হবো লীন মানুষের তরে_মাহমুদ মুযযাম্মিল

 
একটা উৎসব কিংবা মসিবত এলেই আমরা বিভাজিত হয়ে যাই৷ সমাজ দেশ পৃথিবী আমাদের মাঝে বেশ করে বড়সড় একটা ভেদরেখা তৈরী করে দেয়৷ মননবিশ্ব কী করে যেনো আপনাতেই সরে আসে৷ স্বার্থান্ধতার ঝাড়বাতি আমাদের চোখকে করেছে পর৷ মনকে করেছে আরও স্বার্থপর৷ দুনিয়ার মোহগ্রস্ততা অন্ধ বধির সাজতে আমাদের বাধ্য করেছে৷ পদ-পদপি অর্থলিপ্সায় কাতর আমাদের মনমগজ আত্মসত্তা৷ পরিচিত বিশ্বের সকল দুঃখভোলানো গান আমরা আর গাইতে পারি না৷ শোষিতজনের পক্ষে আর লিখতে পারি না দ্রোহের কবিতা৷ শ্রেণিবৈষম্য বর্ণবৈষম্য গোত্রীয় দাপট সংখ্যাগরিষ্ঠতার দ্বন্দ্বমোহ আমাদের অতিক্রম করতে উদ্বুদ্ধ করেছে হিংস্রতার সকল সীমা-সহরদ৷ কী করে আমরা পাবো শান্তি-সুষমা? কীভাবে মিলবে আমাদের আত্মতুষ্টির সোনালি সুখ? কোন প্রেরণা আমাদের মাঝে জাগাবে ভ্রাতৃত্ববোধ সহনশীলতা জনে জনে বন্ধুতা? এর একটা হিসাব আমরা নিজেরাই করতে পারি এই সময়ে৷
 
মানুষ যবে নিজেকে চিনিতে পারিবে
তবেই সে কার্যে আসিবে অন্যের তরে
 
শাস্ত্রের জ্ঞান ধারণ করে আপনি শাস্ত্রজ্ঞ বা শাস্ত্রবিদ বা বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী হতে পারেন৷ একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব রূপেও আবির্ভূত হতে পারেন সমাজে৷ দেশের নামিদামি স্কলার এবং প্রথম সারির পণ্ডিত হতে পারেন আপনি৷ কিন্তু সুনাগরিক দেশের কর্ণধার তখনই হতে পারবেন আপনি, যখন আপনি নিজেকে চিনতে পারবেন৷ আপনার শিক্ষা-সংস্কৃতি জ্ঞান-উপলব্ধি এবং কর্মদক্ষতা সমাজের প্রতিটি মানুষের দোরগোড়ায় পৌছতে পারবে৷ বিষয়ে আপনার ব্যক্তিউদ্যোগ আপনার প্রতিষ্ঠানের অর্থ-সহযোগিতাই কমন ভুমিকা রাখতে সক্ষম৷ এক্ষেত্রে অবহেলিত জনগোষ্ঠী, নীচুজাত শ্রেণির মানুষ, প্রান্তিক চিন্তার জনগণ দরিদ্র মানুষজনকে প্রাধান্যের তালিকায় রাখতে হবে৷ এরপর বন্যা খরা নদীভাঙন প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামীণ জনগোষ্ঠী৷ আমরা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এদেরকে এগিয়ে নিয়ে গেলেই এরা এগিয়ে যাবে৷ কারণ সমাজের ঘটমান অপরাধগুলো সাধারণত এইসব নিম্ন-অসহায় কর্মহীন অশিক্ষিত কিছু মানুষেরাই ঘটিয়ে থাকে৷ অশিক্ষা দারিদ্র্যতার শিকার হয়ে এরা নানান অপরাধকর্ম বেছে নেয়৷ যা সমাজ দেশের জন্য হুমকি স্বরূপ৷ ধনকুবেররাও যে অপরাধের সাথে জড়িত না তা নয় তবে তারা অপরাধ জগতে জড়ায় নেশায় পড়ে আর গরিব-বেকাররা অপরাধ করে অভাবে পড়ে৷ তাই সফল ব্যক্তিরই এগিয়ে আসতে হবে এই অসহায় শ্রেণিকে কাজে লাগাতে এবং সমাজ দেশকে সাফল্যমণ্ডিত করতে৷
 
এইসব অবহেলা আর কত ?
 
