আলিফ লায়লা : আরব্য রজনী_পর্ব-৫৮

 
ইংরেজি অনুবাদ : ডঃ জে. সি. মারদ্রুস
  
শাহজাদা কামার আলজামান আর শাহজাদী বদরএর প্রণয় কাহিনী
একশো সত্তরতম রজনীর দ্বিতীয় যামে ছোটবোন দুনিয়াজাদ গালিচা থেকে উঠে এসে শাহরাজাদের পাশে বসে বললো, এবার তোমার গল্প শুরু করে দিদি।
শাহরাজাল বললো, শাহেনশাহ যদি শুনতে চান নিশ্চয়ই শোনাবো বোন।
শাহরিয়ার বলে, আমি শোনার জন্যে হাঁ করে আছি। শাহরাজাদ। তুমি এবার শুরু করো।
শাহরাজাদ বলে, তা হলে শুনুন, জাঁহাপনা, এবার শাহজাদা কামার আল-জামান আর শাহজাদী বদর-এর প্রণয় কাহিনী বলছি :
বহুকাল আগে খালিদাসে শাহরিমান নামে এক প্রবল পরাক্রান্ত বাদশাহ ছিলেন। ধন-দৌলত, লোক-লস্কর, সৈন্য-সামন্তে তার তুল্য সুলতান সে সময়ে সমগ্র আরবে। আর কেউ ছিলো না। একদিকে কঠোর হাতে শত্রু দমন এবং অন্যদিকে দক্ষতার সঙ্গে প্রজা পালন তার চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিলো। বিলাস ব্যসনেও ছিলো তার প্রগাঢ় আসক্তি। চারটি বেগম এবং সত্তরটি রক্ষিতা ছিলো তার হারেমে। কিন্তু সত্ত্বেও বাদশাহর মনে সুখ ছিলো না। দেখতে দেখতে বয়স গড়িয়ে বিকেল হতে চলবো, কিন্তু বাদশাহর কোনও সন্তানাদি হলো না। তার এই বিশাল সলতানিয়তের কে হবে উত্তরাধিকারী, সেই চিন্তাতেই নিয়ত মূহ্যমান হয়ে থাকেন। তিনি।
চিন্তায় চিন্তায় দিন দিন কৃশকায় হতে থাকেন সুলতান। একদিন প্রধান উজিরকে মনের দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, আল্লাহ আমাকে সবই দিয়েছেন। কোনও দিকেই কোনও অভাব রাখেননি। কিন্তু একটি পুত্র সন্তান থেকে কেন আমাকে বঞ্চিত করলেন তিনি?
উজির চট করে কথার কোনও জবাব দিতে পারে না। দুঃখ তো শুধু তাঁর একার নয়। সমগ্র খালিদানবাসী সদা সর্বদা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানায়, সুলতান যাতে পুত্র লাভ করেন।
গভীরভাবে চিন্তা করে অনেকক্ষণ পরে উজির বললো, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া সমস্যার টম সমাধান কেউ করে দিতে পারে না, জীহাপনা। আপনি তাঁকেই স্মরণ করুন। নিশ্চয়ই তিনি আপনার আবেদনে সাড়া দেবেন। আজ রাতে যখন আপনি হারেমে যাবেন তার আগে শুদ্ধাচারভাবে হাতমুখ ধুয়ে রুজু করে নামাজ সেরে নেবেন। নামাজান্তে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানাবেন, আজ রাতের সহবাসে যেন একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়।
চমৎকার কথা বলেছ উজির, আনন্দে প্রায় চিৎকার করে ওঠে শাহরিমান, আমারও মনে হয়। এতে আল্লাহ ফেরাতে পারবেন না আমাকে।
সুলতান খুশি হয়ে উজিরকে মূল্যবান সাজ-পোশাক উপহার দিলেন। সন্ধ্যাকালে একটি মনমতে রক্ষিতা পছন্দ করলেন। আজ রাতে তার ঘরেই তিনি কাটাবেন। উজিরের পরামর্শ মতো বেশবাস পরিবর্তন করে শুদ্ধ চিত্তে নামাজ সারলেন। নামাজান্তে কায়মনে প্রার্থনা জানাতে লাগলেন, আল্লাহ, তুমিই একমাত্র ভরসা, তুমি না দিলে আমি এই অতুল বৈভবের মালিক হয়েও দীনভিখারী হয়েই থাকবো।
সেই রাতে সুলতান যে রক্ষিতার ঘরে গিয়েছিনেল দশমাস পরে তারই গর্ভে এক সুদৰ্শন পুত্রের জন্ম হয়। শাহরিমান আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠেন। এতকালের সাধাতাঁর পূর্ণ হলো। সারা সালতানিয়তে আনন্দের বন্যা বয়ে যেতে লাগলো। প্রজারা নবজাতকের শতায় কামনা করে আল্লাহর কাছে মোনাজাত করলো। সুলতান আদর করে নাম রাখলেন কামার আল-জামানঅর্থাৎ যুগের চাঁদ।
তা চাঁদই বটে। এমন রূপ চোখে পড়ে না। তারায় ভরা চৈত্র মাসের রাতে ছাতের ওপর মাদুর পেতে চিৎ হয়ে শুয়ে দূর নীলনভে যে রূপের হাট প্রত্যক্ষ করা যায় একমাত্র তার সঙ্গেই বুঝি তুলনা চলে কামার আল-জামানের রূপ। অথবা কোনও এক বসন্তবিকালের বিদায়ী সূর্যের বিদায় চুম্বনে আরক্তিম ফোটা ফুলের সমারোহ তার তুল্য রূপ ধরা পড়ে।
শাহরিমান পুত্রকে কোনও সময় চোখের আড়াল করেন না। তার লেখাপড়া শেখানোর ভার দেওয়া হয় শহরের সবচেয়ে নামজাদা মৌলভীর ওপর। দিনে দিনে বড় হতে থাকে কামার অল-জামান।
যখন তার পনেরো বছর বয়স, জামানের দেহে যেীবনের জোয়ার আসতে থাকে। শাহরিমান পুত্রের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবেন, আল্লাহ তাকে যখন দিলেন, দুহাত ভরেই দিলেন। এমন রূপ তিনি কখনও চোখে দেখেননি।
সুলতান মনে মনে স্থির করলেন, এবার পুত্রের শাদী দিয়ে দিতে হবে। তার নিজের বয়স হয়েছে। মানুষের শরীর বলা যায় না, হুট করে মরে গেলে মনের সাধামনেই রয়ে যাবে। উজিরকে ডেকে বললেন, শোনো, উজির, ছেলে তো বড় হলো, আমার শরীর স্বাস্থ্যও দেখছো, খুব ভাল নাই। তা জামানের যদি শাদী দিয়ে দিই খুব কি খারাপ দেখাবে। ওর শাদীটা না দেখে যদি মরি আমার এত কালের সাধ অপূর্ণ থেকে যাবে।
উজির বললো, জাঁহাপনা পুত্র আপনার জ্ঞানে গুণে বিদ্যায় বুদ্ধিতে উপযুক্ত হয়ে উঠেছে। এখনই শাদীর প্রশস্ত সময়! আমার মনে হয়। আর দেরি না করে শুভ কাজ সম্পন্ন করে দিন। আপনার প্রজারাও এই শুভ দিনটির জন্যে অধীর আগ্রহে দিন গুণছে। তাছাড়া স্বামী স্ত্রীর সহবাসে দেহ ক্লেদ মুক্ত হয়। সুতরাং আপনি যা ভেবেছেন তা চমৎকার।
সুলতানের মনে যেটুকু দ্বিধা ছিলো তাও সাফ হয়ে গেলো। কামার আল-জামানকে খবর পাঠালেন। একটু পরেই জামান এসে বাবাকে কুর্নিশ জানিয়ে অবনত মস্তকে দাঁড়ায়।আব্ববাজান, আমাকে ডেকেছেন?
এই সময়ে রাত্রি অবসান হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো। দুনিয়াজাদ বলে, কি সুন্দর করে তুমি বলতে পারে দিদি!
