আলিফ লায়লা : আরব্য রজনী_পর্ব-৭৯
ইংরেজি অনুবাদ : ডঃ জে. সি. মারদ্রুস
বাংলা অনুবাদ : ক্ষিতিশ সরকার
দু’শো আটানব্বইতম রজনীতে আবার সে শুরু করে :
কুলি সিন্দবাদ কৃতজ্ঞ চিত্তে গ্রহণ করে তার দান। মহা আনন্দে বাসায় ফিরে আসে। পরদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে রুজু নামাজাদি সেরে আবার সে বৃদ্ধ সিন্দাবাদের প্রাসাদের দিকে রওনা হয়।
সিন্দবাদ নাবিক তারই প্রতীক্ষায় বসেছিলো। আদর করে কাছে বসায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই এক এক করে আবার সব অতিথি অভ্যাগতরা এসে হাজির হয়। যথারীতি টেবিলে সাজানো ছিলো। সকালবেলার নাস্তা। খানাপিনা শেষ হলে সিন্দবাদ কাহিনী শুরু করে :
এবার আমি আর ভারি ভারি মোটা সওদা সঙ্গে নিলাম না। বিদেশের বাজারে আরবের মূল্যবান আতর নির্যাসের কদর খুব বেশি। এছাড়া বাগদাদের সূক্ষ্ম শিল্পকর্মও অন্য দেশে চড়া দামে বিক্রি হয়। পয়সার তো আমার অভাব নাই তখন, অনেক অর্থ ব্যয়ে এই সব বিলাসের সামগ্ৰী সংগ্রহ করে বসরা হয় এসে পৌঁছলাম। এখান থেকে দুনিয়ার প্রায় সব জায়গারই জাহাজ ছাড়ে। বসরা হয় গিয়ে একদল সাচ্চা মুসলমান, সদাশয় সওদাগরের সঙ্গে আমার দোস্তি হয়ে গেলো। তারাও বাণিজ্যে যাবে। ভালো সঙ্গীদল পেয়ে আমিও ভিড়ে গেলাম তাদের দলে।
দিনক্ষণ দেখে, আল্লাহর নাম নিয়ে একদিন জাহাজে চেপে বসলাম আমরা।
পালে হাওয়া লাগলো। জাহাজ চলতে থাকলো।
এক এক করে অনেক বন্দর আসে। শহরে শহরে আমরা সওদা ফিরি করি। আমি যে-ধরনের মূল্যবান বিলাস সামগ্ৰী সঙ্গে নিয়েছি সে-ধরণেও সওদা বড় একটা কেউই সঙ্গে নিতে পারে না। তাই যেখানেই দেখাই সবাই লুফে নিতে থাকে। প্রতিটি সওদায় মোটা লাভ হতে থাকে আমার। খুশিতে মন নেচে ওঠে।
এইভাবে চলতে চলতে একদিন আমরা মুসলমান সুলতানদের সলতানিয়াৎ এলাকা ছাড়িয়ে মোঝ-সমুদ্র ধরে পাডি জমিয়েছি। হঠাৎ কপ্তেন চিৎকার করে ওঠে। সর্বনাশ!
আমরা অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করি, কী হয়েছে, বলবে তো?
আমরা চিৎকার করে উঠি, যেভাবেই হোক, জাহাজের গতি ফেরাও। কাপ্তেন বললো, অসম্ভব। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজ বাঁদর দ্বীপে পৌঁছে যাবে। এখন চেষ্টা করে কোনও লাভ নাই। জোর করে ঘোরাতে গেলে জাহাজ ভেঙ্গে খানখান হয়ে যাবে।
আমরা উদ্রান্তের মতো জাহাজের ডেকে ছুটাছুটি করতে লািগলাম। সামনে মৃত্যু অবধারিত জেনে কে আর চুপচাপ বসে থাকতে পারে?
