যানজট ।। সোনিয়া তাসনিম খান

 
-এক জোড়া লুছনি লইবেন, স্যার? জোড়া বিশ ট্যাকা। সব গুলান লইলে একশ...
 
গাড়ির জানালায় একটা নোংরা, মলিন মুখ দেখা যায়। জীর্ণ চেহারা। চোখ ভরা রাজ্যের ক্লান্তি। ওদের কোলে কাজল কালির প্রলেপ জেগেছে। কৃষ্ণকায় বদনে ঘাম চিকচিক করছে। নাকের ওপর ছোট্ট এক রত্তি সাদা নাক ফুলটা সূর্যের আলোতে জ্বলজ্বল করছে। পরণের লাল প্রিন্টেড শাড়িটির রং বিবর্ণ হয়ে কালচে দেখাচ্ছে। মহিলার কোলে একটা বাচ্চা। সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। শীত এখনও পুরোপুরি জেঁকে না বসলেও প্রকৃতিতে ওর আগমন বার্তা জানান দিচ্ছে বেশ। এমন শিমশিম স্পর্শেও বাচ্চাটি নগ্ন শরীরে খুব আরাম করে মায়ের ঘাড়ে মাথা এলিয়ে দিয়ে ঘুমোচ্ছে। এমন সুখ নিদ্রার নেপথ্য রহস্য কি জননীর শরীরের উষ্ণতা? নাকি পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলার ফলাফল? তা বুঝতে পারি না মোটেও। গাড়ির ভেতর বসে থেকে ওদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি। তাতে বুঝি অবহেলা আর বিরক্তির ছায়াটাই ফুটে উঠল। গাড়ি সায়েন্স ল্যাবের জ্যাম পড়েছে। এই অলস সময়টা কাটানো আসলেই বড় বিরক্তিকর। ভিখিরী এবং রাস্তার যত ভ্রাম্যমান হকার সব যেন হামলে পড়ে এসব স্থবির হয়ে পড়া যান বাহনের ওপর।স্যার কচি শশা লন,” স্যার, তোয়ালে”, “স্যার, কাঁচা ফুল”, “ঠান্ডা পানি”, দুইডা ট্যাকা দেন, ভাত খাবাম...” এমন কত কত অনুনয় যে কার্পাস তুলোর মতন উড়তে থাকে হাওয়ার মাঝে। উফ! চরম অসহ্যকর! কখনও হাত নেড়ে, কখনও চোখ দুটো হাতে থাকা পত্রিকার ওপর স্থির ভাবে নিক্ষেপ করে তো কখনো দাঁত মুখ খিঁচিয়ে নেই এদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য। করেই বা কি লাভ হয়? এরা সবাই যেন জিগালের আঠা। ধরলে আর ছাড়বার নাম নেই।
 
-স্যার, লন না লুছনি...বাড়িতে কাজে লাগব। এইডি কইরেই সংসার চালাই। স্যার লয়ে যান না...
 
মহিলার কথায় কোন প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে গলাটা একটু ওপরে তুলে নেই
 
-রাজন, গাড়ির গ্লাস উঠিয়ে দাও...
 
-জ্বী
 
গাড়ির স্বচ্ছ কাঁচগুলো ধীরে অদৃশ্য ফুঁড়ে ওপরে উঠতে থাকে। এক সময় ওগুলো বন্ধও হয়ে যায়। বদ্ধ কাঁচের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রান্ত মুখটা বুঝি করুণ হয়ে উঠে কিছুটা। ওর মুখ থেকে নি:সৃত অনুনয় শব্দরা কেমন ঢবঢব করে বাজতে থাকে কানে। বিরক্তির অনুভূতিটা কেমন মাছির মত ভনভন করছে। বাইরের দিকে আলতো নজর বুলিয়ে নেই। নাহ! বিশাল জ্যাম। সহসা ছাড়বার কোন নাম নিশানা নেই মোটেও। হাত ঘড়িতে সময়ের কাঁটা সাড়ে আটটার ঘর পেড়িয়ে গিয়েছে। মনের মাঝের অস্বস্তির ঘুন পোকাটা সেই তখন থেকে খচখচিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে অফিস টেবিলের ওপরে থাকা সবুজ ফাইলটার কথা মনে পড়ে যায়। আজ বারোটার পর রফিক সাহেবের ফের আসবার কথা। বিগত এক মাস ধরে কুকুরের মত পিছু পিছু ঘুরছে। মধুর হাঁড়ির মত লোভনীয় এক টোপ ফেলে রেখেছে সামনে। লোকটার গলার স্বর যেন কানে ভেসে আসে আমার
 
