আমার দ্বিতীয়বার ইংল্যান্ড সফর_মুহম্মদ মতিউর রহমান : পর্ব-২

 
১১ জুন, ২০০৯ বৃহস্পতিবার
 
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফযরের নামাজ পড়ে সামান্য কিছু খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি নানা রকম নাস্তা তৈরি। মওলানা আবু আহমদের সাথে বসে একসাথে নাস্তা করে কিছুক্ষণ নানা রকম গল্প-গুজব করে তার সাথে বেরিয়ে পড়লাম। বাসে করে প্রথমে গেলাম পূর্ব লন্ডনের দিত্বীয় বৃহত্তম মসজিদ দারুলউম্মাহ-তে। মওলানা আবু আহমদ সেখানকার প্রধান ইমাম। মসজিদের Complex টি বিশাল। এটা আগে ছিল Greenwich University- এর Science faculty building.  খুব মজবুতভাবে তৈরি করা চারতলা বিল্ডিং। মূল বিল্ডিংটিতে এখন দারুলউম্মাহ স্কুল করা হয়েছে। এটি এখন লন্ডনের অন্যতম বৃহৎ ও নামকরা স্কুল। এখানকার অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত। তবে অন্যান্য দেশের এমনকি, বৃটিশ ছেলেমেয়েরাও অনেকে এখানে পড়াশোনা করে। স্কুলের প্রায় সব শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীই বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত। তবে দু’একজন ভিন দেশী  শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীও আছেন। স্কুল তথা সম্পূর্ণ কমপ্লেক্সটি দাওয়াতুল ইসলামের পরিচালনাধীন। দাওয়াতুল ইসলাম মূলত লন্ডনে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতদের একটি শক্তিশালী ইসলামী সংগঠন।  বিল্ডিং-এর একপাশের অর্ধাংশে একতলা বিল্ডিং-এ আগে Greenwich University-এর Laboratory ছিল, এখন সেখানেই মসজিদ বানানো হয়েছে।  পরবর্তীতে এ অংশটা ভেঙে বহুতল বিল্ডিং করা হবে এবং তাতে কয়েকতলা বিশিষ্ট মসজিদ হবে বলে আবু আহমদ সাহেব আমাকে জানালেন।
দশ/বার বছর আগে বিল্ডিং সহ পুরা জায়গাটি দাওয়াতুল ইসলাম মাত্র আড়াই লক্ষ পাউন্ডে কিনে নেয়। এখন এটার দাম হবে কমপক্ষে দেড়/দুই কোটি পাউন্ড। জমি ও স্থাপনার দাম পৃথিবীর সর্বত্রই ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। বিশেষত যেসব দেশের আয়তন কম, অথচ জনসংখ্যা বেশি সেখানে জমি-জমার দাম দ্রুত গতিতে বাড়ছে। লন্ডন একটি পুরাতন শহর। এখানে জনবসতিও অতি ঘন এবং ক্রমাগত তা বেড়ে চলেছে। তাই জমি-জমার দামও এখানে আকাশচুম্বি।
দারুল উম্মাহ মসজিদে আছরের নামায আদায় করে  মাওলানা আবু আহমদ আমাকে নিয়ে গেলেন পাশে অবস্থিত Whitney বিপণি কেন্দ্রে। সেখানে প্রায় সব দোকানের মালিকই বাংলাদেশী। বিশাল বিশাল দোকানে হরেক রকম বাংলাদেশী মাছ ও সবজি থরে বিথরে সাজানো রয়েছে। দেখে মন ভরে যায়। ভারত ও পাকিস্তান থেকে আনা বিভিন্ন পণ্যও দোকানে স্থান পেয়েছে। মূলত উপমহাদেশের লোকদের প্রয়োজন, চাহিদা ও রুচি অনুযায়ী সব পণ্যের সমাহার ঘটানো হয়েছে। মাওলানা  আবু আহমদ ঘুরে ঘুরে সব দেখালেন। নিজে কিছু বাজারও করলেন। তারপর আমরা মসজিদে এসে মাগরিবের নামায পড়লাম। নামাজের পর ইমামের হুজরাখানায় গিয়ে বসলাম। সেখানে কয়েকজন