সাধক পুরুষ ভবা পাগলার সাহিত্য ও জীবনকর্ম_এম ইব্রাহীম মিজি
ভবা পাগলা জন্মের পূর্ব
সংকেত ঃ ভবা পাগলার জনক গজেন্দ্র মোহন চৌধুরী। জননী গয়া সুন্দরী। ভবার জননী গয়া সুন্দরী
ছিলেন খুব নিষ্ঠাবতী এবং সাধ্বী মহিলা। তিনি ছিলেন বৈষ্ণব সাধিকা। তার ছবিতে দৃশ্যমান
ছিল তিলক চিহ্নিত দেহ। হাতে জপের মালা। এক রাতে গয়া সুন্দরীর স্বপ্নাদেশ হয়- ‘তোমার
গর্ভে জন্ম হবে এক তেজস্বী সাধকপুরুষের।’ অল্পদিন পরেই গর্ভবতী হলেন গয়া সুন্দরী। কিন্তু
তার মনে সন্দেহ- ‘গর্ভে সাধকপুরুষের জন্ম হবে! কোন গর্ভে! কবে! কোন দিন!’ অনুক্ষণ চিন্তা
তার মনে কিসে প্রমাণ পেতে পারেন।
গর্ভাবস্থায় এক রাতে আবার স্বপ্ন দেখলেন তার গর্ভাদেশ একদিব্যজ্যোতি পরিপূর্ণ। অত্যন্ত উজ্জল সেই জ্যোতি। কিন্তু কোটি জন্মের কোটি চন্দ্রের ন্যায় স্নিগ্ধ। সেই স্নিগ্ধতায় ভরে উঠলো তার মন প্রাণ। তিনি মহাভাবে নিমগ্ন হলেন। পুনঃ-পুনঃ অবগাহন করছেন সেই স্নিগ্ধ সাগরে। নিবিড় নিরবতা হঠাৎ শুনলেন সেই নিরবতার মধ্যে গুরুগম্ভীর নাদ ধ্বনি। অতি মধুর সেই ধ্বনি। এইতো বেদমন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। সেই সুক্ষ নাদ ধ্বনির পরই তিনি শুনলেন মধুর সঙ্গীত রচনা। সেই সঙ্গীতের সুরে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল।
ঘুম ভাঙ্গতেই শুনলেন গাছে গাছে পাপিয়ার ডাক, বুলবুলির কলতান। বাইরে এসে দেখলেন নবায়োনূদয় যেন সমস্ত নিশির তিমির ভেদ করে উদিত হচ্ছেন দিনপতি। আলোকে-পুলকে উদ্ভাসিত চারিদিক। ভাবাবেশ গয়া সুন্দরীর মনে। মহাপুরুষ ভিন্ন মানুষের মনোবল অটুট নয়। অখন্ড নয় তার বিশ্বাস। আবার ঝিমিয়ে পড়েন তিনি। আবার তার মনে সংশয়। কি জানি! স্বপ্নতো অলীক! হয়তো প্রহেলিকা। কত স্বপ্নইতো মানুষ দেখে। সবই কি সত্য হয়। কিন্তু তিনি জানেন ঠাকুর দেবতার বিষয় কিছু স্বপ্নে দেখলে সত্য হয়। এইরূপে দোদুল্যমান তার মন।
এবারে পঞ্চম মাস পরিপূর্ণ। তিনি স্থির হয়ে ঘরে বসে আছেন। অধিকাংশ সময় তিনি ইষ্টনাম জপে মগ্ন থাকতেন। ইষ্টনাম জপের মাধ্যমেই অভিভুত হয়ে পড়েছেন। হঠাৎ দেখলেন তার দেহ এক দিব্য জ্যোতিতে পরিপূর্ণ। সেই জ্যোতি: ক্রমশ ঘণিভূত তার গর্ভ প্রদেশে। গর্ভ প্রদেশ হতে সেই জ্যোতি বাইরে বেরিয়ে এলো। সেই জ্যোতি ধারণ করলো এক দেবসম সুন্দর দেহ। সন্মুখ ভাগেই ছিল একটি শিলা। সেই শিলার উপরে তার যুগল চরণ কমল। যুগল চরণের ছাপ পড়ে গেল সেই শিলার উপরে। তারপর সেই মূর্তি দেহ আবার জ্যোতিতে পরিণত হলো। আবার সেই ঘণিভূত জ্যোতি ধীরে-ধীরে গিয়ে গর্ভ প্রদেশে প্রবেশ করলো। ভেঙ্গে গেল গয়াসুন্দরীর আবেশ। বেশ আনন্দেই কাটে গয়াসুন্দরীর গর্ভাবস্থার দিনগুলো।
এক গর্ভে দুটি শিশু। দেবেন ও ভবেন। প্রথম জাতক দেবেন ভুমিষ্ট হওয়ার পরেও বোঝা গেল আরও একটি জাতক গর্ভ প্রদেশে রয়েছে। এই জাতকটি প্রসব করতে প্রসুতির বেশ একটু কষ্ট হলো। কষ্ট দেওয়াই যে তার স্বভাব। প্রেমের স্বভাব জ্বালা। তাই প্রেমময় আবির্ভাবের পূর্বভাগ হতেই সেই জ্বালায় জ্বালিয়ে ছিলেন জননীকে। তিনি সারা জীবন শুধু মানুষকে ¯্রষ্টার প্রেমে দিক্ষা দিয়েছেন। ভবেনের জন্মে যেন পূর্ণ আকাশের চাঁদ এসে পৃথিবীর মাটিতে উদয় হয়েছে। বহুলোক দেখতে এলো এই শিশু জাতককে। যেই দেখে সেই দিব্য আনন্দে মেতে উঠে। এত রূপ যেন কেউ কোনদিন দর্শন করে নাই। ছোট্ট শিশু। কিন্তু সুধা যেমন ভান্ড থেকে উপচে পরে যায়, তেমনি তার রূপের আলোকচ্ছটায় চারদিক আলোকিত হয়ে ওঠে।
সকলেই ভাবছে এইতো সাধারন শিশু নয়! এ নিশ্চয়ই কোন দেবতা! পাপী ভক্ত তরাতে বা উদ্ধারিতে মানব দেহ ধারণ করে এসেছেন এই মর্ত্যধামে। তাই ছন্দে বলতে হয়Ñ
“স্বর্ণকারে চেনে সোনা
জেলে জানে জাল কেমন বোনা
ভবা চেনে মায়ের গর্ভথলে,
তোমরা চিনবে ভাই এই আমতা এলে।”
ভবার কথা-
“শুধু চোখ বুলিয়ে, দেখলে দেখা হয় না।
মন দিয়ে দেখতে হয়,
এ অতিব সত্য কথা।”
“শিশু ভবেন মায়ের মায়ায় মাতাল হয়ে
মাতৃ পুজায় রত। ভাব রহস্যে ভক্ত মাঝে
গান শুনাইতো কত।”
মা, বাবা, ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী, শিক্ষক, চিকিৎসক সকল স্বজন বান্ধবগণের মধ্যে মাকে সর্বাপেক্ষা আপনজন মনে হয় কেন? উত্তরে ভবা গান গায়-
তাল কীর্তনাঙ্গ: দাদরা
তুমি আপন জন, তুমি আপন জন,
কৃপা করে তুমি আমায় দেখালে ভূবণ!! মাগো!
(মা) তুমি আমার বেদ-বেদান্ত, তুমি চন্ডীগীতা,,
(মা) তুমি আমার লাল জবা, নীল অপরাজিতা। মাগো!
(মা) তুমি আমার রক্ত-চন্দন ভজন-পূজন,,
(মা) তুমি আমার মহাভারত, তুমি রামায়ন!! মাগো!
