আমার দ্বিতীয়বার ইংল্যান্ড সফর_মুহম্মদ মতিউর রহমান : পর্ব-১০

১১ জুলাই, শনিবার
এখানে শনি, রবি দু’দিন সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সকালে আমরা গেলাম ক্যানসাস সিটির ঐতিহ্যবাহী সিটি মার্কেটে। সিটি মার্কেটে গেলে এখানকার প্রাচীন জীবনযাত্রার কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায়। এটা শহরের প্রাচীনতম এলাকা, আগে এটাই ছিল ক্যানসাস সিটির কেন্দ্রবিন্দু। প্রাচীন-ঐতিহ্য ধারণ করে এখনও এ মার্কেট প্রাণ-”ঞ্চল হয়ে আছে। স্থানীয় কৃষকরা তাদের উৎপাদিত নানারকম ফলমূল, সবজি ও অন্যান্য দ্রব্য এখানে নিয়ে আসে বিক্রি করার জন্য। সবকিছু ঋধৎসভৎবংয -টাটকা ও দামেও কিছুটা সস্তা। শুধু ছুটির দিন অর্থাৎ প্রতি রবিবারে এখানে বাজার বসে। অসংখ্য লোক এখানে বাজার করতে আসে। এত লোকের ভীড়ে গাড়ি রাখার জায়গা পাওয়াই কঠিন। অনেক ঘোড়াঘুড়ি করে একটা জায়গা পাওয়া গেল। মানুষের ভীড় ঠেলে ঠেলে আমরা বেশ কিছু ফলমূল, সবজি কিনলাম। বাজারে বেশ কিছুসংখ্যক আরবদের দোকান আছে। অনেক আগে তারা হয়ত আমেরিকায় বসতি স্থাপন করেছে। বর্তমানে তারা আমেরিকান নাগরিক। এদের মধ্যে লেবানিজ ও ফিলিস্তিনীদের সংখ্যাই অধিক। আরবদের দোকানে আরবি খানার বাহার। কেনাকাটা শেষ করে আমরা এক আরবি দোকানে ঢুকলাম আরবি খানা খেতে। সুস্বাদু খাবার, পেটপুরে খেলাম। তবে দাম একটু বেশি।
খাওয়া-দাওয়া শেষে আমরা সওদা নিয়ে গাড়ির দিকে যাচ্ছি। মাঝখানে একটি বিশাল ঘরের মধ্যে একটি জিনিসের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। উম্মুখ হয়ে তাকালাম। প্রাচীনকালের বিশাল স্টীম চালিত সমুদ্রগামী আরবি নৌকা। ১৮৫৬ সনে এটি এখানে সাগর-তীরে বালিয়াড়ির ফাঁদে পড়ে ডুবে গিয়েছিল। সমুদ্র-তীরে বিশ ফুট মাটির নিচে এ সমদ্রযানটি আবি®কৃত হয়। মাটি খুঁড়ে বের করে সযত্নে দর্শনার্থীদের জন্য এখানে রাখা হয়েছে। পাশে ছবিসহ যানটি কীভাবে উদ্ধার করা হয়েছে তার বিবরণ লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এটা দেখে সহজেই অনুমান করা যায় যে, আরবরা একসময় এ ধরনের নৌযানে সুদূর আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিল। প্রাচীনকাল থেকেই আরবরা, এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশ পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, আদ্দিস আবারা, দারুস সালাম ইত্যাদি দেশে বাণিজ্য করতে যেত। মুসলমানদের গৌরব যুগে তাদের সমুদ্রাভিযান আরো বিস্তৃত ও গতিমান হয়। বাণিজ্যিক পণ্যের সাথে তারা তখন ইসলামের সওদা নিয়েও বিভিন্ন দেশ সফরে গেছেন। আরবদের সে দুঃসাহসিক সমুদ্রাভিযানের কথাই স্পষ্টত স্মরণ করিয়ে দেয় আমেরিকার ক্যানসাস সিটিতে সযত্নে প্রদর্শনীর জন্য রাখা এ অৎধনরধহ ইড়ধঃ টি।
সিটি মার্কেট থেকে আমরা গেলাম এখানকার বিখ্যাত ক্যানসাস সিটির কেন্দ্রস্থলে ৪৫২৫ নং ওক স্ট্রীটে অবস্থিত ২২ একর জমির উপর নির্মিত The Nelson-Atkinsons Museum of Art (located in the centre of Kansas city, at 4525 oak street). এখানে পাঁচ সহস্রাধিক বছরের পুরানো জগৎ-বিখ্যাত সব স্থাপত্য-ভাস্কর্য-কারুকাজ, সর্বাধুনিক খ্যাতনামা সব শিল্পীদের নামকরা অসংখ্য শিল্পকর্ম সুন্দর ও আকর্ষণীয়ভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এখানে স্থান পেয়েছে বিশ্ব-খ্যাত মিসরীয়, গ্রীক, রোমান, আমেরিকান, ইউরোপিয়ান, আফ্রিকান, ইন্ডিয়ান, চাইনীজ, জাপানীজ, দক্ষিণ এশীয়, দক্ষিণ পূর্ব এশীয় বিভিন্ন এলাকার প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন ও নানা ধরনের অপরূপ শিল্প-সম্ভার। এগুলো অত্যন্ত দর্শনীয় ও সুশৃঙ্খলভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। মিউজিয়ামের সুবিশাল বিল্ডিংটিও অত্যন্ত সুদৃশ্য। পুরো বিল্ডিংটিই যেন একটি নিখুঁত শিল্পকর্ম। ১৯৩৩ সনে নির্মিত এ বিল্ডিং-এর স্থপতি স্টিভেন হোল Steven Holl নিজেই এ বিল্ডিং-এর নির্মাণ-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে চমৎকার বর্ণনা দিয়ে বলেন- The stone and the feather, the original building logical and monument- and Bloch building–Transluccnt and integrated into the landscape- are extraordinary built enviorenments.
