আমার দ্বিতীয়বার ইংল্যান্ড সফর_মুহম্মদ মতিউর রহমান : পর্ব-৬

 
২১ জুন রবিবার

এখানে আজ ছুটির দিন। সকালে নাস্তা করে সবাই বসল আমার শারীরিক অবস্থার খোঁজ-খবর নিতে। কী কী ঔষুধ খাই, কখন কী খাবার খাই ইত্যাদি খোঁজ-খবর নেয়ার পর পরিচিত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা হল। বাংলাদেশী একজন বড় ডাক্তার থাকেন এখান থেকে দুঘন্টার রাস্তায়। ডা.জসিম আহমদ এমডি। বাড়ি নোয়াখালি। আমার জামাই আর মেয়ের সােেথ তাদের খুব হৃদ্যতা। তিনি বললেন, ২৪ জুন বুধবার বিকালে তার ওখানে যেতে, তিনি ভাল করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন। আমার ডায়াবেটিস খুব বেড়ে গিয়েছিল। তাই খাওয়া-দাওয়ার উপর খুব কড়াকড়ি আরোপ করা হল। সুপার মার্কেটে গিয়ে কয়েক ব্যাগ ভর্তি ডায়াবেটিক খাবার-দাবার নিয়ে এল আমার ছেলেমেয়েরা। নতুন ধরনের খাবার আমার রুচিতে বাঁধছিল, কিন্তু যেহেতু এটা আমার স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন, তাই বিনা-দ্বিধায় সেসব গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম।

বিকালে আমরা সকলে বেড়াতে বের হলাম। সিডার র‌্যাপিডস একটি ছোট শহর। সুন্দর, ছিমছাম, সাজানো- গোছানো। রাস্তা-ঘাট প্রশস্ত, গাড়ি-ঘোড়া কম। চলাচলে বেশ সুবিধা। দুবছর আগেও আমি আমার স্ত্রী তিন মাসের জন্য এখানে বেড়িয়ে গেছি। জামাই-এর আট সীটের বেশ বড় এবং আধুনিক মডেলের সুন্দর গাড়ি। গাড়ি চালাতেও সে খুব পারদর্শী। আমরা শহর ছাড়িয়ে সিডার নদীর তীরে গিয়ে পৌঁছলাম। স্রোতস্বিনী নদী বয়ে চলেছে, দুকূল কানায় কানায় পানিতে ভরা। নদী অতিক্রম করে আমরা উপনীত হলাম মার্সল্যান্ডে। সারা বছরই নাকি এখানে পানি থাকে। মার্শল্যান্ড পেরিয়ে ডান দিকে কিছুটা অগ্রসর হয়ে আমরা পৌঁছলাম এক হ্রদের ধারে। হ্রদের একদিক দিয়ে রাস্তা চলে গেছে বহুদূর পর্যন্ত। আমরা সেদিকটা ঘুরে এলাম। তারপর হ্রদের পূবপাড়ে, গাছের ছায়ার নিচে বসে পড়লাম। একদল লোক নৌকা নিয়ে এসেছে, তারা নৌকা বাইচের মহড়া দিচ্ছে। নৌকা বাইচ শেষে নৌকাটিকে আলগোছে ভাঁজ করে একটি গাড়ির পিছে তুলে নিয়ে তারা বাড়ি চলে গেল। নৌকাতেও চাকা লাগানো আছে। নৌকা বাইচে অংশগ্রহণকারী ছেলেমেয়েরা যার যার গাড়িতে করে নিজ নিজ গন্তব্যস্থলে চলে গেল। ছুটির দিনে তারা বিনোদনের জন্য এসেছিল। বিনোদন শেষে চলে যাবার পালা। আমরা বসে বসে তাদের নৌকাবাইচ এবং চলে যাওয়ার দৃশ্য উপভোগ করলাম। সবাই বেশ উৎফুল্ল প্রাণবন্ত।