পথশিশু৷ এক একটি মানবফুল৷ ফুলের কলি৷ এরাও স্বপ্ন দেখতে জানে৷ সুন্দর ভবিষ্যত আর সুন্দর জীবনের৷ তাদেরও আছে আকাশ অসীম স্বপ্ন৷ শিক্ষার আলোয় আলোকিত মানুষ হবার এবং দেশ গঠনের প্রশিক্ষিত নাগরিক হবার৷ কিন্তু এইসব পথশিশুদের জন্য সে স্বপ্ন সে সুযোগ ধুম্রকল্পনা ছাড়া আর কিছুই না৷ এরা নিজ থেকে কিছুই করার ক্ষমতা রাখে না৷ যদি না সমাজের বিত্তজন নেতৃমহল এগিয়ে আসে৷ দেশে লক্ষ লক্ষ এতিম-অসহায়, বাবা মা পরিত্যক্ত পথশিশু আছে৷ থাকার ঘর আর খাবার না থাকায় এরা শুরুতেই ভিক্ষাবৃত্তি, টোকাইয়ের কাজ, হোটেলকর্মচারীর কাজ, গ্যারেজে মেরামতের কাজ, গাড়ির হেল্পার, ইটভাঙার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজও বেছে নেয়৷ কিছুটা পরিণত হলে এরাই আবার ছিনতাই চুরি রাহাজানি সন্ত্রাস চাঁদাবাজি ভাড়াটে খুনের কাজও করে৷ ফলে দেশময় অস্থির ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করতে থাকে৷ গণমানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়৷ তাই এদেরকে দেশ মানুষের কল্যাণকামীরূপে গড়ে তুলতে শিক্ষাকার্যক্রম ফলপ্রসূ অনুশীলনের ব্যাপক উদযোগ নিতে হবে৷ দু চারজন পাঁচজন বিত্তবান শিক্ষানুরাগীর এতোসব অসহায় শিশুর দায়ভার গ্রহণ করা আদৌ সম্ভব হবে না৷ সম্মিলিত স্বতঃস্ফূর্ত উদযোগই কাজে সফল উন্নতি লাভ করার উত্তম সোপান হতে পারে৷ তাই দেশের প্রত্যেক শিক্ষানুরাগী দেশপ্রেমিক অর্থশালী লোকের এখনই এগিয়ে আসার কোনো বিকল্প নেই৷
 
মনের পোড়ানি নিভৃতে কাঁদায়
 
মাজেদা বেগম ওরফে নিশির মা৷ এই মধ্যবয়সেও যৌবনের কোথাও ভাটা পড়েনি৷ রূপ-সৌন্দর্যের ষোল আনাই এখনও বলবৎ নিশির মার দেহজুড়ে৷ চার সন্তানের জননী হবার পর ভালোই চলছিলো সংসার৷ হঠাৎ একদিন খবর এলো৷ নিশির বাবা তিনতলা ভবনের ছাদ থেকে পড়ে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি৷ তিনদিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিশির বাবার মৃত্যু ঘটে৷ বিয়ের উপযুক্ত নিশিসহ তার চার চারটি সন্তান হয় এতিম৷ আর মাজেদা বেগম হন স্বামীর মৃত্যুশোকে কাতর এক বিধবা নারী৷ নির্মাণ শ্রমিক স্বামীর করুণ মৃত্যুতে সংসারের একমাত্র রোজগারের পথটি বন্ধ হয়ে যায়৷ ধারদেনা করে কতোদিনই বা চলা যায় আর! এক সময় ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে চার সন্তানসহ পাড়ি জমান বড়োলোকের শহরে৷ ঝিঁ-বুয়া বা রেস্টুরেন্টে আয়ার কাজ যদি পেয়ে যান অন্তত পেটগুলো তো চলবে! পেয়েও গেলেন এক বাসায় রান্নাবান্নার কাজ৷ কিন্তু বিপত্তি দেখা দিলো এখানেও৷ বাড়ির মালিকের মদ্যপ বদমাইশ ছেলেটি মধ্যবয়সী নিশির মার রূপমুগ্ধ হয়ে কুপ্রস্তাবও দিয়ে বসলো৷ কর্মক্লান্ত দিন পাড়ি দিয়ে মাজেদা বেগম যখন ঘুমোতে যান৷ চোখে ঘুম আসে না, আসে কেবল অশ্রুর তুফান৷ চাপা কান্নার সুর৷
 
সেদিন এক মা তার ছোট্ট ছেলেকে মাদরাসায় ভর্তি করাতে এসে কেঁদে কেঁদে বললেনছেলের বাবা তাকে ছেড়ে দিয়েছে৷ অন্য মহিলাকে বিয়ে করে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে৷ দুই সন্তান নিয়ে তিনি এখন অসহায়৷ কোনোরকমে একটা গার্মেন্টসে কাজ নিয়েছেন৷ অথচ তিনি পর্দানশীন৷ জানতে চাইলামআপনার স্বামী বিয়ে করেছেন ভালো কথা, আপনাকে বের করে দেয়ার কারণ কি? বললেন, দীর্ঘদিন যাবত তারা পরকীয়া 'রোগে' আক্রান্ত ছিলো৷ ওই মহিলাটিও স্বামীর সংসার ত্যাগ করে এসেছে৷ ছেলের বাবাকে বুঝালো, আমি যেমন স্বামী-সংসার ছেড়ে এসেছি, তোমাকেও স্ত্রী-সন্তান-সংসার ছাড়তে হবে এবং আমাকে বিয়ে করে নতুন সংসার গড়তে হবে৷ নয়ত তোমার নামে মামলা করবো৷
এই হলো হালচিত্র দেশের এবং অতিশয় 'নিষ্ঠাবান' সুশীল সমাজের৷ যন্ত্রসভ্যতার উন্নতি হলেও ক্রমে মানবিকতার পরাজয় ঘটছে দেশে৷ বাইরের কেউ ঘরে এসে রাণী সাজে আর প্রকৃত রাণী হন পথের ভিখারিণী৷ এই তো বাস্তবতা৷ জয়তু পরকীয়া! জয় তুই ভুবনময়!
 
উপরের ঘটনা দুটি এই ভ্রষ্ট সমাজে বহুলভাবে ঘটে চলেছে৷ একজন বিধবা বাঁচার তাগিদে শহরে আসলো, আর শহর তাকে ইজ্জত খোয়াতে বাধ্য করছে৷
অপরটি পরকীয়া৷ একটা পরকীয়ায় কমপক্ষে দুটি মেয়ের জীবন নষ্ট হয়৷ ভোগায় পুরো একটা সমাজকে৷ এভাবে কতো মেয়ের জীবনে যে অন্ধকার নেমে এসেছে৷ কতো শত মেয়ে রাণীর আসন থেকে পথের ভিখারিণী হয়েছে৷ কতো মা বাসায় বাসায় বুয়ার কাজ করে জীবন ক্ষয় করে চলেছে৷ সাথে শারীরিক মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ধুকছে তো ধুকছেই৷ এইসব কুলহারা দিশাহারা নারীদের ইজ্জত-আব্রু হেফাজত করে সমাজকে সুন্দর কলুষমুক্ত রাখতে হবে৷ স্বউদ্যোক্তাগণের সদয় দৃষ্টি এক্ষেত্রেও বিরল ভুমিকা রাখতে পারে৷
 
কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে
 
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষকের দাম নাই৷ কৃষক মরে খরায়৷ কৃষক মরে বন্যায়৷ কৃষক কাঁদে শিলাবৃষ্টি আর ঝড় হলে৷ কেন কাঁদবে একজন কৃষিজীবী? কৃষকই তো দেশের প্রাণ, দেশের সুখ-স্বচ্ছলতা৷ কৃষি উৎপাদন না থাকলে শহরের লাটরা কি খাওয়ার কিছু পাবে? অথচ এই কৃষক শ্রেণির মানবেতর জীবন ওদের চোখে পড়েনা৷
বাংলাদেশের কৃষিতে বিপ্লব ঘটে গেছে বলে একটা কথা চাউর হয়ে গেছে। কৃষিতে ভর্তুকি দেওয়াসহ কৃষির আধুনিকায়নে জোরদার কাজ করছে সরকার। তারপরও বাংলাদেশের কৃষক মানে হা-হুতাশময় জীবনধারণের পেশা৷ যারা কৃষক এবং কৃষিনির্ভর, এই কৃষিজীবী গোষ্ঠীমাত্রই দারিদ্র্যের প্রতিচ্ছবি। পেশাজীবী কৃষক ভালো নেই। কৃষির জোয়ার এসে গেছে কিন্তু কৃষকের ভাগ্য পরিবর্তন হচ্ছে না সেরকমভাবে। বাংলাদেশের কৃষক মানে বঞ্চিত অবহেলিত অভাবগ্রস্ত দারিদ্র্যের প্রতিনিধি বিশ্ব মানচিত্রে। অথচ পৃথিবীর অনেক দেশেই কৃষিজীবীরা সম্মানিত আর্থিকভাবে সচ্ছল অন্য পেশাজীবীদের চেয়ে। কৃষি নিয়ে সাংবাদিকতা করেন জনপ্রিয় টিভি ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ। তিনি দেশি-বিদেশি কৃষি কৃষকদের নিয়ে প্রতিবেদন করে থাকেন নিয়মিত। বাংলাদেশের কৃষির উন্নয়নের সুখবর থাকে তাতে। তবে অল্প কিছু কৃষিজীবীই এই কঠিন বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে সাফল্যের পথ দেখে। দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন অত্যন্ত মানবেতর। কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার কৃষকদের কঠোর পরিশ্রম কৃষিক্ষেত্রে সময় বাঁচাতে সাহায্য করছে। কৃষিতে প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। সরকারও কৃষিক্ষেত্রে উৎসাহী আন্তরিক। বর্তমান দায়িত্ব নেওয়া সরকারের আগেই পরিকল্পনা আছে গ্রামের দিকে নজর দেওয়া। গ্রামকে শহরের সুযোগ-সুবিধায় রূপান্তরের সংকল্প তাদের। গ্রামকে শহর বানানো যেমন ভালো উদ্যোগ, তেমনি গ্রামে বসবাসকারী বিশাল জনগোষ্ঠী যাদের জীবিকা কৃষি তাদের ভাগ্য পরিবর্তনও জরুরি। বাংলাদেশের কৃষক ধৈর্যশীল পরিশ্রমী। তাদের সহযোগিতার মাধ্যমে উন্নয়নশীল কৃষকের উন্নতি সম্ভব। বিশ্ব দরবারে আমাদের কৃষক মানে দারিদ্র্যের মডেল। থেকেও পরিত্রাণ জরুরি। কৃষক সচ্ছল হলে দেশ বদলে যাবে। বদলে যাবে গ্রামও।

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.