রে
পথিক!
রে
পাষাণহৃদয়
পথিক!
কী
লোভে এত ত্রস্তে দৌড়িতেছ? কী
আশায়
খণ্ডিত
শির
বর্শার
অগ্রভাগে বিদ্ধ করিয়া লইয়া
যাইতেছ? এ
শিরে-হায়! এ
খণ্ডিত
শিরে তোমার
প্রয়োজন কি?
সীমার! এ শিরে তোমার
আবশ্যক কি? হোসেন তোমার
কী
করিয়াছিল? তুমি তো আর
জয়নাবের রূপে মোহিত হইয়াছিলে
না?
জয়নাব
ইমাম
হাসানের স্ত্রী। হোসেনের শির
তোমার বর্শাগ্রে
কেন?
তুমিই-বা সে
শির
লইয়া
ঊর্ধ্বশ্বাসে এত
বেগে দৌড়াইতেছ
কেন?
যাইতেছই-বা কোথায়?
সীমার! একটু
দাঁড়াও। আমার
প্রশ্নের উত্তর দিয়া
যাও!
কার
সাধ্য তোমার
গমনে বাধা
দেয়?
কার
ক্ষমতা তোমাকে কিছু বলে? একটু দাঁড়াও। এ
শিরে তোমার
স্বার্থ কি? খণ্ডিত
শিরে প্রয়োজন কি?
অর্থ?
হায়
রে
অর্থ!
হায়
রে
পাতকী অর্থ!
তুই
জগতের সকল অনর্থের মূল।জীবের
জীবনের ধ্বংস,
সম্পত্তির বিনাশ,
পিতা-পুত্রে
শত্রুতা, স্বামী-স্ত্রীতে মনোমালিন্য,
ভ্রাতা-ভগ্নীতে
কলহ,
রাজা-প্রজায়
বৈরীভাব, বন্ধু-বান্ধবে বিচ্ছেদ। বিবাদ,
বিসম্বাদ, কলহ,
বিরহ, বিসর্জন, বিনাশ,
এ
সকল
তোমার জন্য। সকল
অনর্থের মূল ও
কারণই তুমি। তোমার
কী
মোহিনীশক্তি! কী মধুমাখা বিষসংযুক্ত প্রেম, রাজা, প্রজা,
ধনী,
নির্ধন, যুবক,
বৃদ্ধ, সকলেই
তোমার জন্য ব্যস্ত,-মহাব্যস্ত-প্রাণ ওষ্ঠাগত। তোমারই জন্য-কেবলমাত্র তোমারই কারণে-কত জনে
তীর,
তরবারি, বন্দুক,
বর্শা,
গোলাগুলি
অকাতরে বক্ষ
পাতিয়া বুকে
ধরিতেছে। তোমারই জন্য
অগাধ
জলে
ডুবিতেছে।
ঘোর
অরণ্যে প্রবেশ
করিতেছে, পর্বতশিখরে আরোহণ
করিতেছে, রক্ত,
মাংসপেশী, পরমাণু সংযোজিত শরীর! ছলনে! তোমারই জন্য শূন্যে
উড়াইতেছে। কী
কুহক! কী মায়া!!কী মোহিনীশক্তি!!!
তোমার কুহকে কে না
পড়িতেছে? কে না
ধোঁকা
খাইতেছে?
কে
না
মজিতেছে? তুমি দূর হও,
তুমি দূর হও!
কবির
কল্পনার পথ হইতে একেবারে দূর হও।
কবির
চিন্তাধারা
হইতে একেবারে সরিয়া যাও!
তোমার নাম করিয়া
কথা
কহিতে অঙ্গ শিহরিয়া উঠে!
