হারানো সময়_রাইয়ান জহির

 
ভোরের স্নিগ্ধ আলোটাও চোখের ভেতরটাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। দীর্ঘ দিনের অদেখা আলোকে সইয়ে নিতে চোখের খানিক সময়তো লাগবেই। তবে প্রায় মধ্যরাত থেকে হেঁটে বেড়ানোর ধকল বছর তিনেক বদ্ধ ঘরে বন্দি থাকা জীর্ণশীর্ন শরীরটাকে একটুও কাবু করতে পারলো না। আর খানিক পথ হাঁটলেই আপন বাড়ি ফিরে যাবে অবিনাশ।
এই তো সেই বাড়ি শ্বেত শুভ্র বাড়ি, মমতায় মাখা বাড়ি, ব্যবসায় লভ্যাংশের বিশাল একটা অংশ দিয়ে  প্রিয়তমা স্ত্রীর নামে কেনা বাড়িটিতেই রয়েছে তার স্ত্রী শুভ্রা আর একমাত্র কন্যা শ্রেয়া। জীবিত অবস্থায় তাদের কাছে ফিরবে এই কথা কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি অবিনাশ। কে বা কারা কেনই বা তার মত একজন নিরীহ মানুষকে তুলে নিয়ে গিয়ে তিন বছর পর আবার ছেড়ে দিল এই প্রশ্নের উত্তর তার ভাবনাতেই আসে না। এসব ভাবতেও চায় না সে আর তার ভাবনা জুড়ে আছে মেয়েটির কথা। সে যখন নিখোঁজ হয় শ্রেয়া তখন চতুর্থ শ্রেনীর ছাত্রী, এখনতো সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার কথা। বাবাকে দেখে নিশ্চয়ই বাবা বাবা বলে সারা বাড়ি মাথায় তুলবে।
গেইট থেকে কলিংবেল চেপে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হয় নি তাকে উল্কার বেগে এসে কাজের মেয়ে ময়না গেইট খুলে দিল। এতদিন পর মনিবকে দেখতে পেয়ে উচ্ছসিত ময়না একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
স্যার, আফনে এদ্দিন ফর কইত্থুন আইলেন? কিরাম আছুইন গো স্যার?
আছিরে, ভালো। তোরা কেমন আছিস?
অয় বালা আছি, ভিত্রে কি আইবেন গো স্যার?
বলিস কি? ভিতরে যাবো না তো কই যাবো?
 
হঠাৎ করে যেন চুপসে গেলো মেয়েটি। তারপর আবার উল্কার বেগে দৌড়।
আপন মনে হেসে উঠল অবিনাশ, মেয়েটিকে কখনো হাঁটতে দেখে নি সে। সবসময় দৌড়ের উপর থাকে।
বেডরুমে নিজের পাঁচ মাস বয়সী ছেলে সায়ানকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিল শুভ্রা। ময়না হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
ম্যাম গো স্যারে আইছে।
খানিকটা ভাবনায় পড়ে গেলো শুভ্রা এত সকালে তরিকুল আসে কিভাবে? যদিও মাঝে মাঝে শুভ্রাকে চমকে দেয়ার মত অনেক কিছুই করে তমাল। তাই বলে গতরাতে কলকাতা যাওয়া লোকটা চাইলেই তো এত সকালে ঢাকায় আসতে পারে না। তবে কি সে কলকাতা যায় নি? তা বা কি করে হয়, সে তো কলকাতা এয়ারপোর্টে পৌঁছেই স্কাইপিতে ভিডিও কল দিয়েছিল।
বলিস কি? তরিকুল আসবে কোথা থেকে?
না গো ম্যাম, তরিকুল স্যার না অবিনাশ স্যার আইছে।
আচমকা শিশুর মুখ থেকে মাতৃস্তনটি খসে পড়ল। কয়েকফোঁটা দুধ গড়িয়ে পড়ল বিছানায়। শিশুটি কুই কুই করে দুধ খুঁজতে লাগল। পাথর হয়ে পরে রইল মা। ম্যাডামের অবস্থা বুঝতে পেড়ে শিশুটিকে কোলে তুলে নিল ময়না।
প্রায় বারো বছর একসাথে সংসার করা স্বামী অবিনাশ। সেই প্রিয়তম স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর তাকে পাওয়ার আকুলতায় ব্যাকুল শুভ্রা এমন কিছু নাই যে করে নি এমন কোথাও নি যে যায় নি। সেই স্বামী আজ ফিরে এসেছে অথচ সঙ্কোচে তার সামনে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না শুভ্রা। কারন ইতোমধ্যেই সাবেক হয়ে গেছে অবিনাশ।
শুভ্রাকে ডাকতে ডাকতে বেডরুমে প্রবেশ করতে যাচ্ছিল অবিনাশ তার আগেই ময়নাকে দিয়ে তাকে ড্রয়িংরুমে বসতে বলা হলো।
কালো একটা চাদরে নিজেকে জড়িয়ে ড্রয়িংরুমে আসলো শুভ্রা। অবিনাশ দাঁড়িয়ে ছিল শুভ্রাকে দেখে খুশিতে চিকচিক করে উঠল চোখ দুটো। অনেকটা রোগা হয়ে গেছে অবিনাশ, অবিন্যস্ত চুলগুলো বড়ই খসখসে, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ত্বক, গালের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে, ঝুলে গেছে গলার চামড়া, তিন বছরে মনে হয় বয়স বেড়েছে নয় বছর।
দীর্ঘদিন পর প্রিয়তমা স্ত্রীকে কাছে পেয়ে আবেগে আপ্লুত অবিনাশ দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল শুভ্রাকে আর চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল সুখের অশ্রুজল। একই আকাশের একপাশের ঝিকমিকে রোদ যেমন অন্য পাশের কালো মেঘেরভেলাকে ছুঁয়ে যেতে পারে না তেমনি সাবেক স্বামীর উষ্ণ আলিঙ্গনে কোন উত্তাপ খুঁজে পেলো না শুভ্রা। খুব ঠান্ডা গলায় অবিনাশকে বলল,
সোফায় বসো অবিনাশ, কিছু কথা আছে তোমার সাথে।
জানি তো কই ছিলাম, কেমন ছিলাম এসবইতো জানতে চাইবা? বিশ্বাস করো। কিছুই জানিনা আমি তিনটা বছর শুধু একটি ঘরে বন্দি করে রেখেছিল, দরজার নিচ দিয়ে নিয়ম করে খাবার দিত। অনেক প্রশ্ন করেও কোন উত্তর পাই নি। নিয়ে যাওয়ার সময় যেমন চোখ বেঁধে নিয়ে গিয়েছিল আসার সময়ও তাই। বাদ দাও এসব, শ্রেয়ামণি কই আমাদের? তাকে দেখছি না কেন?
তুমি কি বাড়ির কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করো নি অবিনাশ।
লক্ষ্য করার কি আছে? সব তো আগের মতই আছে।
না, নেই কিছুই আগের মত নেই, সব বদলে গেছে। শুধু ড্রয়িংরুমটা ভালোভাবে দেখো, সব পরিবর্তন বুঝতে পারবা।
কথাটা শেষ করার আগেই ডুকরে কেঁদে উঠল শুভ্রা। স্ত্রীর কান্নার রহস্য বের করতে খুব বেগ পেতে হল না অবিনাশের। চারপাশে একবার তাকিয়েই উত্তর পেয়ে যায় সে। তার মত গোড়া হিন্দুর বাড়িতে আজ দেবদেবীর ছবি নেই সেখানে আজ মক্কা মদিনার ছবি, গীতা আর মহাভারতের জায়গায় স্থান পেয়েছে নেয়ামুল কুরআন আর কুরআন শরীফ। শ্রেয়ার গৃহশিক্ষক তরিকুলের সাথে শুভ্রার হাসোজ্জল বিয়ের একটি আলোকচিত্রই চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে অবিনাশের অনুপস্থিতে নিজের চেয়ে ১০ বছরের কম বয়সি মুসলমান তরুন তরিকুলকে নতুন জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছে শুভ্রা।
বেদনায় নীল হয়ে গেছে অবিনাশের অন্তর, মাথার ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, স্তব্ধ হয়ে গেছে ভাষা।
কয়েক মিনিট অখন্ড নিরবতা। নিজেকে সামলে শান্তভাবেই শুরু করল অবিনাশ, এটা কিভাবে করলে শুভ্রা?তিনটা বছর অপেক্ষা করতে পারলে না?
তুমি কথা দিয়ে যাও নি অবিনাশ যে তুমি ফিরে আসবে। তোমার সাথে যারা নিখোঁজ হয়েছিল তারা অনেকেই বেঁচে নেই,লাশ পাওয়া গিয়েছিল তাদের আর যারা ফিরেনি এখনো ফিরে নি।
তাই বলে?
আমি নিরুপায় ছিলাম অবিনাশ। তোমার খোঁজে এমন কোথাও বাদ রাখি নি আমি। কিন্তু প্রাপ্তির খাতা শূন্য। আমার একটা অবলম্বন দরকার ছিল।
আমার ছোটখাট একটা ব্যবসা ছিল, এই বাড়িটা ছিল।
এসব এই শহরে একজন নারীর নিরাপত্তা দিতে পারে না অবিনাশ। শকুনদের চোখ পড়েছিল এই দেহের উপর।
আমার মেয়েটা কোথায় শুভ্রা?
তোমার নিঃসন্তান বন্ধু ফরিদ উদ্দিন এক প্রকার জোর করে নিয়ে গেলো।
এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলো না অবিনাশ। প্রচন্ড রাগে বলতে লাগলো,
, নয়া নাগরের সাথে প্রেমলীলায় বাঁধা হবে বলে আমার মেয়টাকেও সরিয়ে দিয়েছো?
অসভ্য কথা বলবে না অবিনাশ।
হ্যা, আমি অসভ্যই।আর অসভ্য বলেই একদিন জাতপাতহীন তোমাকে বস্তি থেকে তুলে এনে রাজরানী বানিয়েছিলাম। আমার ব্যবসা, এই বাড়ি তোমার নামে লিখে দিয়েছিলাম। তোমাকে বিয়ে করার অপরাধে মৃত্যুর আগেও আমার বাবা মা আমার মুখ দেখেনি। ভাইয়েরাও মুখ তুলে কোনদিন আমার দিকে তাকায় নি। আর সভ্য তুমি কি করলে?
অস্বীকার করি না অবিনাশ।আর আমিও তোমাকে ভালোবেসেছি, বারো বছরে একবারো মন খারাপ করে থাকতে দিয়েছি তোমায়?
স্ত্রীর মুখে ভালোবাসার কথা শুনে গলে গেলো অবিনাশ আবারো সংসার করার আশায় অতীতে ফিরে যেতে চাইল সে, চলো না শুভ্রা আমরা শ্রেয়াকে বাসায় নিয়ে আসি। আবার সুখে ঘর করতে থাকি? তরিকুলকে না হয় কিছু টাকা দিয়ে দেশের বাহিরে পাঠিয়ে দেই?
তা কি আর হয় অবিনাশ?
শিশুটির কান্না থামাতে না পেরে তাকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিল ময়না, ম্যাম গো,কান্দন তো থামে নাহ, বুহের দুধ খাইব করি মনে লয়।
সন্তানকে দুধ খাওয়াতে আঁচলের নিচে হাত ঢুকাল শুভ্রা।
অবিনাশের আর বুঝতে বাকি রইল না যে স্ত্রীর কাছে ফেরার আর কোন পথ খোলা নেই তার। রাগে, দুঃখে আর অপমানে চোখ ঘুরিয়ে নিল সে। পরিশ্রান্ত দেহটা নিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে পড়ল
মায়ের কয়েকফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ল শিশুর গালে
 
পাদটীকা:
সরকার পতনের বিশাল মাস্টারপ্লান হাতে নিয়ে বছর দুয়েক আগে একইসময়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে বিরোধীদল প্রায় শদেড়েক সাধারণ মানুষ গুম করে। তারপর গুম, হত্যার প্রতিবাদে গড়ে তোলে তীব্র আন্দোলন ।কিন্তু হালে পানি পায় নি সেই আন্দোলন। সরকার সরকারের জায়গায় বহাল আর বিরোধীদল তাদের জায়গায়। মাঝখান থেকে কিছু অভগা পরিবার হারলো তাদের প্রিয় মানুষ আর অবিনাশের মত কিছু হতভাগা হারালো তাদের পরিবার।

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.