ওদের আক্রমণ করার দুঃসাহস আমাদের নাই। অথবা ওদের অ’ক্বমণ প্রতিরোধ কর, ‘। শক্তিও আমরা ধরি না। এই অবস্থায় আশু কর্তব্য কী, কিছুই ঠিক করতে পারছি না। এমন সময় হুড়পাড় করে তারা আমাদের জাহাজের ডেকে উঠে এলো। আমরা অনড় অচল হয়ে বসে রইলাম। ওরা আমাদের সওদাপত্র তছনছ করতে লাগলো। ওদের বীভৎ’ চেহারা দেখে আর বিকট চিৎকার শুনে হৃৎপিণ্ড শুকিয়ে যায়। বিচিত্র ধরনের অঙ্গভঙ্গী আর অদ্ভুল ধরনের মুখ বাদন করে তারা যে কত কি বলতে লাগালো তার একবৰ্ণও বুঝলাম না। আমোদর সামনেই তারা মাস্তুলের মাথায় উঠে পালের কাছি খুলে দিলো। তারপর হাল আর দ ডু অধিকার করে জাহাজটাকে সমুদ্রসৈকতে নিয়ে গিয়ে ভেড়ালো।
এক এক করে আমাদের সবাইকে টানতে টানতে তীরে নামালো ওরা কামরা তখন কোরবানীর খাসী; মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও রুখে দাঁড়াবার দুঃসাহস নাই।
আমাদের সকলকে নামিয়ে দিলো, কিন্তু ওরা কেউই জাহাজ থেকে নামবে না। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আমাদের যথাসর্বস্ব সওদাপত্ব ঠাসা জাহাজখানা নিয়ে ওরা মাঝদরিয়ায় অদৃশ্য হয়ে গেলো।
আমার মতো অনেকেই বুক ভাঙ্গা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। কিন্তু কান্নাকাটি করেই বা লাভ কী? বিদেশে বিপৰ্যয় ঘটতেই পারে। তার জন্য আগে থেকে যেমন সতর্ক হওয়াও সম্ভব না, তেমনি বিপদ এসে গেলে ভেঙ্গে পড়াও সঙ্গত না। অবস্থা ও সময়ের সঙ্গে মানিয়ে চলাই বিচক্ষণতা।
যাই হোক, আমাদের সর্বস্ব চলে গেছে। এখন বাঁচার পথ বের করতে হবে। আমরা সকলে সেই সমুদ্রসৈকতে বালির উপরে বসে এক সভা করলাম। ঠিক হলো আগে আমরা দ্বীপের অভ্যন্তরে ঢুকে কিছু খানাপিনার সন্ধান করবো। প্রথমে ফলমূল এবং জলের সন্ধান করে তারপর অন্য ফিকির খুঁজতে হবে।
সমুদ্রতীর থেকে খানিকটা ভিতরে ঢুকতেই নানারকম পাকা মিষ্টি ফল আর ঝর্ণার জলের খোঁজ পাওয়া গেলো। ধরে প্রাণ এলো। যাই হোক, অনাহারে শুকিয়ে মরতে হবে না।
এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে পাকা মিষ্টি ফলের সন্ধান করতে করতে আমরা আরও অনেকটা ভিতরে ঢুকে পড়েছি। হঠাৎ নজরে পড়লো, গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যায়, অদূরে এক প্রাসাদোপম অট্টালিকা। আপাতভাবে মনে হয় জনমানব শূন্য।
খানাপিনা শেষ করে আমরা ঐ ইমারতের দিকে এগিয়ে গেলাম। প্রকাণ্ড উঁচু, প্রস্থে দৈর্ঘে সমান-চতুষ্কোণাকৃতি পোল্লাই এক প্রাসাদ। চারদিক পাথরের প্রাচীরে ঘেরা। দু-দুটো সিংহ দরজা পেরিয়ে তবে প্রাসাদের চত্বরে প্রবেশ করা যায়।
শুধু সিংহ দ্বারই হাট হয়ে পড়ে আছে। সিংহ সদৃশ প্রহরী আজ আর নাই সেখানে। আমরা ভিতরে ঢুকে গেলাম। বিরাট প্রশস্ত প্রাঙ্গণসদৃশ এক কক্ষ। সারা ঘরময় থরে থরে সাজানো রানাবান্নার সাজ-সরঞ্জাম। বড় বড় কড়াই ডেকচি হাতা বেডি প্রভৃতি। ঘরের মেজেয় স্তুপীকৃত হাড়। কতকগুলো একেবারে শুকনো সাদা। আবার কতকগুলো এখনও মাংসের ঝোলকাল লেগে রয়েছে। একটা পচাদুৰ্গন্ধ নাকে এলো। সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। পলকের মধ্যেই আমরা সংজ্ঞা হারিয়ে মেজেয় লুটিয়ে পড়লাম।