(মা) তুমি আমার সকল তীর্থ, তুমি বেল পাতা,,
(মা) তুমি আমার সুখের সংসার অনন্তকালে চিতা। মাগো!
(মা) তুমি আমার ভারতবর্ষ, পৃথিবীর জীবন,,
ভবা কয় মা তুমি আমার বাঁচন-মরণ!! মাগো!
কি মাধুরী কথার! কি চমৎকার গানের গাঁথুনি! এমন মাতৃস্তব শুনতে কার না ভাল লাগে? এই কিশোর ভবা মাতৃভক্ত বলে, মাকে ছেড়ে কথা কই না, মা! তাহলে মা কে? শাস্ত্রে কি বলে?
আরও একটি গান (তাল- বাউল: দাদরা)
(মাগো) অত আদর, অত ¯েœহ, সব করিলি মাটি,
চোখ রাঙ্গিয়ে করলে শাসন হ’তাম আমি খাটি।
মিথ্যা কথা নয়-
ভাঙ্গা-গড়া তোরই হাতে, বেদ পূরাণে কয়,
আমি কি ক’রে মা ভাল হ’ব কোন্ পথে মা হাঁটি।
(হ’তাম আমি খাটি)!
তোর ইচ্ছাময়ী নাম-
খাম-খেয়ালী, কোন খেয়ালে, হ’লি আমার বাম।
(তাই) ভবা পাগলা গাল দিয়ে কয়, সর্বনাশী বেটী।।
(হ’তাম আমি খাটি)!
মায়ের প্রতি অনুযোগ অভিযোগটিও কি সুন্দর ভবেনের। গানের কথায় উচ্চারণের ঢঙে, চোখ পাকানোর ভঙ্গি দেখে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ভবেনের দিকে উপস্থিত সকলে। না-না কথা জিজ্ঞাসা করে-
একজন মন্তব্য প্রকাশ করলে- সব কটি গানের সঙ্গে নিজের নাম গায় কেন?
ভবা উত্তরে বলে- ওটা ঠিকানা, বাড়ির নম্বর- যেমন, কলকাতা শহরে এত বাড়ি, নম্বর না থাকলে খুজে বের করতে পারবেনা। তেমনি এটাও একটা ঠিকানা- মা’র সন্ধান এখানে পাওয়া যায়।
গজেন্দ্রমোহন চৌধুরীর ঔরষে নবাগত দু’ই মুখ ভুমিষ্ট হওয়ার পর এদের প্রথম ভুমিষ্ট সন্তানটির নাম রাখা হ’ল দেবেন্দ্রমোন আর দ্বিতীয়টির নাম ভবেন্দ্রমোহন বা সাধক ভবা পাগলা।
কিন্তু জনমনে প্রশ্ন জাগে- এই যমজ দুই সন্তানের পূর্বে যে সন্তান ভুমিষ্ট হয়ে প্রস্তর খন্ডে পদচিহ্ন রেখে গিয়েছিলেন এবং তখনই কথা বলেছিলেন; ভাব গম্ভির্যের মধ্য দিয়ে।
“আবার আসব মা, দশ মাস পরে”-
সে সন্তানটি কে?
যমজ ভ্রাতৃদ্বয়ের দ্বিতীয়টি অর্থাৎ ভবেন্দ্র কে- অসামান্য, অসাধারন বা অনন্যা এক শিশু রূপে গন্য করতে কারও বেশী দিন অপেক্ষা করতে হ’ল না।
একটু বড় হতেই তার ভাব ভঙ্গিমা অনুপম উক্তি, তার ঈশ্বর ভক্তি এবং প্রতিটি মানুষের প্রতি তার দরদ ও প্রীতির পরিচয় পেয়ে সকলেই মুগ্ধ হতে থাকলেন। শুধু মাতা-পিতা ও আত্মীয়স্বজন নয়, পাড়া প্রতিবেশী, খেলার সঙ্গী-সাথী, দিনমজুর সকলেই বুঝলেন, এ শিশু অসামান্য। এমনকি তেজস্বিতায়ও অনন্য। তার ইচ্ছায় বাঁধা দিতে কেউ পেরে উঠে না তার গতি, প্রকৃতি, ইচ্ছা আকাঙ্খা সবকিছুই যেন অপ্রতিরোধ্য। সবই তার বিস্ময়কর।
পিতা গজেন্দ্রমোহন একদিন পুত্র ভবেন্দ্র’কে কোলে বসিয়ে আদর সুচক কথাবর্তা বলছিলেন। ভবেন্দ্রের বয়স তখন পাঁচ বছরের মতো হবে।
পিতা পুত্রকে বলছিলেন-
তোর যা মেজাজ বাবা, যেমন জেদ দেখছি, পুলিশের চাকরিই তোকে মানাবে ভালো। বড় হলে তোকে পুলিশের দলেই ভর্তি করে দিব।
শিশু পুত্র ভবেন্দ্র পিতার মুখের দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি ছড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন-
পুলিশ কেমন মানুষ, বাবা?
পিতার উত্তর- পুলিশ রাজ্যকে শাসনে রাখে বাবা। শিশু ভবেন্দ্র পিতাকে আবার প্রশ্ন করেন-
মানুষকে শাসন করতে পুলিশের বড় আর কেউ নাই বাবা? পুলিশই কি সবার বড় ?
পুত্রের এ প্রশ্ন গজেন্দ্রমোহনের মনে ভাবান্তর ঘটালো। এ যে গভীর প্রশ্ন। ভাবপূর্ণ কণ্ঠেই তিনি উত্তর করলেন: আছে বাবা! পুলিশের উপরেও আছে। তিনি ব্রহ্মময়ী, সবার পালনকর্তা, মা জগদম্বা।
পুত্র আবার প্রশ্ন করে জগদম্বা কে বাবা? হাম্বা না কি?