হ্রদের পাশে একটি কাঠের প্লাটফরমে বসে বেশ কিছু লোক মাছ ধরায় ব্যস্ত। একটু পর পরই দেখি তারা এক একটা করে মাছ ধরছে। মাছ ধরতে হলে বিশ ডলার ফি দিয়ে লাইসেন্স  নিতে হয়, নইলে মোটা অংকের জরিমানা গুণতে হয়। নয় ইঞ্চির ছোট কোন মাছ ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তা জীবিত ছেড়ে দিতে হয়, নইলে জরিমানা। দেখলাম, নয় ইঞ্চির ছোট মাছগুলো এরা নির্দ্বিধায় পানিতে ছেড়ে দিচ্ছে। আমাদের দেশেও আইন আছে। কিন্তু আইন পালনের ব্যবস্থা নেই। এদেশের মানুষ আইন-কানুনের প্রতি অতিশয় শ্রদ্ধাশীল, কেউ না দেখলেও বা বাধ্য না করলেও এরা নিজে থেকেই সর্বদা আইন মেনে চলে। যেমন রাস্তায় গাড়ি চালাবার সময় কোন গাড়ি না থাকলেও সিগনাল ভঙ্গ করে কেউ কখনও গাড়ি চালায় না। ট্রাফিক পুলিশেরও কোন প্রয়োজন হয় না। রাস্তায় সাধারণত কোন ট্রাফিক পুলিশ থাকেও না, মাঝে মাঝে টহল দেয়া ছাড়া। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখানে কাউকে ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করতে দেখা যায় না।

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলেই জাতি এত বড় হতে পেরেছে। আমরা তো এদের কাছ থেকে অনেক কিছুই গ্রহণ করি, এসব ভাল দিকগুলো কি গ্রহণ করতে পারি না?

 

২২ জুন সোমবার

আমার শারীরিক অসুস্থতার জন্য সবাই ঠিক করল আমাকে এখানকার হেলথ্ ক্লিনিকে নিয়ে যাবে। জামাই এনামুল কবীর, ছেলে আবিদ এবং আমার স্ত্রীও সঙ্গে গেল। আমি যেসব ঔষুধপত্র খাই সে সব সঙ্গে নেয়া হল।

ক্লিনিকে পৌঁছে প্রথমে কাউন্টারে নাম রেজিস্ট্রি করা হল। কিছুক্ষণ পর অন্য কাউন্টার থেকে ডাক পড়লো। সেখান থেকে দুটি ফরম দেয়া হল। একটি ফরমে Personal Information এবং দ্বিতীয়টিতে কী রোগ এবং তার জন্য যেসব ঔষধ খাওয়া হয় তার নাম লিপিবদ্ধ করতে হবে। এনাম আবিদ দুজনে মিলে তা পূরণ করে জমা দিল। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর ডাক্তারের  চেম্বার থেকে ডাক পড়ল। কিন্তু প্রথমে আসল ডাক্তার নয়, কোন নার্স বা জুনিয়র ডাক্তার এসে আমার অসুখ এবং ঔষধপত্রের বিস্তারিত খোঁজ-খবর নিয়ে গেল। এরপর এল ডাক্তার। ডা. ম্যাকডোয়েল, পঞ্চাশের কাছাকাছি এক মহিলা এসে আমার রিপোর্ট দেখল। আমাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করল। ডায়াবেটিস অন্যান্য রোগের জন্য যেসব ঔষধপত্রাদি খাচ্ছি তা সব ঠিক আছে বলে জানাল। তবে সফরকালে ইংল্যান্ডে থাকা অবস্থায় আমার একটি নতুন উপসর্গ দেখা দিয়েছে যার নাম সিঙ্গলস বা জলবসন্ত- তার জন্য একটি ঔষধ দিল এবং সে ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ নয় বলে জুলাই আবার এসে ডায়াবেটিস-বিশেষজ্ঞের সঙ্গে দেখা করতে বললো।

বাসায় এসে দুপুরে  খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। বিকালে আবিদ যাবে ক্যানসাস শহরে। সেখানে সে চাকুরি করে। পাঁচ-সাড়ে পাঁচ ঘন্টার রাস্তা। দীর্ঘপথ, তাকে একাই গাড়ি চালিয়ে যেতে হবে। অবশ্য আমাদের দেশের মত কোন যানজট নেই, হাইওয়েতে উঠে একটানা গাড়ি চালিয়ে যাওয়া। পথিমধ্যে খানিক পর পরই ওয়াশ রুম আছে, ক্লান্তি লাগলে সেখানে কিছুক্ষণের জন্য গাড়ি থামিয়ে পায়খানা-পেশাব করে বা একটু বিশ্রাম নিয়ে প্রয়োজনে নাস্তা- পানি খেয়ে ক্লান্তি দূর করার ব্যবস্থা আছে।

