বিষাদ সিন্ধু : মীর মশাররফ হোসেন_মহরম পর্ব : ২৪তম প্রবাহ
আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্ প্রেরিত কাসেদ্ পুরস্কার-লোভে দিবারাত্রি পরিশ্রম করিয়া দামেস্কে পৌঁছিলেন। দামেস্কাধিপতি এজিদ্ কাসেদের পরিচয় পাইয়া সমুদয় বৃত্তান্ত নির্জনে অবগত হইয়া, মহানন্দে কাসেদ্কে যথোচিত পুরস্কৃত করিয়া প্রধান সৈন্য ও সৈন্যাধ্যগণকে আহ্বানপূর্বক বলিতে লাগিলেন, "এত দিনের পর আমার পরিশ্রমের ফল ফলিয়াছে। আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্ কৌশল করিয়া হোসেনকে মদিনা হইতে বাহির করিয়াছেন, তোমরা এখনই প্রস্তুত হইয়া হোসেনের অনুসরণ কর। মরুস্থল কারবালার পথে যাইলে পলাতক হোসেনের দেখা পাইবে। যদি পথের মধ্যে আক্রমণ করিবার সুযোগ না হয়, তবে একেবারে নির্দিষ্ট স্থানে যাইয়া অগ্রে ফোরাত নদীর পূর্বকূল বন্ধ করিবে। মদিনা হইতে কুফা পর্যন্ত গমনোপযোগী আহারীয় এবং পানীয় বস্তুর সুবিধা করিয়া হোসেন মদিনা পরিত্যাগ করিয়াছেন। সঙ্গেও ষষ্টি-সহস্র লোক। ইহাদের পানোপযোগী জল সর্বদা সংগ্রহ করা সহজ কথা নহে। তোমাদের প্রথম কার্যই কারবালার ফোরাত নদীর কূল আবদ্ধ করিয়া রাখা। হোসেন-পক্ষীয় একটি প্রাণীও যেন ফোরাতকূলে আসিতে না পারে, ইহার বিশেষ উপায় করিতে হইবে। দিবারাত্রি সদাসর্বদা সতর্কভাবে থাকিবে যে, কোন সময়ে কোন সুযোগে এক পাত্র জল হোসেনের কি তৎসঙ্গী কোন লোকের আশু প্রাপ্য না হয়। বারি রোধ করিতে পারিলেই তোমাদের কার্য সিদ্ধ হইবে। হোসেনের মস্তক যে ব্যক্তি এই দামেস্কে আনিয়া আমার সম্মুখে উপস্থিত করিবে, তৎক্ষণাৎ তাহাকে লক্ষ মুদ্রা পুরস্কার দিব এবং বিজয়ী সৈন্যদিগের নিমিত্ত দামেস্কের রাজভাণ্ডার খুলিয়া রাখিব। যাহার যত ইচ্ছা, সে তাহা গ্রহণ করিতে পারিবে; কোন প্রতিবন্ধক থাকিবে না।"
প্রধান প্রধান সৈন্যগণ, ওমর, সীমার প্রভৃতি বলিয়া উঠিলেন, "মহারাজ! এবার হোসেনের মস্তক না লইয়া আর দামেস্কে ফিরিব না।" সীমার অতিদর্পে বলিতে লাগিল, "আর কেহই পারিবে না, আমিই হোসেনের মাথা কাটিব, কাটিব-নিশ্চয়ই কাটিব; পুরস্কারও আমিই লইব। আর কেহই পারিবে না। হোসেনের মাথা না লইয়া সীমার এ নগরে আর আসিবে না। -এ-ই সীমারের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।"
এজিদ্ বলিলেন, "পুরস্কারও ধরা রহিল।" এই বলিয়া এজিদ্ সীমারকে প্রধান সৈন্যধ্যক্ষ পদে নিয়োজিত করিয়া বিদায় করিলেন।
