সাজজাদ হোসাইন খানের ছড়া ইতিহাস ও লোকচেতনা_ড. আশরাফ পিন্টু

 
১৯৪০ সাল পর্যন্ত ছড়া ছিল শিশু-কিশোরদের বিষয়। এর পরবর্তী সময়ে ছড়া শুধু শিশু-কিশোরদের বিষয় হিসাবে থাকেনি; সমকালীন চিন্তা-ভাবনা এসে গেড়ে বসেছে ছড়ার বিষয়ে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা প্রভৃতি সমসাময়িক বিষয় অন্য সবকিছুর মতো ছড়াকারদেরও গভীরভাবে নাড়া দেয়। আধুনিক ছড়ার উৎকর্ষ সাধনে অন্নদাশংকর রায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তার ছড়াতেই সর্ব প্রথম রাজনৈতিক বাণী ধ্বনিত হয়। এরপর থেকে আধুনিক কালের ছড়াকাররা অবলীলায় শামিল হন অন্নদা শংকরীয় ধারায়, ছড়ার ভাষা হয়ে ওঠে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক মুক্তির হাতিয়ার। ১৯৩৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ছড়া নিপুণভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে সাম্প্রদায়িক অমানবিক রাজনৈতিক প্রবণতা বিকাশের পটভূমিতে।
সাজজাদ হোসাইন খান (১৯৪৮-) একজন আধুনিক সমাজসচেতন ছড়াকার। যার ছড়ার মধ্যে ধরা পরেছে সমাজ, রাজনীতি, লোক-ঐতিহ্য, ইতিহাস চেতনা ধর্মীয় মূল্যবোধ। ছড়ার আঙ্গিকগত পরিবর্তন আধুনিক কলাকৌশলের  নৈপুণ্যে তার ছড়া হয়ে উঠেছে অতি ক্ষুরধার হৃদয়স্পর্শী। ভিন্নতর চিন্ত-চেতনা আর আপোসহীনতার মানস নিয়ে তিনি ছড়াসাহিত্যে নির্মাণ করেছেন এক স্বতন্ত্র ভুবন। ইতোপূর্বে অনেক প্রাজ্ঞজন তার ছড়ার বিভিন্ন দিক নিয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আলোচনা করেছেন। এখন আমি তার ছড়ার অনালোচিত দিক-ইতিহাস লোকচেতনা নিয়ে আলোকপাত করব।
ইংরেজ বেনিয়ারা ব্যবসা করতে এসে ষরযন্ত্র করে নবাব সিরজ-উদ্দৌলার পতন ঘটিয়ে দেশের শাসক বনে যায়। ক্ষমতা দখল করে তারা এদেশের জনগণের উপর চালায় চরম জুলুম আর নির্যাতন। তারা বাংলার কৃষকদের নীলচাষে বাধ্য করে। ১৮৩১ সালে তিতুমীরের নেতৃত্বে চব্বিশ পরগণা এলাকায় বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। তাঁর ডাকে দরিদ্র নিঃস্ব মানুষ ব্যাপকভাবে সাড়া দেয়। তিনি চব্বিশ পরগণাসহ নদিয়া ফরিদপুর ভূখ- পর্যন্ত মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তিনি বাঁশের কেল্লা  তৈরি করেন। যুদ্ধে তিতুমীর শহিদ হলেও ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন। এই বিখ্যাত ঐতিহাসিক চরিত্রটি ছড়াকার সাজজাদ হোসাইন তাঁর ছড়ায় সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন-
দুর্গ বাঁশের গড়ে
ভীষণ লড়ে লড়ে
বীর সে তিতুমীর
গোলাপ হয়ে ঝরে।
(তিতুমির: নীল সবুজের হাট)
শুধু তিতুমীর নয়, বৃটিশদের হাত থেকে এদেশের স্বাধীনতার জন্যে আরো অনেক বীর প্রাণ দিয়েছেন, শহিদ হয়েছেন।
লক্ষণসেনের বিলাসিতা, ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি কর্তৃক এদেশের মুসলমানদের খেলাফত প্রতিষ্ঠা এবং ঈশা খাঁর শৌর্য-বীর্যের ঐতিহাসিক চিত্র ফুটে উঠেছে তাঁরবিজয় হাসেছড়াটিতে-
ছিড়ত যখন খুশির রেণু
সেনের বেটা সর্বনেশে
আসল তখন সতেরো ঘোড়া