এখানে ওয়াশরুম মানে পায়খানা-পেশাব গোছলের ব্যবস্থাসহ খেলাধূলা ইত্যাদি সবকিছুরই ব্যবস্থা আছে। এগুলো খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, খোলা-মেলা আধুনিক। সবই বিনা পয়সায়। আরামে নিরিবিলি বসে গল্প-গুজব করারও চমৎকার ব্যবস্থা আছে। টুকটাক খাবার পানীয়ের ব্যবস্থাও আছে। সারা আমেরিকা জুড়েই হাইওয়ের দুপাশে কয়েক মাইল পর পর ধরনের অসংখ্য ওয়াশরুমের চমৎকার সব ব্যবস্থা রয়েছে। ওয়াশরুমগুলো যথাযথরূপে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দেখাশোনারও উপযুক্ত ব্যবস্থা রয়েছে। তাই এগুলো সবসময় ঝকমকে তকতকে। আমাদের দেশের পাবলিক টয়লেটগুলোর মত স্যাঁতসেঁতে, নোংরা আবর্জনাপূর্ণ নয়।

আমাদের দেশের পাবলিক টয়লেটগুলো বলতে গেলে নানারকম ময়লা-আবর্জনা, দুর্গন্ধ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের আকর। সেখানে নাক বন্ধ করে ঢুকতে হয়, ঢোকার পর দম বন্ধ করে কিছু প্রয়োজনীয় কাজ সারার পর বাইরে বেরিয়ে ওজু-গোছল না করলে জান বেরিয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। অথচ একটু সর্তক হলেই এবং জনস্বাস্থ্য বিভাগ বা  পৌর কর্তৃপক্ষ দায়িত্বপালনে একটু তৎপর হলেই সুন্দর স্বাস্থ্যকর একটা পাবলিক টয়লেট সিস্টেম গড়ে তোলা সম্ভব। পৌর কর্তৃপক্ষ জনগণের কাছ থেকে নিয়মিত মোটা অংকের পৌর কর আদায় করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত জনকল্যাণের প্রতি তাদের কোনই নজর নেই। প্রতিবছর জনগণের টাকায় সরকারী কর্মচারীরা দেশ ভ্রমণ করেন, তারা বিদেশে এসব দেখেও কি কিছুই শেখেন না, শেখার প্রয়োজন বোধ করেন না অথবা শিখে তা কাজে লাগাবার গরজ অনুভব করেন না?

 

২৩ জুন, মঙ্গলবার

আজ সারাদিন ঘরেই কাটালাম। এনাম সকাল ৮টায় অফিসে যায় ৫টায় আসে। মেয়ে সুমাইয়া সকাল ছয়টায় নাতনি জারা নাতী আইয়ানকে নিয়ে স্কুলে যায়, আসে তিনটায়। মাঝখানে সুমাইয়া একঘন্টার ছুটিতে আসে নয়টায়, কিছু নাস্তা বানিয়ে এনামকে তার অফিসে দিয়ে আবার দশটায় স্কুলে যায়।

তিনটায় সুমাইয়া স্কুল থেকে এসে রান্না-বান্না করে। ইতঃমধ্যে এনাম পাঁচটায় অফিস থেকে এলে সবাই মিলে একসাথে খাওয়া-দাওয়া হয়। খেয়ে-দেয়ে এনাম যায় জিমে ব্যায়াম করতে, জারাকে নিয়ে যায় কারাতে শিখাতে। সুমাইয়া আইয়ানকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এত ব্যস্ত জীবন ওদের যে, বিশ্রামেরও কোন সময় নেই।

উপরন্ত এতবড় বাড়ি। ছুটির দিনে নিজেদেরই বাড়ি-ঘর সব পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। এছাড়া বাড়ির সামনে-পিছনে বাগান, বিশাল উন্মুক্ত স্থান- এগুলোও নিয়মিত পরিচর্যা করতে হয়। বাড়ির সামনে, পিছনে পাশের খোলা জায়গায় আগাছা বেড়ে গেলে বা বড় হলে তার জন্য জরিমানা দিতে হয়। তাই সবসময় সর্তক থাকতে হয়, পরিবেশ যাতে নষ্ট না হয়। নিজের জায়গা বলেই যা-তা ভাবে রেখে দেয়ার উপায় নেই। স্বাস্থ্যকর পরিবেশসম্মতভাবে সবকিছু রাখার দায়িত্ব বাড়ির মালিকের। নইলে জবাবদিহি বা জরিমানা।