পাঠকগণ! এতদিন আপনাদের সঙ্গে আসিতেছি, কোন দিন মনের কথা বলি নাই। বিষাদ-সিন্ধুতে হাসি রহস্যের কোন কথা নাই, তন্নিমিত্ত এ পর্যন্ত হাসি নাই। কাঁদিবার অনেক কথা আছে, অথচ নিজে কাঁদিয়া আপনাদিগকে কাঁদাই নাই। আজ মন কাঁপিয়া উঠিল। সীমার হোসেনের মস্তক না লইয়া আর দামেস্কে ফিরিবে না-প্রতিজ্ঞা করিল। সীমার কে? পরিচয় এখনো প্রকাশ পায় নাই; কিন্তু ভবিষ্যতে ইহার পরিচয় অপ্রকাশ থাকিবে না। সীমারের নামে কেন যে হৃদয়ে আঘাত লাগিতেছে, জানি না। সীমারের রূপ কোন লেখকই বর্ণনা করেন নাই, আমিও করিব না। কল্পনাতুলি হস্তে তুলিয়া আজ আমি এখন সেই সীমারের রূপ বর্ণনে অক্ষম হইলাম। কারণ বিষাদ-সিন্ধুর সমুদয় অঙ্গই ধর্মকাহিনীর সহিত সংশ্লিষ্ট। বর্ণনার কোন প্রকার ন্যূনাধিক্য হইলে প্রথমতঃ পাপের ভয়, দ্বিতীয়তঃ মহাকবিদিগের মূল গ্রন্থের অবমাননাভয়ে তাঁহাদের বর্ণনায় যোগ দিলাম। সীমারের ধবল বিশাল বক্ষে লোমের চিহ্নমাত্র নাই, মুখাকৃতি দেখিলেই নির্দয় পাষাণহৃদয় বলিয়া বোধ হইত-দন্তরাজি দীর্ঘ ও বক্রভাবে জড়িত-প্রাচীন কবির এইমাত্র আভাস এবং আমারও এইমাত্র বলিবার অধিকার, নাম সীমার।
এজিদ্ সৈন্যদিগকে নগরের বাহির করিয়া দিয়া ফিরিয়া আসিলেন। আবদুল্লাহ্ জেয়াদের লিখনানুসারে মারওয়ানকে সৈন্যসহ মদিনা পরিত্যাগ করিয়া কুফা নগরে মোস্লেমকে আক্রমণ করিবার জন্য আদেশ প্রদান করিলেন। সংবাদবাহক সংবাদ লইয়া যাইবার পূর্বেই ওত্বে অলীদ ও মারওয়ান সৈন্যসহ হোসেনের অনুসরণ করিতে কুফার পথে যাত্রা করিয়াছিলেন। পথিমধ্যে দামেস্কের কাসেদ্মুখে সমুদয় বৃত্তান্ত অবগত হইয়া অলীদ এবং মারওয়ান অবিশ্রামে কুফাভিমুখে সৈন্যসমভিব্যাহারে যাইতে লাগিলেন। দিবারাত্র পরিশ্রম করিয়া বুদ্ধির অগম্য; চিন্তার বহির্ভূত-অল্প সময় মধ্যে কুফার নিকটবর্তী হইলে জেয়াদের অনুচরেরা জেয়াদের নিকট সংবাদ দিল যে, "মহারাজ এজিদের সৈন্যাধ্যক্ষ মারওয়ান এবং ওত্বে অলীদ সৈন্যসহ নগরপ্রান্তে উপস্থিত হইয়াছেন, কী কর্তব্য?"
জেয়াদ এতৎ সংবাদে মহা সন্তুষ্ট হইয়া মোস্লেম-সমীপে যাইয়া করজোড়ে বলিতে লাগিলেন, "বাদশাহ নামদার! এজিদের প্রধান সৈন্যাধ্য মহাবীর মারওয়ান এবং ওত্বে অলীদ কুফার অতি নিকটবর্তী হইয়াছে। বোধ হয় অদ্যই নগর আক্রমণ করিবে। প্রভু হোসেনের আশায় এত দিন রহিলাম, তিনিও আসিলেন না; শত্রুপক্ষ নগরের সীমার নিকটবর্তী, এক্ষণে কী আদেশ হয়?"