পিতা গজেন্দ্রমোহন হেসে দিয়ে বললেন-
আরে না পাগল, হাম্বা নয় জগদম্বা হলেন, জগতের মা- মা কালী।
তাহলে আমি মা কালীরই চাকরী করব বাবা? চটপট উত্তর শিশু ভবেন্দ্রের।
শিশুর মুখে হলেও এযে কত বড় সত্য; কী গভীর তত্ত্ব এবং অন্তরের কতবড় সিদ্ধান্ত এটুকুন বয়সেই ভবেন্দ্র প্রকাশ করলেন, অনাগতকালই তা বর্ণে-বর্ণে প্রমাণ দিবে বা দিচ্ছে। সকল শ্রেণীর মানুষই একদিন হৃদয়ঙ্গম করবেন, শিশু সেদিন বেফাস কিছু বলেননি। বরং তারই রচিত গানে একদিন সকলে শুনতে পাবেন- এই আধ্যান্তিক গান-
আমি মায়ের চাকুরী করি, তাতেই বুকে এত বল,
মাইনে বাবদ পাই যে আমি চর্তুবর্গ ফল।
শুধু মাইনে পাইনা, আরও পাই কিছু উপরি,
ব্রহ্মময়ী দেন ব্রহ্মশক্তী, জ্ঞান দান করেন ত্রিপুরারী।
রাম দেন মোরে নামামৃত, কৃষ্ণ দেন রাধা প্রেম-জল,
যমুনা আর সুরধনী, দু’টি নয়ন মোর
বারানসীসম বদন, রসনা, গৌর,
(সদা) প্রেম তরঙ্গে, নাসারন্ধ্রে পবন বহে ঐ প্রবল।
মায়ের অসি বিবেক মোর; শিবের ত্রিশুল মন,
রামের ধনুক হল বুদ্ধি কৃষ্ণের বাঁশী ধ্যাণ।
এই নিয়ে মুই করি কার্য্য, নাই কোন আর শক্তি,
আছে আমার বিপুল ধৈর্য্য, পাব তাতে মুক্তি।
ভবা পাগলা ভাবে একলা, শমন দূরে যা, দুর্বল।
অলৌকিক মায়ের চাকুরীর লৌকিক অনুষ্ঠান ভবেন্দ্র ওই বালক বয়স থেকেই শুরু করেছেন। শুরু করেছিলেন অদ্ভুত শিল্পাচার্য ভবেন্দ্রমোহনের শিল্প কর্মের নিপুন হাতের মুর্তি তৈরী। মায়ের একটি মৃন্ময় মুর্তি নিজের হাতে গড়ে নিয়ে নিজের রুচিমতো রঙ করে নিলেন তিনি। ভবেন্দ্র যে জাতশিল্পী তারই সুচনা দেখা গেল ওই অতি বাল্যকাল থেকে।
গজেন্দ্রমোহনের এই বিরাট বাড়ীতে ঐ সু-উচ্চ বিলাতী গাব গাছের তলায় বেছে নিয়েছিলেন ভবা পাগলার বাল্য সাথীদের নিয়ে মায়ের পুজায় মত্ত থাকার জন্য।
গাছের কথা বলতে গেলে আর দশটা গাছের সাথে এই গাব গাছের তুলনা করা যায় না, তেমনই ভবা পাগলা আর দশটা ছেলের মত সাধারন ধারণা করা যায় না। সাধারন গাছের মধ্য হতে ঐ গাব গাছটি পরমাশক্তিসিদ্ধ হতে পারে, এ কথা অজ্ঞাত ছিল। গাছের তাৎপর্য, শক্তিমাহাত্ম্য উদঘাটন করেছিল ঐ বাল্য ভবেন্দ্র, আজকের ভবা পাগলা।
শৈশব লীলাসঙ্গী পরিবৃত ভবেন্দ্রমোহনের মাতৃপুজায় গাবতলায় প্রথম মাহাত্ম্য প্রকাশ পেল মায়ের প্রসাদ বিতরণে, সেই প্রসাদের আস্বাদনে। বেণী চৌধুরীর পুত্র বিধুভূষণ চৌধুরী, যজ্ঞেশ্বর রায়ের পুত্র গিরিজা রায়, গোপিশ্বর সাহার পুত্র সুরেশ সাহা, নিতাই বণিক্যের পুত্র রমণী বণিক্য, নিকুঞ্জ সাহার পুত্র সতীশ সাহা প্রমুখ বালকবৃন্দ ছিলেন, এই একই পাড়ার ছেলে। ওরা ভবেন্দ্রমোহনের সমবয়সী পরস্পর দু’তিন বছরের ছোট-বড় এবং ক্রীড়াসঙ্গী। এই সঙ্গীদের নিয়েই ভবেন্দ্র গাব তলায় রত হলেন ভবানীর পুজায়। সাথীরা নিজ হাতে মাটি দিয়ে সন্দেশ বানিয়ে নৈবেদ্য সাজালেন। পুজায় বসলেন ভবেন্দ্র। পুজা অন্তে প্রসাদ বিতরণ শুরু হল জিহ্বাগ্রে- ঐ প্রসাদ ঠেকিয়েই ভবা পাগলার বন্ধুগন পরস্পর বিস্ফোরিত চোখে অতিশয় বিস্ময়সুচক ধ্বনি করে উঠলেন- এ কি রে! এ যে মিষ্টি! এ যে ছানার মতন! ওরে আয়, কে দেখবি আয়, কে খাবি আয়! মাটির সন্দেশ ছানার সন্দেশ হয়ে গেছে!
বালকদের চিৎকারে বড়দেরও আকৃষ্ট করলো। তারাও কৌতুহল বশত; ঐ প্রসাদ মুখে দিয়ে চুড়ান্ত বিস্ময় প্রকাশ করলেন। এ যে অপূর্ব! এ সে অমৃত! এ কেমন মাটির সন্দেশ! ভবেন্দ্র তাদের সংশোধন করে দিলেন এগুলো মাটির সন্দেশ নয় ‘মা’টির সন্দেশ বল। এ তাজ্জবের ব্যাপার নয় আরও আছে দরকার শুধু ‘একের’ সাথে ‘এক’ যোগে সব কিছু হয়। দেখনা এক এর যোগে সত্যিকারের যোগ। ভবেন বলেন, বালী ও কালী হয়। ‘ব’ এর সাথে ১ যোগ করে দেখেন বালী-কালী হয়ে গেছে (উদাহরণ স্বরূপ- ব+১ = ক)। আরও বলেন-
১-এ ১-এ ‘এক’ হলেই সব ঠিক। দুই হলেই পৃথক, দুই হলেই দূরত্ব। তাই একের সাধনাই সাধনা। ঐ ঘটনার স্মারক বাণী স্বয়ং ভবা পাগলার-
“গাবের তলায় কত খেলায় দিন হ’ত তার গত,
নিশা কালে, দিশা হারায়- শ্যামা পুজায় রত।
ছেলে বেলায় মাটির সন্দেশ ‘মা’ টিকে সে দিত,
ছানার ভাবে ভাবময়ী করিত ছানায় পরিণত।”
পাঁচ-ছয় বৎসর বয়সকালে ভবেন্দ্রমোহন আর একটি অতিশয় আশ্চার্য্যজনক কাজ করে মানুষকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিলেন। ভবা পাগলা মা কালীর উদ্দেশ্যে একটি গান মুখে মুখে রচনা করে এবং নিজেই তাতে সুরারোপ করে আপন মনে গাইতে লাগলেন-
এসো মা কালী শুন মা বলি, আমার প্রাণের বেদনা,
লাগেনা ভাল, কি যে করি, তুমি আমায় বল না।
ভাবিয়া, ভাবিয়া হতেছি সারা,
এসো, এসো, এসো মা তারা।
তুমি বিনে আর কেউ নাই আমার,
দগ্ধ হৃদয়ে দিতে সান্তনা।
শেষের দিন ভবার এলো কাছে,
আর কেন মা রইলে পিছে।
এসো এসো মা, জলন্ত প্রতিমা,
আর দূরে (তুমি) থেকো না থেকো না।
এই গানটি দিয়েই শুরু হলো ভবেন্দ্র বা আজকের ভবা পাগলার মাতৃনাম গানের অঞ্জলি। অজ¯্র অঞ্জলি সূত্রপাত হল শ্যামা সঙ্গীত মন্ত্র সাধক রামপ্রসাদেরও। ভবা পাগলার মাতৃনাম সুধা বিতরনের অজ¯্র প্রবাহ। বুঝি একক মনুষ্যসৃষ্ট সাধনা সঙ্গীতের ইতিহাসে সর্বাধিক ভক্তিগীতি রচনার শুভারম্ভ।
