পারে না।
অবসাদে দেহ এলিয়ে পড়ে জমানের। সেখানেই ঘাসের উপর গা ঢেলে দিয়ে শুয়ে পড়ে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে।
ঘণ্টা দুই বাদে ঘুম থেকে জেগে উঠে জামান ভাবতে এখন সে কোথায় যাবে। অচেনা অজানা বিদেশ বিভূঁই। পথ ঘাট কিছুই জানা নাই। একজন পথচারীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে সামনে এগোলেই কিছুদূরে একটা শহর। জামান সেই দিকে চলতে থাকে। মনে মনে ভাবে, তাঁবু থেকে কত দূর সে চলে এসেছে কে জানে। না জানি তার অদর্শনে বদর-এর কি দশা হয়েছে এ ক’দিনে।
শহরের প্রবেশ দ্বারে এসে হাজির হয় জামান। সড়ক ধরে সোজা ঢুকে পড়ে শহরের অভ্যন্তরে। কেউই তাকে বাধা দেয় না। কোনও প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে না। চারিদিকের ঘরবাড়ি দেখে মনে হয়, শহরটা মুসলমান জনবসতি বহুল। আরও খানিকটা এগাতে একটা বিরাট বাগিচার ফটকের সামনে এসে হাজির হয়। বাগানের মালী সাচ্চ মুসলমান। জামানকে সালাম আলেকুম বলে স্বাগত জানায়। জামানও যথারীতি আলেকুম সালাম জানায়। জামান জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা! জনাব, আমি যখন পথ ধরে আসছিলাম, রাস্তায় যাদের দেখলাম, কেউই আমার সঙ্গে কোনও কথাবার্তা বললো না কেন? সবারই চোখে মুখে, লক্ষ্য করলাম অদ্ভুত এক ঠাণ্ডা কৌতূহল। কী ব্যাপার?
বৃদ্ধ
মালী
জবাব
দেয়,
খোদা
মেহেরবান, তাই
আপনি
রেহাই
পেয়ে
গেছেন,
সাহেব।
যাদের
দেখলেন,
ওরা
সবাই
শত্রু
পক্ষের
লোক।
কিছুদিন হলো
শহরটা
আক্রমণ
করে
অধিকার
করে
নিয়েছে
ওরা।
ও-ই শয়তান কাফেরগুলো দরিয়ার
ওপার
থেকে
এসে
আচমকা
আক্রমণ
করে
এখানকার শান্ত
নিরীহ
মুসলমানদের খুন
জখম
করে
শহরটা
তছনছ
করে
ফেলেছে। তারা
আল্লাহকে বিশ্বাস করে
না।
শয়তান
তাদের
একমাত্র একমাত্র উপাস্য। তারা
অসভ্য
অশিক্ষিত জংলী
ভূত।
ওদের
প্রিয়খাদ্য পূতিগন্ধময় পচা
মাংস
আর
চর্বি।
ওরা
কখনও
গোসল
করে
না
বা
রুজু
করে
না।
শুনেছি,
জন্মের
সময়
বাচ্চার মাথায়
এক
কলসী
জল
দেয়।
তারা।
ব্যস,
সারা
জিন্দগীভর আর
তারা
পানি
স্পর্শ
করে
না।
তাই
এ শহরে ঢুকেই প্রথমে
তারা
সব
হামাম,
পানির
ফোয়ারা,
ঝরনাগুলো ভেঙে
গুড়িয়ে
দিয়েছে। আপনি
হয়তো
লক্ষ্য
করে
থাকবেন,
মালিক,
রাস্তার ধারে
দোকানপাটে পসরা
সাজিয়ে
বসে
যারা
সবাই
মেয়েমানুষ। ওরা
সবাই
বেবুস্যা। দোকানে
ঢুকলে
আপনাকে
গেলাসে
ঢেলে
দেবেহাল্কা হলদে
রঙের
এক
ধরনের
চিরতা
ভিজানো
পানি।
দেখবেন,
ফেনায়
ভরে
গেছে
গেলাসের মাথা।
ওরা
পানির
বদলে
ওই
জিনিসই
খায়।
ওকে
ওরা
বলে
‘পিনেক
পানি’। আমার মনে
কি
হয়
জানেন
সাহেব,
ও জিনিসটা গরু ছাগলের মুত
ছাড়া
আর
কিছু
না।
কিংবা
তার
চাইতেও
খারাপ
কিছু
হতে
পারে।
ওদের
মেয়েরা
গোসল
করে
না
বটে।
কিন্তু
এক
ধরনের
লেবুর
রস
দিয়ে
হাত
মুখ
সাফা
রাখে।
ফালা
ফালা
করে
লেবু
কেটে
তার
টুকরোগুলো ঘাড়ে
মুখে
গলায়
ঘসে
ফিসে
সব
ময়লা
সাফ
করে।
ডিমের
খোলা
গুড়িয়ে
ময়দার
মতো
করে
মুখে
মাখে
ওরা।
ওরা
একেবারে বেআব্রু। বোরখা
পরে
না।
এ শহরে আমিই বোধহয়
একমাত্র জীবিত
মুসলমান। ওরা
আমাকে
মারেনি।
এইসব ভয়ঙ্কর তাজ্জব কথাবার্তা শুনতে শুনতে জমানের মাথা ঘুরতে থাকে। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। নিজেকে আর সে ধরে রাখতে পারে না। কোনও রকমে ঘাসের উপর বসে পড়তে পারে।
মালী বুঝতে পারে, ছেলেটি অনাহারে অনিদ্রায় কাহিল হয়ে পড়েছে। জামানকে সঙ্গে করে সে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। ছোট্ট সুন্দর বাড়িখানা বাগানেরই লাগোয়া। কিছু খানা, খানিকটা শরবৎ তাকে খেতে দেয়। ক্ষুধার্তা জামান তৃপ্তি করে খায়। বৃদ্ধ মালি প্রশ্ন করে, কে বাবা, আপনি? কেন এসেছেন এই সর্বনাশা দেশে?