শাহরাজাদ বলে, এবার একটু ঘুমিয়ে নে।
বাদশাহ শারিয়ার শাহরাজাদকে বুকের মধ্যে টেনে নেয়।সত্যি শাহরাজাদ, কিসসাগুলো শুনতে শুনতে কোথা দিয়ে যে রাত কাবার হয়ে যায় বুঝতেই পারি না। তুমি আমার চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছ।
শাহরাজাদ বলে, সেই জন্যেই তো আমি সকাল হতে না হতেই গল্প থামিয়ে দিই, জাঁহাপনা। সারারাত্রি জাগরণের পরে আপনার যাতে ঠিক মতো ঘুম হয় সেটাও তো আমাকে দেখতে হবে।
শারিয়ার আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে, কেন? দেখতে হবে কেন? আমার তবিয়ৎ খারাপ হলে তোমার কী?
বা রে, আপনিই তো আমার সব। স্বামী ছাড়া মেয়েদের আর কি থাকে?
শারিয়ার শাহরাজাদের ঠোঁটে ঠোঁট রাখে। দুনিয়াজাদ দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে নিজের ঠোঁট। রক্ত বেরিয়ে যায়। আড়চোখে চেয়ে চেয়ে দেখে, সুলতান শারিয়্যারের বুকের নিচে কি করে তার দিদি হারিয়ে যেতে থাকে। শাহরাজাদ একটা মৃদু চাপড় দিয়ে দুনিয়াজদকে বলে, দূর মুখপুডি, পাশ ফিরে শো।
পরদিন একশো একাত্তরতম রজনী
সারাদিন দরবারের কাজকর্ম সেরে সন্ধ্যা হতে না হতেই সুলতান শারিয়ার শাহরাজাদার কক্ষে চলে আসে। দুনিয়াজাদ নিচে গালিচায় গিয়ে শোয়। শাহরাজাদ সরে এসে শারিয়ারের গা ঘেঁষে বসে। শারিয়ার ওকে বুকে টেনে নিয়ে আলতো করে একটু চুমু খায়। তারপর চলতে থাকে পূর্বরাগের পালা। রাত বাড়ে। রিরংসাও বাড়তে থাকে দুজনের। উত্তেজনায় অস্ফুট স্তনন করতে থাকে শাহরাজাদ।
দুনিয়াজাদ এবার আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। বুকে তাকিয়া চেপে দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে থাকে।
অনেকক্ষণ বাদে শাহরাজাদ ডাকে, দুনিয়া, ওপরে আয়!
দুনিয়া উঠে এসে শাহরাজাদের পাশে বসে। আবার গল্প শুরু হয়।
তারপর শুনুন, জাঁহাপনা, শাহজাদা কামার আল-জামান বাবাকে কুর্নিশ জানিয়ে বলে, আমাকে ডেকেছেন, আব্ববাজান?
-হ্যাঁ বাবা, বসো।
জামান সুলতানের পাশে গিয়ে বসে। শাহরিমান বলে, আমার বয়স হয়েছে, বেঁচে থাকতে থাকতে তোমার শাদীটা দেখে যেতে চাই, বাবা।
কামার আল-জামানের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়, কিন্তু আব্বাজান, এখনই আমি বিয়ে করতে চাই না। জীবনে নারীর প্রয়োজন নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত আমি তার কোনও অভাব বুঝতে পারিনি, আব্বাজান। মেয়েদের সম্বন্ধে আমার কোনও ধ্যান ধারণা গড়ে ওঠেনি। ওদের সম্পর্কে আমার কোন মোহ বা আকর্ষণ কিছুই নাই। অবস্থায় হঠাৎ একটা মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক, আমার মনে হয়, সুখের হবে না। আদিত কথা, শাদী নিয়ে আমি এখনও কিছু ভাবিইনি। আমার মন ঠিক তৈরি হয়ে ওঠেনি। আপনি অপেক্ষা করুন, আব্বজান। আমি শাদী করবো নাএমন কথা বলছি না। কিন্তু শাদী করার আগে আমাকে প্রস্তুত হতে দিন, এই আমার আর্জি।
শাহরিমান পুত্রের কথায় বিচলিত হলেন।কিন্তু বাবা, শিক্ষাদীক্ষার পাঠ তোমার হয়ে শেষ হয়ে গেছে। এবার সংসার ধর্ম পালন করার সময় এসেছে। এখন তুমি বলছো, মেয়েদের সম্পর্কে তোমার কোনও ধ্যান ধারণাই গড়ে ওঠেনি। আমার মনে হচ্ছে, তুমি কিছু গোপন করছে। কিন্তু গোপন করার কোনও ব্যাপার থাকতে পারে না, বাবা। তুমি এখন বড় হয়েছে। অনেক পড়াশুনা করেছে। সব কিছু ভালোমন্দ বোঝার বিদ্যাবুদ্ধি তুমি অর্জন করেছে। তুমি বিনা দ্বিধায় বলো, আমি তোমার কথাই শুনতে চাই।
কামার আল-জামান মাথা নিচু করে বসে থাকে। বাবার কাছে সে ধরা পড়ে গেছে। সত্যিই সে আসল কথাটা শত চেষ্টা করেও বাবাকে বলতে পারেনি। কিন্তু বৃদ্ধ শাহরিমানের চোখ এড়ায়নি। জামান যে কি একটা গোপন করতে চাইছে তা তিনি বুঝতে পেরেছেন।
একটুক্ষণ পরে জামান বললো, আপনি ঠিকই ধরেছেন, আব্বাজান, আমি একটা কথা বলতে গিয়ে বলতে পারিনি। আপনি আমাকে নানা শাস্ত্র শিক্ষা দিয়েছেন। আমি বহু কিতাবে পড়েছি, মেয়েদের নানারকম ছলাকলা বিশ্বাসঘাটকতার কাহিনী। তাদের রূপ যৌবন দিয়ে কিভাবে পুরুষের সর্বনাশ করে সেই সব বিচিত্র বিবরণ জানলে কোনও মেয়েকে কেউ ভালো চোখে দেখতে পারে না, আব্বাজান। যে মেয়ে খারাপ হতে চায় তাকে আপনি জিঞ্জিরে বেঁধে কয়েদ করে রাখলেও সে পরপুরুষের অঙ্কশায়িনী হতে পারে। একথা আমি বানিয়ে বলছি না, আব্বাজান, আমাদের পীর পয়গম্বররা এই বাণী রেখে গেছেন। আর আমার একমাত্র আর্জি, জাঁহাপনা। আপনি আমাকে আর শাদীর কথা বলবেন না। সত্ত্বেও আমার কথা যদি না শোনেন, যদি জোর করে কোনও মেয়েকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেন, ফল ভালো হবে না। হয়তো আপনার মনের একটা সাধ পূরণ করতে গিয়ে আমাকেই আপনি চিরকালের মতো হারাবেন।
বাদশাহ শাহরিমান শিউড়ে ওঠেন। না না না, সে হতে পারে না। অমন অলুক্ষণে কথা মুকে আনতে নাই, বাবা। আমি তো তোমাকে জোর জবরদস্তি করছি না। তোমার বয়স হয়েছে। আর আমিও বুড়ো হয়েছি। অবস্থায় বিয়ে শাদী করে ধন দৌলত বুঝে নিয়ে প্রজােপালন করাই তোমার ধর্ম। আর আমার কথাটা একবার ভাবো, কবে মরে যাবো, মরার আগে কে না নাতির মুখ দেখে েেত চায়? যাই হোক, তুমি আদৌ ভেবো না তোমাকে ধরে বেঁধে শাদী দিয়ে আমার মনোবাসনা চরিতার্থ করবো। যাকে শাদী করবে। সে হবে তোমার খাস বেগম। সারাজীবনের সঙ্গী। তার সঙ্গে তোমার যদি বনিবনাও না হয় সে শাদী তো জহর সামিল। আমি কিছুতেই তা হতে দেব না। কিন্তু বাবা, তবুও একটা কথা থেকেই যায়। আমি জানি তুমি বহু জ্ঞান আহরণ করেছ। বহু দর্শন তোমার নখদর্পণে। তবু বলবো, আরও কিছু অনুসন্ধান করে দেখো, মেয়েদের সম্বন্ধে ভালো কথাও নিশ্চয়ই অনেক মনীষীই বলেছেন। তোমার বয়স অল্প। পুঁথিগত বিদ্যাই এখন একমাত্র মূলধন। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা অনেক সময় হব তোমার অধিত বিদ্যার দৃঢ় প্রত্যয়কে ভেঙ্গেচুরে তছনছ করে দেয়। সে সব নজির তো কিতাবে লেখা থাকে না। নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। যাই হোক, এখন আর তোমাকে উত্যক্ত করতে চাই না। তুমি যেমন ছিলে তেমনি থাক। পরে যদি কখনও তোমার চিন্তা-ভাবনার কোনও রদবদল হয়, আমাকে অসঙ্কোচে জানাবে।
এরপর আরও একটা বছর কেটে যায়। শাহরিমান আর কোনও প্রশ্ন তোলেন না। ছেলের প্রতি তার দারুণ দুর্বলতা। কোনও কথায় সে আহত হয় সুলতান তা আদৌ চান না।
শাহরিমানের শরীর দিন দিন জরাগ্রস্ত হয়ে থাকে। মৃত্যু হাতছানি দিচ্ছে, বুঝতে কষ্ট হয় না। একদিকে অপত্য পুত্র স্নেহ অন্যদিকে জীবনের শেষ সাধ। নির্জন প্রাসাদ কক্ষে একা একা বসে ভাবেন। ছেলে বড় হয়েছে, তার অমতে কোনও কিছু চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। অথচ এদিকে দিনও শেষ হয়ে আসছে। নাতির মুখ আর বুঝি দেখে যাওয়া হলো না। শাহরিমান নিশ্চিত জানেন, প্রথম যৌবনের স্বপ্নরঙিন কল্পনার দিনগুলো সব পুরুষের জীবনেই একবার আসে। ধরাবাঁধা জীবনের শাশ্বত আবর্তকে সে তখন কিছুকালের জন্য স্বীকার করতে চায় না। সকলে যা করে সকলে যা বলে তা সে করতে চায় না-বলতে চায় না। সে চায় নতুন কিছু একটা করতেযাতে সে হতে পারবে অনন্য। তারপর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধির প্রসারতা বাড়ে, অভিজ্ঞতার আয়তন ব্যাপ্ত হয়।
শাহরিমান ভাবেন। জামানকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে হয়তার ধ্যানধারণার কোনও পরিবর্তন হয়েছে কিনা।
কামার আল-জামান আবার এসে সুলতানকে কুর্নিশ জানিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। মুখের দিকে তাকালে কেউ ভাবতেই পারবে না। ছেলে বাবার কথার অবাধ্য হতে পারে। তার কথাবার্তায় হাব-ভাবে চাল-চলনে এত শালীনতা, এত ভব্যতা বিশ্বাসই করা যায় না যে বাবার একটি অপূর্ণ সাধ, সে মেটাবে না। শাহরিমান জিজ্ঞেস করেন, এখনও কি তোমার সেই একমত, জামান?