ভবা পাগলার এক ভক্তের চাকুরী চলে গেছে তার খেদের কথা শুনে তার চাকুরী বিচ্যুতির ফলে সংসারে অভাব অভিযোগের ভাবনা দেখে। ভবা পাগলা সেদিন গানের মাধ্যমে সকল ভক্তজনকেই শোনালেন মাতৃপদে চাকুরীর কথা মাতৃপদে চাকুরীর তাৎপর্যের কথা। তিনি গানটি রচনা করেন এবং যথারিতি সঙ্গে সঙ্গে সুরারোপ করে সে’টি শোনাতে লাগলেন-
মন মাতৃপদে চাকুরী কর, চাকুরী যাবে না,
স্বভাব পাবে, অভাব যাবে, হবে তুমি খাটি সোনা।
(চাই) ভক্তি, বিশ্বাস, সরলতা,
পাবে রে মন,, একটি খাতা।
লিখবে তাতে, ঐ বিধাতা,
অমর হবে, মরণ হবে না।
কেবল দেহখানি উলট-পালট, বেদ বেদান্তে এই ঘোষনা।
অভাবে স্বভাব নষ্ট
(এ) ব্যাধির জ্বালা, বড়ই কষ্ট,
বড়ই সুন্দর এই কারখানা।
(কত) মুনি, ঋষি, চাকুরী করে (পায়) মনের মত মাহিনা।
মানুষ হবে, নামটি রবে,
এ কালির দাগ সত্য হবে,
(কোন কালেও) মুছে যাবে না।
শমন রাজা হেরে যাবে, (আর) শমনজারী করবে না।
ভবা পাগলা, ভুলের বশে।
কি যেন কি, কপাল দোষে।
ঘরের কোণে, রইলো বসে।
(সদাকরে) ছয় রিপুতে টানাটানি হারিয়ে গেল ষোলআনা।
মাতৃপদে চাকুরী করতে ভবা পাগলার আহ্বান অকুণ্ঠ।
ভবা পাগলার গান ভারত উপমহাদেশের সঙ্গীত ভান্ডারে এক অমূল্য সম্পদ। অতি বিশ্ময়কর এবং মনোহর ছিল তাল ছন্দ ও লয়, লোক কবি, বাণীকণ্ঠ, সুরকার, যন্ত্রবিশারদ, এক অদ্ভুদ পদকর্তা এবং সর্বপরি সাধক ছিলেন তিনি। গানই ছিল তার সাধনার মাধ্যম। “গানই সর্বশ্রেষ্ঠ সাধনা, গান সাধনা করতে লাগেনা ফুল চন্দন, লাগেনা তন্ত্র মন্ত্র ”। গানের মাধ্যমেই ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়ার পথ দেখিয়েছেন। ভবা পাগলার গান শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয় বরং লোকশিক্ষারও একটা বড় মাপের মাধ্যমও। তিনি ছিলেন মাতৃসাধক । এই মহাবিশ্বের ¯্রষ্টা, লালনকর্তা, পালনকর্তা, যিনি অনাদি-অনন্ত সেই পরম করুনাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকেই মাতৃজ্ঞানে ভজন করে খ্যাতি লাভ করেছেন। “মাতৃসাধক পরমগুরু ভবা পাগলা” যার জাতের নেই কোন ভেদাভেদ-
ভিন্ন নয়রে আল্লাহ হরি,
শোনরে ফকির ব্রহ্মচারি।
দেখতে তারে হয় না দেরি,
খুলে দে তোর হৃদয় প্রাণ।
জগতের সকল ধর্মের অনুসারীদের হিংসা বিদ্বেষ ত্যাগ করে স্ব-স্ব ধর্মে নিষ্টাবান থেকে ¯্রষ্টার আরাধনা করতে করজোরে প্রার্থনা করেছেন সর্বপরি কল্যাণের জন্য। বাণী-
১। ‘অজানার সঙ্গে, মিলন করিতে ২। ‘কর্মই ধর্ম, শত ব্যস্ততায় ও যেন,
পৃথিবীতে আনাগোনা। মাগো, তোমারই ঐ দু’টি পায়
দু’দিনের তরে আপন করিয়া, মনটি আমার পড়িয়া থাকে।
ভেঙ্গে ফেলে কত খেলনা। ৪। কত সোনার মানুষ দেশে দেশে,
ঘুরে গেল পাগল বেশে।
৩। প্রিয়জনে অপ্রিয় কথা কইওনা, চিনে তারে অবশেষে,
অপ্রিয়কেও ভাল ছাড়া মন্দ বল না। দেশ ছেড়ে যেদিন পালায়।
ঢাকা জেলার অন্তর্গত ধামরাই থানার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বংশী নদীর তীর ঘেষে গর্বিত আমতা গ্রাম। এই গ্রামে পরম গুরু সাধক ভবা পাগলা ১৩০৭ বাংলা ১৯০২ ইংরেজী সালে জন্মগ্রহণ করেন। আশ্বিন মাস, শরৎ কাল, কোজাগরী পূর্ণিমা, শারদিয়া উৎসবে সারা বাংলা বিভোর। শিউলির গন্ধে আকাশ বাতাস আমোদিত। আকাশে পূর্ণচন্দ্র, চারদিকে ঢাক-ঢোলের বাজনায় মুখরিত। ঠিক এমনি দিনে ভবা পাগলার আবির্ভাব।
প্রতিটি মানুষের অন্তর্নিহিত পরমাত্মার বিকাশ সাধনের জন্যেই ধর্ম। ধর্মই মানুষকে মহাগুনে গুনাম্বিত করে। জীবনকে গৌরবে ও ঐশ্বর্যময়ে রূপান্তরিত করে। সাধক ভবা পাগলা এই মহিমাম্বিত ও গৌরবাম্বিত মানবতা তত্বের সাধক। ভক্ত মাঝে ভবা পাগলা নিজেই তার পরিচয় দিয়েছেনÑ
“পূর্ব বঙ্গের ঢাকার গর্ভে গর্বিত গ্রাম আমতা,
সেই গ্রামে জন্ম মোর পিতা গজেন্দ্র-গয়া মাতা।
বাঁচন মরণ এই দুই কূল সমাজ অমর ধাম,
সেই সমাজের অধিকারী মুই ভবা পাগলা নাম।
স্বজাতির মায়া ত্যাগ করে জন্মভূমি ছেড়ে ভবা পাগলা ভারত যাত্রা করেন বাংলা ১৩৫৪ সনে, তখনো তার বয়স পঞ্চাশ পেরোয়নি। দুঃখজনক সত্য হলেও ভবা পাগলার জীবদ্দশায় তার জন্মস্থান আমতায় আর ফিরে আসেননি। তিনি ছিলেন কালী সাধক, মা কালীকে সামনে বসিয়ে তার হুবহু মুর্তি বানিয়ে সে মুর্তিকে পূজা দিতেন ভবা পাগলা। ৩২টি কালীর নাম জানতেন তিনি। যেমন- ক্ষেপা কালী, যজ্ঞা কালী, ক্ষয় কালী, জয় কালী আরও অনেক। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো সাধক ভবা পাগলার এক লক্ষ পয়ষট্টি হাজার মুরিদ ছিল। তার মধ্যে সব ধর্মের মিলিয়ে বাংলাদেশে তার মুরিদের সংখ্যা সর্বসাকুল্যে বার হাজারের মতো। ভবা পাগলার লিখিত গানের সংখ্যা পনের হাজার পাঁচশত এর মতো। এবং কি ভবা পাগলার নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত ভারতে মন্দিরের সংখ্যা বাষট্টিটি। তার তিন সন্তান, দুই ছেলে এক মেয়ে। ছেলেদের নাম- সনৎ চৌধুরী ও সংকল্প চৌধুরী, মেয়ের নাম প্রতিমা চৌধুরী বা পুতুল। সাধক ভবা পাগলা মা কালীর সাথে সামনাসামনি বসে কথা বলতেন। মা আর সন্তান যেমন কথা বলে। বাংলাদেশে থাকা কালীন স্বজাতির কুচক্রীমহল তার নামে অনেক কুৎসা রটায় এবং মিথ্যা অপবাদ দেয়। এই রকম একটি মিথ্যা ঘটনাকে কেন্দ্র করে এলাকার কিছু দুষ্ট লোক থানায় মামলা করলে তৎকালীন সাভার থানার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সরোজমিন তদন্তে এসে ভবা পাগলার ঈশ্বরিক ক্ষমতার প্রমাণ পেয়ে মিথ্যা মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দিয়ে তারা ফিরে যান। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কালনায় ‘ভবার ভবানী মন্দির’ নামক বাড়িতে তিনি আমৃত্যু বসবাস করেন। এবং ঐ মন্দিরে থেকে তিনি ভক্তজনদের ঈশ্বর প্রেমের দীক্ষা দিতেন। ১৯৮৪ ইং বাংলা ১৩৯০ সনের ১২ইং ফাল্গুন রবিবারে কলকাতার আর্জু হাসপাতালে অগনিত ভক্তকুলকে কাঁদিয়ে আধ্যাত্মিক গানের অমর শ্রষ্টা সাধক পুরুষ ভবা পাগলা দেহ ত্যাগ করেন।