এই
সময়
রাত্রি
শেষ
হয়ে
আসে।
শাহরাজাদ গল্প
থামিয়ে
চুপ
করে
বসে
থাকে।
দু’শো আটতম রজনীতে আবার সে শুরু করে :
বৃদ্ধ
মালীর
সহায়তায় জামান-এর মন ভরে
যায়।
এমন
অচেনা
অজানা
দেশে
এসে
এমন
একটি
দরদী
মানুষের সন্ধান
পাওয়া
ভাগ্যের কথা।
জামান
তার
দুঃখের
কাহিনী
খুলে
বললো
তাকে।
বলতে
বলতে
চোখের
জলে
বুক
ভেসে
যায়।
বৃদ্ধ
বুঝতে
পারে
জামানের মর্মবেদনা। নানাভাবে সাত্মনা দেবার
চেষ্টা
করে
সে।
-কী করবেন। বাবা, সবই খোদাতালার ইচ্ছা। তিনি যা করান। তাই আমরা করি, তিনি যা বলান তাই আমরা বলি। ও নিয়ে দুঃখ করে লাভ নাই। নিয়তির লেখা খণ্ডাতে পারে না কেউ। প্ৰাণ ভরে শুধু তীকে ডাকুন, তিনিই সব সমস্যার সুরাহা করে দেবেন। তবে আমার কি মনে হয় বাবা, জানেন? রাজকুমারী এখন আর ওখানে নাই। একদিন দেখার পরই তারা খালিদানে রওনা হয়ে গেছে। ভেবেছে, আপনার সন্ধান করতে হলে, সুলতান শাহরিমানকে খবর দেওয়া দেওয়া দরকার। তাহলে তিনি চারদিকে লোকলিস্কর পাঠিয়ে তল্লাস করতে পারবেন। আমার এই ছোট্ট গরীবখানায় আপনি কয়েকটা দিন বিশ্রাম করুন। তারপর আমি আপনার দেশে ফেরার ব্যবস্থা করে দেব। এখানকার বন্দরে মাঝে মাঝে খালিদানের সওদাগরি জাহাজ এসে ভেড়ে। কাজকাম শেষ করে আবার তারা ফিরে যায়। ওই রকম যে কোনও একটা জাহাজে চেপে দিব্যি আপনি দেশে চলে যেতে পারবেন। আমি রোজই একবার বন্দরে গিয়ে খোজ নিয়ে আসবো। খালিদানের জাহাজ এলেই আপনি চলে যাবেন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, কখনও বা দেখা যায় হামেশাই জাহাজ আসছে যাচ্ছে। আবার কখনও বা বছর ঘুরে যায়। তবুও একখানার পাত্তা মেলে না।
বৃদ্ধ মালী তার কথা রাখে। প্রতিদিন সে বন্দরে খোঁজখবর নিতে যায়। কিন্তু দিনের পর দিন কেটে থাকে, জামান জামাই-আদরে তার বাড়িতে দিন কাটাতে থাকে।
আসুন এবার আমরা রাজকুমারী বদর-এর দিকে চোখ ফেরাই। তাঁবুর ভিতরে বদরের ঘুম ভেঙে যায়। এদিক ওদিক তাকিয়ে কামার অল-জামানকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু এদিক ওদিক কোথাও না দেখতে পেয়ে উঠে বসে। হঠাৎ সে বুঝতে পারে তার কোমরের পাথরটা নাই। বদর ভাবে হয়তো তার স্বামী দেখার জন্যে খুলে নিয়ে গেছে। এখুনি এসে পড়বে।
কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরেও যখন পর সে ফিরে আসে না বদর চিন্তিত হয়ে। ওঠে। উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। আরও অনেক সময় কেটে যায়, কিন্তু জামান ফিরে আসে না। ক্রমে সন্ধ্যা নেমে আসে, অজানা আশঙ্কায় বদর-এর বুক কেঁপে ওঠে। ঐ মন্ত্রপূত পাথরটার উপরেই তার রাগ হতে থাকে। রাগ হয় তার পাতানো ভাই মারজাবনের ওপর। কেন সে ঐ হতচ্ছাড়া পাথরটা তাকে পরতে দিয়েছিলো? হয়তো। ওরা হাতে ধরাতেই জামানের কোনও বিপদ আপদ ঘটেছে।
সারাটা রাত বিনিদ্র ভাবে কাটে। তারপর দিনও সে দারুণ উৎকণ্ঠা নিয়ে কাটায়। কিন্তু জামান ফিরে আসে না। ভয়ে কাউকে কিছু বলতে সাহস করে না। সঙ্গের চাকর নফররা যদি শোনে, শাহজাদা নাই তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে তাদের মনে বদ মতলব মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। এই চরম সংকটের সময়ে নিজেকে খুব শক্ত সহজ করে রাখার চেষ্টা করে, বদর তার বাঁদীকে বলে, খু হুঁশিয়ার, শাহজাদা তাঁবুতে নাই, একথা যেন ঘুণাক্ষরেও কেউ টের না পায়।
আর মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে সে তার আশু কর্তব্য ঠিক করে ফেলে। নিজের সাজপোশাক ছেড়ে ফেলে বদর পরে নেয় জামানের সাজপোশাক। মাথায় পরে একটা বাহারী রেশমী টুপী। কোমরে বেঁধে নেয় একখানা ইয়াবড় তলোয়ার। আর বাঁদীটাকে পরিয়ে দেয় তার নিজের পোশাক। এমনভাবে সাজিয়ে তোলে, দেখলে কে বলবে সে-ই বদর নয়।
দুজনে তাঁবু ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। আগে আগে বদর আর পিছন পিছন বাঁদী। সকলে দেখলে, শাহজাদা জামান তার বেগম বদরকে নিয়ে বেরিয়েছেন। আভুমি আনত হয়ে সকলে কুর্নিশ জানিয়ে নতমুখে দাঁড়িয়ে থাকে। বদর বলে, এবার আমরা রওনা হবো, আজই, এখুনি। সবাই তৈরি হয়ে নাও।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বাঁধোচাঁদা শেষ করে আবার, তারা যাত্রা শরু করে। সমুদ্রতীরে এসে একখানা জাহাজ ভাড়া করা হলো। সাগর। পাডি দিয়ে যেতে হবে এবার।
একটানা প্ৰায় দশ দিন চলার পর এবনি দ্বীপের বন্দরে এসে জাহাজ নোঙর করা হলো। শহরের প্রধান প্রবেশদ্বারের মুখে তাঁবু গাড়ার হুকুম দিলো বন্দর। সেখানকার লোকের কাছ থেকে জেনে নিলো, সেই দ্বীপটার নাম-এ বনি দ্বীপ।
-এখানকার অধিপতির কি নাম?