টগবগিয়ে ভাটির দেশে।
তিতুমীরের বাঁশের যাদু
ঈশা খানের কামান ফোটে
এমনি করেই পাথর ভেঙে
স্বাধীনতার সূর্য ওঠে।
(জগৎশেঠ মিরজাফর: স্বৈরাচারের ঐরাবত)
এই ধারাবাহিকতায় এবং অনেক রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতার সূর্যটাকে হাতে পেয়েছি। কিন্তু এত বছর পরেও দেখি-
জগৎশেঠের ভাই-ভাতিজা
মিরজাফরের নাতি
বানের মতো ভাটির দেশে
বাড়ছে রাতারাতি।
ডাইনে  ঘুরে শেঠের পোলা
হাঁটছে বাঁয়ে মির
শহর-নগর গাঁও-গেরামে
কোন ভূতের ভিড়।
তাই কবি এদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন; সকলের প্রতি আহ্বান করেছেন-
বাবর তিতুর সন্তানেরা তুর্কি ঘোড়া হাঁকাও
হৃদয় ভরা আকাশ নিয়ে
সামনে শুধু তাকাও
বুদ্ধিটারে বাঁকাও
(সামনে তাকাও: ভাঙা চাঁদের রাঙা পাথর)
মিরজাফর, বিভীষণ আর জগৎশেঠরা এদেশে হানাহানি আর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। স্বাধীনতার এত বছর পরে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, নাকি পিছিয়ে যাচ্ছে? তা বোঝা যাবে পার্শ্ববর্তী দুটি দেশ ভারত পাকিস্তানের উন্নয়নের সঙ্গে তুলনা করলে। সাজজাদ খানেরফুর্তিছড়াটি পাঠ করলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবার প্রকৃত চিত্রটি যেন পাওয়া যায়-
দিল্লী লাহোরে এটম বানায়
ঢাকা বানায় মূর্তি
বুদ্ধিজীবীর বদ্ধঘরে
কী আনন্দ ফূর্তি!
ঘোরি ঘোড়ার শব্দ শুনে
কাঁপছে যখনপৃথ্বি
এমন দিনে বাঙালেরা
ধর্ষণে পায় বৃত্তি।
১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসকদের হাত থেকে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়- ভারত পাকিস্তান। তখন বাঙালি মুসলমানেরা এতে সন্তুষ্ট হলেও বাঙালি হিন্দুরা এতে সন্তুষ্টি লাভ করতে পারেননি। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময়ও এমনটি হয়েছিল; দুই বাংলার (পূর্ব পশ্চিমবঙ্গ) অখ- রক্ষার্থে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখলেনসোনার বাংলাগানটি। যা হোক, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তিকে কেন্দ্র করে ছড়াকার অন্নদা শংকর রায় লিখলেন-
তেলের শিশি ভাঙলো বলে
খুকুর উপর রাগ করো
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
ভারত ভেঙে ভাগ করো।
তার বেলা? তার বেলা?
কিন্তু সজজাদ খান ভাঙাঅর্থাৎ স্বাধীনতাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। অন্নদাশংকরের সাথে তাঁর চিন্তার বৈপরীত্য প্রকাশ পেয়েছে এভাবে-
ভারত দেখো ভাঙবে আরো
ভেঙে ভেঙে ছত্রখান
সেই সুদিনের উড়বে হাওয়ায়
শান্তি-সুখের পত্রখান।
(ভাঙাশিশি: )
বাংলা রাঢ়ছড়াটিতেও সেই একই চেতনা প্রকাশিত হয়েছে-
এটা নয় ওটা নয়
দুটা নয় বঙ্গ
এই পাড় ঐপাড়
করো যত রঙ্গ।...
পাড়ে রাঢ় ভূমি
এই পাড়ে বঙ্গ
ভিন ভিন রঙ রসে
মাখা দুই অঙ্গ।
ইতিহাস যেমন আমাদের ঐতিহ্যগত গর্বের সম্পদ তেমনি লোক-ঐতিহ্যও আমাদের অহংকার। সাজজাদ খানেরভাড়শিরোনামের ছড়াটিতে দুটি ঐতিহ্য এক সূত্রে গ্রোথিত হয়েছে-
পয়লা হজুর দোপেঁয়াজা
দুসরা গোপাল ভাড়
তেসরা হজুর আলাই বালাই
বাহ! কী চমৎকার!