মোস্লেম বলিলেন, "আমরা এমন কাপুরুষ নহি যে, শত্রু-অস্ত্রের আঘাত সহ্য করিয়া নগর রক্ষা করিব? আমি এখনই আমার সঙ্গী সৈন্য লইয়া মারওয়ানের গতিরোধ করিব এবং নগর আক্রমণে বাধা দিয়া তাহাদিগকেই আক্রমণ করিব। আপনি যত শীঘ্র পারেন, কুফার সৈন্য লইয়া আমার পশ্চাদ্বর্তী হউন।সৈন্যসহ আপনি আমার পশ্চাৎ-রক্ষক থাকিলে ঈশ্বর-কৃপায় আমি সহস্র মারওয়ানকে অতি তুচ্ছ জ্ঞান করি!"এই কথা বলিয়াই মোস্লেম মদিনার সৈন্যগণকে প্রস্তুত হইতে অনুমতিসঙ্কেত করিলেন। মদিনাবাসীরা এজিদ্ এবং এজিদের সৈন্য-শোণিতে তরবারি রঞ্জিত করিতে সদাসর্বদা প্রস্তুত। মোস্লেমের সাঙ্কেতিক অনুমতি, মারওয়ানের সহিত যুদ্ধের অণুমাত্র প্রসঙ্গ পাইয়াই সৈন্যগণ মার্ মার্ শব্দে শ্রেণীবদ্ধপূর্বক মোস্লেমের সম্মুখে দণ্ডায়মান হইল। সৈন্যদিগের উৎসাহ দেখিয়া মোস্লেম দ্বিগুণতর উৎসাহে অশ্বে আরোহণ করিলেন এবং মুহূর্ত মধ্যে সৈন্যগণ শ্রেণীবদ্ধপূর্বক নগরের বাহির হইলেন। কুফার সৈন্যগণও অত্যল্প সময় মধ্যে সুসজ্জিত হইয়া পূর্বতন প্রভু জেয়াদের সহিত সমরে চলিলেন।
মোস্লেম নগরের বাহির হইয়াই দেখিলেন যে, এজিদের চিহ্নিত পতাকাশ্রেণী বায়ু সহিত ক্রীড়া করিতেছে, যুদ্ধবাদ্য মহাঘোর রবে বাদিত হইতেছে। সৈন্যগণকে বলিলেন, "ভাই সকল! যে এজিদ্, যে মারওয়ান, যে ওত্বে অলীদের ভয়ে হোসেন মদিনাবাসীদিগের জন্য, মদিনাবাসীদিগের বিপদ উপদ্রব হইতে রক্ষার জন্য, কুফায় আসিতে মনস্থ করিয়া অগ্রে আমাদিগকে পাঠাইয়াছেন, সেই বিধর্মী কাফের তাঁহারই উদ্দেশে, কি আমাদের প্রাণ লইতে, কি আমাদিগকে যে এত সাহায্য করিতেছে, সেই জেয়াদের প্রাণ বিনাশ করিতে আসিয়াছে। কুফার সৈন্য আসিতে এখনও অনেক বিলম্ব। শত্রুকে সময় দিলেই চতুর্গুণ বল বৃদ্ধি হয়।আর অপেক্ষা নাই, 'কুফার সৈন্য আসিবে, একত্র যাইব'-ইহা বলিয়া আর সময় নষ্ট করিব না। আমরাই অগ্রে গিয়া শত্রুপকে বাধা দিয়া আক্রমণ করি।" মোস্লেম সহস্র সৈন্য লইয়া একেবারে শত্রুপক্ষের সম্মুখীন হইলেন এবং তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হইল।