লোকটি
জানালো,
আমাদের
সম্রাট
আরমাসুস। তার
একটিমাত্র পরমাসুন্দরী কন্যা-ৰ্তার নাম হায়ৎ-আল-নাফুস।
এই সময়ে রাত্ৰি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামায়।
পরদিন দুশো নয়তম রজনী :
গল্প
শুরু
হয়
: বদর
সেখানকার সম্রাটের কাছে
একখানা
চিঠি
পাঠায়।
নিজেকে
পরিচয়
দেয়-সে খালিদানের সুলতান
শাহরিমানের পুত্র
কামার
আল-জামান।
সম্রাট আরমানুসের সঙ্গে সুলতান শাহরিমানের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। তাঁর পুত্র এসেছে তার রাজধানীতে, সুতরাং যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে তাকে আদর অভ্যর্থনা করে রাজধানীতে নিয়ে যাওয়া হলো। শহরের গণ্যমান্য সম্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করিয়ে দিলেন সম্রাট। জামানের সম্মানে বিরাট এক ভোজসভার আয়োজন করা হলো। সারা শহর সুন্দর করে সাজানো হলো। তিন দিন ধরে নানা মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানে তাকে বিস্তর আদর অভ্যর্থনা জানানো হলো।
চতুর্থ দিন সকালে উঠে। বদর একাই হামামে চলে গেলো। সঙ্গে কোনও গোসল করাবার লোক নিলো না। নিজেকে ভাল করে ঘষেমেজে নতুন সাজপোশাক পরে তৈরি হয়ে নিয়ে সম্রাট আরমানুসের পাশে এসে বসলো। সম্রাট জিজ্ঞেস করলেন, বাবা, এখন তোমার কি অভিপ্রায় বলো। এখান থেকে কোথায় যাবে?
বদর
বলে,
তেমন
কোনও
হিসেব
করে
বেরুই
নি।
দেখি,
যে
দিকে
যেতে
ইচ্ছে
হয়,
যাবো।
সম্রাট
আরমানুস বলেন,
তোমার
বাবার
সঙ্গে
আমার
বহুকালের ঘনিষ্ঠ
বন্ধুত্ব। তোমার
কথাও
তার
মুখে
অনেক
শুনেছি। রূপে
গুণে
তুমি
সেরা,
শুনেছিলাম। এখন
তোমার
সঙ্গে
সাক্ষাৎ আলাপ
করে
মুগ্ধ
হয়েছি,
বাবা।
আমার
ইচ্ছা,
আমার
একমাত্র কন্যা
হায়াৎ-অল-নাফুসকে তুমি
শাদী
শাদী
করো।
তার
মতো
সুলক্ষণা সুন্দরী মেয়ে
বড়
একটা
হয়
না।
আমি
বাবা,
মেয়ের
গুণের
কথা
বড়াই
করে
বলতে
নাই,
কিন্তু
সত্যিই
বলছি
বাবা,
তার
মতো
গুণবতী
কন্যা—সে একমাত্র তোমারই
যোগ্য।
নানা
দেশের
নানা
শাহজাদা রাজকুমাররা তাকে
বিয়ে
করার
জন্য
পাগল।
কিন্তু
কাউকেই
আমার
মনে
ধরেনি।
তোমাকে
দেখার
পর,
তোমার
সঙ্গে
আলাপ
পরিচয়
করার
পর
আমি
মনে
মনে
ভেবেছি,
তোমার
জন্যেই
সে
বুঝি
জন্মেছে। এই
সবে
সে
পনেরোয়
পা
দিয়েছে। আমি
বৃদ্ধ
হয়েছি,
আর
ভোগবিলাস ভালো
লাগে
না,
তুমি
যদি
রাজি
হও
বাবা,
তবে
তোমার
হাতে
মেয়েটাকে তুলে
দিয়ে
তোমাকে
আমার
সিংহাসনে বসিয়ে
আমি
বাণপ্রস্থ নিতে
চা।
বাংলা অনুবাদ : ক্ষিতিশ সরকার
ইতি–
কামার আল-জামান
পুনঃ—শহরের প্রবেশদ্বারের পাশে বড় সরাইখানায় আমি উঠিয়াছি। আংটিটা পুরে খোজার হাতে দিয়ে বললো, তোমার রাজকুমারীকে দিয়ে এসো।
বাইরে পর্দার এপারে দাঁড়িয়ে জামান শুনতে পেলো, খোজাটা বলছে, মালকিন, পর্দার এপারে দাঁড়িয়ে আছেন এক জ্যোতিষী। তিনি বলেছেন, আপনাকে সামনে না দেখেই তিনি আপনার ব্যামো সারিয়ে পারবেন। এই নিন, উনি আপনাকে খুলে দেখতে বলেছেন।
বদর-এর আর তাঁর সয় না। ক্ষিপ্রহাতে চিঠিখানা খুলে ফেলে। আংটিটা দেখেই সে চমকে ওঠে। এই তো সেই আংটি। —তার ভালোবাসার হাতে সে পরিয়েছিলো। বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করতে থাকে। তবে কি আল্লাহ এতদিনে মুখ তুলে চাইলেন। চিঠিখানা পড়তে থাকে। হঠাৎ সে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। এবার বুঝি সে সব সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে যাবে। পর্দা ঠেলে সে বাইরে আসে। সামনেই দাঁড়িয়েছিলো জামান। এক মুহূর্তে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে-তারপরই কাঁপিয়ে পড়ে ওর বুকে। দু’হাতে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। এতকাল কোথায় ছিলে, সোনা। এত কষ্ট কি করে দিতে পারলে।
জামানের চোখ দুটিও জলে ভরে আসে। বদরের মাথায় কপালে হাত বুলাতে থাকে। —আমিও তো সেই একই কথা বলতে পারি সোনা। তুমিই সেই রাতে কোথায় উধাও হয়ে গেলে?
