বিষাদ সিন্ধু : মীর মশাররফ হোসেন_উদ্ধার পর্ব : ৪০তম প্রবাহ

 
রে পথিক! রে পা­ষা­­হৃদয় পথিক! কী লো­ভে এত ত্র­স্তে দৌড়িতেছ? কী আশায় খণ্ডিত শির বর্শার অগ্র­ভা­গে বি­দ্ধ করিয়া লইয়া যা­­তেছ? শি­রে-হায়! খণ্ডিত শি­রে তো­মার প্রয়োজন কি? সী­মার! শি­রে তো­মার আব­শ্যক কি? হো­সেন তো­মার কী করিয়াছিল? তু­মি তো আর জয়না­বের রূপে মো­হিত হইয়াছি­লে না? জয়নাব ইমাম হা­সা­নের স্ত্রী। হো­সে­নের শির তো­মার বর্শা­গ্রে কেন? তু­মিই-বা সে শির লইয়া ঊর্ধ্ব­শ্বা­সে এত বে­গে দৌড়াই­তেছ কেন? যা­­তে­ছই-বা কো­থায়? সী­মার! এক­টু দাঁড়াও। আমার প্র­শ্নের উত্তর দিয়া যাও! কার সা­ধ্য তো­মার গম­নে বা­ধা দেয়? কার ক্ষ­­তা তো­মা­কে কি­ছু বলে? এক­টু দাঁড়াও। শি­রে তো­মার স্বা­র্থ কি? খণ্ডিত শি­রে প্রয়োজন কি? অর্থ? হায় রে অর্থ! হায় রে পা­­কী অর্থ! তুই জগ­তের সকল অন­র্থের মূল।জী­বের জী­­নের ধ্বংস, সম্প­ত্তির বি­নাশ, পি­তা-পু­ত্রে শত্রু­তা, স্বা­মী-স্ত্রী­তে মনো­মা­লি­ন্য, ভ্রা­তা-ভগ্নী­তে কলহ, রা­জা-প্র­জায় বৈরী­ভাব, বন্ধু-বা­ন্ধ­বে বি­চ্ছেদ। বি­বাদ, বি­­ম্বাদ, কলহ, বি­রহ, বি­­র্জন, বি­নাশ, সকল তো­মার জন্য। সকল অন­র্থের মূল কা­­ণই তু­মি। তো­মার কী মো­হি­নী­­ক্তি! কী মধু­মা­খা বি­­সং­যু­ক্ত প্রেম, রা­জা, প্র­জা, ধনী, নি­র্ধন, যু­বক, বৃ­দ্ধ, সক­লেই তো­মার জন্য ব্য­স্ত,-মহা­ব্য­স্ত-প্রাণ ওষ্ঠা­গত। তো­মা­রই জন্য-কে­­­মা­ত্র তো­মা­রই কা­­ণে-কত জনে তীর, তর­বা­রি, বন্দুক, বর্শা, গো­লা­গু­লি অকা­­রে বক্ষ পা­তিয়া বু­কে ধরি­তে­ছে। তো­মা­রই জন্য অগাধ জলে ডু­বি­তে­ছে। ঘোর অর­ণ্যে প্র­বেশ করি­তে­ছে, পর্ব­­শি­­রে আরো­হণ করি­তে­ছে, রক্ত, মা­­­পে­শী, পর­মা­ণু সং­যো­জিত শরীর! ছল­নে! তো­মা­রই জন্য শূন্যে উড়াই­তে­ছে। কী কু­হক! কী মায়া!!কী মো­হি­নী­­ক্তি!!! তো­মার কু­­কে কে না পড়িতে­ছে? কে না ধোঁকা খা­­তে­ছে? কে না মজি­তে­ছে? তু­মি দূর হও, তু­মি দূর হও! কবির কল্প­নার পথ হই­তে একে­বা­রে দূর হও। কবির চি­ন্তা­ধা­রা হই­তে একে­বা­রে সরিয়া যাও! তো­মার নাম করিয়া কথা কহি­তে অঙ্গ শি­­রিয়া উঠে! তো­মা­রই জন্য প্র­ভু হো­সেন সী­মা­­­স্তে খণ্ডিত।-রা­ক্ষ­সী! তো­মা­রই জন্য খণ্ডিত শির বর্শা­গ্রে বি­দ্ধ
সী­মার অবি­শ্রা­ন্ত যা­­তে­ছে। দি­­­ণি মলি­­মুখ, অস্তা­চল গম­নে উদ্যো­গী। সী­মা­রের অন্ত­রে না­না ভাব; তন্ম­ধ্যে অর্থ-চি­ন্তাই প্র­বল; চির-অভা­­গু­লি আশু মো­চন করাই স্থির। একাই মা­রিয়াছি, একাই কা­টিয়াছি, একাই যা­­তে­ছি, একাই পা­ইব, আর ভা­­না কী? লক্ষ টা­কার অধি­কা­রীই আমি। চি­ন্তার কোন কা­­ণই নাই। নি­শাও প্রায় সমা­গত। যাই কো­থা? বি­শ্রাম না করি­লেও আর বাঁচি না। নি­­­স্থ পল্লী­তে কোন গৃ­হীর আবা­সে যাইয়া নি­শা­যা­পন করি। তো সক­লই মহা­রাজ এজি­দ্ না­­দা­রের রা­জ্য­ভু­ক্ত, অধীন অন্ত­র্গত।সৈনিক বেশ, হস্তে বর্শা, বর্শা­গ্রে মনু­ষ্য­শির বি­দ্ধ, ভয়ানক রো­ষের লক্ষণ। কে কী বলি­বে? কার সা­ধ্য-কে কী করি­বে?
সী­মার এক গৃ­হীর আশ্র­মে উপ­স্থিত হইয়া স্থা­নে নি­শা­যা­পন করি­বেন জা­না­­লেন। বর্শা­বি­দ্ধ খণ্ডিত শির অস্ত্র­­স্ত্রে সু­­জ্জিত বু­ঝি রা­­সং­ক্রা­ন্ত কেহ-বা হয় মনে করিয়া গৃ­­স্বা­মী আর কোন কথা বলি­লেন না। সা­­রে সী­মা­­কে স্থান নি­র্দেশ করিয়া দি­লেন, পথ­শ্রা­ন্তি দূরী­­­ণের উপ­­রণ আদি আহা­রীয় দ্র­ব্য­সা­­গ্রী আনিয়া ভক্তি­­­কা­রে আতি­থ্য-সে­বা করি­লেন। ক্ষ­­কাল বি­শ্রা­মের পর অতি বি­নী­­ভা­বে বলি­লেন, "মহাশয়! যদি অনু­­তি করেন, তবে এক­টা কথা জি­জ্ঞা­সা করি।"
সী­মার বলিল- "কি কথা?"
"কথা আর কি­ছু নহে, আপ­নি কো­থা হই­তে আসি­তে­ছেন? আর এই বর্শা-বি­দ্ধ-শির কো­ন্ মহা­পু­রু­ষের?"
"ইহার অনেক কথা। তবে তো­মা­কে অতি সং­ক্ষে­পে বলি­তে­ছি। মদি­নার রা­জা হো­সেন, যাঁহার পি­তা আলী এবং মো­হা­ম্ম­দের কন্যা ফা­তে­মা যাঁহার জন­নী, তাঁহা­রই শির। কা­র্বা­লা প্রা­ন্ত­রে, মহা­রাজ এজি­দ্-প্রে­রিত সৈন্য সহিত সম­রে পরা­স্ত হইয়া এই অব­স্থা। দেহ হই­তে মস্তক ভি­ন্ন করিয়া মহা­রা­জের নি­কট লইয়া যা­­তে­ছি, পু­­স্কার পা­ইব। লক্ষ টা­কা পু­­স্কার। তু­মি পৌ­ত্ত­লিক, তো­মার গৃ­হে না­না দে­­দে­বীর প্র­তিমূর্তি আছে দে­খিয়াই আতি­থ্য গ্র­হণ করিয়াছি। মো­হা­ম্ম­দের শি­ষ্য হই­লে কখ­নো তো­মার গৃ­হে আসি­তাম না। তো­মার আদর-অভ্য­র্থ­না­তেও ভু­লি­তাম না, তো­মার আহারও গ্র­হণ করি­তাম না।"
"হাঁ, এত­ক্ষ­ণে জা­নি­লাম, আপ­নি কে? আর আপ­নার অনু­মানও মি­থ্যা নহে। আমি একে­শ্ব­­বা­দী নহি। না­না প্র­কার দেব-দে­বীই আমার উপা­স্য। আপ­নি মহা­রাজ এজি­দের প্রিয় সৈন্য, আমার অপ­রাধ গ্র­হণ করি­বেন না। স্ব­চ্ছ­ন্দে বি­শ্রাম করুন। কি­ন্তু বর্শা-বি­দ্ধ-শির প্র­কা­রে না রা­খিয়া আমার নি­­টে দি­লে ভাল হইত। আমি আজ রা­ত্রে আপন তত্ত্বা­­ধা­নে রা­খি­তাম। প্রা­তে আপ­নি যথা ইচ্ছা গমন করি­তেন। কা­রণ যদি কোন শত্রু আপ­নার অনু­­­ণে আসিয়া থা­কে, নি­শীথ সময়ে কৌ­­লে কি বল­প্রয়োগে এই মহামূল্য শির আপ­নার নি­কট হই­তে কাড়িয়া লয়, কি আপ­নার ক্লা­ন্তি­­নিত অবশ অল­সে, ঘোর নি­দ্রায় অচে­তন হই­লে আপ­নার অজ্ঞা­তে এই মহামূল্য শির,-আপা­­তঃ যা­হার মূল্য লক্ষ টা­কা-যদি কেহ লইয়া যায়, তবে মহা­দু­­খের কা­রণ হই­বে, আমা­কে দিন, আমি সা­­ধা­নে রা­খিব, আপ­নি প্র­ত্যূষে লই­বেন। আমার তত্ত্বা­­ধা­নে রা­খি­লে আপ­নি নি­শ্চি­ন্ত­ভা­বে নি­দ্রা­সুখ অনু­ভব করি­তে পা­রি­বেন।"
সী­মা­রের কর্ণে কথা­গু­লি বড়ই মি­ষ্ট বোধ হইল। আর দ্বি­রু­ক্তি না করিয়া প্র­স্তাব শ্র­­­মা­ত্রেই সম্মত হইল। গৃ­­স্বা­মী হো­সেন-মস্তক সম্মা­নের সহিত মস্ত­কে লইয়া বহু­­মা­­রে গৃ­­­ধ্যে রা­খিয়া দিল। পথ­শ্রা­ন্তি­হে­তু সী­মা­রের কে­বল শয়ন বি­­ম্ব; যে­­নই শয়ন অম­নই অচে­তন
গৃ­­স্বা­মী বা­স্ত­বিক হজ­রত মো­হা­ম্মদ মো­স্ত­ফার শি­ষ্য ছি­লেন না। না­না প্র­কার দেব-দে­বীর আরা­­না­তেই সর্ব­দা রত থা­কি­তেন। উপ­যু­ক্ত তিন পু­ত্র এবং এক স্ত্রী। নাম, "আজর।" (হজ­রত ইব্রা­হিম খলি­লু­ল্লার পি­তার নামও আজর বো­ত্প­­স্ত ছিল। ইনি সে আজর নহেন।)
সী­মা­রের নি­দ্রার ভাব জা­নিয়া, আজর স্ত্রী­পু­ত্র­সহ হো­সে­নের মস্তক ঘি­রিয়া বসি­লেন এবং আদ্য­ন্ত সমুদয় ঘট­না বলি­লেন!
যে ঘট­নায় পশু­­ক্ষীর চক্ষের জল ঝরি­তে­ছে, প্র­কৃ­তির অন্তর ফা­টিয়া যা­­তে­ছে, সেই দেহ-বি­চ্ছি­ন্ন হো­সেন-মস্তক দে­খিয়া কা­হার হৃদয়ে না আঘাত লা­গে? দেব-দে­বীর উপা­সক হউন, ইস­লাম ধর্ম­বি­দ্বে­ষীই হউন, নি­দা­রুণ দু­­খের কথা শু­নি­লে কে না ব্য­থিত হউন? পি­তা­পু­ত্র সক­লে এক­ত্র হইয়া হো­সেন-শো­কে কাঁদি­তে লা­গি­লেন
আজর বলি­লেন, "মনু­ষ্য­মা­ত্রেই এক উপ­­­ণে গঠিত এবং এক ঈশ্ব­রের সৃ­ষ্ট। জা­তি­ভেদ, ধর্ম­ভেদ, সে- সর্ব­­ক্তি­মান ভগ­বা­নের লী­লা। ইহা­তে পর­স্পর হি­­সা, দ্বেষ, ঘৃ­ণা, কে­বল মূঢ়তার লক্ষণ! ইমাম হা­সান-হো­সে­নের প্র­তি এজি­দ্ যেরূপ অত্যা­চার করিয়াছে, তা­হা মনে করি­লে হৃদয়মা­ত্রে­রই তন্ত্রী ছিঁড়িয়া যায়।সে দু­­খের কথায় কো­ন্ চক্ষু না জলে পরিপূর্ণ হয়? মা­নু­ষের প্র­তি এরূপ ঘো­­তর অত্যা­চার হউক আর না-হউক, জা­তীয় জী­বন বলিয়াও কী প্রা­ণে আঘাত লা­গে না? সা­ধু পরম ধা­র্মিক, বি­শেষ ঈশ্ব­­­ক্ত, মহা­পু­রুষ মো­হা­ম্ম­দের হৃদয়ের অংশ, ইঁহা­দের এই দশা? হায়! হায়!! সা­মা­ন্য পশু মা­রি­লে কত মা­নুষ কাঁদিয়া গড়াগড়ি যায়-বে­­নায় অস্থির হয়, আর মা­নু­ষের জন্য মা­নুষ কাঁদি­বে না! ধর্মের বি­ভেদ বলিয়া, মা­নু­ষের বিয়োগে মা­নুষ মনো­বে­­নায় বে­­না বোধ করি­বে না? যন্ত্র­ণা অনু­ভব করি­বে না? যে ধর্মই কেন হউক না, পবি­ত্র­তা রক্ষা করি­তে, তৎকা­র্যে যোগ দি­তে কে নি­বা­রণ করি­বে? মহা­পু­রুষ মো­হা­ম্মদ পবি­ত্র, হা­সান পবি­ত্র, হো­সে­নের মস্তক পবি­ত্র, সেই পবি­ত্র মস্ত­কের এত অব­মা­­না? যু­দ্ধে হত হইয়াছে বলিয়াই কী এত তা­চ্ছি­ল্য? জগৎ কয় দি­নের?এজি­দ্! তুই কী জগ­তে অমর হইয়াছি­স্? জী­­নশূন্য দে­হের সদ্গ­­তির সং­বাদ শু­নিয়া কী তোর চির-জ্ব­­ন্ত রো­ষা­গ্নি নি­র্বাণ হইত না? তোর আকা­ক্স­ক্ষা কি যু­দ্ধ-জয়ের সং­বাদ শু­নিয়া মি­টিত না? হো­সে­­­রি­বা­রের মহা ক্র­ন্দ­নের রোল সপ্ত­তল আকাশ ভেদ করিয়া অন­ন্ত­ধা­মে অন­ন্তরূপে প্র­বেশ করিয়া অন­ন্ত শোক বি­কাশ করি­তে­ছে! ঈশ্ব­রের আসন টলি­তে­ছে!-তোর মন কী এতই কঠিন যে জী­­নশূন্য শরী­রে শত্রু­তা সা­ধন করি­তে ত্রু­টি করি­তে­ছি­স্ না! তো­কে কো­ন্ ঈশ্বর গড়িয়াছিল জা­নি না; কী উপ­­­ণে তোর শরীর গঠিত, তা­হাও বলি­তে পা­রি না। তুই সা­মা­ন্য লো­ভের বশ­­র্তী হইয়া কী কা­ণ্ড করি­লি! তোর এই অমা­নু­ষিক কী­র্তি­তে জগৎ কাঁদি­বে, পা­ষাণ গলি­বে! এই মহা­পু­রুষ জী­বিত থা­কি­লে এই মু­খে কত শত প্র­কা­রে ঈশ্ব­রের গুণ-কী­র্তন-কত কাল ঈশ্ব­রের মহ­ত্ত্ব প্র­কাশ হইত, তা­হার কী ইয়ত্তা আছে? তুই অসময়ে মহা­­ষি হো­সে­নের প্রা­­­রণ করিয়াছি­স্, কি­ন্তু তোর পি­তা ইমাম বং­শের ভি­ন্ন নহেন; তাঁহার হৃদয় এমন কঠিন প্র­স্ত­রে গঠিত ছিল না! তাঁহার ঔর­সে জন্মিয়া তোর কি ভাব? রক্ত, মা­ংস, বী­র্য­গুণ আজ তোর নি­কট পরা­স্ত হইল। মা­নব শরী­রের স্বা­ভা­বিক গুণ আজ বি­­রীত ভাব ধা­রণ করিল। তাই যা­হাই হউক, আজ­রের এই প্র­তি­জ্ঞা-জী­বন থা­কি­তে হো­সেন-শির দা­মে­স্কে লইয়া যা­­তে দি­বে না; যত্নের সহিত, আদ­রের সহিত, ভক্তি­­­কা­রে সে মহা­প্রা­ন্তর কা­­বা­লায় লইয়া যাইয়া, শি­রশূন্য দে­হের সন্ধান করিয়া সদ্গ­­তির উপায় করি­বে; প্রাণ থা­কি­তে শির আজর ছাড়িবে না।"
আজ­রের স্ত্রী বলি­লেন, "এই হো­সেন, বি­বি ফা­তে­মার অঞ্চ­লের নি­ধি, নয়নের পু­ত্ত­লি ছি­লেন।হায়! হায়! তাঁহার এই দশা! জী­বন থা­ক্ বা যা­ক্, প্র­ভাত হই­তে-না-হই­তে আম­রা এই পবি­ত্র মস্তক লইয়া কা­র্বা­লায় যা­ইব। শে­ষে ভা­গ্যে যা থা­কে হই­বে?"
পু­ত্রে­রা বলিল, "আমা­দের জী­বন পণ, তথা­পি কি­ছু­তেই সৈনি­­­স্তে মস্তক প্র­ত্য­র্পণ করিব না। প্রা­তে সৈনি­­কে বি­দায় করিয়া সক­লে এক­ত্রে কা­র্বা­লায় যা­ইব।"
পু­­রায় আজর বলি­তে লা­গি­লেন, "ধা­র্মি­কের হৃদয় এক, ঈশ্ব­­­ক্তের মন এক, আত্মা এক।ধর্ম কী কখ­নো দুই হই­তে পা­রে? সম্ব­ন্ধ নাই, আত্মীয়তা নাই, কথায় বলে-রক্তে রক্তে লে­­মা­ত্রও যো­গা­যোগ নাই, তবে তা­হার দু­­খে তো­মা­দের প্রা­ণে আঘাত লা­গিল কেন? বল দে­খি, তাঁহার জন্য জী­বন উৎসর্গ করি­লে কেন? ধা­র্মিক-জী­বন কা­হার না আদ­রের? ঈশ্বর-প্রে­মিক কা­হার-না যত্নের? তো­মা­দের কথা শু­নিয়া, সা­হস দে­খিয়া, প্রাণ শী­তল হইল। পরো­­কা­­ব্র­তে জী­­­পণ কথা­টা শু­নিয়াও কর্ণ জুড়াইল। তো­মা­দের সা­­সেই গৃ­হে থা­কি­লাম। প্রাণ দিব, কি­ন্তু শির দা­মে­স্কে লইয়া যা­­তে দিব না।"
পর­স্পর সক­লেই হো­সে­নের প্র­­ঙ্গ লইয়া রজ­নী অতি­বা­হিত করি­তে লা­গি­লেন। প্র­ভাত হই­তে সন্ধ্যা পর্য­ন্ত কা­র্বা­লা প্রা­ন্ত­রে যে লো­­­র্ষক ঘট­না ঘটিয়াছে, তা­হা জগৎ দে­খিয়াছে। নি­শা­দে­বী জগৎকে আবার নূতন ঘট­না দে­খা­­তে, জগৎ-লো­চন রবি­দে­­কে পূর্ব গগন-প্রা­ন্তে বসাইয়া নি­জে অন্ত­র্ধান হই­বার উদ্যোগ করি­তে­ছেন। জগৎ কল্য দে­খিয়াছে, আজ আবার দে­খুক-নি­­স্বা­র্থ প্রে­মের আদ­র্শ দে­খুক-পবি­ত্র জী­­নের যথা­র্থ প্রণয়ী দে­খুক-সা­ধু-জী­­নের ভক্তি দে­খুক-ধর্মে দ্বেষ, ধর্মে হি­­সা, মা­নু­ষের শরী­রে আছে কি-না, তা­হার দৃ­ষ্টা­ন্ত দে­খুক-ভ্রা­তা, ভগি­নী, পু­ত্র, জায়া, পরি­জন বিয়োগ হই­লে লো­কে কাঁদি­তে থা­কে, জী­­­কে অতি তু­চ্ছ­জ্ঞা­নে, জী­বন থা­কি­তেই জী­­লী­লা ইতি করি­তে ইচ্ছা করে। পরের জন্য যে কাঁদি­তে হয় না, প্রাণ দি­তে হয় না, তা­হারও জ্ব­­ন্ত প্র­মাণ আজ দে­খুক, শি­ক্ষা করুক। সহা­নুভূতি কা­হা­কে বলে? মা­নু­ষের পরিচয় কী? মহা­­ক্তি­­ম্প­ন্ন হৃদয়ের ক্ষ­­তা কী? নশ্বর জী­­নে অবি­­শ্বর কী? আজ ভাল করিয়া দে­খুক
জগৎ জা­গিল। পূর্ব­­গন লো­হিত রে­খায় পরি­শো­ভিত হইল। সী­মার শয্যা হই­তে উঠিয়া প্রা­তঃ­ক্রিয়াদি সমা­পন করিল। সজ্জিত হইয়া বর্শা­­স্তে দণ্ডায়মান-এবং উচ্চৈঃস্ব­রে বলিল, " হে! আমি আর বি­­ম্ব করি­তে পা­রিব না। আমার রক্ষিত মস্তক আনিয়া দাও, শী­ঘ্র যা­ইব।"
আজর বহি­র্ভা­গে আসিয়া বলি­লেন, "ভ্রা­তঃ! তো­মার না­­টি কি শু­নি­তে চাই। আর তু­মি কো­ন্ ঈশ্ব­রের সৃ­ষ্ট জীব তা­হাও জা­নি­তে চাই। ভাই, রাগ করিয়ো না; ধর্ম­নী­তি, রা­­নী­তি, যু­দ্ধ­নী­তি, অর্থ­নী­তি, যু­ক্তি, বি­ধি-ব্য­­স্থা ইহার কি­ছু­তেই -কথা পাওয়া যায় না যে, শত্রুর মৃ­­­রী­রেও শত্রু­তা সা­ধন করি­তে হয়। বন্য পশু এবং অস­ভ্য জা­তি­রাই গত­জী­বন শত্রু-শরী­রে না­না­প্র­কার লা­ঞ্ছ­না দিয়া মনে মনে আন­ন্দ অনু­ভব করে।ভ্রা­তঃ! তো­মার রা­জা সু­­ভ্য, তু­মিও দি­ব্য সভ্য; অব­স্থায় পশু-আচার কেন, ভাই?"
"রা­ত্রে আমা­কে আশ্রয় দিয়াছ, তো­মার প্র­­ত্ত অন্নে উদর পরিপূর্ণ করিয়াছি, সু­­রাং সী­মা­রের বর্শা হই­তে রক্ষা পা­­লে। সা­­ধান! -সকল হি­তো­­দেশ আর কখ­নো মু­খে আনিয়ো না। তো­মার হি­তো­­দেশ তো­মার মনেই থা­কুক। ভাই সা­হেব! বিড়াল­­­স্বী, কপট ঋষি, ভণ্ড গু­রু, স্বা­র্থ­পর পীর, লো­ভী মৌ­­বী জগ­তে অনেক আছে,-অনেক দে­খিয়াছি,-আজও দে­খি­লাম। তো­মার ধর্ম-কা­হি­নী, তো­মার রা­জনৈতিক উপ­দেশ, তো­মার যু­ক্তি, কা­রণ, বি­ধি-ব্য­­স্থা সমুদয় তু­লিয়া রাখ। ধর্মা­­তা­রের ধূর্ত­তা, চতু­­তা সী­মা­রের বু­ঝি­তে আর বা­কী নাই; -কথায় মহা­বীর সী­মার ভু­লি­বে না। আর মো­টা কথা­টা কে না বু­ঝি­বে যে, হো­সে­নের মস্তক তো­মার নি­কট রা­খিয়া যাই, আর তু­মি দা­মে­স্কে যাইয়া মহা­রা­জের নি­কট বা­হা­দু­রি জা­নাইয়া লক্ষ টা­কা পু­­স্কার লাভ কর। যদি ভাল চাও, যদি প্রাণ বাঁচা­­তে ইচ্ছা কর, যদি কি­ছু­দিন জগ­তের মুখ দে­খি­তে বা­­না হয়, তবে শী­ঘ্র হো­সে­নের মা­থা আনিয়া দাও।"
"ওরে ভাই! আমি তো­মার মত স্বা­র্থ­পর অর্থ­লো­ভী নহি। আমি দে­­তার নাম করিয়া বলি­তে­ছি, অর্থ­লা­­সায় হো­সেন-মস্তক কখ­নোই দা­মে­স্কে লইয়া যা­ইব না। টা­কা অতি তু­চ্ছ পদা­র্থ, উচ্চ­হৃদয়ে টা­কার ঘাত-প্র­তি­ঘাত নাই। দয়া, দা­ক্ষি­ণ্য, ধর্ম, সু­নাম, যশঃ­কী­র্তি, পর­দু­­খে কা­­­তা, এই সকল মহামূল্য রত্নের নি­কট টা­কার মূল্য কি রে ভাই!"
"ওহে ধা­র্মি­­বর! আমি -সকল কথা অনেক জা­নি। টা­কা যে জি­নিস, তা­হাও ভাল করিয়া চি­নি। মু­খে অনে­কেই টা­কা অতি তু­চ্ছ, অর্থ অন­র্থের মূল বলিয়া থা­কেন; কি­ন্তু জগৎ এম­নই ভয়ানক স্থান যে, টা­কা না থা­কি­লে তা­হার স্থান কো­থাও নাই, সমা­জে নাই, স্ব­জা­তির নি­­টে নাই, ভ্রা­তা ভগ্নীর নি­কট কথা­টার প্র­ত্যা­শা নাই। স্ত্রীর ন্যায় ভা­­বা­সে, বল তো জগ­তে আর কে আছে? টা­কা না থা­কি­লে অমন অকৃ­ত্রিম ভা­­বা­সারও আশা নাই; কা­হা­রো নি­কট সম্মান নাই। টা­কা না থা­কি­লে রা­জায় চি­নে না, সা­ধা­­ণে মা­ন্য করে না, বি­­দে জ্ঞান থা­কে না। জন্ম­মা­ত্র টা­কা, জী­­নে টা­কা, জী­­না­ন্তেও টা­কা। জগ­তে টা­কা­রই খে­লা। টা­কা যে কি পদা­র্থ, তা­হা তু­মি চেন বা না-চেন, আমি বেশ চি­নি। আর তু­মি নি­শ্চয় জা­নিয়ো, আমি নে­হাত মূর্খ নহি, আপন লা­ভা­লাভ বেশ বু­ঝি­তে পা­রি। যদি ভাল চাও, যদি আপন প্রাণ বাঁচা­­তে চাও, তবে শী­ঘ্র খণ্ডিত মস্তক আনিয়া দাও! রা­­দ্রো­হীর শা­স্তি কি?-ওরে পা­গল! রা­­দ্রো­হীর শা­স্তি কি, তা­হা জান?"
"রাজ-বি­দ্রো­হীর শা­স্তি আমি বি­শে­ষরূপে জা­নি। দেখ ভাই! তো­মার সহিত বাদ-বি­­ম্বাদ কৌ­শল করি­তে আমার ইচ্ছা­মা­ত্র নাই। তু­মি মহা­রাজ এজি­দের সৈনিক, আমি তাঁহার অধী­­স্থ প্র­জা, সা­ধ্য কি রা­­­র্ম­চা­রীর আদেশ অব­হে­লা করি! এক­টু অপে­ক্ষা কর, খণ্ডিত শির আনিয়া দি­তে­ছি, মস্তক পা­­লেই তো ভাই তু­মি ক্ষা­ন্ত হও?"
"হাঁ, মস্তক পা­­লেই আমি চলিয়া যাই, ক্ষ­­কালও এখা­নে থা­কি না।-আর ইহাও বলি­তে­ছি-মহা­রা­জের নি­কট তো­মার ভাল কথাই বলিব। আমা­কে আদর-আহ্লা­দে স্থান দিয়াছ, অভ্য­র্থ­না করিয়াছ, সক­লই বলিব। হয়তো ঘরে বসিয়া কি­ছু পু­­স্কারও পা­­তে পার। শী­ঘ্র শির আনিয়া দাও।"

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com


#উপন্যাস
#মোলাকাত
#সাহিত্য_ম্যাগাজিন
#Molakat
#ওয়েব_ম্যাগাজিন
#সাহিত্য
#বিষাধসিন্ধু
#মীর_মশাররফ_হোসেন


No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.