-কি করছেন কি? মি: শান্তুনু! এমন সুযোগ কেউ হাত ছাড়া করে? আর কতকাল এসব ধ্যাড়ধ্যাড়ে সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ির দিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে অফিস পৌঁছুবেন? আরে নতুন নতুন মডেলের কার, দামী অ্যাপার্টমেন্ট...এসবেরও অভ্যেস গড়ে নিতে শিখুন...
 
-কতবার বলব, সম্ভব নয়। আপনি এখন আসুন প্লিজ।
 
আমার কথাতে টেবিলের ওপর দুহাতে ভর দিয়ে উবু হয়ে দাঁড়ান রফিক হাসান। ওর কুতকুতে চোখ দুটো আরও ছোট হয়ে আসে। কেমন সাপের মত স্থির সেই দৃষ্টি। শরীর থেকে ভুরভুর করে আসতে থাকাএক্স সিগনেচারএর কড়া গন্ধ আমার নাকে এসে লাগছিল। পান খেয়ে ক্ষয়ে যাওয়া লাল টুকটুকে দাঁতগুলো বের করে ফিচেল হাসি হেসে লোকটা বলে
 
-আহা! শান্তুনু সাহেব, এত সিরিয়াস হবার কি আছে? আরে ভাবুন, ভাবুন। ভেবে বলুন। ওসব সেঁকেলে নীতি কথা দিয়ে কি পেট ভরে বলুন? আর এটাকে ওভাবে দেখছেন কেন? ধরে নিন না, আমি আপনাকে এক্সট্রা কিছু অফার করছি। এই যেমন গিফ্ট... আজ আসি। কাল আবার আসব।
 
জুতোতে মচমচ শব্দ তুলে রফিক হাসান দরজার ওপারে মিলিয়ে যায়। আমি ফ্ল্যাশব্যাকে চিত্রগুলো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম যেন। কি করা উচিত আমার, এখন? এই মিডল ক্লাসের প্রতিনিধি হয়ে আসলেই আর কত কাল? আশেপাশের সবাই তো পানির স্রোত ধারার মত তরতরিয়ে লক্ষ্যে এগিয়ে চলে যাচ্ছে। বইয়ের পাতার অকেজো কিছু নীতি বাক্য নিয়ে পড়ে থেকে কি কোন লাভ হচ্ছে আমার আদৌ? কিচ্ছু না! দিনের পর দিন দায়িত্বের বোঝাটা কাঁধের ওপর ক্রমশ ভারী হয়ে পড়ছে। চাহিদা আর যোগানের গ্রাফটা সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে ধেয়ে চলছে। তাহলে কি রফিক হাসানের কথাটাই সঠিক? সবুজ রঙের পাতলা চৌকা ফাইলটার প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে চোখের তারাতে। হাল্কা লেফাফার ভেতরে যেন সমাধান লুকিয়ে এই হাঁপিয়ে ওঠা জীবন ধাঁধাঁর।
 
- স্যার, লয়ে লন না। এডি করেই খাই...
 
জানালার কাঁচে ধুপ ধুপ আওয়াজে চমক কাটে আমার। সেই মহিলা। হাতে লুছনি ধরা। কোলের শিশুটি জেগে উঠেছে ওর। ক্ষুদে ক্ষুদে হাত দিয়ে চোখ কচলে নিচ্ছে। বলবার অপেক্ষা থাকে না এবারে চরম বিরক্ত হই। আর সেই সঙ্গে রাগের পারদটাও যেন আকাশ চুম্বী হয়ে যায়। হিন্দিতে একটা কথা আছেলাথোকা ভূত কভি বাতোসে নেহি মানতি কথাটা ষোল আনা সঠিক। এবার একটু কড়া হতে চাইলাম। কিন্তু কি মনে করে যেন গ্লাস নামিয়ে নেই। আর ওর হাতের দিকে ইশারা করে বলি
 
-কত?
 