তথ্য সহায়তাকারী
(১) আমতা ভবা পাগলার আশ্রমের সেবায়েত =
তরুনী সাধু
(২) ভবা পাগলার একমাত্র মুসলমান মুরিদ =
আমতা নিবাসী জনাব আলী হোসেন।
গর্ভাবস্থায় এক রাতে আবার স্বপ্ন দেখলেন তার গর্ভাদেশ একদিব্যজ্যোতি পরিপূর্ণ। অত্যন্ত উজ্জল সেই জ্যোতি। কিন্তু কোটি জন্মের কোটি চন্দ্রের ন্যায় স্নিগ্ধ। সেই স্নিগ্ধতায় ভরে উঠলো তার মন প্রাণ। তিনি মহাভাবে নিমগ্ন হলেন। পুনঃ-পুনঃ অবগাহন করছেন সেই স্নিগ্ধ সাগরে। নিবিড় নিরবতা হঠাৎ শুনলেন সেই নিরবতার মধ্যে গুরুগম্ভীর নাদ ধ্বনি। অতি মধুর সেই ধ্বনি। এইতো বেদমন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। সেই সুক্ষ নাদ ধ্বনির পরই তিনি শুনলেন মধুর সঙ্গীত রচনা। সেই সঙ্গীতের সুরে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল।
ঘুম ভাঙ্গতেই শুনলেন গাছে গাছে পাপিয়ার ডাক, বুলবুলির কলতান। বাইরে এসে দেখলেন নবায়োনূদয় যেন সমস্ত নিশির তিমির ভেদ করে উদিত হচ্ছেন দিনপতি। আলোকে-পুলকে উদ্ভাসিত চারিদিক। ভাবাবেশ গয়া সুন্দরীর মনে। মহাপুরুষ ভিন্ন মানুষের মনোবল অটুট নয়। অখন্ড নয় তার বিশ্বাস। আবার ঝিমিয়ে পড়েন তিনি। আবার তার মনে সংশয়। কি জানি! স্বপ্নতো অলীক! হয়তো প্রহেলিকা। কত স্বপ্নইতো মানুষ দেখে। সবই কি সত্য হয়। কিন্তু তিনি জানেন ঠাকুর দেবতার বিষয় কিছু স্বপ্নে দেখলে সত্য হয়। এইরূপে দোদুল্যমান তার মন।
এবারে পঞ্চম মাস পরিপূর্ণ। তিনি স্থির হয়ে ঘরে বসে আছেন। অধিকাংশ সময় তিনি ইষ্টনাম জপে মগ্ন থাকতেন। ইষ্টনাম জপের মাধ্যমেই অভিভুত হয়ে পড়েছেন। হঠাৎ দেখলেন তার দেহ এক দিব্য জ্যোতিতে পরিপূর্ণ। সেই জ্যোতি: ক্রমশ ঘণিভূত তার গর্ভ প্রদেশে। গর্ভ প্রদেশ হতে সেই জ্যোতি বাইরে বেরিয়ে এলো। সেই জ্যোতি ধারণ করলো এক দেবসম সুন্দর দেহ। সন্মুখ ভাগেই ছিল একটি শিলা। সেই শিলার উপরে তার যুগল চরণ কমল। যুগল চরণের ছাপ পড়ে গেল সেই শিলার উপরে। তারপর সেই মূর্তি দেহ আবার জ্যোতিতে পরিণত হলো। আবার সেই ঘণিভূত জ্যোতি ধীরে-ধীরে গিয়ে গর্ভ প্রদেশে প্রবেশ করলো। ভেঙ্গে গেল গয়াসুন্দরীর আবেশ। বেশ আনন্দেই কাটে গয়াসুন্দরীর গর্ভাবস্থার দিনগুলো।
এক গর্ভে দুটি শিশু। দেবেন ও ভবেন। প্রথম জাতক দেবেন ভুমিষ্ট হওয়ার পরেও বোঝা গেল আরও একটি জাতক গর্ভ প্রদেশে রয়েছে। এই জাতকটি প্রসব করতে প্রসুতির বেশ একটু কষ্ট হলো। কষ্ট দেওয়াই যে তার স্বভাব। প্রেমের স্বভাব জ্বালা। তাই প্রেমময় আবির্ভাবের পূর্বভাগ হতেই সেই জ্বালায় জ্বালিয়ে ছিলেন জননীকে। তিনি সারা জীবন শুধু মানুষকে ¯্রষ্টার প্রেমে দিক্ষা দিয়েছেন। ভবেনের জন্মে যেন পূর্ণ আকাশের চাঁদ এসে পৃথিবীর মাটিতে উদয় হয়েছে। বহুলোক দেখতে এলো এই শিশু জাতককে। যেই দেখে সেই দিব্য আনন্দে মেতে উঠে। এত রূপ যেন কেউ কোনদিন দর্শন করে নাই। ছোট্ট শিশু। কিন্তু সুধা যেমন ভান্ড থেকে উপচে পরে যায়, তেমনি তার রূপের আলোকচ্ছটায় চারদিক আলোকিত হয়ে ওঠে।
সকলেই ভাবছে এইতো সাধারন শিশু নয়! এ নিশ্চয়ই কোন দেবতা! পাপী ভক্ত তরাতে বা উদ্ধারিতে মানব দেহ ধারণ করে এসেছেন এই মর্ত্যধামে। তাই ছন্দে বলতে হয়Ñ
“স্বর্ণকারে চেনে সোনা
জেলে জানে জাল কেমন বোনা
ভবা চেনে মায়ের গর্ভথলে,
তোমরা চিনবে ভাই এই আমতা এলে।”
ভবার কথা-
“শুধু চোখ বুলিয়ে, দেখলে দেখা হয় না।
মন দিয়ে দেখতে হয়,
এ অতিব সত্য কথা।”
“শিশু ভবেন মায়ের মায়ায় মাতাল হয়ে
মাতৃ পুজায় রত। ভাব রহস্যে ভক্ত মাঝে
গান শুনাইতো কত।”
মা, বাবা, ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী, শিক্ষক, চিকিৎসক সকল স্বজন বান্ধবগণের মধ্যে মাকে সর্বাপেক্ষা আপনজন মনে হয় কেন? উত্তরে ভবা গান গায়-
তাল কীর্তনাঙ্গ: দাদরা
তুমি আপন জন, তুমি আপন জন,
কৃপা করে তুমি আমায় দেখালে ভূবণ!! মাগো!
(মা) তুমি আমার বেদ-বেদান্ত, তুমি চন্ডীগীতা,,
(মা) তুমি আমার লাল জবা, নীল অপরাজিতা। মাগো!
(মা) তুমি আমার রক্ত-চন্দন ভজন-পূজন,,
(মা) তুমি আমার মহাভারত, তুমি রামায়ন!! মাগো!
(মা) তুমি আমার সুখের সংসার অনন্তকালে চিতা। মাগো!
(মা) তুমি আমার ভারতবর্ষ, পৃথিবীর জীবন,,
ভবা কয় মা তুমি আমার বাঁচন-মরণ!! মাগো!
কি মাধুরী কথার! কি চমৎকার গানের গাঁথুনি! এমন মাতৃস্তব শুনতে কার না ভাল লাগে? এই কিশোর ভবা মাতৃভক্ত বলে, মাকে ছেড়ে কথা কই না, মা! তাহলে মা কে? শাস্ত্রে কি বলে?