বাংলাদেশী এলেন, যারা এ মসজিদের মুসল্লী এবং মাওলানা আবু আহমদের বিশেষ পরিচিত বা ভক্ত। তিনি তাদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরপর আমরা দাওয়াতুল ইসলামের অফিসে গেলাম। প্রতিষ্ঠানের সভাপতি, সহ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে পরিচয় হলো। তাদের সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগলো। রাত এগারটায় এশার নামায পড়ে মাওলানা আবু আহমদের সাথে তার বাসায় ফিরে এলাম।
 
১২ জুন, ২০০৯ জু’মাবার
 
আজ জু’মার দিন। মাওলানা আবু আহমদ জু’মার নামাযে ইমামতী করেন অন্য আর একটি মসজিদে। আমিও তার সাথে সে মসজিদে গেলাম জ’ুমার নামায আদায় করতে। মসজিদ কমিটির একজন সদস্য তার গাড়ি নিয়ে এলেন আমাদের নিতে।
মসজিদটি নতুন। একটি বিল্ডিং-এর দুটি দোকান কিনে সেটাকেই মসজিদ বানানো হয়েছে। প্রায় আড়াইশো মুসল্লি একসাথে নামায পড়লাম। কিন্তু এক জামাতে সব মুসল্লির জায়গা না হওয়ায় দ্বিতীয় জামাত হলো। তাতে কত লোক শামিল ছিল তা দেখার সুযোগ হয়নি। আগে দোকানটিতে মদ বিক্রি হতো, এখন সেখানে আযান হয়, খুৎবা হয়, নামায হয়, কুরআন- হাদীসের চর্চা হয়। পাশে আর একটি দোকান, সেটিও বিক্রি হবে এবং মসজিদ কমিটির লোকেরা পরিকল্পনা করেছে সেটিও কিনে নিয়ে বড় আকারের একটি বহুতল মসজিদ নির্মাণ করবে। কয়েক মিলিয়ন পাউন্ডের প্রজেক্ট। সকলেই খুব আশাবাদী তারা এটা সহজেই পারবে। সারা লন্ডনে এভাবেই সব মসজিদ গড়ে উঠেছে। বর্তমানে লন্ডনে প্রায় দু’শো মসজিদ এবং পুরো ইউ.কে.- তে প্রায় দুই হাজার মসজিদ গড়ে উঠেছে। সৌভাগ্যের বিষয় এ সব মসজিদের অধিকাংশই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতদের হাতে। East London-এ অবস্থিত East London Mosque  এখন সেটা গোটা ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বড় মসজিদ। এটা  বাংলাদেশীয় মুসলমানদের দ্বারা নির্মিত ও তাদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত।
লন্ডনে এক সময় বহুসংখ্যক গীর্জা নির্মিত হয়, যেসব গীর্জার অধিকাংশই এখন তালাবদ্ধ। কারণ খ্রীস্টান ধর্মের প্রতি এখন অনেকেরই  কোন আকর্ষণ নেই। শুধুমাত্র রবিবারে গীর্জা খোলা হয়। সেখানে অল্পসংখ্যক ধর্মপরায়ণ খ্রীস্টান আসেন প্রার্থনা করার জন্য। সপ্তাহের অন্যান্য দিন গীর্জায় কেউ আসে না। তাছাড়া, অনেক গীর্জা রয়েছে, যেগুলো লোকের অভাবে সারা বছরই তালাবদ্ধ থাকে। এ ধরনের অনেক গীর্জা এখন বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। সেগুলো এখন বিভিন্নভাবে কাজে লাগছে। লন্ডনের এ ধরনের অনেক গীর্জা মুসলমানরা কিনে নিয়ে সেগুলোতে মসজিদ ও ইসলামী কেন্দ্র স্থাপন করেছে।