কামার আল-জামান বাবার বিষণ্ণ করুণ মুখের দিকে সোজাসুজি তাকাতে পারে না। তার একটি অপূর্ণ সাধ পূরণ করতে পারছে না সে। সেই অপরাধ তাকে এই একটা বছর ধরে দংশন করে আসছে। কিন্তু, তন্নতন্ন করে খুঁজেও, কোনও একটা কিতাবে মেয়েদের সম্পর্কে একটা ভালো কথাও তার নজরে পড়েনি। বরঞ্চ যতই বইয়ের পাত উল্টিয়েছে মেয়েদের সম্পর্কে আরও মারাত্মক খারাপ খারাপ উক্তি সে পড়েছে। তাদের মতো ভ্বষ্টা, নষ্ট চরিত্রা, নির্বোধি, বিশ্বাসঘাতিকা, ছলনাময়ী প্রাণী বিশ্ব সংসারে আর কিছু নাই। কামার আল-জামান-এর ধারণা দিন দিন বদ্ধমূল হতে থাকে। কোন নারীর সঙ্গে জীবনের গাঁটছড়া বাঁধার আগে তার যেন মৃত্যু হয়, এই তার আল্লাহর কাছে একমাত্র প্রার্থনা।
আব্বাজান, আমি অনেক ভেবে দেখলাম, আপনার সাধ আমি কিছুতেই পূরণ করতে পারবো না। এই একটা বছরে আমি আরও নানা কিতাব পড়েছি। যতই পড়ছি, বিশ্বাস করুন, মেয়েদের সম্পর্কে ধারণা আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। দুনিয়াতে যত খারাপ কাজ আছে তার
সুলতান শাহরিমান বুঝলেন, পুত্র এখন ঘোরে রয়েছে। তাকে বোঝানো বিষম দায়। সময়ে সবই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এখন জোর করে বোঝাতে গেলে হিন্তে-বিপরীত হতে পারে।
মনের দুঃখ কিছুটা হাল্কা করার জন্য উজিরকে ডেকে বললেন, দেখো উজির, আমি ভেবে দেখেছি, মানুষের চাওয়ার লোষ নাই। আমি যখন নিঃসন্তান ছিলাম তখন আল্লাহর কাছে আমার একমাত্র প্রার্থনা ছিলো, আল্লাহ আমাকে একটি পুত্র সন্তান দাও। আর কিছু বাসনা নাই আমার। তিনি আমার প্রার্থনা পূরণ করলেন। একটা চাঁদের মতো ছেলে দিলেন। আজ কিন্তু আমি তাতেই সন্তুষ্ট নই-আজ আমার সাধ একটি নাতির। কিন্তু জামান ঘোরতর নারী বিদ্বেষী। এক বছর। আগে যা ছিল এখন তার থেকেও আরও এক কাঠি বেশি। ভারি ভারি কিতাব পড়ে ওর দিন দিন মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মেয়েদের নামই সে কানে শুনতে চায় না। এখন কি করা যায় বলতো? অনেকক্ষণ একথার কোনও জবাব দিতে পারে না। উজির। তন্ময় হয়ে ভাবতে থাকে। তাইতো বড় কঠিন সমস্যা।
জাঁহাপনা, উজির বলে, আপনি মেহেরবানী করে আরও একটা বছর ধৈর্য ধরে থাকুন। তারপর একদিন আচমকা তাকে দরবারে ডেকে পাঠাবেন। সেখানে উপস্থিত আমির ওমরাহ-গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সামনে আপনি ঘোষণা করে দেবেন, কামার আল-জামানের শাদীর দিন পাকা করে ফেলেছেন।
কিন্তু উজির, ছেলে যেমন এক রোখা, এতে কি ফল ভালো হবে?