আরও একটি গান (তাল- বাউল: দাদরা)
(মাগো) অত আদর, অত ¯েœহ, সব করিলি মাটি,
চোখ রাঙ্গিয়ে করলে শাসন হ’তাম আমি খাটি।
মিথ্যা কথা নয়-
ভাঙ্গা-গড়া তোরই হাতে, বেদ পূরাণে কয়,
আমি কি ক’রে মা ভাল হ’ব কোন্ পথে মা হাঁটি।
(হ’তাম আমি খাটি)!
তোর ইচ্ছাময়ী নাম-
খাম-খেয়ালী, কোন খেয়ালে, হ’লি আমার বাম।
(তাই) ভবা পাগলা গাল দিয়ে কয়, সর্বনাশী বেটী।।
(হ’তাম আমি খাটি)!
মায়ের প্রতি অনুযোগ অভিযোগটিও কি সুন্দর ভবেনের। গানের কথায় উচ্চারণের ঢঙে, চোখ পাকানোর ভঙ্গি দেখে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ভবেনের দিকে উপস্থিত সকলে। না-না কথা জিজ্ঞাসা করে-
একজন মন্তব্য প্রকাশ করলে- সব কটি গানের সঙ্গে নিজের নাম গায় কেন?
ভবা উত্তরে বলে- ওটা ঠিকানা, বাড়ির নম্বর- যেমন, কলকাতা শহরে এত বাড়ি, নম্বর না থাকলে খুজে বের করতে পারবেনা। তেমনি এটাও একটা ঠিকানা- মা’র সন্ধান এখানে পাওয়া যায়।
গজেন্দ্রমোহন চৌধুরীর ঔরষে নবাগত দু’ই মুখ ভুমিষ্ট হওয়ার পর এদের প্রথম ভুমিষ্ট সন্তানটির নাম রাখা হ’ল দেবেন্দ্রমোন আর দ্বিতীয়টির নাম ভবেন্দ্রমোহন বা সাধক ভবা পাগলা।
কিন্তু জনমনে প্রশ্ন জাগে- এই যমজ দুই সন্তানের পূর্বে যে সন্তান ভুমিষ্ট হয়ে প্রস্তর খন্ডে পদচিহ্ন রেখে গিয়েছিলেন এবং তখনই কথা বলেছিলেন; ভাব গম্ভির্যের মধ্য দিয়ে।
“আবার আসব মা, দশ মাস পরে”-
সে সন্তানটি কে?
যমজ ভ্রাতৃদ্বয়ের দ্বিতীয়টি অর্থাৎ ভবেন্দ্র কে- অসামান্য, অসাধারন বা অনন্যা এক শিশু রূপে গন্য করতে কারও বেশী দিন অপেক্ষা করতে হ’ল না।
একটু বড় হতেই তার ভাব ভঙ্গিমা অনুপম উক্তি, তার ঈশ্বর ভক্তি এবং প্রতিটি মানুষের প্রতি তার দরদ ও প্রীতির পরিচয় পেয়ে সকলেই মুগ্ধ হতে থাকলেন। শুধু মাতা-পিতা ও আত্মীয়স্বজন নয়, পাড়া প্রতিবেশী, খেলার সঙ্গী-সাথী, দিনমজুর সকলেই বুঝলেন, এ শিশু অসামান্য। এমনকি তেজস্বিতায়ও অনন্য। তার ইচ্ছায় বাঁধা দিতে কেউ পেরে উঠে না তার গতি, প্রকৃতি, ইচ্ছা আকাঙ্খা সবকিছুই যেন অপ্রতিরোধ্য। সবই তার বিস্ময়কর।
পিতা গজেন্দ্রমোহন একদিন পুত্র ভবেন্দ্র’কে কোলে বসিয়ে আদর সুচক কথাবর্তা বলছিলেন। ভবেন্দ্রের বয়স তখন পাঁচ বছরের মতো হবে।
পিতা পুত্রকে বলছিলেন-
তোর যা মেজাজ বাবা, যেমন জেদ দেখছি, পুলিশের চাকরিই তোকে মানাবে ভালো। বড় হলে তোকে পুলিশের দলেই ভর্তি করে দিব।
শিশু পুত্র ভবেন্দ্র পিতার মুখের দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি ছড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন-
পুলিশ কেমন মানুষ, বাবা?
পিতার উত্তর- পুলিশ রাজ্যকে শাসনে রাখে বাবা। শিশু ভবেন্দ্র পিতাকে আবার প্রশ্ন করেন-
মানুষকে শাসন করতে পুলিশের বড় আর কেউ নাই বাবা? পুলিশই কি সবার বড় ?
পুত্রের এ প্রশ্ন গজেন্দ্রমোহনের মনে ভাবান্তর ঘটালো। এ যে গভীর প্রশ্ন। ভাবপূর্ণ কণ্ঠেই তিনি উত্তর করলেন: আছে বাবা! পুলিশের উপরেও আছে। তিনি ব্রহ্মময়ী, সবার পালনকর্তা, মা জগদম্বা।
পুত্র আবার প্রশ্ন করে জগদম্বা কে বাবা? হাম্বা না কি?
পিতা গজেন্দ্রমোহন হেসে দিয়ে বললেন-
আরে না পাগল, হাম্বা নয় জগদম্বা হলেন, জগতের মা- মা কালী।
তাহলে আমি মা কালীরই চাকরী করব বাবা? চটপট উত্তর শিশু ভবেন্দ্রের।
শিশুর মুখে হলেও এযে কত বড় সত্য; কী গভীর তত্ত্ব এবং অন্তরের কতবড় সিদ্ধান্ত এটুকুন বয়সেই ভবেন্দ্র প্রকাশ করলেন, অনাগতকালই তা বর্ণে-বর্ণে প্রমাণ দিবে বা দিচ্ছে। সকল শ্রেণীর মানুষই একদিন হৃদয়ঙ্গম করবেন, শিশু সেদিন বেফাস কিছু বলেননি। বরং তারই রচিত গানে একদিন সকলে শুনতে পাবেন- এই আধ্যান্তিক গান-
আমি মায়ের চাকুরী করি, তাতেই বুকে এত বল,
মাইনে বাবদ পাই যে আমি চর্তুবর্গ ফল।
শুধু মাইনে পাইনা, আরও পাই কিছু উপরি,
ব্রহ্মময়ী দেন ব্রহ্মশক্তী, জ্ঞান দান করেন ত্রিপুরারী।
রাম দেন মোরে নামামৃত, কৃষ্ণ দেন রাধা প্রেম-জল,
যমুনা আর সুরধনী, দু’টি নয়ন মোর
বারানসীসম বদন, রসনা, গৌর,
(সদা) প্রেম তরঙ্গে, নাসারন্ধ্রে পবন বহে ঐ প্রবল।
মায়ের অসি বিবেক মোর; শিবের ত্রিশুল মন,
রামের ধনুক হল বুদ্ধি কৃষ্ণের বাঁশী ধ্যাণ।
এই নিয়ে মুই করি কার্য্য, নাই কোন আর শক্তি,
আছে আমার বিপুল ধৈর্য্য, পাব তাতে মুক্তি।
ভবা পাগলা ভাবে একলা, শমন দূরে যা, দুর্বল।
অলৌকিক মায়ের চাকুরীর লৌকিক অনুষ্ঠান ভবেন্দ্র ওই বালক বয়স থেকেই শুরু করেছেন। শুরু করেছিলেন অদ্ভুত শিল্পাচার্য ভবেন্দ্রমোহনের শিল্প কর্মের নিপুন হাতের মুর্তি তৈরী। মায়ের একটি মৃন্ময় মুর্তি নিজের হাতে গড়ে নিয়ে নিজের রুচিমতো রঙ করে নিলেন তিনি। ভবেন্দ্র যে জাতশিল্পী তারই সুচনা দেখা গেল ওই অতি বাল্যকাল থেকে।