-জোড়া পঁচিশ। সবডি একশ।
 
উত্তরটা চটজলদি আসে।
 
-দাও।
 
-কয়ডা?
 
পকেট হাতরে পাঁচশ টাকার একটা নোট মিলল। ভাংতি নেই। ফের মেজাজ বিগড়ে গেল। হাতের নোটটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলি
 
-সবগুলোই। তবে ভাংতি দাও...
 
-ভাঙা নাই স্যার... হবায় বাইর হইছি।
 
ইস! আজ যে সকাল সকাল কার মুখ দর্শন করেছিলাম? ভেতরের ছাই চাপা ক্রোধ আর অস্থিরতা এবার বাইরে বেড়িয়েই এল। একটু ঝাঁঝের সঙ্গে বলি
 
-আচ্ছা ভাংতি লাগবে না। বাকিটাও রাখ তবে...
 
আচমকা বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা দুর্বল ঘর্মাক্ত মুখটা কঠোর হয়ে গেল। হাতে ধরা রসদ আমার দিকে এগিয়ে আসতে নিয়েও থমকে গেল।
 
-কি হলো দাও!
 
নিমের মতন তিক্ত বিরক্তি ঝরে পড়ছে আমার কন্ঠে
 
-না, স্যার। আফনের লুছনি নাওন লাগত না।
 
-মানে? ফাইজলামি কর। এতক্ষণ তো কানের পোকা নাড়িয়ে দিয়েছিলে...
 
এবার নিচু গলায় উত্তর আসে। তবে ওটা হয় ইস্পাত দৃঢ়
 
-ফাও ট্যাকা লইতাম না, স্যার। হিসেবে যা আইব তাই নিমু। হুদা ট্যাকা দিয়া পোলাক ভাত খাওয়ামু না।
 
কথাটা বলে মহিলাটি আর দাঁড়ায় না। বাই বাই করে পেছন দিকে অদৃশ্য হয়ে যায়। আমি স্তম্ভিত। কেমন একটু ভ্যাবাচাকাও খেয়ে গেলুম। কি বলল? অশিক্ষিত রমনী? কিছু তো একটা বলে গেল। কি সেটা? মস্তিষ্কের নিউরনে চঞ্চলতা জেগে ওঠে। কেমন যেন এক রহস্য বলয়ে আটকে যাই। গাড়ি আচম্বিত দুলে উঠাতে ভাবনাতে ছেদ পড়ল আবারও। খেয়াল করি, চারপাশের যানগুলোর গতি মৃদু বেড়ে গিয়েছে। কৌতুহলী হয়ে সামনের দিকে তাকাই। ওহ! আর কিছু নয়, জ্যাম ছেড়েছে। হাঁফ ছাড়লাম আর তখুনি মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। মূর্খ সেই রমনীর কথার মর্ম উদ্ধার হল এতক্ষণে। প্রশ্নের উত্তর মিলে গেল আমার। সঙ্গে প্রশান্তির একটা শ্বাস বেড়িয়ে এল বুক চিঁড়ে। আর অবাক কান্ড! মনটা এক অদ্ভুত ধরনের কৃতজ্ঞতা বোধেও ভরে উঠল। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সেই মহিলাকে খুঁজে নেবার চেষ্টা করি। কিন্তু দেখা মেলে না তার। গাড়ি ছুটতে আরাম্ভ করেছে। অয়ন গলে শীতল বাতাস ঝাঁপিয়ে পড়ছে আমার কোলে। জ্যাম ছেড়ে গিয়েছে পুরোদস্তুর ভাবে। মনে মনে ভাবি, কেবল বিদঘুটে যানজট নয় বিবেকের জটটাও আমার খুলে গেল হঠাই।

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com

#গল্প
#ছোটগল্প
#সাহিত্য
#বাংলাসাহিত্য
#মোলাকাত
#সাহিত্য_ম্যাগাজিন
#ওয়েব_ম্যাগাজিন
#Molakat
#ShortStory
#Story
#Literature
#Bengali_Literature
#সোনিয়া_তাসনিম_খান

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.