হবে জাঁহাপনা, হবে। আমজিনি জামানের মতো বিনয়ী ভদ্র নম্র এবং পিতৃভক্ত পুত্র খুব বড় একটা হয় না। আপনি পাঁচজন গণ্যমান্য ব্যক্তির কাছে খেলো হয়ে যাবেন, আপনার কথার কোনও দাম থাকবে না তেমন বেয়াদপি সে কখনও করতে পারবে না। আমি তার স্বভাব চরিত্র খুব ভালো করে জানি, হুজুর। অমন চরিত্রবান ছেলে আমার জিন্দগীতে দেখিনি।
এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
একশো বাহাত্তরতম রজনীতে আবার সে শুরু করে :
উজিরের পরামর্শে সুলতান শাহরিমান উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন।তুমি ঠিক বলেছ, উজির। সে আমাকে ভক্তি করে, ভালোবাসে। আমার ইজৎ নষ্ট হতে পারে এমন কাজ সে কখনও করতে পারে নাএকথা আমি জানি। যদি প্রকাশ্য দরবারে দশজন সম্রাস্ত মানুষের সামনে আমি বড় মুখ করে ঘোষণা করি, শাহজাদা জামানের শাদীর ব্যবস্থা পাকা করেছি। তাহলে তার অনিচ্ছা! থাকলেও, আমার মুখরক্ষা করার জন্যও সে না করতে পারবে না। তুমি ঠিকই বলেছে, উজির। তোমার বুদ্ধির তারিফ না করে পারছি না। তোমার মতো বিদ্বান বিচক্ষণ উজির পেয়ে আমি গর্বিত। এই নাও তোমার পুরস্কার।
শাহরিমান তাঁর কণ্ঠ থেকে মহামূল্যবান মণিমুক্তা খচিত রত্নহার খুলে উজিরের হাতে তুলে দিলেন। উজির দ্বিধা ভরে হাত পেতে নিতে নিতে অবাক হয়ে বললো, যে অমূল্য রত্নহার, জাঁহাপনা।
তোমার পরামর্শ মূল্য দিয়ে যাচাই করা যায় না, উজির। আমি খুশি হয়ে দিলাম। তুমিও মনে কোনও সংশয় রেখো না।
এরপর আরও একটা বছর কেটে গেলো। একদিন পূর্ণ দরবার কক্ষে কামার আল-জামানকে ডেকে পাঠালেন শাহরিমান। পিতৃভক্ত পুত্র যথাবিহিত কুর্নিশ জানিয়ে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো। জামানের রূপের আলোয় যেন দরবার কক্ষ আরও বেশি আলোকিত হয়ে উঠলো। আমির ওমরাহ। অভ্যাগতদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন উঠলোআহা, আল্লাহ কি ভাবেই গড়েছেন? আসমানের চাঁদও হার মেনে যায়।
শোনো বাবা, সুলতান শাহরিমান ধীরে ধীরে বলেন, আমি তোমার শাদীর ব্যবস্থা করছি। আমি বুড়ো হয়েছি। কবে আছি কবে নাই, তাই যাবার আগে তোমাকে শাদী দিয়ে যেতে চাই। আজ এখানে শহরের সম্রান্ত আমির ওমরাহরা আছেন। তাদের সামনে ঘোষণা করছি, যত সত্বর সম্ভব আমি তোমার শাদী দেব।
কামার আল-জামান এতক্ষণ বিনয়াবনত সুবোধ বালকের মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো। সুলতানের কথায় সে লাঠি খাওয়া ক্রুদ্ধ সাপের মতো ফণা তুলে ধরলো। চোয়ালের হাড় শক্ত হয়ে উঠলো। রোষ কষায়িত বিস্ফারিত চোখে সে সুলতানের দিকে উদ্ধতভাবে চেয়ে রইলো। মুখে কোনও ভাষা নাই। চোখে তার অগ্নিঝরা প্রতিবাদ।
উপস্থিত আমির ওমরাহ। অভ্যাগতরা মাথা নিচু করে বসে রইলো। সুলতান গর্জে উঠলেন।আমার অবাধ্য! এতবড় স্পর্ধা! এই-কে আছিস, ওকে বাধ। বেঁধে নিয়ে গিয়ে পাশের পোড়ো বাড়িটার চিলেকোঠার ঘরে বন্ধ করে রেখে দে।
সুলতানের হুকুম। সঙ্গে সঙ্গে শাহজাদাকে বেঁধে প্রহরীরা নিয়ে গেলো পোড়ো বাড়ির চিলে কোঠায়। অন্ধকার ঘরে বন্ধ করে তারা দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। যদি শাহজাদা কিছু বলেন এই প্রত্যাশায় উৎকৰ্ণ হয়ে রইলো তারা। কিন্তু না, কামার আল-জামান কোন সাড়াশব্দ করলো না। অন্ধকার ঘরের এক কোণে বসে ভাবতে লাগলো; - বরং ভালো হয়েছে। বাবার কথায় যদি সুবোধ বালকের মতো সে সায় দিত সে- হতো তার অপমৃত্যু। আজ এই জীর্ণবাড়ির অন্ধকার চিলেকোঠায় আমাকে বন্দী করে সুলতান আর একবার প্রমাণ করলেন, দুনিয়াতে যত অঘটন ঘটেছে তার মূলে সেই নারী।
শোক-কাতর অবসন্ন মনে সুলতান শাহরিমান প্রাসাদে নিজের শয়নকক্ষে ফিরে গেলেন। প্ৰাণাধিক একমাত্র পুত্র আজ তারই হুকুমে কারারুদ্ধ। অথচ এই পুত্র লাভের আকুতি তাকে একদিন পাগল করে তুলেছিলো। দুহাতে মুখ ঢেকে শিশুর মতো ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলেন। অপত্য স্নেহ একসময় পুত্রের সব গুনাহ মাফ করে দিলো। সুলতান ভাবলেন, তার কি দোষ? সে তো তাকে একাধিকবার তার মনের কথা খুলে বলেছে। অবস্থায়, ছেলে বড় হয়েছে, জোর করে তার ওপর কিছু চাপিয়ে দিতে যাওয়াই অন্যায়। জন্যে তার তো কোনও অপরাধ নাই। যত নষ্টের গোড়া উজির। তার বাজে পরামর্শ নিতে গিয়েই যত অনৰ্থ ঘটলো। যতই ভাবেন তিনি, সমস্ত আক্রোশ গিয়ে পড়তে থাকে উজিরের উপর। উজিরকে ডেকে পাঠালেন। শাহরিমান।
তুমিই এর জন্যে একমাত্র দায়ী, উজির। তোমার বদ পরামর্শ নিয়েই আমার মান-ইজৎ সব গেলো। একমাত্র পুত্রকে আমি কয়েদ করলামসবই তোমার অপরিণামদৰ্শিতায়।যাক এখন উপায় বাতিলাও, কিভাবে এর সমাধান হতে পারে। তুমি তো জানো উজির, আমার বুকের কলিজা একমাত্র পুত্র সে। তাকে এইভাবে কষ্ট দিয়ে আমি কি করে বাঁচবো?
উজির করজোড়ে বলে, হুজুর। অধমের কথা শুনুন, ধৈর্য ধরে পনেরোটা দিন আপনি চুপচাপ থাকুন।
-কী বললে? পনেরো দিন? পনেরো দিন ধরে সে নোংরা অন্ধকার ঘরে পচবে?
না হুজুর, পচবে কেন, তার সব ব্যবস্থাই আমি করে দিয়েছি।
একথা শুনে শাহরিমান-এর মুখ কঠিন হয়ে ওঠে।কী ব্যবস্থা করে দিয়েছ। কার হুকুমে? তোমার আমি গর্দান নেবো।
হুজুরের ইচ্ছা। যেদিন হুজুরের দরবারে চাকরী নিয়েছি সেইদিন জানি কবুল করেছি। জাঁহাপনার যদি তাই অভিপ্ৰায় হয় নিতে পারেন আমার গর্দান। কিন্তু সুলতানের কোনও ইজৎহানি হয় তেমন কোনও কাজ আমি করিনি। করতে পারি না। শাহজাদা আপনার যেমন পরম পেয়ারের আমাদেরও কি কম আদরের? আপনার সালতানিয়তের প্রতিটি মানুষ তাকে বড় ভালোবাসে। সে- আমাদের একমাত্র আশা ভরসা। ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী। এই কারণে, যদি কোনও প্রহরী শাহজাদার কষ্টে কাতর হয়ে তার সুখস্বাচ্ছন্দ্যের একটু ব্যবস্থা করে থাকে। তবে কি সুলতান তাদের সে গুণাহ উপেক্ষার চোখে এডিয়ে যেতে পারেন না?
উজির, সত্যিই তোমার বুদ্ধির তুলনা নাই। কিন্তু সাবধান এসব কথা আমি জানি তা যেন তোমার প্রহরীরাও জানতে না পারে।
আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন জাঁহাপনা, শাহজাদা জানেন না, আমার হুকুমে প্রহরীরা তার থাকা খাওয়ার আমন সুন্দর ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তার ধারণা প্রহরীরা ভালোবেসে সবারই অলক্ষ্যে এসব করছে। তারা তাকে - শুনিয়ে দিয়েছে, সুলতান জানতে পারলে তাদের হয়তো গর্দান যাবে। তা যাক। কিন্তু তাই বলে তাদের শাহজাদাকে এইভাবে তারা কষ্টে রাখতে পারবে না।
সুলতান শাহরিমান শুনে খুশি হয়। বলেন, কিন্তু পনেরো দিন তার আদর্শন আমি কেমন করে সইবো? তাকে পাশে না পেলে যে আমি ঘুমাতে পারি না, উজির।
উজির বলে, এছাড়া কোনও উপায় নাই, জাঁহাপনা। এই পনেরোটা দিন আপনাকে কষ্ট করে থাকতেই হবে। তারপর দেখবেন, শাহজাদা আপনার কত বাধ্য হয়ে গেছে। শাদীতে আর সে অমত করবে না।
সুলতান সবই বুঝলেন জামান-এর সুখ-স্বাচ্ছন্দোর কোনও ত্রুটি হবে না তা সত্ত্বেও সে রাতে তিনি ভালো করে ঘুমাতে পারলেন না। পালঙ্কে শুয়ে শুধু বার বার জামানের শূন্য শয্যার দিকেই নজর চলে যায়। বুকের মধ্যে কেমন হু হু করতে থাকে। রাত্রির প্রহর বাড়ে। সুলতান ঘরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত অবধি পায়চারি করতে থাকেন। ঘুম আর আসে না।
ওদিকে কামার আল-জামান রাতের খানাপিনা শেষ করে। বইপত্র নিয়ে বসে। অনেক রাত অবধি একমনে পড়াশুনা করে শুতে যাবার আগে রোজ-এর অভ্যাসমতো হাত মুখ ধুয়ে রুজু করে কোরানের কয়েক পাতা সুর করে পড়ে। পাঠ শেষ হলে গায়ের একটি মাত্র কামিজ ছাড়া পরনের সব সাজপোশাক খুলে ফেশেয্যায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। আর শোয়ামাত্র গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
তারপর যেসব ঘটনা ঘটলো সেগুলো স্বপ্ন না। সত্যি তা কে বলতে পারে?
এইসময় রজনী শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
[এর আগের তিনটি রজনী মাত্র কয়েকটি ছত্রে শেষ করেছেন ডঃ মারদ্রুস। এখানে সেই কয়েক ছত্রের জন্য আলাদাভাবে সেই রাজনী-ত্বয়ের উল্লেখ করলাম না। এতে গল্পের গতি ব্যাহত হতো মাত্র। এরপরে এই ধরনের বর্জন উল্লেখ করে জানানো হবে না-অনুবাদক]
এরপর একশো ছিয়াত্তরতম রজনী :
দ্বিতীয় প্রহরে আবার কাহিনীর সূত্রপআত হয়। শাহরাজাদ বলতে থাকে।
যে পোড়ো বাড়িটার চিলেকোঠায় কামার আল-জামান গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলো সেই ধ্বংসস্তুপ সদৃশ জরাজীর্ণ পোড়ো প্রাসাদটা এক সময়ে খুব রমরমা চেহারার ছিলো। সে অতি প্রাচীনকালের কথা। রোম তখন দুনিয়ার সেরা শহর। তখন সব রাস্তাই রোমে গিয়ে মিশেছিলো। সব মানুষই রোম-যাত্রী। এই ভাঙা প্রাসাদ সেই আমলের। তখনকার সুলতান বাদশাহের সুখের আধার ছিলো এই প্রাসাদ। কালের হাতছানিতে আজ শুধু দাঁত বের করাইটের পাজ ছাড়া আর কোন বাহারই অবশিষ্ট নাই।
এই ভাঙা প্রাসাদের পিছনে একটা বিশাল কূপ আছে। সেই কূপে বাস করে এক যুবতী জিনি। ইবলিসের বংশধর মাইমুনাহ। মাইমুনাহর বাবা সাবটেরা নিয়ানের বাদশাহ জিন দিমিরিয়াৎ। তার অমিত শৌর্যবীর্যের অলৌকিক কাহিনী বিশ্ববিশ্রুত।
মাঝরাতে মাইমুনোহ কুপ থেকে বেরিয়ে আকাশে ওড়ে। এই তার প্রতিদিনের অভ্যাস। উড়তে উড়তে সে প্রথমে মহাশূন্যে উঠে যায়। তারপর ঠিক করে কোনদিকে কোথায় যাবে।
সেদিন রাতেও সে যথা নিয়মে কূপ থেকে বেরিয়ে উপরে উঠছে হঠাৎ আশ্চর্য হয়ে দেখলো, চিলেকোঠার ঘরে আলো জুলছে। জন্মাবধি এতকালের মধ্যে এমন অভূতপূর্ব দৃশ্য সে কখনও প্রত্যক্ষ করেনি। এইরকম জনমানব পরিত্যক্ত একটা পোড়ো বাড়িতে কেউ কখনও পদার্পণ করে না। আজ হঠাৎ এখানে মানুষ কি করে এলো? জিনি ভাবলো, এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনও গূঢ় রহস্য আছে। ব্যাপারটা কি দেখতে হবে। চিলেকোঠার ঘরের জানোলা দিয়ে সে ভিতরে ঢুকে পড়লো।
চাঁদের মতো ফুটফুটে সুন্দর কামার আল-জামানের অর্ধ উলঙ্গ দেহটার দিকে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকে জিনি। এত রূপ কোনও পুরুষ মানুষের হয়। তার দেহমানে এক অজানা আনন্দের শিহরণ লাগে। পা টিপে টিপে সে জামানের পালঙ্কের পাশে যায়। অপলক চোখে তাকে প্ৰাণ ভরে দেখতে থাকে। এইভাবে প্রায় এক ঘণ্টা কেটে যায়। কিন্তু জিনির আর দেখে দেখে আশ মেটে না। আশ মেটে না। আল্লাহর এই অতুলনীয় সৃষ্টির কথা স্মরণ করে শ্রদ্ধার মাথা নত হয়ে আসে। দুচোখ জলে ভরে যায়। ভাবে, এমন খোদার আশীর্বাদকে এইভাবে নির্বািসন দিয়েছে কোন পাষাণ হৃদয় বাবা-মা। কি তার এমন অপরাধ-যার জন্য তাকে বন্দী করে রেখেছে। এই রুদ্ধ কয়েদখানায়? তারা কি জানে না এটা শয়তান আফ্রিদি দানবের আস্তানা? একবার তাদের কারো নজরে পড়লে ছেলেটাকে কি তারা আস্ত রাখবে? যাইহোক, অন্য কোন জিন যাতে এর কোন অনিষ্ট না করতে পারে তা আমাকে দেখতেই হবে।
জামানের কপালে মুখটা নামিয়ে আলতোভাবে একটু চুমু দিলো জিনি। তারপর জানালা দিয়ে বেরিয়ে আকাশের ওপরে উঠে গেলো। যেখানে সাদা মেঘের পেজার হালকা হাওয়ার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে সেখানে উঠে গিয়ে ডানা মেলে ভেসে বেড়াতে থাকে সে।
একটুক্ষণ পরে পাখার ঝটপটানি আর বিকট কর্কশ আওয়াজে সে সজাগ হয়ে এদিক ওদিক চায়। একটা বিশাল দৈত্য তার দিকেই উড়ে আসছে। আরও একটু কাছে আসতেই চিনতে পারে-আফ্রিদি দানাশ। একটা শয়তান দৈত্য। ব্যাটা সর্বশক্তিমান শাহেনশাহ সুলেমানের বশ্যতা স্বীকার করে না। পয়লা নম্বরের নাস্তিক। এর বাবা সামহারিস সবচেয়ে দ্রুতগামী জিন বলে। পরিচিত।
মাইমুনাহর আশঙ্কা জাগে, যদি পোড়ো প্রাসাদের চিলেকোঠার দিকে ওর নজর পড়ে? সুতরাং আর অপেক্ষা না করে শোঁ করে অনেকটা নিচে নেমে এসে একেবারে দানাশের মুখোমুখি থামে। ইচ্ছে ছিলো পাখার একবাড়ি মেয়ে একেবারে ধরাশায়ী করে দেবে তাকে। কিন্তু দানাশ বোধহয় বুঝতে পেরেছিলো। মাথার উপরে মাইমুনাহকে শোঁ শো করে নামতে দেখে চিৎকার করে ওঠে সে।
শোনো, শাহজাদী মাইমুনাহ, আমি দানাশ! শাহেনশাহ সুলেমান আমার রক্ষা কর্তা, দোহাই তোমরা আমাকে মেরো না। সুলেমান তোমার ভালো করবেন।
মাইমুনাহ মনে মনে হাসেভূতের মুখে রাম নাম। এখন ব্যাটা বেকায়দায় পড়েছে আমনি সুলেমান ওর রক্ষা কর্তা হয়ে গেলো। অন্য সময় সে সুলেমানকে মানতেই চায় না। এত বড় আহাম্মক। দানাশ বলে, তুমি আমাকে মেরো না মাইমুন্নাহ। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, তোমার কোনও অনিষ্ট করবো না।
ঠিক বলেছে, আমি তোমাকে ছেড়ে দিতে পারি, একটা শর্তে। সত্যি করে বলো, তুমি কোথা থেকে আসছে? আর এত দেরিই বা কেন? এখন তোমার মনের মধ্যে কি শয়তানীই বা উকি ঝুঁকি দিচ্ছে। ঠিক ঠিক সাচ্চা বাৎ বলবে। আমার সঙ্গে বেগড়বাই করলে তোমাকে আমি জ্য।অন্ত রাখবো না। পাখা ছিঁড়ে খুঁড়ে দেব। আঁচড়ে গায়ের ছাল চামড়া খুলে নেবো। আর এমন গোত্তা মারবো-পিঠের শিরদাঁড়া ভেঙে গুড়িয়ে যাবে। তোমার কোনও বাবা রক্ষা করতে আসবে না। এখানে।
দানাশ জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে, কি যে বলো সুন্দরী, তোমার কাছে আমি মিথ্যে বলতে পারি। আর বলবো বা কেন? যাক ওসব কথা, তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে বেশ ভালোই হলো। আজ যে কি মজার কাণ্ড কারখানা হয়েছে, বলছি শোনো। কিন্তু তার আগে আমাকে কথা দাও, আমার কিসসা শোনার পর তুমি যদি খুশি হওআমাকে যেখানে খুশি চলে যেতে দেবে? মাইমুনাহ অধৈর্য হয়ে বলে, আমি সুলেমানের নামে হলফ করে বলছি জলে স্থলে অন্তরীক্ষে যেখানে খুশি তুমি যেও, আমি কোনও বাধা দেব না, নাও এবার তোমার কাহিনী শুরু করে।
আমি সুদূর চীনের পশ্চিম অঞ্চল থেকে উড়ে আসছি। তুমি হয়তো শুনে থাকবে, প্রবল পরাক্রান্ত সম্রাট ঘায়ুরের সাম্রাজ্য সেটা। তার দাপটে কত বড় বড় সাম্রাজ্যের পতন হয়েছে তার ইয়ত্তা নাই। তার সেনাবাহিনীর মেয়েরা সবাই পরমা সুন্দরী-হুরীর মতো। স্নানের পরে তাদের দেহ থেকে ফুলের খুশবু ছড়িয়ে পড়ে সারা ঘরে। সেই সম্রাট ঘায়ুরের একটি মাত্র কন্যা বদর। তার রূপের বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। তবু যদি শুনতে চাও, আমার সাধ্যমতো বর্ণনা দিতে চেষ্টা করবো।
তার আজানুলম্বিত কালো চুলের সঙ্গে বুঝিবা একমাত্র নিরন্তর নির্বান ঝরনারই তুলনা চলে। তার মুখের সৌন্দর্যের বর্ণনা আর কি করে দিই! শুধু বলতে পারি। আশমানের চাঁদ যদি তার মুখের মতো সুন্দর হতে পারতো-ধন্য হতো সে। হরিণীর মতো তার কাজল কালো চোখের তারায় আমি ঘন নীল অতল সমুদ্রের গভীরতা প্রত্যক্ষ করেছি। তার পাকা আঙুরের মতো দুটি ঠোঁট, মর্যালের মতো গ্ৰীবা, সুডৌল স্তন, ক্ষীণ কাটি, ভারি নিতম্ব, নিরাসক্ত পুরুষের বুকেও ঝড় তুলতে পারে।
সম্রাট ঘায়ুর তার মেয়েকে প্ৰাণাধিক ভালোবাসে। তার মুখে হাসি ফোটাবার জন্য ঘায়ুরের চেষ্টার অন্ত নাই। কিছুদিন আগে মেয়ের জন্য সে সাতখানা সাতমহলা আজব প্রাসাদ বানিয়ে দিয়েছে। একখানা প্রাসাদ আগাগোড়া স্ফটিকের তৈরি। দ্বিতীয়খানা দুধের মতো চকমিলানো অ্যালাব্যাসটারের তৈরি। তৃতীয় প্রাসাদ পুরোটাই চীনে মাটিতে গড়া। চতুৰ্থখানা বাহারী রঙের মার্বেল পার্থ দিয়ে তৈরি করেছে সে। পঞ্চমখানা রূপে, ষষ্ঠখানা সোনা আর সপ্তম প্রাসাদখানা তৈরি করা হয়েছে হীরে দিয়ে। প্রত্যেকটি প্রাসাদ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। কি তাদের গড়ন আর কি তাদের কারুকর্ম। দুনিয়ার সেরা কারিগর দিয়ে বানিয়ে দিয়েছে সম্রাট ঘায়ুর। শুধু মেয়ের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য। সম্রাটের ইচ্ছা প্রত্যেকটি প্রাসাদে বদর একটি করে বছর কাটাবে। প্রত্যেক বছরে নতুন নতুন প্রাসাদে বাস করলে তারা মনে একঘেয়েমির ছাপ পড়বে না। সদা সর্বদা হাসি খুশি উৎফুল্ল হয়ে থাকবে সে।
প্রাসাদের মনোরম পরিবেশে আমি তাকে দেখেছি। তুমি কি বিশ্বাস করবে তাকে দেখার পর থেকেই আমার মাথাটা কেমন বিগড়ে গেছে।
দেশ বিদেশের রাজা বাদশাহরা এসেছিলো তার পাণি প্রার্থনা করতে। সম্রাট ঘায়ুর চেয়েছিলেদা মেয়ে তার পছন্দ মতো পাত্ব বেছে নিক। কিন্তু বদর কারো দিকে ফিরেও তাকায় নি। তার এক কথাঃ আমি নিজেই আমার রানী। ভারতের সূক্ষ্ম মসলিনের স্পর্শেই যে কাতর হয়ে পড়ে সেই কুসুমাদপি কোমল এই তনু কি করে একটা পুরুষের দৌরাত্ম্য সহ্য করবে, বাবা? না, তুমি ওদের বিদেয় করে দাও। আমি কোনও পুরুষের প্রভুত্ব সহ্য করতে পারবো না।
সম্রাট ঘায়ুর মেয়েকে অখুশি করার কথা ভাবতেই পারে না। সে যা পছন্দ করে না তা কিছুতেই তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চায় না সে।
একবার এক পরাক্রমশালী সম্রাট লক্ষ লক্ষ মোহরের উপহার উপটৌকন পাঠিয়ে সম্রাট ঘায়ুরের কাছে প্রস্তাব পেশ করলে, সে তার কন্যার পাণিপ্রার্থী।
সম্রাট ঘায়ুর মেয়েকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলো। এই সম্রাটের রানী হলে তার মর্যাদার হানি হবে না। কারণ ঘামুরের মতো তারও জগৎজোড়া নাম।
কিন্তু এত বোঝানোর ফল হলো উল্টো। বদর রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো, বাবা তুমি যেভাবে আমাকে নির্যাতন করছে তাতে আর আমি জীবন রাখতে চাই না। এক্ষুণি তরবারির এক কোপে নিজেকে আমি শেষ করে দেব।
বাবা শিউড়ে উঠলো। সে কি মা! কথা কি মুখে আনতে আছে? থাক, ওসব কথা আর মুখে আনবো না আমি। তোমার যখন একান্তই ইচ্ছা নয়, আমি আর তোমাকে বিরক্ত করবো না, মা। কিন্তু দোহাই বেটা, রাগের মাথায় যা তা কিছু করে বসে না।
আফ্রিদি দানাশ বললো, শুনলে তো মাইমুন্নাহ। আমি নিজের চোখে দেখে এসেছিসেই মেয়েকে। চলো, তুমিও দেখে আসবে সেই ডানাকাটা হুরীকে।
এই সময় রজনী অতিক্রান্ত হচ্ছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
মাইমুনাহ এতক্ষণ চুপচাপদানাশের কাহিনী শুনছিল। দানাশ থামলে সে হো হো করে হাসতে হাসতে বললো, একটা মেয়ের রূপেই তুমি মজে গেছ! কি করে ভাবলে তার মতো সুন্দর আর হয় না? তুমি দেখোনি বলে? আমি যে শাহজাদাকে ভালোবেসেছি তাকে যদি দেখতে তাহলে আর তোমার এই উচ্ছাসের ফুলঝুরি মুখ দিয়ে বেরুতো না।
দানাশ বললো, তা হতে পারে। কিন্তু তোমার ভালোবাসাকে তো আমি দেখিনি। যাই হোক, তোমার যদি আপত্তি না থাকে চলো তাকে একবার দেখে নয়ন সার্থক করে আসি। তবে নিজে চোখে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতে রাজিনই যে, আমার রাজকুমারীর চেয়েও সুন্দর কেউ হতে পারে।
মাইমুনাহ রেগে ওঠে, চুপ করো। যাকে চোখে দেখিনি সে বড় সুন্দরী। অমন চোেখ ঝলসানো রূপ আমি ঢের দেখেছি। আমি বাজি রেখে বলতে পারি, আমার ভালোবাসার নখের যুগ্য হবে না। তোমার সেই রাজকুমারী। তার রূপ দেখেই যদি তোমার মাথা বিগড়ে গিয়ে থাকে। তবে আর আমার ভালোবাসাকে দেখে কাজ নাই। একবার তাকে চোখে দেখলেই তুমি ভিরমি খেয়ে পড়ে যাবে।আর চৈতন্য ফিরবে না। কেন বেঘোরে প্রাণটা হারাবে, থাক, তাকে আর চোখে দেখে তোমার কাজ নাই।
দানাশ বলে, কিন্তু কে সে? কোথায় থাকে?
মাইমুনাহ বলে, সে এই বাদশাহর ছেলে। আমি যে কুপে বাস করি তার পাশে যে ভাঙা প্রাসাদতারই চিলেকোঠার ঘরে সে এখন বন্দী হয়ে আছে। সাবধান, কক্ষণো তুমি এক যাবে না সেখানে। যদি দেখতে চাও আমি তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি। তোমার মতো শয়তানকে আমি এক ফোঁটা বিশ্বাস করি না। সুন্দর ছেলে দেখলেই তার সর্বনাশ করতে তোমরা ওস্তাদ।
আহা, অত্য চটছে কেন সুন্দরী। একবার যখন বলেছে সে তোমার ভালোবাসা, আমি তার অনিষ্ট করতে পারি? আমি কসম খেয়ে বলছি, একা সেখানে কখনো যাবো না। তবে তাকে একবার দেখতে চাই-কেমন সে সুন্দর। তা তোমার সঙ্গেই যাবো। দূর থেকে এক পলক দেখবো মাত্র।
মাইমুনাহ বলে, নিয়ে যেতে পারি একটা শর্তে। তাকে দেখে যদি তোমার মনে হয়। সত্যি সে তোমার রাজকুমারীর চেয়ে সুন্দর তা হলে আমাকে পেট পুরে ভালো মন্দ খাওয়াতে হবে। আর তোমার রাজকুমারী যদি আমার শাহজাদার চেয়ে বেশি সুন্দর হয়, আমি তোমাকে খাওয়াবো-যা চাইবে।
দানাশ আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, চমৎকার! ঠিক আছে, তাই হবে। তাহলে চলো, আগে আমার রাজকুমারী বন্দরকে দেখিয়ে নিয়ে আসি
মাইমুনাহ বাধা দিয়ে বলে, আমার শাহজাদা তো নিচে ভাঙা প্রাসাদের চিলেকোঠার ঘরেই শুয়ে আছে। এখান থেকে সোজা নেমে গেলেই তাকে দেখতে পাবে। এক পলকের ব্যাপার। আগে চলো তাকে দেখিয়ে নিয়ে আসি। তারপর যাওয়া যাবে তোমার রাজকুমারীর দেশে। সেখানে যেতে তো রাত কাবার হয়ে যাবে।
ওরা দুজনে কামার আল-জামানের ঘরে ঢুকে পড়লো।
মাইমুনাহ ফিস ফিস করে দানাশের কানে কানে বলে, খুব সাবধান, কোনও শব্দ করবে না। তোমার যা বাজাখাই স্বভাব, এখুনি হয়তো খ্যা খ্যা করে উঠবে। তা হলে ওর ঘুম ভেঙে যাবে।
দানাশ একভাবে চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে। এমন নিখুঁত দেহসৌষ্ঠব সে কোন মানুষের কখনও দেখেনি।
মাইমুনাহ বিরক্ত হয়ে বলে, অমন হাঁ করে দেখছ কী?
দানাশের তন্ময়তা কাটে, সত্যি, এমন অপরূপ সুন্দর ছেলে আমি আর কোথাও দেখিনি, মাইমুনাহ। দেখে নয়ন সার্থক হয়ে গেলো। নাঃ, আমি হেরে গেলাম তোমার কাছে। রূপের কোনও জুড়ি নাই। বেহেস্তেও আছে কি না সন্দেহ। আমার রাজকুমারী দুনিয়ার সেরা সুন্দরী বলে তোমার কাছে বড়াই করেছিলাম। কিন্তু সে দম্ভ আমার ভেঙে দিলে। কিন্তু এত প্রশংসা করেও একটা কথা ভয়ে ভয়ে বলবো। যাই বলো এত রূপ কোনও পুরুষ মানুষের মানায় না। আল্লাহ বোধ হয় মেয়ে গড়তে গড়তে হঠাৎ ভুল করে ছেলে বানিয়ে দিয়েছেন। দেখছি না, ওর সারা দেহটায় কেমন মেয়েলী ছাপ-একেবারে বদর-এর মতন।
দানাশের মুখের কথা মুখেই রয়ে গেলো, মাইমুনাহ দানাশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রচণ্ড জোরে পাখারবাড়ি মারলো। দানাশের একটা শিং ভেঙে পড়ে গেলো। মাইমুনাহ রাগে থর থর কাঁপতে থাকে, শয়তান বদমাইশ, বেল্লিক, যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা! তুই তো তুই, তোর বাপ-ঠাকুরদা-চোঁদপুরুষের কেউ কখনও দেখেছে এমন রূপবান পুরুষ? ভাগ হতচ্ছাড়া, প্ৰাণে যদি বাঁচতে চাস, এক্ষুণি বেরিয়ে যা এখান থেকে। না হলে তোকে আমি তুলে আছাড় মারবো।
দানাশ ভয়ে জড়সড় হয়ে গেছে। গুটি গুটি জানলার দিকে এগিয়ে যায়। মাইমুনাহ হুকুমের স্বরে বলে, এক্ষুণি সোজা চলে যা তোর রাজকুমার বদর-এর কাছে। আজ রাতেই তাকে এখানে নিয়ে আসা চাই। আমি শাহজাদার সঙ্গে মিলিয়ে দেখবো সে কেমন সুন্দরী? আর তার মেয়েলী শরীরের সঙ্গে শাহজাদার শরীরেরই বা কতটুকু মিল আছে আমার দেখা দরকার। আমার হুকুম তামিল না করিস, এইরাতেই যদি বদরকে এখানে না আনিস তোর কপালে অনেক দুঃখ। তোকে আমি কেটে টুকরো টুকরো করে শেয়াল শকুন দিয়ে খাওয়াবো মনে থাকে যেন!
দানাশ কোনও কথা না বলে ঘাড় নেড়ে জানোলা দিয়ে বেরিয়ে গেলো। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে সে ফিরে আসে। পিঠের ওপর ঘুমন্ত রাজকুমারী বন্দর। ফিনফিনে পাতলা একটিমাত্র শেমিজ ছাড়া তার পরণে অন্য কোনও পোশাক নাই। প্রায় কঁচের মতো স্বচ্ছ শেমিজটার নিচে ধবধবে ফর্সা দেহখানা আয়নার মতো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। ঘরের মধ্যে ঢুকতেই দানাশকে লক্ষ্য করে মাইমুনাহ কটাক্ষ করে বলে, কি রে হতচ্ছাড়া এত দেরি কেন? এই খালিদান থেকে চীনে যেতে আসতে কতটুকু সময় লাগে? না, রাজকুমারীর ন্যাংটো শরীর দেখে আর ঠিক থাকতে পারিস নি? পথের মাঝে কোথাও ঝোপ জঙ্গলে নামিয়েছিলি বুঝি? যাগ গে, এখন শাহজাদার যেন ঘুম না ভাঙে।
থেকে খুলে নিলো। মাইমুনাহ অপলকভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলো। নাঃ, কোথাও কোনও খুঁত ধরা গেলো না। বরং দানাশ যা রূপের বর্ণনা দিয়েছিলো আসলে সে তার চেয়ে ঢের-ঢের বেশি সুন্দরী। শাহজাদার সঙ্গে রাজকুমারীর অঙ্গ সৌষ্ঠবের তফাৎ কিছুই নাই। মনে হয়, ওরা যেন একই ছাঁচে গড়াযমজ। দুজনেরই মুখের সুরৎ একই রকম অনন্যসাধারণঅপূর্ব সুন্দর।
মাইমুনাহ বললো, হাঁ, স্বীকার করতেই হয় তোমার রাজকুমারী কিছু কম সুন্দরী না। দুজনের মধ্যে কে বেশি সুন্দর নিয়ে তর্ক করা যেতে পারে। আমি বলবো, আমার শাহজাদা বেশি সুন্দর। আর তুমি বলতে পারো তোমার রাজকুমারীই বেশি সুন্দরী। তর্কের মীমাংসা হতে পারে না। কিন্তু তুমি যে একটা ডাহা মিথ্যে কথা বলেছি তা তো প্রমাণ হয়ে গেলো। আমার শাহজাদার শরীরে যে আদৌ মেয়েলী ছাপ নাই। তা তো এখন দেখতে পোচ্ছ? আর তা ছাড়া মেয়েদের সারা শরীর জুড়ে থাকে কামের ছাপ। ওই দেখো, ওর বুক, ওর কোমর, পাছা, যেখানে দেখবে, শরী চনমান করে উঠবে। আপনা থেকেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে বাঃ কিন্তু সত্যিই বাঃ বলার নিখুঁত কিনা সেটা কেউ খুটিয়ে দেখতে পারে? নিরুত্তাপ নিষ্কাম চিত্তে যদি বিচার করো আমার শাহজাদাই প্রথম পুরস্কার পাবে কি বলো?
দেখ মাইমুনাহ, নিয়ে তোমার সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ করতে চাই না। তুমি যদি খুশি হও, আমি মনের কথা চেপে তোমাকে খুশি কোরর জন্যে না হয় মিথ্যেটাই মেনে নিলাম।
কী, এত বড় কথা, আমি মিথ্যে বলছি।
আহা-হা অত্য চটছ কেন? আমি তো মেনে নিচ্ছি, তোমার শাহজাদাই বেশি সুন্দর। সে- প্রথম, আমার রাজকুমারী দ্বিতীয়। তুমি খুশি তো?
মাইমুন্নাহ আরও চটে ওঠে। অমন ঘুরিয়ে পেচিয়ে বলার কি দরকার? যদি সাহস থাকে তবে বেলা, আমার কথা তুই মানতে রাজিনোস। তুই না পুরুষ মানুষএকটা নপুংসক কোথাকার।
তোমার ভারি অন্যায়। অমন করে গালাগাল দিচ্ছে কেন? আমি তো তোমার কথা মেনেই নিয়েছি!
এই সময়ে রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
একশো বিরাশিতম রজনীতে আবার গল্প শুরু হয়?
মাইমুনাহ রেগে কাঁই। তুমি কি আর সত্যি সত্যি মেনে নিয়েছ? মুখে মানছো আমার প্যাদানীর ভয়ে। কিন্তু তাতেও তোমার নিস্তার নাই। তোমার মতো মিচকে শয়তানকে কি করে। শায়েস্তা করতে হয় আমার জানা আছে।
এই বলে মাইমুনাহ একখানা পাখার ঝাপট মারে দীনেশের চোখে। বেচারী, বড়ৎ জোর, তড়াক করে দুপা পিছিয়ে যেতে পেরেছিলো তাই রক্ষে। না হলে চোখটাই যেত। কিন্তু ততক্ষণে মাইমুনাহ ক্ষেপে উঠেছে। তাক করছে, দীনেশের ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। দানেশ ওর মতলব বুঝে নিমেষের মধ্যে একটা মাছি হয়ে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে বিছানায়-ওদের দুজনের মাঝখানে। অন্য সময় মাইমুনাহ ছেড়ে কথা কইতো না। যেন তেন প্রকারে ওর পিণ্ডি চটকে দিত। কিন্তু এখন, এই অবস্থায় বিছানার ওপর ধস্তাধস্তি করা সম্ভব না। তাতে ওদের দুজনের ঘুম ভেঙে যাবে। তাই সে নিজেকে সামলে নিলো।
-ঠিক আছে, কিছু বলবো না। বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে এসো।
দানাশ বলে, তুমি আমাকে মারবে।
মাইমুনাহ বলে, খোদা কসম, কিছু বলবো না, বেরিয়ে এসো।
এবার দানাশ উড়ে এসে আবার নিজের আসল রূপ ধরলো।
শোনো দানাশ, মাইমুনাহ বলে, এভাবে এই বিতর্কের নিম্পত্তি হবে না। তার চেয়ে এমন কাউকে সালিশ মানা যাকযে ব্যাপারটার ফয়সালা করে দিতে পারবে।
দানাশ বললো, সেই ভালো। তোমার যাকে ইচ্ছে ডাকে। মাইমুনাহ মেঝের উপর তিনবার টোকা দিলো। আর সঙ্গে সঙ্গে মেঝেটাি দুভাগ হয়ে নিচে থেকে উঠে এলো বিশাল বিকট কদাকার কুৎসিত এক দৈত্য। মাথায় তার ইয়া বড় বড় খানা শিং। এক এক খানার মাপ কীটার মতো। তে-ভাগা। পিঠের উপর দুম্বার মতো একটা কুঁজ। আর একটা পা খোড়া। নাক বলে কোন বস্তু নাই। গোলাকার চোখ দুটো নাকের জায়গাটা দখল করে আছে। তার একখানা বাহু লম্বায় পাঁচ হাজার পাঁচশো পঞ্চাশ হাত। আর একখানা মাত্র বিঘৎখানেক লম্বা; এক একখানা হাতের থাবা দেখতে ঠিক জলের ডেকচির মতো। ওর নাম কশকশ ইবন ফকরাশ ইবন আত্রাশ-আবু হানফাশের বংশধর।
ঘরের ভিতরে উঠে দাঁড়াতেই আবার মেঝেটা জোড়া লেগে গেলো। কশকশ আভূমি আনত। হয়ে মাইমুনাহকে কুর্নিশ জানিয়ে বললো, বান্দা হাজির মালকিন।
মাইমুনাহ হাত তুলে আশীর্বাদের ভঙ্গী করে বললো, জিত রহো, বেটা। আমার সঙ্গে হাড়েহারামজাদা এই দানাশের ঝগড়া বেঁধেছে। তোমাকে আমরা সালিশ মানছি। তুমি ফয়সালা করে দাও। যে দেখছ শাহজাদা আর রাজকুমারী শুয়ে ঘুমাচ্ছে, তোমাকে বলে দিতে হবে কে বেশি খুবসুরৎ। খুব ভালো করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখো! তোমার বিচারে যাকে বেশি সুন্দর মনে হবে আমরা তাকেই সেরা বলে মেনে নেবো। রায় দেবার আগে খুব ভালো করে ভেবে দেখবেযেন কোনও অবিচার না হয়।
কশকশ এতক্ষণ পালঙ্কের দিকে পিছন করে দাঁড়িয়েছিলো। এবার ফিরে দেখেই আনন্দে উত্তেজনায় ধেই ধেই করে নাচতে লাগলো। ওরেকবাস, একি দেখছি। আশমানের চাঁদ মাটিতে নেমে এসেছে। কিন্তু মালকিন, বড় মুশকিলে ফেললেন, দুজনেই তো দেখি একইতরা খুবসুরৎ। ফারাক তো কিছু বুধি না।
মাইমুনাহ বলে, তা বললে তো হবে না কশকশ, এর মধ্যে একজনকে বাছাই করে বলতেই হবে।
কশকশ বলে, ঠিক আছে ঘাবড়াবেন না, উপায় একটা বাৎলে দিচ্ছি।কী সে উপায়? কশকশ বললো, প্রথমে আমি এই রাজকুমারীর রূপের গুণগান করে একটা কবিতা শোনাতে চাই।
মাইমুনাহ বাধা দিতে বলে, অত সময় নাই। ওসব কাব্যিটাব্যি রাখো। এখন সোজাসুজি যা বলতে চাও বলো।
কশকশ বললো, তা হলে এক কাজ করুন। আমরা তিনজনই অদূল্য হয়ে হাওয়ায় মিশে থাকি। তারপর সকাল হতে দিন। ওরা ঘুম থেকে জেগে উঠুক। দুজনে দুজনকে দেখুক। তখনই বোঝা যাবে কার রূপে কে বেশি মুগ্ধ হয়। যদি ছেলেটা মেয়েটার জন্যে পাগল হয়ে ওঠে তা হলে বুঝতে হবে মেয়েটাই বেশি সুন্দরী। আর যদি ছেলেটার জন্য মেয়েটার ছটফটানি ধরে তা হলে বুঝবেন ছেলেটার রূপে এমন কোন যাদু আছে যার টানে মেয়েটা আর ঠিক থাকতে পারছে না। সব সমস্যা লহমায় জল হয়ে যাবে মালকিন। খালি অদৃশ্য হয়ে ঘাপটি মেরে দেখতে থাকুন।
এই সময় রাত কাবার হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামায়।

বাংলা অনুবাদ : ক্ষিতিশ সরকার

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN


🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com 

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.