নাগরিক সচেতনতা সৃষ্টি নাগরিকদের দায়িত্ব পালনের ব্যবস্থা থাকায় এদেশটি এত সুন্দর। এর পরিবেশ এত মনোরম স্বাস্থ্যকর।

 

২৪ জুন, বুধবার

আজ আমাদের ডা. জসিমের বাসায় যাওয়ার কথা। তিনি আমার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করবেন। সঙ্গে পরিবারের সবাইকে সন্ধ্যায় তার বাসায় খাবার দাওয়াত দিয়েছেন। তিনি এমডি পাশ একজন বড় ডাক্তার। এখানে একটি ক্লিনিকের প্রধান চিকিৎসক হিসাবে কর্মরত। তিনি মূলত নেফ্রোলজি হাইপারটেশন বিশেষজ্ঞ। তার ক্লিনিকে আমার রক্ত, পেশাব ইত্যাদি পরীক্ষা করে তিনি পরামর্শ দিবেন।  সিডার র‌্যাপিডস থেকে তার বাসা তথা ক্লিনিক দুই ঘন্টার  রাস্তা।

বিকাল সোয়া পাঁচটায় আমরা রওয়ানা হলাম। আমি, আমার স্ত্রী, মেয়ে, নাতি-নাতনি জামাই। এনাম গাড়ি চালাচ্ছে। গাড়িতে নেভিগেটর আছে। একটু যাওয়ার পরই নেভিগেটর বলে দিচ্ছে- ডাইনে না বায়ে, সোজা না ঘোড়া পথে। কী সুন্দর ব্যবস্থা! বিজ্ঞানের নিত্য নতুন আবিষ্কার মানুষের জীবনকে কত স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ করে তুলেছে। দীর্ঘ পথ। নেভিগেটর পায়ে পায়ে এনামকে পথ দেখিয়ে দুঘন্টা পনের মিনিটে আমাদেরকে ডা. জসিম আহমদের বাসায় পৌঁছে দিল। একটু ভুল রাস্তায় গাড়ি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নেভিগেটর বলে দিচ্ছে- না পথে নয়, পথে যাও। সারা আমেরিকার যত বড় বড় রাস্তা, অলি-গলি, হাট-বাজার, দোকনপাট, বাড়ি-ঘর সবই নেভিগেটর নির্ভুলভাবে বলে দেয়। খুব অবাক হওয়ার মত ব্যবস্থা।

ডা. জসিমের বাসার দরজায় নক করার সাথে সাথে তার স্ত্রী দরজা খুলে সহাস্য বদনে আমাদের সংবর্ধনা জানালেন। আমরা সবাই ঘরে ঢুকলাম। তিনতলা বাড়ি। থাকেন মাত্র দুজনে। ডাক্তারের এক ছেলে দুই মেয়ে। বড় মেয়ে সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা করে, বর্তমানে বেইজিং- রয়েছে ট্রেনিং-এ। ছেলে পিএইসডি পড়ে অন্য শহরে, ছোট মেয়েও উচ্চ শিক্ষার জন্য আরেকটি শহরে থাকে। বাড়ির সামনে পাঁচটি গাড়ি দাঁড় করানো দেখলাম। অর্থাৎ ছেলেমেয়েরা এখানে না থাকলেও তাদের গাড়িগুলোসহ ডা. তার স্ত্রীর গাড়ি সবই এখানে পার্ক করা রয়েছে। গাড়িগুলো, সবই দামি। ডাক্তাররা এদেশে প্রচুর বেতন পায়। তাই তাদের বড় বাড়ি, এতগুলো গাড়ি সবই মানায়।

ডা. তখন ছিলেন তার ক্লিনিকে। খবর পেয়ে তিনি বাসায় এলেন। ততক্ষণে আমাদের জন্য নাস্তা এল। একসঙ্গে সবাই  নাস্তা খেলাম। তারপর ডাক্তার আমাকে নিয়ে, গেলেন তার ক্লিনিকে। সঙ্গে আমার স্ত্রী এনাম গেল। বিশাল ক্লিনিক। ক্লিনিকের বড় ডা. একজন বাংলাদেশী। এটা ভেবে গর্বে বুক ফুলে উঠলো। আরো ভালো লাগলো ১০/১২ জন ডাক্তারের মধ্যে তিন/চারজন মুসলিম। তারা সবাই বাংলাদেশ, পাকিস্তান ইন্ডিয়ার।