—কী, কী হয়েছে? রাজকুমারী সাফ কি রে?
ঘায়ুর বিশ্বাস করতে পারে না। —কী সব যা তা বলছিস?
—বলিস কি রে?
সম্রাট আর তিলমাত্র ধৈর্য ধরতে পারেন না। মাথার মুকুট পরতে ভুলে গেলেন। পায়ের জুতা ওখানেই পড়ে রইলো। খালি পায়ে খালি মাথায় ছুটলেন হারেমে। দেখলেন, সত্যিই বদর, আগের মতো হাসি খুশি সুস্থ হয়ে গেছে। মেয়ের কপালে চুম্বন করে বললেন, যাক, এতদিনে আমার দুঃখের দিন শেষ হলো।
কামার আল-জামানকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি অসাধ্য সাধন করেছ বাবা। আমার সব দিয়েও তোমার ঋণ শোধ করতে পারবো না। এখন বলে কে তুমি?
সম্রাট বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে শুনলেন সেই অদ্ভূত কাহিনী। শুধু মুখে বলতে পারলেন, তাজ্জব ব্যাপার! এ কাহিনী সোনার অক্ষরে লিখে রাখা দরকার।
দরবারের সেরা কলমচীকে ডেকে বললেন, শাহজাদার এই কাহিনী যত্ন করে লিখে রেখে দাও। আগামী দিনের মানুষ এ কাহিনী পাঠ করে অনেক শিক্ষা লাভ করতে পারবে।
শহরের প্রধান কাজীকে ডাকা হলো। খাঁটি মুসলমান প্রথায় শাদীনামা তৈরি হয়ে গেলো। আনন্দ উৎসবমুখর হয়ে উঠলো সারা প্রাসাদ, সারা শহর। আলোর মালায় সাজানো হলো প্রাসাদ, ইমারৎ। খানাপিনা, নাচ গান হৈ-হাল্লায় মাতোয়ারা হয়ে উঠলো সকলে। লাহরের এবং দরবারে সম্রান্ত আমির ওমরাহ সওদাগর সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা এসে নব দম্পতির সুখ সুনিবিড় দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন কামনা করে শুভেচ্ছা জানিয়ে গেলো।
দীর্ঘকালের প্রতীক্ষার অবসান হলো, আবার ফিরে এলো সেই মধুযামিনী। বদর আর কামার অল-জামান সুখের সায়রে গা ভাসিয়ে দিলো। এতদিন পরে তারা প্ৰাণ ভরে হাসলো, গাইলো, খানা পিনা করলো, আর গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে নিশ্চিন্ত আরামে ঘুমালো।
ভোরের দিকে জামান স্বপ্ন দেখলো, তা বাবা সুলতান শাহরিমান সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। কেঁদে কেঁদে তার দু’চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। বলছেন, জামান, বেটা, তোমার শোকে আমি আজ মৃত্যুপথ যাত্রী। একটি বার এসো বাবা, যাবার আগে একবার প্রাণ ভরে দেখে যাই। তুমি ছাড়া জীবন আমার মরুভূমি হয়ে গেছে। কি হবে আমার এই অতুল ঐশ্বর্য, এই বিশাল সলতানিয়ত দিয়ে? একটি বার এসো বাবা।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো। বাবার বিষাদ বিষণ্ণ করুন মুখখানাই বারবার চোখের সামনে ভূক্ত থাকলো। এক অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করে ওঠে জামান। তার আর্তনাদ বদর জোগে \3CQ
জামান কঁকিয়ে ওঠে, না।
—তবে? তবে কি তোমার পেটে দরদ হচ্ছে? মৌরির তেল মালিশ করে দেব পেটে?
—তবে কি তোমার বদহজম হয়েছে। একটু জোয়ানের আরেক খাবে? কিংবা এক গেলাস গোলাপ জলের শরবৎ?
এই সময় রাত্রি শেষ হতে চলেছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিমে চুপ করে বসে থাকে।
দুশো ছয়তম রজনীতে আবার সে গল্প শুরু করে :
খুব ভোরো বদর প্রধান খোজাকে পাঠালো সম্রাটের কাছে। ঘায়ুর তাকে দেখেই শঙ্কিত হলেন, আবার এই সক্কালবেলায় কী দুঃসংবাদ বয়ে নিয়ে এলি বাঁদর।
-আজ্ঞে রাজকুমারী আপনার সঙ্গে দুটো কথা কইতে চান। খুব দরকারী।
—দাঁড়া, আমি আমার মুকুট আর জুতো পরে নিই।
বদরের হারেমে এসে ঘায়ুর বললেন, কাল রাতে কি এক গাদা লঙ্কার ঝাল খেয়েছিলি, মা? এই সাত সকলে তোমাদের ঘুম ভাঙলো কি করে? কী ব্যাপার? কেন ডেকেছো?