মসজিদে জু’মার খুৎবা দেবার আগে ইমাম আবু আহমদ মসজিদ নির্মাণের জন্য মুসল্লীদের নিকট সাহায্যের আবেদন জানালেন। বহুলোক তাতে সাড়া দিল। এভাবে এখানকার সব মসজিদেই নামাযের সময় সাহায্যের আবেদন জানানো হয়। কখনো সে সাহায্যের টাকা দিয়ে স্থানীয় মসজিদ নির্মাণের কাজ হয় কখনো বাংলাদেশের কোন মসজিদ-মাদ্রাসা-এতিমখানা অথবা দুর্গত এলাকায় সাহায্য পাঠানো হয়। এবার সাইক্লোনে খুলনায় বাগেরহাট এলাকায় এরকম সাহায্যের টাকা দিয়ে লন্ডনের  দাওয়াতুল ইসলাম সেখানে কয়েকশো বাড়ি-ঘর নির্মাণ করে দিয়েছে। এখানে টিভিতেও সাহায্যের আবেদন জানানো হয়। তাতেও বিপুল সংখ্যক লোক সাড়া দেয়। এতে ইসলাম ও মুসলমানদের যে কত উপকার হয় তা ধারণারও বাইরে। কিন্তু এটা বন্ধ করার জন্য এখন নানা ষড়যন্ত্র চলছে। মুসলিম নামধারী বাংলাদেশের জনৈক প্রবীণ বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক, যিনি সর্বদা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে লেখনী পরিচালনা করে থাকেন, তিনি ইদানীং বৃটিশ সরকারের নিকট দাবি জানিয়েছেন এসব সাহায্য দেয়া-নেয়া বন্ধ করার জন্য। কারণ এ সাহায্যের টাকা নাকি বাংলাদেশে তথাকথিত মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের প্রচার-প্রসারের কাজে ব্যয় হয়। এধরনের ধিকৃত ব্যক্তিরা সব সময় ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধির জন্য স্বদেশ ও স্বজাতির পৃষ্ঠে ছুরিকাঘাত করার কাজে লিপ্ত থাকে। তিনিও কি সে ধরনের ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দেয়ার কাজে লিপ্ত রয়েছেন? দেখলাম, লন্ডনে প্রায় সব মুসলমানই তাকে ধিক্কার দিয়ে থাকেন। তার বক্তব্য জনমনে দারুণ ক্ষোভ সৃষ্টি করলেও মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় ও জনহিতকর কার্যক্রম যথারীতি চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা জানেন, গণতন্ত্রের আর্দশে বিশ্বাসী বৃটিশ সরকার ব্যক্তির চেয়ে সবসময় ব্যষ্ঠির মতামতের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাশীল। বৃটিশ সরকার সেদেশের মুসলমানদের কার্যক্রম সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ। সেদেশে বেআইনী বা অবৈধ কোন কাজে কেউ লিপ্ত হলে সে খবর সরকারের নিকট রয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে সরকার যথাযথ ব্যবস্থাও গ্রহণ করে থাকেন। ইংল্যান্ডের কোন ইসলামী সংগঠনের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কোনরূপ বেআইনী বা অবৈধ কাজ করার অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। মূলত ইসলাম মানুষকে শান্তির দিকে আহ্বান জানায়, সুন্দর-সুশৃঙ্খল-আর্দশ জীবনযাপনে সকলকে উদ্ধূদ্ধ করে থাকে। তাই ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানারূপ উদ্দেশ্যমূলক নেতিবাচক প্রচারণা সত্ত্বেও পাশ্চাত্যে ইসলামের প্রচার-প্রসার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জু’মার নামায শেষে যে ভদ্রলোক আমাদেরকে মসজিদে নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনিই আবার আমাদেরকে বাসায় নিয়ে গেলেন। আমরা একসঙ্গে মাওলানা আবু আহমদের বাসায় দুপুরের খানা খেলাম। তারপর তার গাড়িতে করেই আবু আহমদ আমাকে ও আমার স্ত্রীকে নিয়ে গেলেন লন্ডনের বিখ্যাত ভিক্টোরিয়া স্টেশনে। এখান থেকে অসংখ্য বাস ও ট্রেন লন্ডনের ভিতরে ও বাইরে বিভিন্ন রুটে যাতায়াত করে। অবশ্য ট্রেনগুলো প্রাায় সবই মাটির নিচ দিয়ে চলাচল করে। তাই মাটির উপরে যানজট অনেকটা কম। আমরা লন্ডন থেকে চার ঘন্টার পথ শেফিল্ড শহরে যাব আমার আত্মীয় সুমনা ও ড. মনসুর আহসানের বাসায়।
আবু আহমদ আমাদেরকে শেফিল্ডের বাসে তুলে দিয়ে বাসায় ফিরে গেলেন। আমরা বাসে বসে দু’দিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যরাজি দেখতে দেখতে গন্তব্যস্থলের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। গ্রীষ্মের বিকাল। সুন্দর সূর্য-স্নাত মনোরম  সবুজ প্রকৃতির  সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে আমরা যাচ্ছি। প্রকৃতি কত সুন্দর হতে পারে গাঢ় সবুজে আচ্ছাদিত সমগ্র মাঠ প্রান্তর কত মনোমুগ্ধর হতে পারে স্বচক্ষে না দেখলে তা বিশ্বাস করা যায় না। মনোরম সবুজ প্রকৃতির মধ্য দিয়ে আমাদের বাস অগ্রসর হচ্ছে। মাঝে মধ্যে অনুচ্চ পাহাড়। পাহাড়ের গায়েও সবুজ লতা-পাতা-বনানী আচ্ছাদিত। বাইরের দিকে তাকালে চোখ ফেরানো যায়না। ইংল্যান্ডের প্রকৃতি যে কত সুন্দর, তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
আমি ও আমার স্ত্রী উভয়েই খুব ক্লান্ত ছিলাম। মাঝে মাঝে ক্লান্তিতে আমাদের দু’জনের  চোখই জড়িয়ে আসছিল। নির্দিষ্ট সময়ের ৫ মিনিট আগেই আমরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেলাম। ড. মনসুরকে আমাদের আসার খবর আগেই বলা ছিল। আমরা কখন পৌঁছাব, সেটাও তাকে জানিয়েছিলাম। কিন্তু মনসুরের আসতে দেরি হলো। প্রায় চল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করার পর মনসুর ও তার মেয়ে নাজিফা গাড়ি নিয়ে এলো। তারা নাকি রাস্তায় জামে আটকা পড়েছিল। যাইহোক, গাড়িতে উঠে আমরা বাসায় গিয়ে পৌঁছলাম। সুমনা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। বিদেশে এতদিন পর আমাদের সঙ্গে দেখা হওয়াতে সে যারপর নাই খুশি হয়েছে। নানারূপ রান্নাবান্না করে সে এতক্ষণ ব্যস্ত সময় কাটিয়েছে। তাই আমাদেরকে আনার জন্য সে বাস স্টেশনে যেতে পারেনি। সুমনা আমার স্ত্রীর বড় ভাই রফিকুল আলম খানের বড় মেয়ে। সে ঢাকাতে আমার বাসায় থেকেই পড়াশোনা করে অনার্স পাশ করেছে। বিয়ের পরও আমার বাসার পাশেই ছিল তার স্বামীর কেনা ফ্ল্যাট। তার বড় মেয়ে নাজিফা শৈশবে আমার স্ত্রীর কোলে-পিঠেই মানুষ হয়েছে। তাই  ওদের সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠতা অনেক বেশি।
বাসায় পৌঁছে হাত-মুখ ধুয়ে, ওযু করে খেয়ে-দেয়ে নামায পড়ে কিছুটা গল্প-গুজব করে শোয়ার প্রস্তুতি নিলাম। শরীর খুব ক্লান্ত ছিল তাই শুয়ে পড়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়লাম।
 
১৩ জুন, ২০০৯ শনিবার
 
সকালে নাস্তা করে আমরা শহর দেখতে বের হলাম। ড. মনসুর আহসান তার গাড়ি চালাচ্ছে আমি তার পাশে বসে আছি। পেছনে আমার স্ত্রী, সুমনা ও তার দুই ছেলেমেয়ে। শেফিল্ড শহরকে খুব সুন্দর মনে হল। এটা মূলত শিল্প নগরী হিসাবে পরিচিত হলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পরিমন্ডিত এ শহরকে আমার কাছে অত্যন্ত আর্কষণীয় মনে হলো।
শেফিল্ড শহর সাতটি পাহাড়ের উপর গড়ে উঠেছে। পাহাড়গুলো এক হাজার থেকে দুই হাজার ফুট উঁচু। পাহাড়ের গা ঘেঁষে সর্বত্র বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট, রাস্তা-ঘাট নির্মিত হয়েছে। মাঝে মাঝে ঘন সবুজ বাগান। চারদিকে সবুজের বিচিত্র সমারোহ। গ্রীষ্মকালে প্রকৃতি প্রাণ-প্রাচুর্যে পূর্ণ হয়ে জীবন্ত রূপ পরিগ্রহ করে। নানা রঙের অসংখ্য ফুল ফুটে আছে। সুন্দর পরিচ্ছন্ন শহর। মাঝে মাঝে উঁচু-নিচু রাস্তা। গাড়ি ছাড়া এখানে চলা কষ্টকর। পাহাড়ের উঁচু-নিচু পথে চলা অতিশয় ক্লান্তিকর। তাই পায়ে হাঁটা  লোক বড় একটা চোখে পড়ল না। অবশ্য যারা নিয়মিত ব্যায়াম বা হাঁটাহাঁটি করে তাদের কথা আলাদা।
একবার পাহাড়ের উপরে ওঠা আরেকবার পাহাড়ের সমতলে নামা, সুন্দর মসৃন পথ পাড়ি দিয়ে আমরা প্রথমে গেলাম বাংলাবাজার এলাকায়। ‘বাংলাবাজার’ নাম শুনে আমি হতচকিত হলাম। ইংল্যান্ডেও বাংলাবাজার! সুখের বিষয় যুক্তরাজ্যের প্রায় সর্বত্রই বাংলাদেশীদের বসবাস। কোথাও সংখ্যায় বেশি, কোথাও কম। কিন্তু যেখানেই বাংলাদেশীরা বসবাস করে, সেখানে তারা নিজেদের একটি আলাদা স্বতন্ত্র পরিচিতি গড়ে তোলার প্রয়াস পায়। ঐক্যবদ্ধভাবে তারা সামাজিক জীবন গড়ে  তোলে। স্বকীয় ধর্ম, ঐতিহ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য তারা সর্বত্রই নিজেদের শিক্ষালয়, মসজিদ, কোরআন শিক্ষার কেন্দ্র, ব্যবসা কেন্দ্র ইত্যাদি গড়ে তুলেছে। বিদেশে তারা বাংলাদেশের পরিচিতিকে সর্বসমক্ষে উজ্জ্বল করে তুলে ধরার প্রয়াসে লিপ্ত। এটা তাদের স্বাজাত্যবোধের গৌরবময় প্রকাশ।
শেফিল্ড শহরের বাংলাবাজারে পৌঁছে দেখলাম, সেখানে বাংলাদেশীদের সারি সারি দোকান-পাট, মাঝে মাঝে মসজিদ। প্রায় আধা মাইলের মধ্যেই তিনটি মসজিদ দেখা গেল। এক সিলেটী ভাইয়ের দোকানে ঢুকে আমরা টুকিটাকি বাজার করলাম। দোকানটি বাংলাদেশী পণ্যে ঠাসা। বিভিন্ন ধরনের মাছ, তরিতরকারি ইত্যাদি। ভারত ও পাকিস্তানের কিছু পণ্যদ্রব্যও চোখে পড়ল। সেখানে সব দোকানের একই অবস্থা। শেফিল্ডে বসবাসকারী বাংলাদেশীরা এখানকার বাংলাবাজারে এসে মনের আনন্দে বিভিন্ন বাংলাদেশী পণ্য ক্রয় করে থাকে। অন্যরাও আসে, তবে তাদের সংখ্যা বেশি নয়। দোকান থেকে বের হয়ে আবার আমাদের যাত্রা শুরু হল।
 শেফিল্ড শহরের কেন্দ্রস্থলে বিশাল এলাকা জুড়ে শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি অবস্থিত। এটি বেশ নামকরা ইংল্যাণ্ডে। মানের দিক থেকে চতুর্থ। ইউনিভার্সিটিতে মেডিসিন ফ্যাকাল্টি আছে এবং তার সাথে বিশাল হাসপাতাল। হাসাপাতালের গেটে দেখলাম, বিভিন্ন ভাষায় সাইনবোর্ড লেখা। সেখানে বাংলাতেও একটি সাইনবোর্ড লেখা দেখে আমি যুগপৎ আনন্দ-বিস্ময় অনুভব করলাম। ড. মনসুরকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করায়, সে বলল- এ শহরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশী বসবাস করে। তাই তাদের বোঝার সুবিধার জন্যই বাংলাতে সাইনবোর্ড টানানো হয়েছে। শুনে খুশী হলাম। যে মাতৃভাষার জন্য আমরা দীর্ঘকাল সংগ্রাম করেছি, যে ভষার মর্যাদা রক্ষায় আমাদের তরুণেরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে, সে ভাষা আজ আন্তর্জাতিক বিশ্বেও কোন না কোনভাবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। এটা জাতি হিসাবে আমাদের জন্য অত্যন্ত মর্যদার ও আনন্দের।
ইউনিভার্সিটি এলাকা পার হয়ে আমরা গেলাম এখানকার একটি মিউজিয়াম দেখতে। বিশাল পার্কের মধ্যে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে মিউজিয়ামটি নির্মিত হয়েছে। পার্কে প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ানোর ব্যবস্থা, বিনোদন এবং নানারূপ শরীর-চর্চার ব্যবস্থা রয়েছে। পার্কের একপাশে মিউজিয়াম। সেখানে শেফিল্ডের ইতিহাস, মানব-সভ্যতার ক্রমবিকাশ এবং সেখানকার মানুষের জীবনের বিচিত্র কর্মকান্ডের পরিচয় নানাভাবে তুলে ধরা হয়েছে। মানব-কৃতির নানা নির্দশন নিয়ে গড়ে উঠেছে এ  চমৎকার মিউজিয়ামটি। মূলত যেকোন মিউজিয়ামই ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রাণবন্ত নির্দশন। এ মিউজিয়ামটি এর ব্যতিক্রম নয়।
শেফিল্ড মূলত একটি শিল্প-নগরী। বিভিন্ন ধরনের শিল্প গড়ে উঠেছে এখানে। বিশেষত ইস্পাত শিল্পের জন্য এর খ্যাতি দুনিয়া জোড়া। এখানে লোহার খনি আছে । খনি থেকে লোহা উত্তোলন, বিভিন্নভাবে তা শিল্পজাত করা এবং বিভিন্নভাবে তা কল-কব্জা, মিশিনারীতে পরিণত করা ইত্যাদি সব কাজ এখানেই সম্পন্ন হয়। মানব-সভ্যতার বিকাশ ও উন্নয়নে লোহা এক অভি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। পৃথিবীতে মানুষ যখন লোহার ব্যবহার শিখেছে, তখন থেকেই আধুনিক সভ্যতার বিকাশ। আল-কোরআন থেকে জানা যায়, হযরত দাউদ (আ) লোহার ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তিনি লোহা দিয়ে বিভিন্ন সামগ্রী নির্মাণ করতে পারতেন। তাঁর সমকালে অনেকেই তাঁর কাছ থেকে এ প্রযুক্তি আয়ত্ত করেছিল। সে সময় থেকেই আধুনিক সভ্যতার সূত্রপাত। মধ্যযুগে ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের অনেক আগে থেকেই মানব সভ্যতার বিকাশ শুরু হয়েছিল।
প্রাচীনকালে শেফিল্ডের বিভিন্ন পাহাড়ে গড়ে ওঠে  ছোট ছোট বসতি। প্রথম দিকে যাতায়াতের সুবিধা না থাকায় প্রত্যেকটি জনবসতিই বিচ্ছিন্ন বা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে গড়ে ওঠে। প্রত্যেক জনবসতির ভাষা, আচার-আচরণ, তাহজিব-তমুজ্জন সবই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। ধীরে ধীরে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডের ফলে এসব বিচ্ছিন্ন জনপদ পরস্পর কাছাকাছি আসার সুযোগ পায়। পরস্পর ভাবের আদান-প্রদান, অর্থনৈতিক লেনদেন, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের সৃষ্টি হয়। ফলে তাদের জীবনধারা ও সংস্কৃতিও  ধীরে ধীরে সমন্বিত হয়ে আধুনিক নগর-কেন্দ্রিক সভ্যতার সাথে অনেকটা সমন্বিত বা একাকার হয়ে গেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রত্যেকটি জনপদের এক একটি  Distinct character বা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের পরিচয় এখনও কিছুটা হলেও বিদ্যমান রয়েছে। মিউজিয়ামে এসব বিষয়ে চমৎকারভাবে তুলে ধরার প্রয়াস লক্ষ্য করা গেল।
মিউজিয়াম ঘুরে ঘুরে দেখে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। ওখান থেকে আমরা তাই বাসায় ফিরে এলাম। খাওয়া-দাওয়া ও নামায পড়ে বিকালে আবার বেড়াতে বের হলাম। শহরের নানা দৃশ্য দেখতে দেখতে এক পার্কে এসে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম। বিভিন্ন  দেশ, জাতি বর্ণ-গোত্রের মানুষ এসে সেখানে ভীড় করেছে। আরব মহিলাদেরও একটি গ্র“প পার্কের একপাশে বসে গল্প-গুজব ও খাওয়া-দাওয়ায় মেতে আছে। পাহাড়ের উপর পার্ক আর নিচে বিস্তৃত সমতল ভূমিতে অসংখ্য বাড়ি-ঘর নির্মিত হয়েছে। যতদূর দৃষ্টি যায়, সর্বত্র একই দৃশ্য চোখে পড়ে। পৃথিবীর সর্বত্রই প্রকৃতি সাধারণত সুন্দর। কিন্তু প্রকৃতি যখন বৈচিত্র্যময় হয়, তখন তার রূপ-সৌন্দর্য আরো অপরূপ হয়ে ওঠে।
পার্ক থেকে আমরা গেলাম এখানকার একটি বিখ্যাত হালাল খাবারের দোকানে। সেখান থেকে মনসুর বড় সাইজের দুটো পিৎজা নিয়ে এলো। গরম পিৎজা আমরা সবাই মিলে খুব মজা করে খেলাম। তারপর গেলাম এখানকার পাকিস্তানী এলাকায়। শেফিল্ড শহরের একটি এলাকা যেমন বাংলাদেশীদের নামে বিশেষভাবে পরিচিত, তেমনি  পাকিস্তানী ও ইন্ডিয়ানদের নামেও দু’টি এলাকা বিশেষভাবে পরিচিত। শেফিল্ডে তথা গোটা যুক্তরাজ্যে ভারতীয় ও পাকিস্তানীদের উপস্থিতি বাংলাদেশীদের তুলনায় অনেক বেশি। তাই তাদের এলাকাও তাদের নিজিস্ব বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। পাকিস্তানী এলাকায় পাকিস্তানীদের দোকান-পাট, স্কুল, মসজিদ ইত্যাদি দেখলাম। এরপর ঘুরতে ঘুরতে আমরা এসে উঠলাম শেফিল্ড ম্যাটার্নিটি হাসপাতালের সন্নিকটবর্তী এক মসজিদে। মাগরিবের সময় হয়েছে। আমরা নামাযের প্রস্তুতি নিলাম। সৌদি আরবের ডক্টরেট ডিগ্রীধারী এক উচ্চ শিক্ষিত ইমাম নামায পড়ালেন। বয়সে তরুণ। শুনলাম ইমামতির জন্য তিনি কোন বেতন-ভাতা নেননা।
অবাক হলাম যখন দেখলাম, মাগরিবের ফরজ নামাজ শেষ হবার সাথে সাথেই আবার আকামত দিয়ে এশার নামায শুরু করা হলো। ইমাম অবশ্য ভিন্ন। মুসল্লীদের মধ্য থেকে আরেকজন ইমামের স্থানে গিয়ে নামায পড়ালেন। মাগরিবের পর সুন্নত নামায পড়ার সুযোগ দেয়া হলো না। ইসলামে মুসাফিরদের জন্য চার রাকাত ফরয নামাযকে দুই রাকাত করা হয়েছে এবং যোহরের সাথে আসর এবং এশার সাথে মাগরিব নামায আদায়ের অনুমোদন আছে। আমি যেহেতু মুসাফির, সেহেতু মাগরিবের পর দ্বিতীয় ইমামের সাথে এশার নামায আদায় করার জন্য জামাতে শরিক হলাম।
এখানে গ্রীষ্মকালে দিন বড় এবং রাত ছোট হওয়ায় নামাযের সময় নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। বিকাল সাতটায় আছর, ৯টায় মাগরিব । লন্ডনের মসজিদগুলোতে দেখলাম এশা রাত ১০.৫০ মিনিটে। ফযর সকাল তিনটায়। ১০:৫০ মিনিট বা রাত এগারোটায় এশার নামায পড়ে আবার রাত তিনটায় ফযরের নামায পড়তে গেলে রাত্রিতে ঘুমের সময় পাওয়া মুসকিল। তাই কিছুসংখ্যক আরবি ইমাম বা ইসলামি স্কলার মসলা দিয়েছেন যে, মাগরিব ও এশা এক সঙ্গে পড়ে ঘুমিয়ে পড়া যাতে ফযরের আগ পর্যন্ত কয়েক ঘন্টা সময় ঘুমিয়ে নেয়া যায়। এভাবে গ্রীষ্মকালে এখানকার আরব-অধ্যূষিত এলাকার দু’একটি মসজিদে মাগরিব-এশা একসঙ্গে পড়ার নিয়ম চালু হয়েছে বলে মনসুর আমাকে জানাল। অবশ্য অনেকেই তা মানে না। বিশেষত উপমহাদেশের মুসলমানগণ মাগরিব ও এশার নামায আলাদা করেই পড়ে থাকে।
নামায পড়ে আমরা বাসায় ফিরে এলাম। পরের দিন সকাল ১০.১৫ মিনিটে ফিরতি বাসে আমাকে লন্ডন যেতে হবে। শেফিল্ড বিরাট শহর। বৃটেনের চতুর্থ বৃহৎ নগরী। তাই মাত্র একদিনে এর কতটুকুই আর দেখা যায়। তবে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম যে, এখানে ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানী, বাংলাদেশী, আরবি, সোমালী, সুদানী ইত্যাদি বিভিন্ন দেশের লোক তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, স্বাতন্ত্র্য ও জাতীয় পরিচয়কে সমুন্নত  রেখেই বসবাস করে। স্থানীয় সংস্কৃতির দ্বারা তারা কমবেশি প্রভাবিত হলেও স্থানীয় সংস্কৃতির মধ্যে তারা নিজেদেরকে সম্পূর্ণ বিলীন করে দেয়নি। নিজেদের সংস্কৃতি ধারণের জন্য তারা মসজিদ, স্কুল, ইসলামি কেন্দ্র ইত্যাদি গড়ে তুলেছে। উপমহাদেশের  লোকেরা সাধারণত জীবিকার্জনের উদ্দেশ্যেই এদেশে এসেছে। আরবদের মধ্যে সোমালী, সুদানী, মরক্কো ইত্যাদি দেশ থেকে যারা এসেছে তারাও এসেছে প্রধানত জীবিকার্জনের উদ্দেশ্যেই। কিন্তু সৌদি আরব ও অন্যান্য গাল্ফ কান্ট্রি থেকে যারা এসেছে তারা প্রধানত ব্যবসা-বাণিজ্য ও আরাম-আয়েশের জন্য এসেছে। কেউ বাড়ি কিনেছে, কেউ ফ্ল্যাট কিনেছে, কেউ বা কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক বা অংশীদার হয়ে এখানে আরাম-আয়েশে জীবনযাপন করছে। বছরের কিছু অংশ বিশেষত গ্রীষ্মকালটা তারা এখানে কাটায়, বাকি সময়টা নিজ নিজ দেশে বা অন্যত্র বসবাস করে। তাদের মধ্যে অনেকেই ভাল মুসলমান। পাশ্চাত্যের অনিসলামী পরিবেশে তারা ইসলামসম্মত জীবন-যাপন করে থাকে। এখানকার অধিকাংশ মসজিদ ও ইসলামী কেন্দ্রসমূহ নির্মাণে তাদের আর্থিক অনুদান ও সহযোগিতা রয়েছে।
এখানে আর একটি জিনিস দেখে খুব আনন্দ পেলাম। সেটা হলো বাংলা সাইনবোর্ড। বাংলাদেশীদের দোকান, মসজিদ, মাদ্রাসা, ইসলামী কেন্দ্রসমূহ তো বটেই শেফিল্ড হাসপাতাল ও পাবলিক প্লেসে ইংরাজি Welcome এর সাথে আরবি, উর্দু, হিন্দী এবং বাংলা- ‘স্বাগতম’ লেখা আমাকে যেমন অবাক করেছে, তেমনি উৎফুল্ল করেছে।

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com 

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.