গজেন্দ্রমোহনের এই বিরাট বাড়ীতে ঐ সু-উচ্চ বিলাতী গাব গাছের তলায় বেছে নিয়েছিলেন ভবা পাগলার বাল্য সাথীদের নিয়ে মায়ের পুজায় মত্ত থাকার জন্য।
গাছের কথা বলতে গেলে আর দশটা গাছের সাথে এই গাব গাছের তুলনা করা যায় না, তেমনই ভবা পাগলা আর দশটা ছেলের মত সাধারন ধারণা করা যায় না। সাধারন গাছের মধ্য হতে ঐ গাব গাছটি পরমাশক্তিসিদ্ধ হতে পারে, এ কথা অজ্ঞাত ছিল। গাছের তাৎপর্য, শক্তিমাহাত্ম্য উদঘাটন করেছিল ঐ বাল্য ভবেন্দ্র, আজকের ভবা পাগলা।
শৈশব লীলাসঙ্গী পরিবৃত ভবেন্দ্রমোহনের মাতৃপুজায় গাবতলায় প্রথম মাহাত্ম্য প্রকাশ পেল মায়ের প্রসাদ বিতরণে, সেই প্রসাদের আস্বাদনে। বেণী চৌধুরীর পুত্র বিধুভূষণ চৌধুরী, যজ্ঞেশ্বর রায়ের পুত্র গিরিজা রায়, গোপিশ্বর সাহার পুত্র সুরেশ সাহা, নিতাই বণিক্যের পুত্র রমণী বণিক্য, নিকুঞ্জ সাহার পুত্র সতীশ সাহা প্রমুখ বালকবৃন্দ ছিলেন, এই একই পাড়ার ছেলে। ওরা ভবেন্দ্রমোহনের সমবয়সী পরস্পর দু’তিন বছরের ছোট-বড় এবং ক্রীড়াসঙ্গী। এই সঙ্গীদের নিয়েই ভবেন্দ্র গাব তলায় রত হলেন ভবানীর পুজায়। সাথীরা নিজ হাতে মাটি দিয়ে সন্দেশ বানিয়ে নৈবেদ্য সাজালেন। পুজায় বসলেন ভবেন্দ্র। পুজা অন্তে প্রসাদ বিতরণ শুরু হল জিহ্বাগ্রে- ঐ প্রসাদ ঠেকিয়েই ভবা পাগলার বন্ধুগন পরস্পর বিস্ফোরিত চোখে অতিশয় বিস্ময়সুচক ধ্বনি করে উঠলেন- এ কি রে! এ যে মিষ্টি! এ যে ছানার মতন! ওরে আয়, কে দেখবি আয়, কে খাবি আয়! মাটির সন্দেশ ছানার সন্দেশ হয়ে গেছে!
বালকদের চিৎকারে বড়দেরও আকৃষ্ট করলো। তারাও কৌতুহল বশত; ঐ প্রসাদ মুখে দিয়ে চুড়ান্ত বিস্ময় প্রকাশ করলেন। এ যে অপূর্ব! এ সে অমৃত! এ কেমন মাটির সন্দেশ! ভবেন্দ্র তাদের সংশোধন করে দিলেন এগুলো মাটির সন্দেশ নয় ‘মা’টির সন্দেশ বল। এ তাজ্জবের ব্যাপার নয় আরও আছে দরকার শুধু ‘একের’ সাথে ‘এক’ যোগে সব কিছু হয়। দেখনা এক এর যোগে সত্যিকারের যোগ। ভবেন বলেন, বালী ও কালী হয়। ‘ব’ এর সাথে ১ যোগ করে দেখেন বালী-কালী হয়ে গেছে (উদাহরণ স্বরূপ- ব+১ = ক)। আরও বলেন-
১-এ ১-এ ‘এক’ হলেই সব ঠিক। দুই হলেই পৃথক, দুই হলেই দূরত্ব। তাই একের সাধনাই সাধনা। ঐ ঘটনার স্মারক বাণী স্বয়ং ভবা পাগলার-
“গাবের তলায় কত খেলায় দিন হ’ত তার গত,
নিশা কালে, দিশা হারায়- শ্যামা পুজায় রত।
ছেলে বেলায় মাটির সন্দেশ ‘মা’ টিকে সে দিত,
ছানার ভাবে ভাবময়ী করিত ছানায় পরিণত।”
পাঁচ-ছয় বৎসর বয়সকালে ভবেন্দ্রমোহন আর একটি অতিশয় আশ্চার্য্যজনক কাজ করে মানুষকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিলেন। ভবা পাগলা মা কালীর উদ্দেশ্যে একটি গান মুখে মুখে রচনা করে এবং নিজেই তাতে সুরারোপ করে আপন মনে গাইতে লাগলেন-
এসো মা কালী শুন মা বলি, আমার প্রাণের বেদনা,
লাগেনা ভাল, কি যে করি, তুমি আমায় বল না।
ভাবিয়া, ভাবিয়া হতেছি সারা,
এসো, এসো, এসো মা তারা।
তুমি বিনে আর কেউ নাই আমার,
দগ্ধ হৃদয়ে দিতে সান্তনা।
শেষের দিন ভবার এলো কাছে,
আর কেন মা রইলে পিছে।
এসো এসো মা, জলন্ত প্রতিমা,
আর দূরে (তুমি) থেকো না থেকো না।
এই গানটি দিয়েই শুরু হলো ভবেন্দ্র বা আজকের ভবা পাগলার মাতৃনাম গানের অঞ্জলি। অজ¯্র অঞ্জলি সূত্রপাত হল শ্যামা সঙ্গীত মন্ত্র সাধক রামপ্রসাদেরও। ভবা পাগলার মাতৃনাম সুধা বিতরনের অজ¯্র প্রবাহ। বুঝি একক মনুষ্যসৃষ্ট সাধনা সঙ্গীতের ইতিহাসে সর্বাধিক ভক্তিগীতি রচনার শুভারম্ভ।
ভবা পাগলার এক ভক্তের চাকুরী চলে গেছে তার খেদের কথা শুনে তার চাকুরী বিচ্যুতির ফলে সংসারে অভাব অভিযোগের ভাবনা দেখে। ভবা পাগলা সেদিন গানের মাধ্যমে সকল ভক্তজনকেই শোনালেন মাতৃপদে চাকুরীর কথা মাতৃপদে চাকুরীর তাৎপর্যের কথা। তিনি গানটি রচনা করেন এবং যথারিতি সঙ্গে সঙ্গে সুরারোপ করে সে’টি শোনাতে লাগলেন-
মন মাতৃপদে চাকুরী কর, চাকুরী যাবে না,
স্বভাব পাবে, অভাব যাবে, হবে তুমি খাটি সোনা।
(চাই) ভক্তি, বিশ্বাস, সরলতা,
পাবে রে মন,, একটি খাতা।
লিখবে তাতে, ঐ বিধাতা,
অমর হবে, মরণ হবে না।
কেবল দেহখানি উলট-পালট, বেদ বেদান্তে এই ঘোষনা।
অভাবে স্বভাব নষ্ট
(এ) ব্যাধির জ্বালা, বড়ই কষ্ট,
বড়ই সুন্দর এই কারখানা।
(কত) মুনি, ঋষি, চাকুরী করে (পায়) মনের মত মাহিনা।
মানুষ হবে, নামটি রবে,
এ কালির দাগ সত্য হবে,
(কোন কালেও) মুছে যাবে না।
শমন রাজা হেরে যাবে, (আর) শমনজারী করবে না।
ভবা পাগলা, ভুলের বশে।
কি যেন কি, কপাল দোষে।
ঘরের কোণে, রইলো বসে।
(সদাকরে) ছয় রিপুতে টানাটানি হারিয়ে গেল ষোলআনা।
মাতৃপদে চাকুরী করতে ভবা পাগলার আহ্বান অকুণ্ঠ।