ক্লিনিকে আমার পেশাব পরীক্ষা করা হল। রক্ত পরীক্ষার জন্য আমাকে নিয়ে যাওয়া হল পাশের হসপিটালে। সেখানে একজন নার্স আমার রক্ত নিল। রক্ত দিয়ে নানা-রকম পরীক্ষা করা হবে- ডায়াবেটিস, কিডনি ইত্যাদি। এরপর আমরা ডাক্তারের বাসার দিকে রওয়ানা হলাম। পথিমধ্যে ডা. জসিম আমাদেরকে তার বাড়ির পরিপার্শ্ব ঘুরে দেখালেন। নির্জন এলাকা। ঝোঁপ-ঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে দুএকটি বাড়ি- ছবির মত সুন্দর। সুন্দর পাকা রাস্তা- রাস্তার দুপাশে গাছপালা, ঝোঁপঝাড়। মাঝে মধ্যে পাশের ঝোঁপ থেকে হরিণ বেরিয়ে আসছে রাস্তায়। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম। এখানে বনের হরিণকে কেউ মারে না, ধরে না- মুক্তভাবে তারা  যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়।

ডা. জসিমের বাসায় রাতের খানা খেলাম। নানা রকম সুস্বাদু ব্যঞ্জন। সবাই মনের মত করে খেয়ে-দেয়ে আমরা আবার  রাস্তায় বের হলাম। নেভিগেটর আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। কুয়াশা পড়েছে। চলতে কিছুটা কষ্ট হলেও, এনামের ড্রাইভিং পটুতায় তা বশীভূত হল। রাত সোয়া একটায় আমরা সিডার র‌্যাপিডস্- পৌঁছে গেলাম।

 

২৫ জুন, বৃহস্পতিবার

সকালে ঘুম থেকে উঠে পূব পাশের জানালা দিয়ে তাকালাম। বাসার পূবদিকে একটা খোলা জায়গা। তার উত্তর পাশে বাড়ি-ঘর, দক্ষিণ পূব পাশ জুড়ে বন, ঘন সবুজ বন। গ্রীষ্মকালে এখানকার গাছপালা সব নতুন প্রাণ পেয়ে সজীব সতেজ হয়ে ওঠে। শীতের সময় গাছপালা কেমন লতা-পাতাহীন শুষ্ক মৃতপ্রায় হয়ে থাকে। গ্রীষ্মের আগমনের সাথে সাথে প্রকৃতির রূপ সম্পূর্ণ বদলে যায়। নানা বিচিত্র বর্ণের ফুল ফুটে বনভূমি রীতিমত বর্ণাঢ্য হয়ে ওঠে। ওগুলো দেখে প্রাণে নতুন পুলক খেলে যায়।

পূব পাশের জানালা দিয়ে খোলা জায়গার দিকে তাকালে সেখানে একটি পায়ে চলা সরু রাস্তা চোখে পড়ে। মনে হয়, সে পথে নিয়মিত লোকজন চলাচল করে। রাস্তাটি পূবদিক ঘন বনের মধ্যে হারিয়ে গেছে। আমি কখনো কাউকে সে পথে হাঁটতে দেখিনি, মাত্র সামনের বাসার একজন মধ্যবয়সী দম্পতি ছাড়া।

আমার মেয়ের বাসার পশ্চিম পাশে এক দম্পতি বসবাস করে। তাদের দুটো বাঘা কুকুর আছে। প্রতিদিন ভোরে বিকালে তারা তাদের কুকুর দুটো নিয়ে ঐপথে যাতায়াত করে। নিজেদের ব্যায়াম হয়, তাছাড়া কুকুরদের নিয়মিত ব্যায়াম করাতে হয়, যারা কুকুর পালে তাদেরকে। এখানে কুকুর বিড়ালের যত্ন-আত্তী দেখলে রীতিমত বিস্মিত হতে হয়। পোষা কুকুরের নিয়মিত খাওয়া-দাওয়া, পেশাব-পায়খানা পরিষ্কার করা, ঔষধ-পত্র ইত্যাদি সবকিছুর জন্য তারা অজস্র পয়সা খরচ করে। ভাবলে অবাক হতে হয়। এক হিসাবে জানা যায়, কুকুর বিড়ালের খাবার বাবদ আমেরিকানরা বছরে ষোল হাজার কোটি ডলার খরচ হয়। টাকা বাংলাদেশের দশ বছরের বাজেটের সমপরিমাণ বা তারও বেশি। পরিমাণ টাকায় বাংলাদেশের মতো দশটি অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের দারিদ্র্য বিমোচন করা সম্ভব।