সূর্য সবে পাটে বসেছে; এমন সময় বাজ পড়ার মতো। হুঙ্কারে আমাদের তন্দ্রাভাব কেটে গেলো। ধড়মড় করে উঠে বসতেই দেখলাম বিশাল দৈত্যের মতো একটা কালো কুৎসিত কদাকার একটা মানুষ সিডি দিয়ে নিচে নেমে আসছে। লম্বায় সে তাল গাছের সমান, হতকুৎসিৎ বাঁদরের চেয়েও দেখতে বীভৎস। তার চোখ দুটো গোলাকৃতি আগুনের ভঁটা। গাইতির কাটার মতো তার দাঁত আর মুখের গহ্বর ঠিক একটা ইদারার মতো। নিচের ঠোঁটটা ঝুলে পড়েছে বুক অবধি। কুলোর মতে কান দু’খানা কাঁধ ঢেকে ফেলেছে। হাতের নখগুলো ইয়া বড় বড়, আর থাবা-ঠিক সিংহের মতো।
দেখা মাত্র আমরা ভয়ে শিউরে উঠেছিলাম। পরে পাথরের মত নিশ্চল হয়ে বসে রইলাম। দেওয়ালের পাশে একটা বেঞ্চির উপরে সে বসলো। এক এক করে আমাদের সকলের ওপর চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিলো। তারপর উঠে এসে সিংহের মতো থাবা দিয়ে আমার ঘাড়টা চেপে ধরলো। তারপর ছোট্ট একটা ইঁদুর ছানার মতো আমার দেহটাকে শূন্যে তুলে এদিক ওদিক ঘোরাতে থাকলো। তারপর কি খেয়াল হলো, আমাকে মেজের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে আর একজনের ঘাড়ে থাবা বসালো। হয়তো আমার কৃশকায় দেহটা তার পছন্দসই হলো না। কিন্তু আমাকে ছেড়ে যাকে ধরলো তাকেও দু-একবার দুলিয়ে ছুঁড়ে দিলো। এইভাবে এক এক করে সে সকলের দেহের ওজন পরীক্ষণ করে দেখতে থাকলো। সব শেষে সে এলো কাপ্তেনের কাছে।
কাপ্তেনের শরীরটা বেশ মোটাসোটা তাগড়াই। যেমন লম্বা তেমনি চওড়া। তাকে দেখে দৈত্যাটার মুখে হাসি আর ধরে না। অর্থাৎ খুব পছন্দ হয়েছে তার।
এক হাত দিয়ে ওর কোমরটা আর এক হাত দিয়ে ঘাড়টা ধরে একটা মোচড় দিয়ে মুণ্ডুটা ছিঁড়ে ফেললো সে। তারপর একটা বিরাট কড়াই-এর মধ্যে ফেলে উনুনে আগুন জেলে দিলো। কিছুক্ষণ পরে কাপ্তেনের দেহের আধ সেদ্ধ মাংসপিণ্ডটা তুলে গোগ্রাসে খেতে থাকলো সে। খুব তৃপ্তি করে খেয়ে মোটা মোটা হাড়গুলো মেজের ওপর ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হওয়া মাত্র সে বেঞ্চিটার ওপরে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ে মোষের মতো নাক ডাকাতে লাগলো। এইভাবে পরদিন সকাল অবধি সে ঘুমিয়ে কাটালো। ঘুম ভাঙ্গামাত্র কোন দিকে ভ্বদক্ষেপ না করে যে পথে নেমে এসেছিলো। সেই সিডি দিয়েই আবার ওপরে উঠে চলে গেলো। আমাদের অবস্থা তখন অবৰ্ণনীয়। বেঁচে আছি কি নাই, সে বোধশক্তিও নাই কারো।
যখন বুঝলাম সে সত্যিই চলে গেছে, আমরা হাঁউমাউ করে কেঁদে ফেললাম।-এর চেয়ে গহিন সমুদ্রে ডুবে মরাও ঢের ভালো ছিলো, আল্লাহ। অথবা বাঁদরগুলো যদি আমাদের কলিজা ছিঁড়ে রক্ত পান করতো সেও বরং সহ্য হতো, কিন্তু কড়াই-এর ফুটন্ত তেলে ফেলে ভাজা হওয়া-উফঃ!
প্রাসাদের বাইরে বেরিয়ে এলাম আমরা। সারাদিন দ্বীপের এদিক ওদিক ঘুরলাম। লুকিয়ে থাকার মতো কোনও একটা গুহা বা ডেরা যদি কোথাও পাওয়া যায়। কিন্তু আতি পাতি করে খুঁজেও কোথাও কিছু পাওয়া গেলো না। সারা দ্বীপটািয়। আর কোনও বাড়িঘর নাই। না আছে কোনও পাহাড় পর্বত, না আছে কোনও গভীর জঙ্গল। সর্বত্রই ফাঁকা ফাঁকা গাছপালা বা উন্মুক্ত প্রান্তর।
সন্ধ্যা নেমে এলো। আমরা নিরুপায় হয়ে আবার সেই রাক্ষস পুরীতেই ফিরে এলাম। এছাড়া উপায়ই বা কী? রাক্ষসটার একটা গুণ-সে। আমাদের একজনকে ছাড়া দুজনকে এক সঙ্গে খাবে না। কিন্তু এই অরক্ষিত গাছতলায় রাত কাটোনর কী ভরসা। হয়তো এক রাতেই সদলে সকলে প্ৰাণ খোয়াবো আমরা। তার চাইতে যার নসীবে যা আছে, তাই হবে। রাক্ষস পুরীতেই যাওয়া যাক। যার বরাত খারাপ আজ রাতে তার প্রাণ যাবে
আমাদের বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই দৈত্যটা হুংকার ছাড়তে ছাড়তে নেমে এলো। আবার সে গত রাতের মতো এক এক করে সকলের দেহ পরীক্ষা করে। দেখতে থাকলো। কোনটা ওজনে বেশি ভারি। শেষ পর্যন্ত একজনকে বেছে নিয়ে একই কায়দায় আধাসিদ্ধ করে খেয়ে আবার বেঞ্চে শুয়ে পড়ে মোষের মতো নাক ডাকাতে লাগলো। যথারীতি পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কোনদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে আবার সে উপরে উঠে গেলো!
এরপর আমি উঠে আমার বক্তব্য পেশ করলাম। —শুনুন শেখ সাহেবরা, দৈত্যটাকে যদি মারতে পারি তো খুব ভালো, কিন্তু না যদি পারি সে ক্ষেত্ৰেও তো একটা উপায় ভাবতে হবে। আমি বলি কি—আমরা একটা কাঠের ভেলা বানাই। আমি দেখেছি সমুদ্রের ধারে অনেক কাঠের গুডি পালা দেওয়া আছে। ভোলাটায় চড়ে আমরা ভাসতে ভাসতে চলি। তারপর আল্লাহ। যদি মুখ তুলে চান, নিশ্চয়ই কোনও জাহাজের নাবিক আমাদের তুলে নেবে। নতুবা হয়তো কোনও নতুন দ্বীপে গিয়ে ভিড়বো! আর যদি পথের মধ্যে ডুবেই মরি, সে-ও তো এর চেয়ে অনেক ভালো হবে। এই অবধারিত আপ-মৃত্যুর জন্য প্রতিটি মুহূর্ত অপেক্ষা করার চেয়ে অনেক ভালো হবে। অনেক গৌরবের হবে।
সকলে আমার কথায় সায় দিলো।–বহুৎ আচ্ছা, চমৎকার!
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
#উপন্যাস
#মোলাকাত
#সাহিত্য_ম্যাগাজিন
#মোলাকাত
#সাহিত্য_ম্যাগাজিন
#Molakat
#ওয়েব_ম্যাগাজিন
#সাহিত্য
#ওয়েব_ম্যাগাজিন
#সাহিত্য
No comments