—এ তো বড় সুখের কথা, মা। স্বামীর সঙ্গে শ্বশুর ঘরে যাবে, এর চেয়ে আনন্দের কথা আর কি হতে পারে? তবে একটা কথা মা, তুমিও তো আমার একমাত্র সন্তান, জীবনে কোনও একটা দিন চোখের আড়াল করিনি। আমার কষ্টটাও নিশ্চয়ই বুঝবে। তাই বলছি, একটা বছর পরে একবার আমার কাছে ফিরে এসো।
বদর বাবার হাতে চুমু খেয়ে বলে, এ তুমি কি বলছে, বাবা, তোমাকে না দেখে কি আমিই থাকতে পারবো? যত তাড়াতাডি হয় আমি তোমাকে দেখতে আসবো।
সকাল থেকে সাজ সাজ রাব পড়ে গেলো। রাজকুমারী বদর যাবে শ্বশুরবাড়ি। গাধা খচ্চর উটের পিঠে বোঝাই হতে থাকলো সাজ-সামগ্ৰী। সম্রাট ঘায়ুর নানা মূল্যবান দুষ্প্রাপ্য উপহার উপটৌকনে ভরে দিলেন। সেই সঙ্গে দিলেন অমূল্য ধন-দৌলত হীরা-জহরৎ। জিনিস পত্র বাঁধা ছাঁদা করতেই দুপুর গড়িয়ে গেলো। সম্রাট সাশ্রনয়নে বিদায় দিলেন কন্যা জামাতাকে। কামার অল-জামান আর বদর-এর চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়লো।
কিন্তু শহর ছাড়িয়ে প্রান্তরের পথে যেতে না যেতেই চোখের জল শুকিয়ে গেলো। আনন্দে উদ্দাম হয়ে উঠলো দুজনে। তারপর চলা আর চলা।
এইভাবে তিরিশটা দিন পথ চলার পর একটা ঘন সবুজ শস্যক্ষেত্রের পাশে এসে ওরা আস্তানা গাড়লো। এইখানে কয়েকটা দিন বিশ্রাম করবে তারা। কাছেই নদী আছে, সুতরাং জলের কষ্ট হবে না। খুঁজে পেতে খেজুর গাছের ছায়ায় তাঁবু গাড়া হলো! বন্দরের শরীরে এত ধকল হইবে কি করে। ফুলের ঘায়ে যে মেয়ে মূৰ্ছা যায়, সে কি না একটানা এতটা পথ উটের পিঠে এসেছে। যদিও হাওদায় মখমলের গদি ছিলো। তবুও উটের দুলকি চালের দুলনিতে সারা শরীর ব্যথায় টন টন করছে। সামান্য একটু কিছু মুখে দিয়ে তীবুর ভিতরে সে টান ট্রান হয়ে শুয়ে পড়লো। শোয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমে গলে গেলো বন্দর। কামার আল-জামান সঙ্গের অনুচরদের বললো, তোমাদের তীবুগুলো একটু দূরে খাটাও। রাজকুমারী বড় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়েছেন। তোমাদের হট্টগোলে তার নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
তাঁবুর ভিতরে ঢুকে জামান দেখে, একটা কঁচুলী আর পাতলা ফিনফিনে একটা মসুল-এর তৈরি রেশমী-সেমিজ পরে বদর ঘুমে অচেতন। মাঝে মাঝে একটা হালকা হাওয়া এসে সেমিজটা ওপরের দিকে উড়িয়ে দিয়ে পালাচ্ছে। জামানের চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। একটি মাসের অতৃপ্ত কামনা দেহ কুরে কুরে খেতে থাকে। পাশে বসে বদরের সারা দেহে হাত বুলাতে থাকে জামান। দেহ, মন উত্তপ হতে থাকে। হঠাৎ কোমরে শক্ত মতো কি একটা হাতে ঠেকে। একটা অচেনা পাথর। নিশ্চয়ই মহামূল্যবান। তা না হলে বদর কেন শরীরে ধারণ করবে। হয়তো এর কোনও দৈব ক্ষমতা আছে। তার পাতানো ভাই মারজাবন দিয়ে থাকবে হয়তো বা। হয়তো এর গুণে অনেক বিপদ আপদ কেটে যায়—
আলগোছে পাথরটাকো খুলে নিয়ে তীবুর বাইরে চলে এলো জামান। পরীক্ষা করে দেখবে, চিনতে পারে কি না। পাথরটার চারটে মুখ। কি সব আঁকিবুকি কাটা আছে চারপাশে। কিছুই বোধগম্য হয় না। তবে দেখে বোঝা যায়, পাথরটা কোনও মন্ত্রপুত।
পাথরটা হাতে নিয়ে একমনে নিরীক্ষণ করছিলো সে। এমন সময় একটা পাখি শো করে নেমে এসে, ছোঁ। মেরে ছিনিয়ে নিয়ে নিমেষে উধাও হয়ে গেলো।
এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
দুশো সাততম রজনীতে আবার শুরু করে :
কিছুক্ষণের জন্য সে হতভম্ব হয়ে পড়ে। এমন যে একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারে তার মাথাতেই আসেনি। কিন্তু এখন উপায় কি হবে। রাজকুমারী জেগে যখন দেখতে তার পাথরটা নাই তখন সে তাকে কি বলে সান্ত্বনা দেবে। পাথরটা নিশ্চয়ই তার প্রাণাধিক প্রিয়।