আজ বিকালে টিভি খুলতেই একটি খবরের দিকে দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। আমেরিকার বিশ্ব-বিখ্যাত পপ সঙ্গীত শিল্পী মাইকেল জ্যাকসন মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। টিভি জুড়ে কেবল তাঁর খবরই বার বার প্রচারিত হচ্ছে। তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য নানাভাবে একটু পরপরই প্রচার করা হচ্ছে। এরূপ একজন বিশ্ব-বিখ্যাত ব্যক্তির মৃত্যুতে স্বভাবতই মন খারাপ হলো।

 

২৬ জুন, শুক্রবার

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠলাম। নামায পড়ে মনে মনে প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। আমাদের আজ বিকালে বেড়াতে যাবার কথা। দুদিনের উইকএন্ড আমরা কাটাবো পাশ্ববর্তী একটি রাজ্যে- নাম নেব্রাসকা। এখান থেকে সাড়ে চার ঘন্টার ড্রাইভ।

সাড়ে এগারটায় গোছল করে পায়জামা-পাঞ্জাবী পড়লাম। আজ জুমাবার। জুমার নামায পড়ার প্রস্তুতি নিলাম। এনাম অফিস থেকে এসে আমাকে মসজিদে নিয়ে যাবে- আশায় আমি প্রস্তুত হয়ে থাকলাম। কিন্তু কেন জানি না এনাম এল না। নামাযের টাইম গড়িয়ে গেলে আমি  ঘরেই জোহরের নামায আদায় করলাম। জুমার নামায মিছ হল। গত জুমার দিনও ছিলাম প্লেনের মধ্যে। সফরে বা বিদেশ-বিভূইয়ে তো আর সবকিছু ঠিকমত করা যায়না। এজন্যই আল্লাহতালা মেহেরবানী করে তাঁর বান্দাহর জন্য অনেক কমসেশন দিয়েছেন। চার রাকাত নামাযের বদলে দুরাকাত, জোহরের সাথে আছর এবং এশার সাথে মাগরিব একসাথে পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। জুমার নামায মুসাফিরের জন্য মাফ এমন কি রমজানের রোজাও সফর অবস্থায় মাফ, পরে কাজা আদায় করতে হয়। এভাবে মুসাফিরের জন্য মহান আল্লাহ অনেক কিছু মাফ অথবা সহজ করে দিয়েছেন।  বান্দাহকে তার সাধ্যের বাইরে আল্লাহ কোন কিছু চাপিয়ে দেন না। মানুষের জন্য প্রদত্ত আল্লাহর বিধানের নাম ইসলাম। মহান স্রষ্টা তা বান্দার অবস্থা সম্যক অবগত আছেন। তাই কখন বান্দার জন্য কতটুকু কী করতে হবে সেটা তার চেয়ে ভাল আর কেউ জানে না। সেভাবেই তিনি মানুষের জন্য ইসলামের বিভিন্ন বিধি-বিধান তৈরি করেছেন। সেটা পালনে মানুষই উপকৃত হয়। আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির প্রতি যে কতটা মেহেরবান, থেকে এটা প্রমাণিত হয়।

বিকাল চারটায় আমরা খেয়ে-দেয়ে গাড়িতে উঠলাম। সাড়ে চার ঘন্টা ড্রাইভ করে ওমাহা শহরে গিয়ে পৌঁছলাম। সেখানে আগে থেকেই হোটেল ম্যারিয়টে দুটো ডাবল বেডের রুম বুক করা ছিল। আমি, আমার স্ত্রী, মেয়ে, মেয়েজামাই, নাতি-নাতনি এবং ক্যানসাস সিটি থেকে আবিদের এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়ার কথা। আমরা রুমে গিয়ে ঢুকতে ঢুকতেই আবিদও এসে গেল। আমরা হোটেলে উঠে সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে রাতের খাবারের সন্ধানে বের হলাম। কিন্তু কী আশ্চর্য! হোটেল সব এরি মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। অগত্যা ফাস্টফুডের দোকান থেকে ফিস বার্গার, রুটি, চীজ, সালাত নিয়ে এলাম। হোটেলে এসে খেয়ে-দেয়ে নামায পড়ে শুয়ে পড়লাম।

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN


🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com 

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.