জেয়াদ্ কুফার সৈন্য সংগ্রহ করিয়া মোস্লেমের পশ্চাদ্বর্তী হইলেন। নগরের অন্তসীমা শেষ তোরণ পর্যন্ত আসিয়া দেখিলেন, নগরের অন্তসীমায় যুদ্ধ আরম্ভ হইয়াছে। সৈন্যগণ অবাক্ হইল। সকলেই পূর্ব প্রভুর আজ্ঞা হঠাৎ লঙ্ঘন করা বিবেচনাসিদ্ধ নহে, এই বলিয়া বিরক্তিভাবে দণ্ডায়মান রহিল।
আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্ বলিতে লাগিলেন, "আমি এতদিন মনের কথা তোমাদিগকে কিছুই বলি নাই, আজ বলিবার সময় হইয়াছে বলিয়াই এণে বলিতেছি। হোসেনকে রাজ্যদান আমার চাতুরীমাত্র। আমি মহারাজ এজিদের আজ্ঞাবহ, অনুগৃহীত, আশ্রিত এবং দামেস্কাধিপতি আমার একমাত্র পূজ্য। কারণ আমি তাঁহার অধীনস্থ প্রজা। সেই রাজাদেশে হোসেনকে কৌশল করিয়া বন্দি করাই আমার মুখ্য উদ্দেশ্য, ঘটনাক্রমে তাহা হইল না। মোস্লেমকে যে উদ্দেশ্যে সিংহাসনে বসাইয়াছিলাম, তাহা এক প্রকার সম্পূর্ণ হইল; কিন্তু মূল উদ্দেশ্য সফল হইল না। মহারাজ এজিদের সৈন্য আসিয়াছে, কৌশলে মোস্লেমকেও নগরের বাহির করিয়া মহারাজ এজিদের সৈন্যসম্মুখীন করিয়া দিলাম, রাজাজ্ঞা প্রতিপালিত হইল! আমাদের নগরের বাহিরে কোন প্রয়োজন নাই, আমরা যুদ্ধে যাইব না, মোস্লেমের সহায়তাও করিব না। নগর-তোরণ আবদ্ধ কর, বলবান সাহসী সৈনিক পুরুষ দ্বারা দ্বার রক্ষা হউক। মোস্লেমের বাঁচিবার সাধ্য নাই। ওত্বে অলীদের অস্ত্রসম্মুখীন হইলেই মোস্লেমের ইহজগৎ পরিত্যাগ করিতে হইবে। তথাচ যদি মোস্লেম যুদ্ধে পরাস্ত হইয়া প্রাণরক্ষার জন্য নগরে আশ্রয় লইতে নগরদ্বারে উপস্থিত হয়, কিছুতেই নগরমধ্যে প্রবেশ করিতে দিবে না।"
সৈন্যাধ্যক্ষ আবদুল্লাহ্ জেয়াদের বাক্যে একেবারে অবাক্ হইয়া রহিল। জেয়াদের মনে এত চাতুরী, এত ছলনা, এত প্রতারণা, ইহাতে আরো আশ্চর্যান্বিত হইল। কি করিবে নগরদ্বার রুদ্ধ করিয়া দ্বারের নিকটবর্তী স্থানেই সৈন্য সহিত সকলেই একত্র হইয়া রহিল। ওত্বে অলীদ মোস্লেমকে দেখাইয়া সৈন্যগণকে বেগে অগ্রসর হইতে অনুমতি করিলেন। মোস্লেম ওত্লবে অলীদের আক্রমণে বাধা দিয়া বিশেষ পারদর্শিতার সহিত ব্যূহ রচনা করিয়া শত্রুসম্মুখে সৈন্যদিগকে দণ্ডায়মান করাইলেন। কিন্তু আক্রমণ করিতে আর সাহসী হইলেন না, আত্মরক্ষাই আবশ্যক মনে করিলেন। কুফার সৈন্য কত নিকটবর্তী হইয়াছে, তাহা দেখিতে পশ্চাতে ফিরিয়া যাহা দেখিলেন, তাহাতে মোস্লেমের মস্তক ঘুরিয়া গেল। জনপ্রাণীমাত্র নাই, অথচ নগরতোরণ বদ্ধ-মোস্লেম একেবারে হতবুদ্ধির ন্যায় হইয়া নগরের দিকে বারংবার চাহিয়া দেখিলেন, পূর্ব প্রকারেই নগরদ্বার বদ্ধ রহিয়াছে। নিশ্চয়ই মনে মনে জানিলেন যে, এ সকল জেয়াদের চাতুরী। চতুরতা করিয়া আমাকে নগরের বাহির করিয়াছে। এখন নিশ্চয়ই জানিলাম যে, জেয়াদের মনে নানাপ্রকার দুরভিসন্ধি ছিল। হোসেন-বধের জন্যই এই মায়াজাল বিস্তার,-তাহার তো আর সন্দেহ নাই। ভালই হইয়াছে, কুফায় আসিলে যে প্রকার বিপদগ্রস্ত হইতেন, তাহা আমার ভাগ্যেই ঘটিল। মোস্লেমের প্রাণ যাইয়াও যদি হোসেনের প্রাণরক্ষা হয়, তাহাও মোস্লেমের পক্ষে সার্থক।
মোস্লেম হতাশ হইলেন না; কিন্তু তাঁহাকে নূতন প্রকার চিন্তার আলোচনায় প্রবৃত্ত হইতে হইল।নিজ সৈন্য এবং কুফার সৈন্যের সাহায্যে যে যে প্রকার যুদ্ধের কল্পনা করিয়াছিলেন, এক্ষণে তাহা পরিবর্তন করিয়া নূতনরূপ চিন্তায় নিমগ্ন হইলেন। ওদিকে ওত্বে অলীদ কি মনে করিয়া আর অগ্রসর হইলেন না। আপন আয়ত্তাধীনে সম্ভবতঃ দূরে থাকিয়াই দ্বৈরথ যুদ্ধ আরম্ভ করিবার অভিপ্রায়ে মহাবীর ওত্বে অলীদ গম্ভীর স্বরে বলিতে লাগিলেন, "মোস্লেম, যদি নিতান্তই যুদ্ধসাধ হইয়া থাকে, তবে আইস, আমরাই উভয়ে যুদ্ধ করি, জয়-পরাজয় আমাদের উভয়ের উপরেই নির্ভর। অনর্থক অন্য অন্য প্রাণ বিনষ্ট করিবার আবশ্যক কী?"
মোসলেম সে কথায় উত্তর না দিয়া কতক সৈন্য সহিত ওত্বে অলীদকে ঘিরিয়া ফেলিলেন।
ওত্বে অলীদ আবার বলিলেন, "মোস্লেম! এই কী যুদ্ধের রীতি, না বীরপুরুষের কর্তব্য কার্য?কে তোমাকে বীর আখ্যা দিয়াছিল? 'কহ মহারথি! এই কী মহারথি-প্রথা'?"
মোস্লেম সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া সৈন্যদিগকে বলিলেন, "ভ্রাতৃগণ! বিধর্মীর হস্তে মৃত্যুই বড় পুণ্য। প্রভু মোহাম্মদের দৌহিত্রগণকে যাহারা, যে পাপাত্মারা-যে নরপিশাচেরা শত্রু মনে করে, তাঁহাদের প্রাণবিনাশের চেষ্টা করে, তাহাদের হস্তে প্রাণবিসর্জন করিতে পারিলে, তাহা অপেক্ষা ইহজগতে আর কী অধিকতর সুখ আছে? এক দিন মরিব বলিয়াই জন্মিয়াছি। যে মরণে সুখ, সহস্র সহস্র পাপ থাকিলেও সর্বসুখ ভোগের অধিকার, এমন মরণে কে না সুখী হয়? আমরা যুদ্ধে জয়ী হইব না, আশাও করি না। তবে বিধর্মীয় হস্তস্থিত তরবারি ইসলাম-শোণিতে রঞ্জিত হইয়া পরিণামে আমাদিগকে স্বর্গ-সুখের অধিকারী করিবে, এই আমাদের আশা। জয়ের আশা আর মনে করিয়ো না, আজই যুদ্ধের শেষ-আজই আমাদের জীবনের শেষ।" মোস্লেম এই বলিয়া ওত্বে অলীদের প্রতি অস্ত্রবর্ষণ করিতে লাগিলেন; মারওয়ান দেখিলেন যে, অলীদের পরমায়ু শেষ হইল, সমুদয় সৈন্য একত্রিত করিয়া মোস্লেম আক্রমণ করিয়াছে! ইহাতে একা এক প্রাণ, কতণ অলীদ রক্ষা করিবে? ক্ষণকাল বিলম্ব না করিয়া মারওয়ান সমুদয় সৈন্যসহ মোস্লেমকে আক্রমণ করিলেন। ভয়ানক যুদ্ধ আরম্ভ হইল। মোস্লেমের জীবনের আশা নাই; তাঁহার সৈন্যগণ বিধর্মীর হস্তে মরিবে, সেই আশায় কেবল মারিতেই লাগিলেন; ভবিষ্যৎ জ্ঞান, পশ্চাৎ লক্ষ্য, পার্শ্বে দৃষ্টি ইত্যাদির প্রতি কিছুই লক্ষ্য রাখিলেন না। মহাবীর মোস্লেম দুই হস্তে তরবারি ধরিলেন। অশ্ববল্গা দন্তে আবদ্ধ করিলেন। শত্রুসৈন্য অকাতরে কাটিয়া চলিলেন।মধ্যে মধ্যে "আল্লাহু আক্বার" নিনাদে দ্বিগুণ উৎসাহে সৈন্যদিগকে উৎসাহিত করিলেন। ওত্বে অলীদ ও মারওয়ান বহু পরিশ্রম ও বহু চেষ্টা করিয়াও মোস্লেমের লঘুহস্তচালিত চপলাবৎ তরবারি সম্মুখে আর তিষ্টিতে পারিলেন না। ক্ষণকালমধ্যে সৈন্যগণ ছত্রভঙ্গ হইয়া দিগ্বিদিকে পলাইতে লাগিল। মোস্লেমের সৈন্যগণও ঐ পলায়িত শত্রুর পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইয়া দেহ হইতে বিধর্মী মস্তক মৃত্তিকাশায়ী করিতে লাগিল।
পাঠকগণ! এতদিন আপনাদের সঙ্গে আসিতেছি, কোন দিন মনের কথা বলি নাই। বিষাদ-সিন্ধুতে হাসি রহস্যের কোন কথা নাই, তন্নিমিত্ত এ পর্যন্ত হাসি নাই। কাঁদিবার অনেক কথা আছে, অথচ নিজে কাঁদিয়া আপনাদিগকে কাঁদাই নাই। আজ মন কাঁপিয়া উঠিল। সীমার হোসেনের মস্তক না লইয়া আর দামেস্কে ফিরিবে না-প্রতিজ্ঞা করিল। সীমার কে? পরিচয় এখনো প্রকাশ পায় নাই; কিন্তু ভবিষ্যতে ইহার পরিচয় অপ্রকাশ থাকিবে না। সীমারের নামে কেন যে হৃদয়ে আঘাত লাগিতেছে, জানি না। সীমারের রূপ কোন লেখকই বর্ণনা করেন নাই, আমিও করিব না। কল্পনাতুলি হস্তে তুলিয়া আজ আমি এখন সেই সীমারের রূপ বর্ণনে অক্ষম হইলাম। কারণ বিষাদ-সিন্ধুর সমুদয় অঙ্গই ধর্মকাহিনীর সহিত সংশ্লিষ্ট। বর্ণনার কোন প্রকার ন্যূনাধিক্য হইলে প্রথমতঃ পাপের ভয়, দ্বিতীয়তঃ মহাকবিদিগের মূল গ্রন্থের অবমাননাভয়ে তাঁহাদের বর্ণনায় যোগ দিলাম। সীমারের ধবল বিশাল বক্ষে লোমের চিহ্নমাত্র নাই, মুখাকৃতি দেখিলেই নির্দয় পাষাণহৃদয় বলিয়া বোধ হইত-দন্তরাজি দীর্ঘ ও বক্রভাবে জড়িত-প্রাচীন কবির এইমাত্র আভাস এবং আমারও এইমাত্র বলিবার অধিকার, নাম সীমার।
এজিদ্ সৈন্যদিগকে নগরের বাহির করিয়া দিয়া ফিরিয়া আসিলেন। আবদুল্লাহ্ জেয়াদের লিখনানুসারে মারওয়ানকে সৈন্যসহ মদিনা পরিত্যাগ করিয়া কুফা নগরে মোস্লেমকে আক্রমণ করিবার জন্য আদেশ প্রদান করিলেন। সংবাদবাহক সংবাদ লইয়া যাইবার পূর্বেই ওত্বে অলীদ ও মারওয়ান সৈন্যসহ হোসেনের অনুসরণ করিতে কুফার পথে যাত্রা করিয়াছিলেন। পথিমধ্যে দামেস্কের কাসেদ্মুখে সমুদয় বৃত্তান্ত অবগত হইয়া অলীদ এবং মারওয়ান অবিশ্রামে কুফাভিমুখে সৈন্যসমভিব্যাহারে যাইতে লাগিলেন। দিবারাত্র পরিশ্রম করিয়া বুদ্ধির অগম্য; চিন্তার বহির্ভূত-অল্প সময় মধ্যে কুফার নিকটবর্তী হইলে জেয়াদের অনুচরেরা জেয়াদের নিকট সংবাদ দিল যে, "মহারাজ এজিদের সৈন্যাধ্যক্ষ মারওয়ান এবং ওত্বে অলীদ সৈন্যসহ নগরপ্রান্তে উপস্থিত হইয়াছেন, কী কর্তব্য?"
মোস্লেম নগরের বাহির হইয়াই দেখিলেন যে, এজিদের চিহ্নিত পতাকাশ্রেণী বায়ু সহিত ক্রীড়া করিতেছে, যুদ্ধবাদ্য মহাঘোর রবে বাদিত হইতেছে। সৈন্যগণকে বলিলেন, "ভাই সকল! যে এজিদ্, যে মারওয়ান, যে ওত্বে অলীদের ভয়ে হোসেন মদিনাবাসীদিগের জন্য, মদিনাবাসীদিগের বিপদ উপদ্রব হইতে রক্ষার জন্য, কুফায় আসিতে মনস্থ করিয়া অগ্রে আমাদিগকে পাঠাইয়াছেন, সেই বিধর্মী কাফের তাঁহারই উদ্দেশে, কি আমাদের প্রাণ লইতে, কি আমাদিগকে যে এত সাহায্য করিতেছে, সেই জেয়াদের প্রাণ বিনাশ করিতে আসিয়াছে। কুফার সৈন্য আসিতে এখনও অনেক বিলম্ব। শত্রুকে সময় দিলেই চতুর্গুণ বল বৃদ্ধি হয়।আর অপেক্ষা নাই, 'কুফার সৈন্য আসিবে, একত্র যাইব'-ইহা বলিয়া আর সময় নষ্ট করিব না। আমরাই অগ্রে গিয়া শত্রুপকে বাধা দিয়া আক্রমণ করি।" মোস্লেম সহস্র সৈন্য লইয়া একেবারে শত্রুপক্ষের সম্মুখীন হইলেন এবং তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হইল।
জেয়াদ্ কুফার সৈন্য সংগ্রহ করিয়া মোস্লেমের পশ্চাদ্বর্তী হইলেন। নগরের অন্তসীমা শেষ তোরণ পর্যন্ত আসিয়া দেখিলেন, নগরের অন্তসীমায় যুদ্ধ আরম্ভ হইয়াছে। সৈন্যগণ অবাক্ হইল। সকলেই পূর্ব প্রভুর আজ্ঞা হঠাৎ লঙ্ঘন করা বিবেচনাসিদ্ধ নহে, এই বলিয়া বিরক্তিভাবে দণ্ডায়মান রহিল।
আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্ বলিতে লাগিলেন, "আমি এতদিন মনের কথা তোমাদিগকে কিছুই বলি নাই, আজ বলিবার সময় হইয়াছে বলিয়াই এণে বলিতেছি। হোসেনকে রাজ্যদান আমার চাতুরীমাত্র। আমি মহারাজ এজিদের আজ্ঞাবহ, অনুগৃহীত, আশ্রিত এবং দামেস্কাধিপতি আমার একমাত্র পূজ্য। কারণ আমি তাঁহার অধীনস্থ প্রজা। সেই রাজাদেশে হোসেনকে কৌশল করিয়া বন্দি করাই আমার মুখ্য উদ্দেশ্য, ঘটনাক্রমে তাহা হইল না। মোস্লেমকে যে উদ্দেশ্যে সিংহাসনে বসাইয়াছিলাম, তাহা এক প্রকার সম্পূর্ণ হইল; কিন্তু মূল উদ্দেশ্য সফল হইল না। মহারাজ এজিদের সৈন্য আসিয়াছে, কৌশলে মোস্লেমকেও নগরের বাহির করিয়া মহারাজ এজিদের সৈন্যসম্মুখীন করিয়া দিলাম, রাজাজ্ঞা প্রতিপালিত হইল! আমাদের নগরের বাহিরে কোন প্রয়োজন নাই, আমরা যুদ্ধে যাইব না, মোস্লেমের সহায়তাও করিব না। নগর-তোরণ আবদ্ধ কর, বলবান সাহসী সৈনিক পুরুষ দ্বারা দ্বার রক্ষা হউক। মোস্লেমের বাঁচিবার সাধ্য নাই। ওত্বে অলীদের অস্ত্রসম্মুখীন হইলেই মোস্লেমের ইহজগৎ পরিত্যাগ করিতে হইবে। তথাচ যদি মোস্লেম যুদ্ধে পরাস্ত হইয়া প্রাণরক্ষার জন্য নগরে আশ্রয় লইতে নগরদ্বারে উপস্থিত হয়, কিছুতেই নগরমধ্যে প্রবেশ করিতে দিবে না।"
মোস্লেম হতাশ হইলেন না; কিন্তু তাঁহাকে নূতন প্রকার চিন্তার আলোচনায় প্রবৃত্ত হইতে হইল।নিজ সৈন্য এবং কুফার সৈন্যের সাহায্যে যে যে প্রকার যুদ্ধের কল্পনা করিয়াছিলেন, এক্ষণে তাহা পরিবর্তন করিয়া নূতনরূপ চিন্তায় নিমগ্ন হইলেন। ওদিকে ওত্বে অলীদ কি মনে করিয়া আর অগ্রসর হইলেন না। আপন আয়ত্তাধীনে সম্ভবতঃ দূরে থাকিয়াই দ্বৈরথ যুদ্ধ আরম্ভ করিবার অভিপ্রায়ে মহাবীর ওত্বে অলীদ গম্ভীর স্বরে বলিতে লাগিলেন, "মোস্লেম, যদি নিতান্তই যুদ্ধসাধ হইয়া থাকে, তবে আইস, আমরাই উভয়ে যুদ্ধ করি, জয়-পরাজয় আমাদের উভয়ের উপরেই নির্ভর। অনর্থক অন্য অন্য প্রাণ বিনষ্ট করিবার আবশ্যক কী?"
ওত্বে অলীদ আবার বলিলেন, "মোস্লেম! এই কী যুদ্ধের রীতি, না বীরপুরুষের কর্তব্য কার্য?কে তোমাকে বীর আখ্যা দিয়াছিল? 'কহ মহারথি! এই কী মহারথি-প্রথা'?"
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com

No comments