তোমারই জন্য
প্রভু হোসেন
সীমারহস্তে খণ্ডিত।-রাক্ষসী! তোমারই জন্য
খণ্ডিত
শির
বর্শাগ্রে বিদ্ধ।
সীমার অবিশ্রান্ত যাইতেছে। দিনমণি
মলিনমুখ, অস্তাচল গমনে
উদ্যোগী। সীমারের অন্তরে
নানা ভাব; তন্মধ্যে অর্থ-চিন্তাই প্রবল;
চির-অভাবগুলি আশু মোচন করাই স্থির।
একাই
মারিয়াছি, একাই কাটিয়াছি, একাই যাইতেছি,
একাই
পাইব, আর ভাবনা কী?
লক্ষ
টাকার অধিকারীই আমি। চিন্তার কোন কারণই নাই।
নিশাও প্রায় সমাগত। যাই কোথা? বিশ্রাম
না
করিলেও আর বাঁচি
না।
নিকটস্থ
পল্লীতে কোন গৃহীর আবাসে
যাইয়া
নিশাযাপন
করি।
এ
তো
সকলই মহারাজ
এজিদ্ নামদারের রাজ্যভুক্ত,
অধীন
ও
অন্তর্গত।সৈনিক বেশ, হস্তে বর্শা,
বর্শাগ্রে মনুষ্যশির বিদ্ধ,
ভয়ানক
রোষের লক্ষণ। কে
কী
বলিবে? কার সাধ্য-কে কী
করিবে?
সীমার এক গৃহীর আশ্রমে
উপস্থিত হইয়া ঐ
স্থানে নিশাযাপন করিবেন জানাইলেন। বর্শাবিদ্ধ খণ্ডিত
শির
অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত বুঝি রাজসংক্রান্ত
কেহ-বা হয় মনে
করিয়া
গৃহস্বামী
আর
কোন
কথা
বলিলেন না। সাদরে সীমারকে
স্থান
নির্দেশ করিয়া দিলেন, পথশ্রান্তি দূরীকরণের উপকরণ আদি
ও
আহারীয় দ্রব্যসামগ্রী
আনিয়া
ভক্তিসহকারে আতিথ্য-সেবা করিলেন। ক্ষণকাল বিশ্রামের পর অতি
বিনীতভাবে বলিলেন,
"মহাশয়!
যদি
অনুমতি করেন,
তবে
একটা কথা জিজ্ঞাসা করি।"
সীমার বলিল- "কি কথা?"
"কথা আর
কিছু নহে, আপনি কোথা
হইতে আসিতেছেন? আর এই
বর্শা-বিদ্ধ-শির
কোন্ মহাপুরুষের?"
"ইহার অনেক
কথা।
তবে
তোমাকে অতি
সংক্ষেপে বলিতেছি। মদিনার রাজা
হোসেন, যাঁহার পিতা আলী এবং
মোহাম্মদের
কন্যা
ফাতেমা যাঁহার
জননী, এ তাঁহারই শির। কার্বালা
প্রান্তরে, মহারাজ এজিদ্-প্রেরিত সৈন্য
সহিত
সমরে পরাস্ত
হইয়া
এই
অবস্থা। দেহ হইতে মস্তক ভিন্ন করিয়া মহারাজের নিকট লইয়া যাইতেছি,
পুরস্কার পাইব। লক্ষ টাকা পুরস্কার। তুমি
পৌত্তলিক, তোমার গৃহে
নানা দেবদেবীর প্রতিমূর্তি আছে দেখিয়াই
আতিথ্য গ্রহণ
করিয়াছি। মোহাম্মদের
শিষ্য হইলে
কখনো তোমার
গৃহে আসিতাম
না।
তোমার আদর-অভ্যর্থনাতেও
ভুলিতাম না,
তোমার আহারও গ্রহণ করিতাম
না।"
"হাঁ, এতক্ষণে জানিলাম, আপনি কে? আর
আপনার অনুমানও
মিথ্যা নহে। আমি
একেশ্বরবাদী নহি। নানা প্রকার
দেব-দেবীই আমার
উপাস্য। আপনি
মহারাজ এজিদের
প্রিয়
সৈন্য,
আমার
অপরাধ গ্রহণ
করিবেন না। স্বচ্ছন্দে বিশ্রাম করুন। কিন্তু বর্শা-বিদ্ধ-শির এ
প্রকারে না
রাখিয়া আমার নিকটে দিলে ভাল হইত।
আমি
আজ
রাত্রে আপন তত্ত্বাবধানে রাখিতাম। প্রাতে আপনি
যথা
ইচ্ছা
গমন
করিতেন। কারণ
যদি
কোন
শত্রু
আপনার অনুসরণে আসিয়া
থাকে, নিশীথ
সময়ে
কৌশলে কি
বলপ্রয়োগে এই মহামূল্য শির
আপনার নিকট
হইতে কাড়িয়া লয়,
কি
আপনার ক্লান্তিজনিত অবশ
অলসে, ঘোর নিদ্রায় অচেতন
হইলে আপনার
অজ্ঞাতে এই মহামূল্য শির,-আপাততঃ
যাহার মূল্য লক্ষ
টাকা-যদি কেহ
লইয়া
যায়,
তবে
মহাদুঃখের
কারণ হইবে,
আমাকে দিন, আমি
সাবধানে
রাখিব, আপনি
প্রত্যূষে লইবেন।
আমার
তত্ত্বাবধানে রাখিলে আপনি নিশ্চিন্তভাবে
নিদ্রাসুখ অনুভব করিতে
পারিবেন।"
সীমারের কর্ণে
কথাগুলি বড়ই
মিষ্ট বোধ হইল।
আর
দ্বিরুক্তি না
করিয়া
প্রস্তাব শ্রবণমাত্রেই
সম্মত
হইল।
গৃহস্বামী
হোসেন-মস্তক সম্মানের সহিত মস্তকে লইয়া বহুসমাদরে গৃহমধ্যে রাখিয়া দিল। পথশ্রান্তিহেতু সীমারের কেবল
শয়ন
বিলম্ব; যেমনই শয়ন
অমনই অচেতন।
গৃহস্বামী
বাস্তবিক হজরত মোহাম্মদ মোস্তফার শিষ্য
ছিলেন না। নানা প্রকার
দেব-দেবীর আরাধনাতেই
সর্বদা রত থাকিতেন। উপযুক্ত তিন
পুত্র এবং এক
স্ত্রী। নাম,
"আজর।"
(হজরত ইব্রাহিম
খলিলুল্লার পিতার নামও আজর
বোত্পরস্ত
ছিল।
ইনি
সে
আজর
নহেন।)
সীমারের নিদ্রার ভাব জানিয়া, আজর স্ত্রীপুত্রসহ
হোসেনের মস্তক
ঘিরিয়া বসিলেন
এবং
আদ্যন্ত সমুদয় ঘটনা বলিলেন!
যে
ঘটনায় পশুপক্ষীর চক্ষের জল
ঝরিতেছে, প্রকৃতির অন্তর
ফাটিয়া যাইতেছে, সেই
দেহ-বিচ্ছিন্ন
হোসেন-মস্তক দেখিয়া কাহার
হৃদয়ে
না
আঘাত
লাগে? দেব-দেবীর উপাসক
হউন,
ইসলাম ধর্মবিদ্বেষীই হউন,
এ
নিদারুণ দুঃখের কথা
শুনিলে কে
না
ব্যথিত হউন? পিতাপুত্র
সকলে একত্র
হইয়া
হোসেন-শোকে
কাঁদিতে লাগিলেন।
আজর
বলিলেন, "মনুষ্যমাত্রেই এক উপকরণে
গঠিত
এবং
এক
ঈশ্বরের সৃষ্ট।
জাতিভেদ, ধর্মভেদ, সে-ও
সর্বশক্তিমান
ভগবানের লীলা। ইহাতে
পরস্পর হিংসা, দ্বেষ, ঘৃণা, কেবল
মূঢ়তার
লক্ষণ!
ইমাম
হাসান-হোসেনের প্রতি
এজিদ্ যেরূপ অত্যাচার করিয়াছে, তাহা মনে করিলে হৃদয়মাত্রেরই তন্ত্রী ছিঁড়িয়া যায়।সে
দুঃখের কথায়
কোন্ চক্ষু না
জলে
পরিপূর্ণ হয়?
মানুষের প্রতি এরূপ ঘোরতর অত্যাচার হউক আর
না-হউক, জাতীয়
জীবন বলিয়াও কী
প্রাণে আঘাত লাগে না? সাধু পরম ধার্মিক, বিশেষ
ঈশ্বরভক্ত,
মহাপুরুষ মোহাম্মদের
হৃদয়ের
অংশ,
ইঁহাদের এই দশা?
হায়!
হায়!!
সামান্য পশু
মারিলে কত
মানুষ কাঁদিয়া গড়াগড়ি
যায়-বেদনায়
অস্থির
হয়,
আর
মানুষের জন্য
মানুষ কাঁদিবে
না!
ধর্মের
বিভেদ বলিয়া, মানুষের বিয়োগে
মানুষ মনোবেদনায় বেদনা বোধ
করিবে না? যন্ত্রণা অনুভব
করিবে না? যে
ধর্মই
কেন
হউক
না,
পবিত্রতা রক্ষা
করিতে, তৎকার্যে
যোগ
দিতে কে নিবারণ করিবে? মহাপুরুষ মোহাম্মদ পবিত্র,
হাসান পবিত্র,
হোসেনের মস্তক
পবিত্র, সেই পবিত্র মস্তকের
এত
অবমাননা?
যুদ্ধে হত হইয়াছে
বলিয়াই
কী
এত
তাচ্ছিল্য? জগৎ
কয়
দিনের?এজিদ্!
তুই
কী
জগতে অমর হইয়াছিস্? জীবনশূন্য দেহের
সদ্গগতির সংবাদ শুনিয়া
কী
তোর
চির-জ্বলন্ত
রোষাগ্নি নির্বাণ হইত না?
তোর
আকাক্সক্ষা কি
যুদ্ধ-জয়ের সংবাদ শুনিয়া
মিটিত না? হোসেনপরিবারের
মহা
ক্রন্দনের রোল
সপ্ততল আকাশ ভেদ
করিয়া
অনন্তধামে
অনন্তরূপে প্রবেশ করিয়া
অনন্ত শোক বিকাশ করিতেছে! ঈশ্বরের
আসন
টলিতেছে!-তোর
মন
কী
এতই
কঠিন
যে
জীবনশূন্য শরীরে শত্রুতা
সাধন করিতে
ত্রুটি করিতেছিস্ না!
তোকে কোন্
ঈশ্বর
গড়িয়াছিল জানি না; কী
উপকরণে
তোর
শরীর
গঠিত,
তাহাও বলিতে
পারি না। তুই
সামান্য লোভের বশবর্তী হইয়া কী
কাণ্ড করিলি!
তোর
এই
অমানুষিক কীর্তিতে জগৎ
কাঁদিবে, পাষাণ
গলিবে! এই মহাপুরুষ জীবিত থাকিলে এই মুখে কত শত
প্রকারে ঈশ্বরের গুণ-কীর্তন-কত কাল
ঈশ্বরের মহত্ত্ব
প্রকাশ হইত, তাহার কী ইয়ত্তা
আছে?
তুই
অসময়ে
মহাঋষি হোসেনের প্রাণহরণ
করিয়াছিস্,
কিন্তু তোর পিতা ইমাম বংশের ভিন্ন
নহেন;
তাঁহার
হৃদয়
এমন
কঠিন
প্রস্তরে গঠিত
ছিল
না!
তাঁহার
ঔরসে জন্মিয়া তোর
এ
কি
ভাব?
রক্ত,
মাংস, বীর্যগুণ আজ তোর
নিকট পরাস্ত
হইল।
মানব শরীরের
স্বাভাবিক গুণ
আজ
বিপরীত ভাব
ধারণ করিল। তাই
যাহাই হউক, আজরের এই প্রতিজ্ঞা-জীবন থাকিতে হোসেন-শির দামেস্কে লইয়া যাইতে দিবে না; যত্নের
সহিত,
আদরের সহিত, ভক্তিসহকারে সে মহাপ্রান্তর কারবালায়
লইয়া
যাইয়া,
শিরশূন্য দেহের
সন্ধান
করিয়া
সদ্গগতির উপায়
করিবে; প্রাণ থাকিতে এ
শির
আজর
ছাড়িবে
না।"
আজরের স্ত্রী বলিলেন, "এই হোসেন,
বিবি ফাতেমার অঞ্চলের
নিধি, নয়নের পুত্তলি ছিলেন।হায়! হায়! তাঁহার এই
দশা!
এ
জীবন থাক্
বা
যাক্, প্রভাত
হইতে-না-হইতে আমরা
এই
পবিত্র মস্তক লইয়া
কার্বালায়
যাইব। শেষে
ভাগ্যে যা থাকে হইবে?"
পুত্রেরা বলিল,
"আমাদের জীবন
পণ,
তথাপি কিছুতেই সৈনিকহস্তে এ
মস্তক
প্রত্যর্পণ করিব
না।
প্রাতে সৈনিককে বিদায়
করিয়া
সকলে একত্রে
কার্বালায়
যাইব।"
পুনরায় আজর
বলিতে লাগিলেন, "ধার্মিকের
হৃদয়
এক,
ঈশ্বরভক্তের
মন
এক,
আত্মা
এক।ধর্ম কী
কখনো দুই হইতে পারে?
সম্বন্ধ নাই, আত্মীয়তা নাই,
কথায়
বলে-রক্তে রক্তে লেশমাত্রও
যোগাযোগ নাই,
তবে
তাহার দুঃখে তোমাদের প্রাণে
আঘাত
লাগিল কেন? বল
দেখি, তাঁহার জন্য
জীবন উৎসর্গ করিলে কেন? ধার্মিক-জীবন
কাহার না আদরের? ঈশ্বর-প্রেমিক কাহার-না যত্নের? তোমাদের কথা
শুনিয়া, সাহস
দেখিয়া, প্রাণ শীতল হইল। পরোপকারব্রতে জীবনপণ
কথাটা শুনিয়াও
কর্ণ
জুড়াইল। তোমাদের সাহসেই গৃহে থাকিলাম। প্রাণ দিব,
কিন্তু শির দামেস্কে লইয়া
যাইতে দিব
না।"
পরস্পর সকলেই
হোসেনের প্রসঙ্গ লইয়া
রজনী অতিবাহিত করিতে
লাগিলেন। প্রভাত হইতে
সন্ধ্যা পর্যন্ত কার্বালা প্রান্তরে যে
লোমহর্ষক
ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহা জগৎ দেখিয়াছে। নিশাদেবী জগৎকে আবার
নূতন
ঘটনা দেখাইতে, জগৎ-লোচন রবিদেবকে
পূর্ব
গগন-প্রান্তে বসাইয়া
নিজে অন্তর্ধান
হইবার উদ্যোগ করিতেছেন। জগৎ
কল্য
দেখিয়াছে, আজ আবার
দেখুক-নিঃস্বার্থ প্রেমের আদর্শ
দেখুক-পবিত্র
জীবনের যথার্থ প্রণয়ী দেখুক-সাধু-জীবনের
ভক্তি
দেখুক-ধর্মে দ্বেষ,
ধর্মে
হিংসা, মানুষের শরীরে আছে কি-না, তাহার
দৃষ্টান্ত দেখুক-ভ্রাতা,
ভগিনী, পুত্র,
জায়া,
পরিজন বিয়োগ হইলে লোকে
কাঁদিতে থাকে,
জীবনকে
অতি
তুচ্ছজ্ঞানে,
জীবন থাকিতেই জীবলীলা ইতি
করিতে ইচ্ছা করে।
পরের
জন্য
যে
কাঁদিতে হয় না,
প্রাণ
দিতে হয় না,
তাহারও জ্বলন্ত প্রমাণ
আজ
দেখুক, শিক্ষা
করুক।
সহানুভূতি কাহাকে বলে? মানুষের পরিচয়
কী?
মহাশক্তিসম্পন্ন হৃদয়ের
ক্ষমতা কী?
নশ্বর
জীবনে অবিনশ্বর কী?
আজ
ভাল
করিয়া
দেখুক।
জগৎ
জাগিল। পূর্বগগন লোহিত
রেখায় পরিশোভিত হইল। সীমার শয্যা হইতে উঠিয়া প্রাতঃক্রিয়াদি সমাপন করিল। সজ্জিত
হইয়া
বর্শাহস্তে দণ্ডায়মান-এবং
উচ্চৈঃস্বরে
বলিল,
"ও
হে!
আমি
আর
বিলম্ব করিতে পারিব
না।
আমার
রক্ষিত
মস্তক
আনিয়া
দাও,
শীঘ্র যাইব।"
আজর
বহির্ভাগে আসিয়া
বলিলেন, "ভ্রাতঃ! তোমার নামটি কি শুনিতে চাই।
আর
তুমি কোন্
ঈশ্বরের সৃষ্ট
জীব
তাহাও জানিতে চাই। ভাই,
রাগ
করিয়ো
না;
ধর্মনীতি, রাজনীতি,
যুদ্ধনীতি,
অর্থনীতি, যুক্তি, বিধি-ব্যবস্থা
ইহার
কিছুতেই এ-কথা পাওয়া যায়
না
যে,
শত্রুর
মৃতশরীরেও শত্রুতা
সাধন করিতে
হয়।
বন্য
পশু
এবং
অসভ্য জাতিরাই গতজীবন শত্রু-শরীরে নানাপ্রকার লাঞ্ছনা দিয়া
মনে
মনে
আনন্দ অনুভব
করে।ভ্রাতঃ!
তোমার রাজা
সুসভ্য, তুমিও দিব্য
সভ্য;
এ
অবস্থায় এ পশু-আচার কেন, ভাই?"
"রাত্রে
আমাকে আশ্রয় দিয়াছ,
তোমার প্রদত্ত অন্নে উদর
পরিপূর্ণ করিয়াছি, সুতরাং সীমারের বর্শা
হইতে রক্ষা পাইলে। সাবধান! ও-সকল হিতোপদেশ আর
কখনো মুখে
আনিয়ো
না।
তোমার হিতোপদেশ তোমার মনেই থাকুক। ভাই সাহেব! বিড়ালতপস্বী, কপট
ঋষি,
ভণ্ড
গুরু, স্বার্থপর পীর, লোভী মৌলবী জগতে
অনেক
আছে,-অনেক দেখিয়াছি,-আজও দেখিলাম। তোমার
ধর্ম-কাহিনী,
তোমার রাজনৈতিক
উপদেশ, তোমার
যুক্তি, কারণ,
বিধি-ব্যবস্থা সমুদয় তুলিয়া রাখ। ধর্মাবতারের
ধূর্ততা, চতুরতা সীমারের বুঝিতে আর বাকী নাই; ও-কথায় মহাবীর
সীমার ভুলিবে না। আর
এ
মোটা কথাটা
কে
না
বুঝিবে যে,
হোসেনের মস্তক
তোমার নিকট
রাখিয়া যাই, আর
তুমি দামেস্কে যাইয়া মহারাজের নিকট বাহাদুরি জানাইয়া লক্ষ টাকা পুরস্কার লাভ কর।
যদি
ভাল
চাও,
যদি
প্রাণ
বাঁচাইতে ইচ্ছা
কর,
যদি
কিছুদিন জগতের মুখ দেখিতে বাসনা হয়,
তবে
শীঘ্র হোসেনের মাথা
আনিয়া
দাও।"
"ওরে ভাই!
আমি
তোমার মত স্বার্থপর অর্থলোভী নহি।
আমি
দেবতার নাম
করিয়া
বলিতেছি, অর্থলালসায়
হোসেন-মস্তক কখনোই দামেস্কে লইয়া যাইব না। টাকা অতি তুচ্ছ পদার্থ,
উচ্চহৃদয়ে টাকার
ঘাত-প্রতিঘাত
নাই।
দয়া,
দাক্ষিণ্য, ধর্ম,
সুনাম, যশঃকীর্তি, পরদুঃখে কাতরতা,
এই
সকল
মহামূল্য রত্নের
নিকট টাকার
মূল্য
কি
রে
ভাই!"
"ওহে ধার্মিকবর!
আমি
ও-সকল কথা অনেক
জানি। টাকা
যে
জিনিস, তাহাও
ভাল
করিয়া
চিনি। মুখে
অনেকেই টাকা
অতি
তুচ্ছ, অর্থ অনর্থের মূল বলিয়া
থাকেন; কিন্তু
জগৎ
এমনই ভয়ানক স্থান
যে,
টাকা না থাকিলে তাহার স্থান কোথাও নাই, সমাজে নাই, স্বজাতির নিকটে নাই,
ভ্রাতা ভগ্নীর নিকট কথাটার
প্রত্যাশা নাই।
স্ত্রীর ন্যায়
ভালবাসে,
বল
তো
জগতে আর কে
আছে?
টাকা না থাকিলে অমন
অকৃত্রিম ভালবাসারও আশা
নাই;
কাহারো নিকট সম্মান নাই।
টাকা না থাকিলে রাজায় চিনে
না,
সাধারণে
মান্য করে না,
বিপদে জ্ঞান
থাকে না। জন্মমাত্র টাকা, জীবনে টাকা,
জীবনান্তেও
টাকা। জগতে
টাকারই খেলা। টাকা
যে
কি
পদার্থ, তাহা
তুমি চেন বা
না-চেন, আমি বেশ
চিনি। আর তুমি নিশ্চয়
জানিয়ো, আমি নেহাত মূর্খ নহি,
আপন
লাভালাভ বেশ
বুঝিতে পারি। যদি ভাল
চাও,
যদি
আপন
প্রাণ
বাঁচাইতে চাও,
তবে
শীঘ্র খণ্ডিত মস্তক
আনিয়া
দাও!
রাজদ্রোহীর
শাস্তি কি?-ওরে
পাগল! রাজদ্রোহীর শাস্তি কি, তাহা জান?"
"রাজ-বিদ্রোহীর শাস্তি আমি বিশেষরূপে জানি। দেখ ভাই!
তোমার সহিত বাদ-বিসম্বাদ
ও
কৌশল করিতে
আমার
ইচ্ছামাত্র নাই।
তুমি মহারাজ
এজিদের সৈনিক, আমি
তাঁহার
অধীনস্থ প্রজা, সাধ্য
কি
রাজকর্মচারীর আদেশ
অবহেলা করি!
একটু অপেক্ষা
কর,
খণ্ডিত
শির
আনিয়া
দিতেছি, মস্তক
পাইলেই তো
ভাই
তুমি ক্ষান্ত
হও?"
"হাঁ, মস্তক
পাইলেই আমি
চলিয়া
যাই,
ক্ষণকালও এখানে থাকি
না।-আর ইহাও বলিতেছি-মহারাজের নিকট তোমার
ভাল
কথাই
বলিব।
আমাকে আদর-আহ্লাদে স্থান দিয়াছ,
অভ্যর্থনা করিয়াছ,
সকলই বলিব। হয়তো
ঘরে
বসিয়া
কিছু পুরস্কারও পাইতে পার। শীঘ্র শির আনিয়া
দাও।"
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
#উপন্যাস
#মোলাকাত
#সাহিত্য_ম্যাগাজিন
#Molakat
#ওয়েব_ম্যাগাজিন
#সাহিত্য
#বিষাধসিন্ধু
#মীর_মশাররফ_হোসেন
No comments