একটা পাথরের ঢ়িল কুড়িয়ে নিয়ে ছুটে যায় গাছটার দিকে। প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে ছুঁড়ে মারে। কিন্তু তার আগেই পাখিটা উড়ে পালায়। পালিয়ে কিন্তু বেশি দূর যায় না। আর একটু দূরের একটা গাছের ডালে গিয়ে বসে। আর একটা ঢ়িল নিয়ে জামান ওকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। কিন্তু পাখিটা মহা ধডিবাজ। ঢ়িল মারার মুহূর্তেই সে শো করে উড়ে যায়। গিয়ে বসে আর একটা গাছের ডালে। জামানের মাথায় খুন চেপে যায়। যে ভাবেই হোক, পাখিটাকে মেরে ফিরে পেতেই হবে পাথরটা। পাখিটাও বড় সেয়ানা। বারবারই এমন একটা দূরত্ব রেখে কোনও একটা গাছের ডালে বসছে, যেখান থেকে পাথরটা স্পষ্ট দেখা যায়—এবং জামানের মনে আশা জাগে, হয়তো সে এবার তাকে ধরাশায়ী করতে পারবে। কিন্তু না, তাড়া করতে করতে অনেক বাগ বাগিচা পার হয়ে যায়। মারতে আর পারে না কিছুতেই।
গাছপালা ছাড়িয়ে পাখিটা গিয়ে বসে কাছেরই একটা পাহাড়ের চূড়ায়। জামান মরিয়া হয়ে উঠেছে। কোনও দিকে তার ভ্রূক্ষেপ নাই। পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠে যায়। পাথর ছুঁড়ে মারে পাখিটাকে। পাখিটাও টুক করে উড়ে গিয়ে বসে আর একটা চূড়ায়। এইভাবে পাহাড়ের কন্দরে উপত্যকায় পাখিটার পিছনে পিছনে ছুটে হয়রান হয়ে পড়ে।
কয়েক ঘণ্টা কেটে গেলো। সূর্য গেলো পাটে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো। ঘেমে নেয়ে একশা হয়ে গেছে সে। এখন কি করে বদরের সামনে দাঁড়াবে। কী জবাবদিহি সে করবে? হয়তো এমনও হতে পারে, তার এই অমূল্য রত্নটার শোকে সে অসুস্থও হয়ে পড়তে পারে।
ক্রমশঃ অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে থাকে। কামার আল-জামান ভাবে, এই অবস্থায় এই দুৰ্গম গিরি পর্বত অতিক্রম করে তাঁবুতে ফেরা সঙ্গত হবে না। অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনাই বেশি। তা ছাড়া হিংস্ব জন্তু জানোয়ারদের ভয়ও তাকে শঙ্কিত করে তোলে।
সামনের একটা গাছের ডালে বসে পাখিটা পাখা ঝাপটায়। সেই অন্ধকুরেও জামান দেখতে পায় পাখির ঠোঁটে পাথরটা ধক ধিক করে জুলছে। দারুণ আক্ৰোশে ফেটে পড়ে সে। পাথরের টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে ছুঁড়ে মারে। পাখিটা বিশ্ৰী বিদঘুটে একটা আওয়াজ তুলে উড়ে গিয়ে আর একটা গাছের ডালে বসে। জামান তখন উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন দুৰ্গম গিরি পথ ভেঙে পাখিটাকে তাড়া করতে থাকে। কিন্তু বৃথাই সে চেষ্টা। এক সময় ক্লান্ত অবসন্ন দেহটাকে আর টানতে পারে না। একটা পাথরের টিলার উপর বসে পড়ে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে।
পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে দেখে সেই টিলোটার উপরই শুয়ে তার অঘোর ঘুমে রাত কেটে গেছে। পাখিটার ডানা ঝাপটানিতে আবার সে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। মরিয়া হয়ে জামান ওর পিছু পিছু ধাওয়া করে। পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারতে থাকে। কিন্তু পাখিটা তার নাগালের বাইরে অথচ আশেপাশেই এগাছ ও গাছ লাফিয়ে উড়ে বসে।
জামানের তখন রোখি চেপে বসেছে। যে ভাবেই হোক পাখিটাকে ঘায়েল করে পাথরটা পেতে হবে। কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। পাখিটা একটু একটু করে উড়তে উড়তে আরও অনেকটা পথ তাকে প্রলুব্ধ করে নিয়ে যায়।
সারাটা দিন পাখিটার পিছনে ধাওয়া করতে করতে আবার সন্ধ্যা নেমে আসতে থাকে। জামান ক্লান্ত দেহে বসে পড়ে। দুটো দিন দানা পানি পেটে পড়েনি। তৃষ্ণায় ছাতি ২ ফেটে যাচ্ছে। ক্ষিদেয় পেট জুলছে। এবার সে এদিক ওদিক এগোতেই দেখতে থাকে, কোথাও খাবার কিছু সংগ্বহ করা যায়। কিনা। একটু এগোতেই কয়েকটা আপেল আর চেরী গাছ দেখতে পেলো। সামনে একটা ঝরনা। গোটাকয়েক আপেল আর চেরী ফল পেড়ে গোগ্রাসে খেলো। তারপর আঁজলা করে ঝরনার জল খেয়ে পাশেই একটা জায়গায় শুয়ে পড়লো। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘুম।
