সৃষ্টির স্রষ্টা ।। তৈমুর খান

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে,
হে ছলনাময়ী।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
জগৎ স্বপ্ন নয়জানার পরইতুমিসর্বনামের আড়ালে সেই স্রষ্টাকেই রবীন্দ্রনাথ বার বার উপলব্ধি করেছেন। তুমি কখনােআমি ভেতর প্রবেশ করেছে, কখনােআমিহতে বেরিয়ে এসেছে। অনাদি অদৃশ্য হতে আমিও এসেছি, কিন্তু এই অদৃশ্যের আড়ালে যে আছে তাঁকে কি আমরা চিনি?‘ আমির আবরণ সহজে স্খলিত হয়ে যাকবললেও চৈতন্যের শুভ্রজ্যোতি কুহেলিকা ভেদ করে জেগে ওঠা কত অসম্ভব তা আমরা বুঝি রবীন্দ্রনাথ সারাজীবনের তপস্যায় তাঁকেই অনুধাবন করেছেন। দার্শনিক দেকার্ত বলেছেন, “আমি কথা বলছি, তাই আমি আছি।" এইআমিবােধটি স্বজ্ঞা, ব্রহ্মের অংশ। ব্রহ্ম হতেই সমূহ সৃষ্টি পরম্পরা জগৎব্যাপী চলে আসছে।
 
  মহাভারতের স্বর্গারােহন পর্বে যুধিষ্ঠির শ্রীকৃষ্ণের স্তব করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন
 
'‘কৃষ্ণপদে পড়ি রাজা করেন স্মরণ।
তব মায়া কে বুঝিতে পারে নারায়ণ।।
সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের তুমি হর্তা কর্তা।
প্রধান পুরুষ তিন ভুবনের ভর্তা ।।"
 
   আমাদের বিশ্বাস, ধর্ম, ঐতিহ্যের মধ্যেই এই 'নারায়ণজেগে থাকেন। আমরা এই নারায়ণ অর্থাৎ ব্রহ্মাকেই জেনে আসছি আমাদের আচরিত যাবতীয় ক্রিয়াকর্মে। ইহকাল পরকাল সবই তাঁর উপর সমর্পিত। তা না হলে কি এই জগৎ-সংসার হত? চন্দ্র-সূর্য হত? দিন-রাত্রি হত? জন্ম-মৃত্যুর বৃত্ত তৈরি হত? সব দেখার পেছনে যেমন কোনও বস্তু বিরাজ করে, তেমনি সব সৃষ্টির পেছনেই থাকে কোনও স্রষ্টা। স্রষ্টা না থাকলে কি সৃষ্টি সম্ভব? ছেলের বা সন্তানের জন্মের পেছনে থাকে তার পিতা, চারাগাছ জন্মের পেছনে থাকে তার বীজ, তেমনি সমূহ জীবনের পেছনে আছে এক মহাজীবন। এই মহাজীবনকেই আমরা উৎস বলে জানি।
 
 আমাদের আদি মানব সব ধর্মগ্রন্থগুলিতে প্রায় একইরকম উল্লেখ করা হয়েছে। বাইবেলে আদম-ইভের নিষিদ্ধ ফল খাওয়া এবং সন্তান প্রসব করার কাহিনি যেমন আছে, তেমনই মুসলমানের ধর্মীয় গ্রন্থকসসুল আম্বিয়া'তে আছে আদম বিবি হাওয়ার কাহিনি। উভয় ক্ষেত্রেই মাটি থেকেই স্রষ্টার আদম সৃষ্টি এবং আদমের পাঁজর থেকে তাঁর স্ত্রীর সৃষ্টির কথা পাই। হিন্দুশাস্ত্রের ভবিষ্যপুরাণে আছে, ঈশ্বরের ইচ্ছায় এক পুরুষ আর এক নারীর সৃষ্টির কথা। পুরুষের নাম এবং স্ত্রীর নাম সেখানেও দেওয়া হয়েছে আদম এবং হব্যবতী। সেখানে নিষিদ্ধ ফল বা পাপগাছের ফল খেয়ে তাঁদের হিংসুক চঞ্চল হয়ে ওঠার কথা আছে। পৃথিবীতে তাঁরাই বংশ বিস্তার করলেন। সব ধর্মের কথা মােটামুটি একই। মানুষ সৃষ্টির আদি স্রষ্টা ঈশ্বর বা প্রভু বা আল্লাহ। আর মানুষের উৎস এই আদম এবং হাওয়া বা হবা বা হব্যবতী।।
 
 একজন ঈশ্বর বিশ্বাসী আস্তিককে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, পৃথিবীতে স্রষ্টা আছে এর প্রমাণ
 
কী ?
 
উত্তরে তিনি একটি গল্প বলেছিলেন। গল্পটি এমনই
 
একদিন নদীর তীর ধরে একজন ঋষি ভ্রমণ করছিলেন। একসময় তিনি দেখলেন, জলের স্রোতে একটা গাছের আস্ত গুঁড়ি ভেসে চলেছে। কিছুদিন পর একই স্থানে তিনি আবার এলেন, দেখলেন গাছের গুঁড়িটি আর নেই। তার বদলে গুঁড়িটির চেরাই করা কতকগুলি তক্তা ভেসে চলেছে। আরও কিছুদিন পর একই স্থানে তিনি আবার এলেন। লক্ষ করলেন তক্তাণ্ডলি সব জোড়া দেওয়া একখানা আস্ত নৌকা হয়ে গেছে। তিনি প্রশ্ন করলেন, এটা কীভাবে সম্ভব?
 
উত্তরে জানালাম, নিশ্চয়ই এর পেছনে একজন স্রষ্টা আছেন, যিনি গাছ কেটেছেন, চেরাই করেছেন, চেরা কাঠের পাটাতন দিয়ে নৌকো বানিয়েছেন।
 
তখন তিনি জানালেন, এই পৃথিবীটাও তেমনি।স্রষ্টা আছেন বলেই এর সৃষ্টি সম্পূর্ণ হয়েছে। আলাে অন্ধকার দিয়েছেন। ঘুম জাগরণ দিয়েছেন। এসব যদি প্রাকৃতিক বলাে, তবে সেই প্রকৃতিই স্রষ্টা। কোনও কোনও ক্ষেত্রে Nature is God যেমন, তেমনি Time is Godও। সভ্যতা নৌকার মতাে, নদী প্রবাহ সময়েরই আনুভূমিক স্রোত, নিরীক্ষণকারী মানবই সেই বােধিকল্প বৃক্ষের উপমা বহন করে চলেছে।
 
আমাদের চৈতন্যসীমানা সীমিত। জলবিম্ব তুল্য আয়ু সীমানাও। বলেই আদিম জীবনকে বহন করে চলি আমরা। জগৎ সৃষ্টির মহাবিস্ময়কে অনুধাবন করার প্রয়াস অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়। নাস্তিকের দৃষ্টি যেমন নঞর্থকবাদের অন্ধকারে নিবদ্ধ;আস্তিকের দৃষ্টিও তেমনই ভক্তিবাদের তরলতায় স্বচ্ছ। উভয় ক্ষেত্রেই এক প্রজ্ঞাকে ধারণ করে বেড়ে ওঠে। মাঝখানে সংশয়বাদীরাই দোলায়িত হয় অস্বচ্ছ জীবনবােধে। তাঁদের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ সত্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্র হয়; তেমনি ইতিহাসের অভিজ্ঞতাকেও এই মতবাদে কাজে লাগাতে চায়। আবার মধ্যযুগে খ্রিস্টিয় ধর্মতত্ত্বের বিশ্বাসে আঘাত হানার জন্য সংশয়বাদের উত্থান হয়েছিল। কিন্তু কোনও সংশয়বাদই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।ভাববাদের প্রসন্ন অভিব্যক্তিটি অধিকাংশ মানুষকেই আশ্রিত করেছে। আত্মা হল ভাবেরই ভিন্নরূপ এবং আত্মা বা ভাব হল জগতের সমস্ত বস্তুর উৎস। পরমাত্মা ঈশ্বরই Universal Spirit বা ব্রহ্মাত্মা। বিশ্বপ্রকৃতি বিশ্বাত্মারই প্রতিচ্ছবি মাত্র। ভাববাদের বিভিন্নতা বহুধা বিস্তৃত। সুতরাং সদর্থক জীবনযাপনের ক্ষেত্রে ভাববাদী দর্শনের মূল্য অপরিসীম।
 
আদি পুস্তক পবিত্র বাইবেলে জগৎ সৃষ্টির বিবরণ এভাবে দেওয়া হয়েছে
 
'‘আদিতে ঈশ্বর আকাশমণ্ডল পৃথিবীর সৃষ্টি করিলেন।
 
পৃথিবী ঘাের শূন্য ছিল, এবং অন্ধকার জলধির উপরে ছিল, আর ঈশ্বরের আত্মা জলের উপরে অবস্থিতি করিতেছিলেন। পরে ঈশ্বর কহিলেন, দীপ্তি হউক; তাহাতে দীপ্তি হইল। তখন ঈশ্বর দীপ্তি উত্তম দেখিলেন এবং ঈশ্বর অন্ধকার হইতে দীপ্তি পৃথক করিলেন। আর ঈশ্বর দীপ্তির নাম দিবস অন্ধকারের নাম রাত্রি রাখিলেন।"
 
এই ভাবেই জগৎ জীবন সৃষ্টির ধারাটি ঈশ্বর সপ্তম দিন পর্যন্ত চালিয়ে বিশ্রাম নিলেন।
 
মুসলমান ধর্মে নবিগণের বিভিন্ন কাহিনিকসসুল আম্বিয়াগ্রন্থে আছে।সেখানে জগৎ সৃষ্টির কাহিটিও প্রায় অনুরূপরসুলুল্লাহ (দঃ) নিজেই বলেছেন, “আমি আল্লাহতালার নূর থেকে সৃষ্টি হয়েছি এবং আমার নূর থেকে সারা জগৎ সৃষ্টি।"
 
 হজরত আবদুল্লাহ বিন ছালাম (রাঃ) একদিন পৃথিবীর অবস্থা জানার জন্য হজরত (দঃ)-এর কাছে গিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে যেসব কথাবার্তা হয়েছিল তাতেই জানা যায় পৃথিবী কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে।
 
আল্লাহতালা দুনিয়াকে কী দিয়ে তৈরি করেছেন?
জলের ফেনা থেকে।
 —জলের ফেনা কিসের থেকে পয়দা হল ?
 —পানির ঢেউ থেকে।
ঢেউ কোথা থেকে পয়দা হল ?
পানি থেকে।
পানি কোথা থেকে পয়দা হল?
মরওয়ারেদ পাথরের টুকরা থেকে।
মরওয়ারেদ কোথা থেকে পয়দা হল?
অন্ধকার থেকে।
আপনি ঠিক বলছেন। আচ্ছা, দুনিয়া কিসের দ্বারা স্থায়ী রয়েছে?
কুহে কাহাকের দ্বারা।
কুহে কাহাক কিসের তৈরি?
নীল জমরদ পাথরের তৈরি এবং আসমানের নীলিমাও তার থেকে হয়েছে।
 
এইভাবেই জগৎ-জীবন সৃষ্টির নানা তথ্য একে একে উঠে আসে যা একজন বিশ্বাসীর কাছে পরম মূল্যবান। অন্ধকারের উৎস হতেই আলােকের উৎপত্তি উপনিষদের দর্শনে এই সত্যই সন্নিবিষ্ট হয়েছে। মুণ্ডক উপনিষদে বলা হয়েছে
 
‘'যথা সুদীপ্তাৎ পাবকাৎ বিস্ফুলিঙ্গাঃ সহস্রশঃ প্ৰভন্তে সরূপাঃ।।
 তথাক্ষরাৎ বিবিধাঃ সৌম্য ভাবাঃ প্রজায়ন্তে তত্র চৈবাপিযন্তি।।"
 
(//)
 
 অর্থাৎ প্রজ্জ্বলিত আগুন থেকে সহস্র সহস্র সজাতীয় স্ফুলিঙ্গ বেরিয়ে আসে, সেই রকম হে সৌম্য, সেই অক্ষর পুরুষ থেকে বিবিধ সত্তা উৎপন্ন হয় এবং তাতেই বিলীন হয়। এই অনন্তসত্তা, যা এই বিশ্বের উৎস বা মূলকারণ। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, "ইন্দ্রিয়ানুভূতির বাহিরে বাহিরে, এক অনন্ত সত্তা রহিয়াছে। জগৎ আমাদের সজ্ঞানভূমিতে প্রকাশিত (প্রক্ষেপিত) অনন্তসত্তা মাত্র। অনন্তের কিয়দংশ আমাদের চেতনার স্তরে প্রকাশিত হইয়াছে, উহাকেই আমরা আমাদের জগৎ বলিয়া থাকি।"
 
(বাণী রচনা /৩২৬)
 
 ব্রহ্ম যে অনন্ত, তার রূপে ওঁ স্বাহা অর্থাৎনূরঅর্থাৎ আলাে বা আগুন প্রক্ষিপ্ত তা বলাই বাহুল্য।নাসতাে সদ্ জায়েত' অর্থাৎ অনস্তিত্ব থেকে কোনও অস্তিত্বের উদ্ভব সম্ভব নয়। এই বিশ্ব সূক্ষ্ম একটি কারণের অন্যরূপ প্রকাশ এবং সেই কারণটি হলঅনন্ত। সুতরাং ব্রহ্মস্বয়ম্ভুআর এই ব্রহ্মাইঅনন্ত' এই অনন্তকেই আমরা ভিন্ন রূপে আল্লাহ, ঈশ্বর বলে থাকি। দীপ্তি বা তেজ, আলাে বা নূর সবই স্বজ্ঞা, বােধের চৈতন্যে উদ্গত ধারণা।স্রষ্টার মহাবিস্ময় বিচিত্র রূপ উপলব্ধি করি। কোনও কিছু আপনা থেকে হয় না, তার কারণ থাকে। অনন্তের কারণ এই অনন্তই। আমরাও অনন্তের অংশ ''পূর্ণাৎ পূর্ণম উদচ্যতে" (বৃহদারণ্যক //)—অনন্ত থেকে অনন্তই উদ্গত হয়। অতএব অনন্ত পিতাহীন বা কারণহীন। অনন্তব্রহ্মবা স্বয়ম্ভু।
  
আমাদের ধর্মীয় দর্শনে জগৎ-জীবনকে এভাবেই তুলে ধরা হয়েছে। স্রষ্টা তাঁর লীলাময় প্রকাশে প্রাণীকুল, উদ্ভিদজগৎ, জড়জগৎ এবং অদৃশ্য জগৎ সৃষ্টি করেছেন। মন অনন্ত জগৎকে জানতে গিয়েমায়াজগতেআবদ্ধ হল। আমাদের যাবতীয় জ্ঞান, বিজ্ঞান, যুক্তি, দর্শন সবকিছুই এই মায়ার জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
 
 ব্রহ্ম—                                 মায়ার জগৎ
মূলসত্তা বা আদি                    স্থান
একম বা infinite                     কাল
বা অনন্ত সত্তা                        নিমিত্ত বা   কার্যকারণ সম্পর্কযুক্ত
 
ইন্দ্রিয়ে আবদ্ধ বা সীমাবদ্ধমনঅনন্তের স্বরূপ উপলব্ধি করতে অক্ষম। সীমার মধ্যেই তার বিচরণ তাই স্থান-কাল-নিমিত্ত বা কার্যকারণেই তার সদ্গতি। সুতরাংমনবা বুদ্ধির সাহায্যে যে-জ্ঞান আমরা পাই তা পূর্ণ সত্য নয়, তা একধরনের সীমিত জ্ঞানমাত্র। তাই জগৎ বা জগৎস্রষ্টাকে বুঝতে হলে মনকে অতিক্রম করতে হবে। গীতায় আছে—“বিষ্টভ্যাহং ইদং কৃৎস্নং একাংশেন স্থিতাে জগৎ" (১০/৪২) অর্থাৎ আমি এক অংশের দ্বারা এই সমস্ত জগৎ ব্যাপিয়া অবস্থিত আছি। জগৎ সৃষ্টির পেছনে এই ব্রহ্মই বিরাজ করছেন। আর আমরা সর্বকালে এক একজন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্রষ্টা। সকলেই মায়ার জগৎ সৃষ্টি করে চলেছি। সংস্কৃতগমধাতু থেকে জগৎ এসেছে, যার অর্থ চলমান' বা dynamic আমরা বিশ্বকর্মার এক একটা হাতের আঙুলে এই চলমানতাকে সক্রিয় করে চলেছি মাত্র ছায়ার পেছনে যেমন কায়া তেমনি সৃষ্টির পেছনে স্রষ্টা কোথাও ব্যত্যয় নেই।

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.