মোগল রাজা গোজার গিয়া
চাঁদরাজাও ভূত
কিন্তু তবু ভাড়ের পাল
খেলেরে কুত কুত।
লোকছড়ার শরীর থেকেই আধুনিক ছড়ার ক্রম উন্নতি হয়েছে। কোনো আধুনিক ছড়াকারই লোকছড়ার প্রভাবকে অস্বীকার করতে পারেননি। ফলে লোকছড়ার অনেক উপাদান এবং এর শব্দ সুর আর ছন্দ নিয়েই গড়ে উঠেছে আধুনিক ছড়া। সাজজাদ খানের এরূপ কয়েকটি ছড়া নিচে তুলে ধরা হলো:
.            ধান ফুরালো, পান ফুরালো
                আর ফুরালো কি?
                খুচরো পয়সা কেউ পাবে না
                পোটলা বেঁধেছি।
                (নোটিশ: রাজার কথা প্রজার কথা)
.            এননা পাতা ভেননাপাতা ভাউয়া ব্যাঙের পাও
                অচম্বিতে আইলো তুফান ডুবলো সাধের নাও।
                (উজাড় রাজার ছড়া-: )
.           ইতল বিতল চিতল সোনা গগন কালা কালা
                বাংলাদেশের মানুষগুলো আর সবে না জ্বালা।
                (উজাড় রাজা ছড়া-: )
.            ইষ্টিকুটুম মিষ্টিকুটুম হলদে পাখির ছাও
                ঢেউয়ে ঢেউয়ে দুধসাদা হাঁস ময়ূরপঙ্খীর নাও।
                (ইষ্টিকুটুম: নীল সবুজের হাট)
 লোকছড়ার পাশাপাশি তাঁর কিছু ছড়ার লোককথা রূপকথা বাগধারা প্রবাদ-প্রবচন প্রভৃতি লোকজ উপাদান লক্ষ্য করা যায়। রূপকথার আদলে নিচের ছড়াটিতে ফুটে উঠেছে সমকালীন চিত্র-
সুতানতি পার হয়ে
হস্তিনাপুর
চলে যান বিবিজান
বাজিয়ে নূপুর।
(বিবি ঘষেটি)
তাঁর কিছু ছড়ায় বাগধারা প্রবাদেরও ব্যবহার লক্ষণীয়। কিছু ছড়ার শিরোনামও হয়েছে বাগধারা দিয়ে; যেমন- কাঁচকলা, আকল দাঁত (আক্কেল দাঁত), ঘোড়াদের আণ্ডা (ঘোড়ার ডিম) ইত্যাদি।
ইজ্জতকা সওয়ালছড়াটিতে পাওয়া যায়পান থেকে চুন খসাপ্রবাদের ব্যবহার যেখানে রাজনৈতিক চেতনা লক্ষ্য করা যায়-
পান থেকে চুন খসলেযদি মান চলে যায় দিল্লীতে
ঠুনকো এমন মানের মাথা চিবায় তখন বিল্লীতে।
পরিশেষে বলা যায়, সাজজাদ হোসাইন খানের অধিকাংশ ছড়াই সমাজ চেতনায় সমৃদ্ধ। তার এসব সমাজচেতনা সমৃদ্ধ ছড়ায় ঐতিহ্যগতভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ইতিহাস লোকচেতনা। বলা চলে তার কবিমানসে সতত ক্রিয়াশীল ঐতিহ্যগত চেতনা। তার ছড়া পড়ে অভিনব আঙ্গিক কাঠামো ছন্দিত জংকারের জন্যে এক দিকে যেমন আমরা আনন্দ পাই, অপর দিকে আনন্দের ভিতর দিয়ে আমাদের স্বর্ণালি ঐতিহ্যকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। তাই সাজজাদ খানের ভাষায়ই আশাবাদ ব্যক্ত করছি তার
ছড়া হোক’-
ছড়া হোক যুদ্ধের চকচকে তরবার
দেশটাকে গড়বার
সত্যরে ধরবার
সাহসের সাথে মন দিয়ে লড়বার।
ছড়া হোক যুদ্ধের ক্ষুরধার তরবার
মোগলের দরবার
তাজি ঘোড়া চড়বার
শহিদের  হাত ধরে বারে বারে মরবার।

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.