ভবা পাগলার গান ভারত উপমহাদেশের সঙ্গীত ভান্ডারে এক অমূল্য সম্পদ। অতি বিশ্ময়কর এবং মনোহর ছিল তাল ছন্দ ও লয়, লোক কবি, বাণীকণ্ঠ, সুরকার, যন্ত্রবিশারদ, এক অদ্ভুদ পদকর্তা এবং সর্বপরি সাধক ছিলেন তিনি। গানই ছিল তার সাধনার মাধ্যম। “গানই সর্বশ্রেষ্ঠ সাধনা, গান সাধনা করতে লাগেনা ফুল চন্দন, লাগেনা তন্ত্র মন্ত্র ”। গানের মাধ্যমেই ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়ার পথ দেখিয়েছেন। ভবা পাগলার গান শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয় বরং লোকশিক্ষারও একটা বড় মাপের মাধ্যমও। তিনি ছিলেন মাতৃসাধক । এই মহাবিশ্বের ¯্রষ্টা, লালনকর্তা, পালনকর্তা, যিনি অনাদি-অনন্ত সেই পরম করুনাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকেই মাতৃজ্ঞানে ভজন করে খ্যাতি লাভ করেছেন। “মাতৃসাধক পরমগুরু ভবা পাগলা” যার জাতের নেই কোন ভেদাভেদ-
ভিন্ন নয়রে আল্লাহ হরি,
শোনরে ফকির ব্রহ্মচারি।
দেখতে তারে হয় না দেরি,
খুলে দে তোর হৃদয় প্রাণ।
জগতের সকল ধর্মের অনুসারীদের হিংসা বিদ্বেষ ত্যাগ করে স্ব-স্ব ধর্মে নিষ্টাবান থেকে ¯্রষ্টার আরাধনা করতে করজোরে প্রার্থনা করেছেন সর্বপরি কল্যাণের জন্য। বাণী-
১। ‘অজানার সঙ্গে, মিলন করিতে ২। ‘কর্মই ধর্ম, শত ব্যস্ততায় ও যেন,
পৃথিবীতে আনাগোনা। মাগো, তোমারই ঐ দু’টি পায়
দু’দিনের তরে আপন করিয়া, মনটি আমার পড়িয়া থাকে।
ভেঙ্গে ফেলে কত খেলনা। ৪। কত সোনার মানুষ দেশে দেশে,
ঘুরে গেল পাগল বেশে।
৩। প্রিয়জনে অপ্রিয় কথা কইওনা, চিনে তারে অবশেষে,
অপ্রিয়কেও ভাল ছাড়া মন্দ বল না। দেশ ছেড়ে যেদিন পালায়।
ঢাকা জেলার অন্তর্গত ধামরাই থানার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বংশী নদীর তীর ঘেষে গর্বিত আমতা গ্রাম। এই গ্রামে পরম গুরু সাধক ভবা পাগলা ১৩০৭ বাংলা ১৯০২ ইংরেজী সালে জন্মগ্রহণ করেন। আশ্বিন মাস, শরৎ কাল, কোজাগরী পূর্ণিমা, শারদিয়া উৎসবে সারা বাংলা বিভোর। শিউলির গন্ধে আকাশ বাতাস আমোদিত। আকাশে পূর্ণচন্দ্র, চারদিকে ঢাক-ঢোলের বাজনায় মুখরিত। ঠিক এমনি দিনে ভবা পাগলার আবির্ভাব।
প্রতিটি মানুষের অন্তর্নিহিত পরমাত্মার বিকাশ সাধনের জন্যেই ধর্ম। ধর্মই মানুষকে মহাগুনে গুনাম্বিত করে। জীবনকে গৌরবে ও ঐশ্বর্যময়ে রূপান্তরিত করে। সাধক ভবা পাগলা এই মহিমাম্বিত ও গৌরবাম্বিত মানবতা তত্বের সাধক। ভক্ত মাঝে ভবা পাগলা নিজেই তার পরিচয় দিয়েছেনÑ
“পূর্ব বঙ্গের ঢাকার গর্ভে গর্বিত গ্রাম আমতা,
সেই গ্রামে জন্ম মোর পিতা গজেন্দ্র-গয়া মাতা।
বাঁচন মরণ এই দুই কূল সমাজ অমর ধাম,
সেই সমাজের অধিকারী মুই ভবা পাগলা নাম।
স্বজাতির মায়া ত্যাগ করে জন্মভূমি ছেড়ে ভবা পাগলা ভারত যাত্রা করেন বাংলা ১৩৫৪ সনে, তখনো তার বয়স পঞ্চাশ পেরোয়নি। দুঃখজনক সত্য হলেও ভবা পাগলার জীবদ্দশায় তার জন্মস্থান আমতায় আর ফিরে আসেননি। তিনি ছিলেন কালী সাধক, মা কালীকে সামনে বসিয়ে তার হুবহু মুর্তি বানিয়ে সে মুর্তিকে পূজা দিতেন ভবা পাগলা। ৩২টি কালীর নাম জানতেন তিনি। যেমন- ক্ষেপা কালী, যজ্ঞা কালী, ক্ষয় কালী, জয় কালী আরও অনেক। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো সাধক ভবা পাগলার এক লক্ষ পয়ষট্টি হাজার মুরিদ ছিল। তার মধ্যে সব ধর্মের মিলিয়ে বাংলাদেশে তার মুরিদের সংখ্যা সর্বসাকুল্যে বার হাজারের মতো। ভবা পাগলার লিখিত গানের সংখ্যা পনের হাজার পাঁচশত এর মতো। এবং কি ভবা পাগলার নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত ভারতে মন্দিরের সংখ্যা বাষট্টিটি। তার তিন সন্তান, দুই ছেলে এক মেয়ে। ছেলেদের নাম- সনৎ চৌধুরী ও সংকল্প চৌধুরী, মেয়ের নাম প্রতিমা চৌধুরী বা পুতুল। সাধক ভবা পাগলা মা কালীর সাথে সামনাসামনি বসে কথা বলতেন। মা আর সন্তান যেমন কথা বলে। বাংলাদেশে থাকা কালীন স্বজাতির কুচক্রীমহল তার নামে অনেক কুৎসা রটায় এবং মিথ্যা অপবাদ দেয়। এই রকম একটি মিথ্যা ঘটনাকে কেন্দ্র করে এলাকার কিছু দুষ্ট লোক থানায় মামলা করলে তৎকালীন সাভার থানার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সরোজমিন তদন্তে এসে ভবা পাগলার ঈশ্বরিক ক্ষমতার প্রমাণ পেয়ে মিথ্যা মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দিয়ে তারা ফিরে যান। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কালনায় ‘ভবার ভবানী মন্দির’ নামক বাড়িতে তিনি আমৃত্যু বসবাস করেন। এবং ঐ মন্দিরে থেকে তিনি ভক্তজনদের ঈশ্বর প্রেমের দীক্ষা দিতেন। ১৯৮৪ ইং বাংলা ১৩৯০ সনের ১২ইং ফাল্গুন রবিবারে কলকাতার আর্জু হাসপাতালে অগনিত ভক্তকুলকে কাঁদিয়ে আধ্যাত্মিক গানের অমর শ্রষ্টা সাধক পুরুষ ভবা পাগলা দেহ ত্যাগ করেন।
(১) আমতা ভবা পাগলার আশ্রমের সেবায়েত =
তরুনী সাধু
(২) ভবা পাগলার একমাত্র মুসলমান মুরিদ =
আমতা নিবাসী জনাব আলী হোসেন।
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments