শৈশবের রমজান মানেই অন্যরকম উল্লাস৷ ইবাদতের আনন্দঘন উদযাপন৷ বুঝি আর না বুঝি, রমজানের বাকা চাঁদ দেখতেই শুরু হয়ে যেত আমাদের সেই লাফালাফি৷ হুল্লোড়ে কাণ্ড৷ মূলত শবেবরাত থেকেই সবার মাঝে রমজান রমজান আবহ তৈরি হতো৷ যদিও পনেরো দিনের অপেক্ষা তখনো বাকি৷ একে একে দিন যখন শেষ, শাবানের ঊনত্রিশ তারিখ সন্ধ্যায় কাঙ্ক্ষিত চাঁদ খোঁজা শুরু করতাম আমরা৷ প্রায় সময় ব্যর্থ হতো আমাদের এই চন্দ্রতালাশি৷ কারণ শাবানের আরও একদিন বাকি আছে৷ ওই একদিন যেন যেতে চাইত না৷ বহু কষ্টে যখন দিনটা পার হতো৷ আমরা বেখেয়ালেই ছুট লাগাতাম পশ্চিম পানে৷ বিশাল-বিস্তৃত দিগন্তের লালিমার কাছাকাছি৷ ওই দিন সন্ধ্যায় আকাশ যেন অনেক কাছে চলে আসত৷ অনেকটাই নিচে নেমে আসত যেনো আকাশের নীলাভ সমুদ্র৷ হাত বাড়ালেই বুঝি অধরাকে ধরা যাবে৷ পেড়ে আনা যাবে ‘আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা— আগিলাকালের ছন্দায়িত এই চাঁদের প্রথম চিকন রেখাটা৷
নানি-দাদিরা, মা-খালারা কলপাড়ের বেড়ার ওপর দিয়ে চাঁদ দেখার কসরত করতেন৷ অনেকে বাড়ি ছেড়ে পশ্চিম দিকটায় চলে আসতেন৷ সবজিবাগানের পাশে৷ নেবুতলায় কাপড় শুকোবার বাড়ে হাত ধরে কায়দামতো দাঁড়িয়ে চোখ বড় বড় করে নতুন চাঁদ দেখতেন আর বিড়বিড় করে কীসব বলতেন৷ পরে জেনেছি ওগুলো ছিল নতুন চাঁদ দেখার দুআ৷ আমরা পোলাপান সারা গ্রাম ঘুরে ঘুরে মিছিল করতাম৷ স্লোগান ছিল একটাই— ‘চান উঠছে কইনদা, মৌন্না বাড়ির ওরফেদা’৷ মৌন্না মানে আমাদের বাড়ির পশ্চিম দিকে কিছু প্রাচীন বসতবাড়ি আছে৷ যার কর্তার নাম ‘মনু মিয়া’৷ এই মনু মিয়ার বাড়ি বরাবর পশ্চিম দিকে ওপরে চাঁদ দেখা যেত বলেই এই বুলি আমরা দলবেঁধে আওড়াতাম৷ খাপেরখাপ মিলে যাওয়া এই ছন্দস্লোগান শুনিয়ে গ্রামের প্রতিটি ঘরে জানান দিতাম রমজান আগমনের৷
তারাবিহ সালাত সেহরি ইফতার— এ-জাতীয় পূণ্যময় শব্দগুলোও ঘুরপাক খেত আমার মাথায়৷ ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে দেখতাম মায়েরা ভোরভোজের প্রাথমিক আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত৷ প্ৰথম রোজা সবাই একটু-আধটু ভালো সেহরি খেয়ে রাখতে চাইবে৷ সেই সুবাদে মাছ-মাংস ও দুধকলার জোগাড় আগে থেকেই নেয়া হতো৷ আমাদের ঘরেও সাধ্যমতো ভালো রান্নাবান্নার চেষ্টা করা হতো৷ যদিও আব্বুর উপার্জন ছিল সীমিত এবং খানেওয়ালার সংখ্যা ছিল তিনতিনে নয়৷ আমরা রোজা রাখার বয়সে উপনীত হইনি যদিও, কিন্তু প্ৰথম প্রথম সেহরি মিস করতে চাইতাম না কেউই৷ দেখা গেছে রমজানে যেখানে বড়দের দুবেলা খাবারের নিয়ম সেখানে আমাদের ছোটদের হয়ে যাচ্ছে চারবেলা৷ ছোট হওয়ার কারণে মা আমাদের রোজা রাখতে দিতেন না৷ ‘ছোটদের রোজা নাই, রোজা কেবল বড়দের জন্য’— এই রকম নানা কথা বলে আমাদের ভুলিয়ে রাখতেন৷
একদিন জোর বায়না ধরলাম— ‘মা আইজ্জা রোজা রাখমু, মা আইজ্জা রোজা রাখমু৷’ মা বললেন— ‘তুমি রোজা রাখতারতা না বাবা, আট্টু বড় অও পরে রাখবা৷’ আমি মাথা ঝাঁকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় পীড়াপীড়ি করতে থাকলাম— ‘না না রোজা রাখমু রোজা রাখমু, অ্যা মা! রোজা রাখমু রোজা রাখমু৷’ অবশেষে মা বিরক্ত হয়ে অনুমতি দিয়ে দিলেন৷ মা জানতেন আমি পুরা দিন রোজা রাখতে পারব না৷ আমার কচি পেটে যখন ক্ষুধার আন্দোলন শুরু হবে তখন এমনিতেই ভাত খেতে আসব৷ হলোও তাই৷ দ্বিপ্রহর শুরু হওয়ার আগেই পেট ভরে খেতে হলো আমাকে৷ প্রতিদিন ঠিক একই কারবার ঘটত আমার বেলায়৷ খাওয়ার পর মা বলতেন— ‘যাও, তোমার রোজা অইব দুইট্টা, আবার খাইলে অইব তিনডা৷’ আমি খুশিতে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলার বন্ধুদের সাথে মিশে যেতাম৷ এভাবেই রমজান শেষ হয়ে যেত৷ কিন্তু আমার আর পূর্ণ রোজা রাখা হয় না৷
আমার বয়স যখন নয়-দশ বছর৷ স্থানীয় এক মাদরাসায় মক্তবে ভর্তি হলাম আমি৷ বছর ঘুরে যখন রমজান এল, থানার এসপি সাহেবের বাসায় আমার লজিং হয়ে গেল৷ রমজানের লজিংয়ের ব্যাপারে সবাই জানি, কেবল ইফতার সন্ধ্যারাত ও ভোররাতের খাবারই লজিং থেকে আনা যায়৷ দিনের কোনো বেলায়ই খাবার আনার নিয়ম নেই৷ কারণ, সবাই তো রোজাদার৷ বাধ্য হয়েই রোজা রাখতে হয়৷ সেই যে রোজা রাখা শুরু করলাম তারপর থেকে রোজা রাখায় আর কষ্ট অনুভূত হয়নি৷
আমার মনে আছে সেই রমজানে আমি ২০টি রোজা রেখেছিলাম৷ অনেকেই অবাক হতো শুনে৷ এতোটুকুন ছেলে কী করে সারাদিন না খেয়ে থাকে৷ অবশ্য দিনের শেষভাগে কিছুটা কষ্ট হলেও এসপি সাহেবের বাসার মজাদার ইফতার ফল-ফ্রূট শরবত গোগ্রাসে খাওয়ার পর নিমিষেই সব কষ্ট ভুলে যেতাম৷ তা ছাড়া সন্ধ্যা ও ভোরে মাছ-মাংস আর দুধকলার আয়োজন তো থাকতই ৷
ছোটবেলার সেই রোজার মধুময় স্মৃতিগুলো মনে পড়লে আজও বেশ পুলকিত হই৷ অজান্তেই হারিয়ে যাই মুখর শৈশবে৷ কান পাতলেই যেন শুনতে পাই চাঁদ দেখার সম্মিলিত জাগরণ৷ পাড়া জুড়ে এক নতুনকে আলিঙ্গনের মহাসমারোহ৷ এক পবিত্রতম মাসকে বরণোৎসবের হৈ-হল্লা৷ ঘরে ঘরে সেহরির আয়োজন৷ ইফতারির শরবত তেলতেলা বুট আলুচপ পেঁয়াজু বেগুনির ঘ্রাণ যেন এখনো নাকে এসে লাগছে৷ মসজিদে ইফতারির আগে ইমাম সাহেবের কান্নাজড়িত কণ্ঠের মুনাজাত৷ হাপুস-হুপুস ইফতারভোজ৷ রাতের দীর্ঘ তারাবিহ নামাজ৷ মধুময় কুরআন তেলাওত৷ বৃদ্ধ দাদা-নানাদের তসবিহ-তাহলিল৷ দাদি-নানিদের গুনগুনিয়ে কুরআন পড়ার আওয়াজ৷ আরও কত ইবাদতের মুগ্ধতা এখনো জড়িয়ে আছে স্মৃতিজুড়ে৷ হয়তো এইসব মিষ্টি-অতীত কখনোই ভুলব না৷ ভোলা যাবে না।
mahmud hasan
mahmudhasan629@gmail.com
#স্মৃতিকথা
#মোলাকাত
#সাহিত্য_ম্যাগাজিন
#Molakat
#ওয়েব_ম্যাগাজিন
#সাহিত্য
#মাহমুদ_মুযযাম্মিল
No comments