দুটো দিন দুটো রাত পার হয়ে গেছে। তিন দিনের দিন সকাল বেলায় চোখ খুলেই আবার সেই দৃশ্য। সামনের একটা চেরী গাছের ডালে পাখিটা বসে ডানা ঝাপটাচ্ছে। আবার শুরু হলো পাখি সংহারের প্রচেষ্টা। সে দিনও জামান-এর সব চেষ্টা বিফল হলো। কোনও ক্রমেই সে তাকে কব্জা করতে পারে না। অথচ তারই নাকের ডগা দিয়ে শো করে উড়ে গিয়ে অন্য এক গাছের ডালে অথবা গিরিচূড়ায় বসে। জামানও নাছোড়বান্দা-পাখিটাকে তাক করে করে অজস্র অগুন্তি ঢিল ছুঁড়তে থাকে। কিন্তু পাখিটা এমনই ওস্তাদ তার সব নিশানাকেই অবলীলাক্রমে পাশ কাটিয়ে দিতে পারে। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে থাকে। গিরি পর্বতমালা পেরিয়ে এবার সে সমতলভূমিতে এসে পড়ে। চাষীরা যাব। ভুট্টার ক্ষেতে কাজ করে চলেছে। পাখিটা উড়তে গিয়ে বসে কোনও খেজুর গাছের মাথায়। জামান মাটির ঢ়িল তুলে তাক করে মারে। কিন্তু পাখিটা টুক করে উড়ে গিয়ে আরও একটু দূরে আর একটা গাছের ডালে বসে।
জামানের মাথায় তখন খুন চেপে গেছে। ঐটুকু পাখির এই রকম বেয়াদপি সুলতান শাহরিমানের পুত্র হয়ে কিছুতেই সে বরদাস্ত করতে পারে না। মনে হয়, একবার যদি তাকে হাতের মুঠোয় পায়, তাহলে ওর এই ফাজিল চালাকি হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দেবে। কিন্তু হাতের মুঠোয় সে আর এলো না। বরং শাহজাদা জামানকে নাকে দড়ি দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে এসে ফেলল, এক সমুদ্রের ধারে। একটা আখরোটের গাছের ডালে বসে অদ্ভুত উল্লাসের আওয়াজ করতে লাগলো। সে। জামানের সারা শরীর খর রৌদ্রতাপে ঝলসে গেছে। দরদরি করে ঘাম ঝরছে। দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁফ ধরে গেছে। তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। চোখে সর্ষে ফুল দেখতে। তবু ক্ষোভ আক্ৰোশে জুলতেই থাকে। প্রায় অবসন্ন দেহে একটা মাটির ডেলা তুলে ঈশুনিয়ে প্রাণপণে ছুঁড়ে মারে। পাখিটা ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে আকাশে ওড়ে। জামানের মাথার ওপরে চক্রাকারে কয়েকটা পাক দেয়। জামান আর একটা ঢ়িল হাতে তুলে নেয়। কিন্তু ততক্ষণে পাখিটা অদৃশ্য হয়ে যায়।
জামানের সব আশা ভরসার ইতি হয়ে গেলো। এবার সে মাটির ওপরে থাপ করে বসে পড়ে। চোখে ফেলে জল আসে। এত প্রচেষ্টা সব ব্যর্থ হয়ে গেলো। এখন সে কি করবে? কিছুই ভাবতে পারে না।
অবসাদে দেহ এলিয়ে পড়ে জমানের। সেখানেই ঘাসের উপর গা ঢেলে দিয়ে শুয়ে পড়ে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে।
ঘণ্টা দুই বাদে ঘুম থেকে জেগে উঠে জামান ভাবতে এখন সে কোথায় যাবে। অচেনা অজানা বিদেশ বিভূঁই। পথ ঘাট কিছুই জানা নাই। একজন পথচারীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে সামনে এগোলেই কিছুদূরে একটা শহর। জামান সেই দিকে চলতে থাকে। মনে মনে ভাবে, তাঁবু থেকে কত দূর সে চলে এসেছে কে জানে। না জানি তার অদর্শনে বদর-এর কি দশা হয়েছে এ ক’দিনে।
শহরের প্রবেশ দ্বারে এসে হাজির হয় জামান। সড়ক ধরে সোজা ঢুকে পড়ে শহরের অভ্যন্তরে। কেউই তাকে বাধা দেয় না। কোনও প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে না। চারিদিকের ঘরবাড়ি দেখে মনে হয়, শহরটা মুসলমান জনবসতি বহুল। আরও খানিকটা এগাতে একটা বিরাট বাগিচার ফটকের সামনে এসে হাজির হয়। বাগানের মালী সাচ্চ মুসলমান। জামানকে সালাম আলেকুম বলে স্বাগত জানায়। জামানও যথারীতি আলেকুম সালাম জানায়। জামান জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা! জনাব, আমি যখন পথ ধরে আসছিলাম, রাস্তায় যাদের দেখলাম, কেউই আমার সঙ্গে কোনও কথাবার্তা বললো না কেন? সবারই চোখে মুখে, লক্ষ্য করলাম অদ্ভুত এক ঠাণ্ডা কৌতূহল। কী ব্যাপার?
এইসব ভয়ঙ্কর তাজ্জব কথাবার্তা শুনতে শুনতে জমানের মাথা ঘুরতে থাকে। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। নিজেকে আর সে ধরে রাখতে পারে না। কোনও রকমে ঘাসের উপর বসে পড়তে পারে।
মালী বুঝতে পারে, ছেলেটি অনাহারে অনিদ্রায় কাহিল হয়ে পড়েছে। জামানকে সঙ্গে করে সে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। ছোট্ট সুন্দর বাড়িখানা বাগানেরই লাগোয়া। কিছু খানা, খানিকটা শরবৎ তাকে খেতে দেয়। ক্ষুধার্তা জামান তৃপ্তি করে খায়। বৃদ্ধ মালি প্রশ্ন করে, কে বাবা, আপনি? কেন এসেছেন এই সর্বনাশা দেশে?
দু’শো আটতম রজনীতে আবার সে শুরু করে :
-কী করবেন। বাবা, সবই খোদাতালার ইচ্ছা। তিনি যা করান। তাই আমরা করি, তিনি যা বলান তাই আমরা বলি। ও নিয়ে দুঃখ করে লাভ নাই। নিয়তির লেখা খণ্ডাতে পারে না কেউ। প্ৰাণ ভরে শুধু তীকে ডাকুন, তিনিই সব সমস্যার সুরাহা করে দেবেন। তবে আমার কি মনে হয় বাবা, জানেন? রাজকুমারী এখন আর ওখানে নাই। একদিন দেখার পরই তারা খালিদানে রওনা হয়ে গেছে। ভেবেছে, আপনার সন্ধান করতে হলে, সুলতান শাহরিমানকে খবর দেওয়া দেওয়া দরকার। তাহলে তিনি চারদিকে লোকলিস্কর পাঠিয়ে তল্লাস করতে পারবেন। আমার এই ছোট্ট গরীবখানায় আপনি কয়েকটা দিন বিশ্রাম করুন। তারপর আমি আপনার দেশে ফেরার ব্যবস্থা করে দেব। এখানকার বন্দরে মাঝে মাঝে খালিদানের সওদাগরি জাহাজ এসে ভেড়ে। কাজকাম শেষ করে আবার তারা ফিরে যায়। ওই রকম যে কোনও একটা জাহাজে চেপে দিব্যি আপনি দেশে চলে যেতে পারবেন। আমি রোজই একবার বন্দরে গিয়ে খোজ নিয়ে আসবো। খালিদানের জাহাজ এলেই আপনি চলে যাবেন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, কখনও বা দেখা যায় হামেশাই জাহাজ আসছে যাচ্ছে। আবার কখনও বা বছর ঘুরে যায়। তবুও একখানার পাত্তা মেলে না।
বৃদ্ধ মালী তার কথা রাখে। প্রতিদিন সে বন্দরে খোঁজখবর নিতে যায়। কিন্তু দিনের পর দিন কেটে থাকে, জামান জামাই-আদরে তার বাড়িতে দিন কাটাতে থাকে।
আসুন এবার আমরা রাজকুমারী বদর-এর দিকে চোখ ফেরাই। তাঁবুর ভিতরে বদরের ঘুম ভেঙে যায়। এদিক ওদিক তাকিয়ে কামার অল-জামানকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু এদিক ওদিক কোথাও না দেখতে পেয়ে উঠে বসে। হঠাৎ সে বুঝতে পারে তার কোমরের পাথরটা নাই। বদর ভাবে হয়তো তার স্বামী দেখার জন্যে খুলে নিয়ে গেছে। এখুনি এসে পড়বে।
কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরেও যখন পর সে ফিরে আসে না বদর চিন্তিত হয়ে। ওঠে। উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। আরও অনেক সময় কেটে যায়, কিন্তু জামান ফিরে আসে না। ক্রমে সন্ধ্যা নেমে আসে, অজানা আশঙ্কায় বদর-এর বুক কেঁপে ওঠে। ঐ মন্ত্রপূত পাথরটার উপরেই তার রাগ হতে থাকে। রাগ হয় তার পাতানো ভাই মারজাবনের ওপর। কেন সে ঐ হতচ্ছাড়া পাথরটা তাকে পরতে দিয়েছিলো? হয়তো। ওরা হাতে ধরাতেই জামানের কোনও বিপদ আপদ ঘটেছে।
সারাটা রাত বিনিদ্র ভাবে কাটে। তারপর দিনও সে দারুণ উৎকণ্ঠা নিয়ে কাটায়। কিন্তু জামান ফিরে আসে না। ভয়ে কাউকে কিছু বলতে সাহস করে না। সঙ্গের চাকর নফররা যদি শোনে, শাহজাদা নাই তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে তাদের মনে বদ মতলব মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। এই চরম সংকটের সময়ে নিজেকে খুব শক্ত সহজ করে রাখার চেষ্টা করে, বদর তার বাঁদীকে বলে, খু হুঁশিয়ার, শাহজাদা তাঁবুতে নাই, একথা যেন ঘুণাক্ষরেও কেউ টের না পায়।
আর মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে সে তার আশু কর্তব্য ঠিক করে ফেলে। নিজের সাজপোশাক ছেড়ে ফেলে বদর পরে নেয় জামানের সাজপোশাক। মাথায় পরে একটা বাহারী রেশমী টুপী। কোমরে বেঁধে নেয় একখানা ইয়াবড় তলোয়ার। আর বাঁদীটাকে পরিয়ে দেয় তার নিজের পোশাক। এমনভাবে সাজিয়ে তোলে, দেখলে কে বলবে সে-ই বদর নয়।
দুজনে তাঁবু ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। আগে আগে বদর আর পিছন পিছন বাঁদী। সকলে দেখলে, শাহজাদা জামান তার বেগম বদরকে নিয়ে বেরিয়েছেন। আভুমি আনত হয়ে সকলে কুর্নিশ জানিয়ে নতমুখে দাঁড়িয়ে থাকে। বদর বলে, এবার আমরা রওনা হবো, আজই, এখুনি। সবাই তৈরি হয়ে নাও।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বাঁধোচাঁদা শেষ করে আবার, তারা যাত্রা শরু করে। সমুদ্রতীরে এসে একখানা জাহাজ ভাড়া করা হলো। সাগর। পাডি দিয়ে যেতে হবে এবার।
একটানা প্ৰায় দশ দিন চলার পর এবনি দ্বীপের বন্দরে এসে জাহাজ নোঙর করা হলো। শহরের প্রধান প্রবেশদ্বারের মুখে তাঁবু গাড়ার হুকুম দিলো বন্দর। সেখানকার লোকের কাছ থেকে জেনে নিলো, সেই দ্বীপটার নাম-এ বনি দ্বীপ।
-এখানকার অধিপতির কি নাম?
এই সময়ে রাত্ৰি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামায়।
পরদিন দুশো নয়তম রজনী :
সম্রাট আরমানুসের সঙ্গে সুলতান শাহরিমানের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। তাঁর পুত্র এসেছে তার রাজধানীতে, সুতরাং যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে তাকে আদর অভ্যর্থনা করে রাজধানীতে নিয়ে যাওয়া হলো। শহরের গণ্যমান্য সম্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করিয়ে দিলেন সম্রাট। জামানের সম্মানে বিরাট এক ভোজসভার আয়োজন করা হলো। সারা শহর সুন্দর করে সাজানো হলো। তিন দিন ধরে নানা মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানে তাকে বিস্তর আদর অভ্যর্থনা জানানো হলো।
চতুর্থ দিন সকালে উঠে। বদর একাই হামামে চলে গেলো। সঙ্গে কোনও গোসল করাবার লোক নিলো না। নিজেকে ভাল করে ঘষেমেজে নতুন সাজপোশাক পরে তৈরি হয়ে নিয়ে সম্রাট আরমানুসের পাশে এসে বসলো। সম্রাট জিজ্ঞেস করলেন, বাবা, এখন তোমার কি অভিপ্রায় বলো। এখান থেকে কোথায় যাবে?
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments