শাহীন রেজা'র কবিতা


মেঘরঙ ছায়ার ফড়িং
 
বালু নদীতে ঝরে পড়ছে মেঘ।
কচুরিপানার উপর একাকি একটি বক
ভেসে ভেসে যাচ্ছে কোথাও
শেষ বিকেলের মোহে,
হয়ত তোমার খোঁজে।
 
আহ্ কতকাল তুমি আমাকে খোঁজনা।
 
বকের ব্যাকুল টানে
যদি কোনোদিন বাঁধা পড়ি আমি
শানবাঁধানো সিঁড়ির আঁচলে,
সেদিন আমার দুচোখে যে জলের তৃষা
তারই আগ্রহে প্রাচীন পদ্ম হয়ে
জেগে উঠবে তুমি।
 
ভালবাসা ভেসে যায়
পানকৌড়ি-ডাহুক হয়ে ধানসিঁড়িটির কাছে,
পূবাল বাতাসে ওড়ে তার বালুচরী কেশ।
 
জীবনানন্দীয় সুখে
উজানে বাতাস আঁকে মেঘরঙ ছায়ার ফড়িং।
..................................................
 
বৃক্ষসংক্রান্ত
 
বৃক্ষ দাঁড়িয়ে থাকে ; বৃক্ষ দাঁড়ায়
পাহাড়-দেয়াল ঘেঁষে যেন অর্ফিয়াস
মোহনবাঁশীতে তার রুদ্র জাগে, জাগে দুর্জয়
 
বৃক্ষের ছায়াবুকে দুপুর ঘুমায়
ঘুঘুর ক্লান্ত ডাকে অচেতন প্রজাপতি-বীণ
 
বৃক্ষ নদীকে ডাকে; নদীও বৃক্ষকে
মিলনের কথা রটে তারায় তারায়
 
বৃক্ষ হারিয়ে গেলে স্মৃতি থাকে তার
ডালেডালে স্বপ্নবাকল আর অদেখার
নীলচিঠি শ্রাবণের খামে
 
বৃক্ষ কালের শিখা
জ্বলে শুধু জ্বলে
তাহার প্রস্হানে জল নয়ন-নিখিলে
 
বৃক্ষ দিয়েছে ডুব
ইলিশের জলাশয় নয় কিছু দীর্ঘ এমন
বৃক্ষের রঙগুলো এঁকে চলে ছায়াবৃক্ষ আরো।
..................................................
 
ভুলগুলো
 
খুব সতর্ক ভাবে হাঁটতে গিয়ে দেখলাম
খানাখন্দগুলো জমিন ছেড়ে উঠে এসেছে পথে
আর শুয়োর দুপুরটা রোদ-চিকচিক লোভে
ক্রমশ গ্রাস করে নিচ্ছে ছায়াগুলো,
পল্লবিত বৃক্ষের ডালে নেই কোনো প্রজাপতি,
শুধু ক্ষমাহীন চোখে তাকিয়ে আছে
কয়েকটি শূণ্যলতা এবং পাতার করোটি।
 
আমি হোঁচট খেতে খেতে পথ ভুল করে
আবারও পথের আঙ্গিনায়।
ভুলগুলো ভুল করে ভুল হলে
বেশ হোতো।
..................................................
 
তার জন্যে
 
এই কবিতাটি তার জন্যে
যে একান্ত আগ্রহে একটি শ্রাবণরাত কাটিয়েছে নির্ঘুম শুধু এক বনচড়ুইয়ের প্রতীক্ষায়
 
এই কবিতাটি তার জন্যে
যার আগ্রহে ঘুমের খামে ঢুকে গেছে কাকতাড়ুয়া
আর দীর্ঘ মিছিল শেষে ক্লান্ত রোদেরা খুঁজেছে
ঘুঘু' চোখ ধূসর দহনে
 
এই কবিতাটি তার জন্যে
যার চোখ ক্রোধে নয় জ্বলে উঠেছে অভিমানে
বিপন্ন বিষ্ময়ে খুঁজেছে কামজআশ্রয়
 
এই কবিতাটি তার জন্যে
যার সকল প্রার্থনায় চাতকআহ্বান এবং
সমস্ত সুরে সৃষ্টিতে ক্রিয়াশীল বোধনের ধ্বনি
 
এই কবিতাটি তার জন্যে
যে জেগে উঠেছে ধানরঙ শালিকের ডাকে আর
বেড়ে ওঠেছে অনাবিল পলির প্রশ্রয়ে যেন নীলাচল
 
এই কবিতাটি সত্যিই তার জন্যে
কালিটি' বৃষ্টিভেজা পথে যে খু্ঁজে পেয়েছিলো মালতীর গন্ধমাখা হার আর একান্ত নির্ভয়ে স্বপ্নশিকড় গেড়েছিলো উজানের চরে।
..................................................
 
কিছুটা পেরিয়ে এসেছি
 
কিছুটা পেরিয়ে এসেছি,
পুরোটা নয়।
 
এভাবে চলতে থাকলে
বৃক্ষগুলো বঞ্চিত হবে
জোনাকস্পর্শের আনন্দ থেকে।
 
নিশ্চয়ই সেটা কাম্য নয়
তোমার আমার
এবং অযুত অভ্যাসের।
 
নক্ষত্রের দুটো হাতে
যদি বেঁধে দেই
জোড়া লণ্ঠন,
তবে কি সূর্য হয়ে হাসবে
রাতের আকাশ?
 
সময় আমাকে যতই
বুঝুক ভুল
আমি চেতন-ঘড়ির
পেন্ডুলাম হয়ে তবুও
দুলতে থাকব মহাকালের
মাথার উপর।
 
কিছুটা পেরিয়ে এসেছি
একা,
বাকীটা তোমার সাথে।
..................................................
 
ছায়া অন্তর্বাস
 
পিছু ফিরে দেখে নেই ফেলে আসা পথ; বারবার,
ধূলোর বনে পড়ে থাকা টুকরো চুরুট, বাদামের খোসা আর বিষন্ন বটের পাতা; বিবর্ন হলুদ,
কাছে ডাকে, চুপিসারে।
মৃত্যুর আঁচড় লাগা হরিণের চোখ
করুণ বীণায় তোলে দাদরা-ঠুমরি ; আর তুমি জোনাকির মেয়ে কেমন উড়াও চাঁদ
মধুসূদনের মোহে ; ডাকো মেঘদূত।
 
আমি যতটা জোনাক জ্বালি
তুমি ততটাই বদনে ছড়াও এসে
আসমানী মেঘের ঝালর।
 
- হয়
পৃথিবীটা পথ হলে নারী হয় নদীদের মোহ,
ক্রমশঃ দরাজ থামে
তারপর ছোটাছুটি স্বলাজ উজানে।
 
আমি তো মুদ্রা এক রাতের পকেটে
কখনও হুতুম হই, কখনও বা ঘাস চিকচিক
বাদুড়ের ডানা হয়ে চেনা ভঙ্গিতে
কখনও খামচে ধরি ছায়া অন্তর্বাস।
..................................................
 
কিছু পাখি কবিতার নয়
 
কিছু কথা, কথা হয়ে থাকে
কিছু কথা শুধু স্মৃতি হয়
কিছু পাখি হয়ে ওঠে কবিদের সুখ
কিছু পাখি কবিতার নয়
 
কিছু দিন ফিরে যায় দিনের কাছে
কিছু দিন বলে কথা রাতের ভাষায়
কিছু নদী ভেসে চলে স্রোতের উজানে
কিছু চোখ জেগে থাকে চোখের আশায়
 
কিছু বুক থাকে ভরা মমতামোহরে
কিছু বুকে জমা শুধু আজন্মের তাপ
কিছু প্রেম চুমু হয় কালের কপোলে
কিছু প্রেমে আঁকা হয় জুলিয়েট-পাপ।
..................................................
 
ছায়াঘুড়ি ঘুঘুর গোপনে
 
তোমার পথের ভেতর
হেঁটে যায় সেই পথ এলোমেলো পায়ে
চাঁপালতার ঘাড়ে শীষ দিতে দিতে
আহা মায়ানির্জনে ঘুমের করাত হয়ে
কেটে কেটে রৌদ্রের ফুল
 
আমিও তোমার পিছু...
 
এভাবেই ছায়াঘুড়ি ঘুঘুর গোপনে
 
তুমি আছ আমি আছি
আর কিছু চুমুর কুহক
 
ভালোবেসে - ভালো
'পথ-পথ' খেলা
দরজায় থেমে থাক
সাজিকের ভেলা।|
..................................................
 
বড় ভদ্রলোক ছিলেন
 
তিনি চলে গেলেন।
তাঁর মহাপ্রস্থানের পর শুরু হলো বিতর্ক।
সুশীল নামধারী কেউ কেউ ইন্না-লিল্লাহ উচ্চারণ না করেই মুখে তুলে নিলেন অভিশাপের ভাষা,
স্বৈরাচারের মৃত্যুতে ক্ষমাহীনতার কথাও জোরেশোরে উচ্চারণ করলেন কেউ কেউ,
আবার কেউ বিশ্ব বেহায়ার মৃত্যুপরবর্তী ফাঁসি কার্যকরেরও ঘোষণা দিলেন।
 
আর অন্যদিকে একদল মানুষ ঝরাল অশ্রুকণা ঠিক শিশিরের মতো,
ছুটল এক জানাযা থেকে অন্য জানাযায়,
রোদনের সাথে সাথে উচ্চারণ করতে থাকল- আহা খুব ভাল লোক ছিলেন
এবং একদল মানুষ পরম মমতায় টেনে ধরল তাঁর কফিন, আমার সন্তান থাকবে আমাদেরই বুকে; লিচুতলার নির্জনে শান্তিতে নিরাপদে।
 
দুই স্রোতের মাঝখানে বিহ্বল এক কবি-
অতি নীচু স্বরে ফেলে দীর্ঘশ্বাস, বাতাসের কানে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, কবিস্বভাবের মানুষটি বড় ভদ্রলোক ছিলেন।
..................................................
 
বুকজল ঘেঁষে
 
বুকজল ঘেঁষে ডান দিকে যাই
বায়ে তুসোর মোমজাদুঘর
তামাদি রোদের নীচে কানপেতে শুনি
বিনূনীর গান
অর্কেস্ট্রার ঝিঁঝিগুলো দুপুরে ঘুমায়
শুধু ইউক্যালিপটাস নড়ে ওঠে
ঝিরিঝিরি পাতকুয়া জলে
আর সেই নীলমাখা মেয়ে
গোপন শয্যা রেখে উড়ে যায়
নদীসংগমে
 
এইটুকু বুঝেছি কেবল
সাঁতারের প্রশ্ন এলে
হৃদয়ের চেয়ে ঢের বেশী শ্রেয়
কূয়োর প্লাবন।

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.