বিভিন্ন তলার বিভিন্ন কক্ষ ঘুরে সবকিছু দেখে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। ক্লান্ত দর্শকদের বিশ্রামের গ্যালারির স্থানে স্থানে রয়েছে বসার ব্যবস্থা, রেস্টরুম (পায়খানা-পেশাবের জায়গা) এবং নিচের তলায় পঞ্চদশ শতকের ইতালিয়ান কোর্টইয়াড স্টাইলে নির্মিত বিশাল রেস্টুরেন্ট। আমরা আর হাঁটতে পারছিলাম না। আমি আর আমার স্ত্রী খালেদা বেগম গ্যালারি থেকে বের হয়ে বাইরে উম্মুক্ত চত্ত্বরে গিয়ে বসে পড়লাম। সামনে এক কৃত্রিম জলাশয়। মনে হলো, জলাশয়টিও একটি নিখুঁত শিল্পকর্ম। এটা সাধারণ জলাশয় নয়, কুশলী শিল্পীদের হাতের ছোঁয়া লেগে এটি এক অসাধারণ দর্শনীয় বিষয় হয়ে উঠেছে।
আমাদের গাড়িটা একটু দূরে পার্ক করা ছিল। ইতঃমধ্যে আবিদ গাড়ি নিয়ে এসেছে। আমরা তাতে গিয়ে উঠে পড়লাম। বাসায় যেতে যেতে ক্যানসাস সিটির প্রাচীন সৌধরাজি, রাস্তাঘাট, রাস্তার পাশে কৃত্রিম ঝর্ণা ও সুদৃশ্য নানা দৃশ্যপট দেখে বিস্ময়ে-আনন্দে অভিভূত হলাম। উল্লেখ্য যে, এখানকার রাস্তার পাশে কৃত্রিম ঝর্ণাগুলো অত্যন্ত আর্কষণীয়। আমেরিকার অন্যকোন শহরে এত অধিক সংখ্যক কৃত্রিম ঝর্ণা নেই। এক্ষেত্রে ইতালীর রোম শহরের পরেই ক্যানসাস সিটির অবস্থান। রোম শহরে সর্বাধিক সংখ্যক কৃত্রিম ঝর্ণা পরিদৃষ্ট হয়।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি তাঁর ক্ষমতাবলে মন্ত্রীসভার সদস্য, দেশের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের নিয়োগ দিয়ে থাকেন। সাধারণত প্রেসিডেন্ট তাঁর উপদেষ্টা ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পরামর্শ অনুযায়ী এসব নিয়োগ দেন। তবে প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। অবশ্য প্রেসিডেন্টের যেকোন সিদ্ধান্ত সিনেটের অনুমোদনের পরই কার্যকরী হয়। অনেক ক্ষেত্রে সিনেট ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিলে প্রেসিডেন্টের জন্য তা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। সেক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টকে তাঁর সিদ্ধান্ত পূনর্বিবেচনা করতে হয়। একারণে দেশের সর্বোচ্চ কর্তা ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট সাধারণত স্বেচ্ছাচারী হতে পারেন না।
এবারে সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে দেখা গেল, প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত কীরূপ চুলচেরা বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার সম্মুখীন হয়। প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসাবে সোনিয়া সনোটোমায়ার (Sonia Sonotomyar) নামে স্পেনিশ বংশোদ্ভূত নামকরা একজন প্রবীণ মহিলা আইনজীবীকে নিয়োগ দেন। সোনিয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতা যেমন অসাধারণ, একজন নিরপেক্ষ দক্ষ আইনজীবী হিসাবে তেমনি তাঁর দীর্ঘদিনের খ্যাতি রয়েছে। তাঁর নিয়োগ অনুমোদনের জন্য সেটা যথারীতি সিনেটে পেশ করা হয়। সিনেটে এ বিষয়ে উপর্যপরি চারদিন ধরে আলোচনা চলে। নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারকের জীবনবৃত্তান্তের পুংখানুপুংখ বিবরণ সিনেটে পেশ করা হয়। সিনেট সদস্যগণ তার উপর চুলচেরা বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করেন। এরপর নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারক সিনেটে তাঁর বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যে তিনি আমেরিকার শাসনতন্ত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য, বিচারকর্মে তিনি কীভাবে ন্যায়বিচার সমুন্নত রাখবেন, আইনজীবী হিসাবে তাঁর অবিজ্ঞতা ইত্যদি সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা পেশ করেন। এরপর সিনেট-সদস্যগণ তাঁকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করেন। নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারক একে একে প্রত্যেকটি প্রশ্নের জবাব দেন। সর্বশেষে অনুমোদনের জন্য প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবটি ভোটে দেয়া হয়।
চারদিন ধরে সিনেটে অনুষ্ঠিত এ সমগ্র প্রক্রিয়াটিই টিভিতে প্রচারিত হয়। দেশের বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ এর উপর নিজস্ব মন্তব্য পেশ করেন ও পক্ষে বিপক্ষে খোলা-মেলা আলোচনা করেন। এভাবে সমগ্র দেশবাসীরও বিষয়টি জানা হয়ে যায়। প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত পক্ষপাতদুষ্ট না নিরপেক্ষ সে সম্পর্কে সকলে সম্যক অবগত হয়। নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তির যোগ্যতারও যথাযোগ্য যাচাই-বাছাই হয়। ফলে প্রেসিডেন্ট অনেক ভেবে-চিন্তে দেশ ও জনগণের কল্যাণের কথা চিন্তা করেই অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সাথে সব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, যাতে দেশবাসী পরে তাঁর পক্ষপাতদুষ্টতার কথা জেনে তাঁর প্রতি আস্থাহীন হয়ে না পড়ে। গণতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার এটা একটি ভালো দিক। আমাদের দেশের রাষ্ট্র পরিচালকগণ গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও পক্ষপাতহীন ন্যায়বিচারের কথা মুখে বলেন, কিন্তু কার্যত তারা করেন এর বিপরীত। ফলে ভোগান্তি হয় জনগণের। ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন অনেক ক্ষেত্রেই কেবল কেতাবী বুলি হয়ে থাকে। অথচ ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন ব্যতিরেকে গণতন্ত্র অর্থহীন। সভ্য-সমাজ গঠনের জন্যও এ দু’টির প্রয়োজনীয়তা একান্ত অপরিহার্য।
আবিদের বাসার অদূরে একটি পার্ক আছে, নাম ঝঃৎড়ষষ চধৎশ. ঘন নিকুঞ্জ ঘেরা পার্কের ভিতর এঁকেবেঁকে পাকা রাস্তা চলে গেছে। এখানে অসংখ্য লোক আসে হাঁটাহাঁটি করার জন্য। একটি পথ পায়ে হাঁটার, অন্যটি সাইকেল চালানোর জন্য। বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ হাঁটছে, দৌড়াচ্ছে, কেউ বা সাইকেলে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেউ একা, কেউ বন্ধু বা বান্ধবীসহ, কেউ পরিবার-পরিজন, ছেলেমেয়েসহ। সকলের একই উদ্দেশ্য-শারীরিক কসরৎকরে স্বাস্থ্য-সবল সুস্থ রাখা। আবিদ বলল সে প্রায়ই এ পার্কে যায়-কখনো হাঁটতে, কখনো মনের আনন্দে ঘন বনের আঁকা-বাঁকা পথে সাইকেলে দীর্ঘপথ ঘুরে বেড়াতে।
আমরা বিকালে পার্কে বেড়াতে গেলাম। কিন্তু গাড়ি পার্ক করার কোন জায়গা নেই। আবিদ এ পার্কে আসে পায়ে হেঁটে অথবা সাইকেলে চড়ে। আমাদের অতটা পথ হাঁটতে কষ্ট হবে বলে সে গাড়ি নিয়ে এসেছে। গাড়ি রাখার জায়গা খুঁজতে খুঁজতে অনেক সময় পার হয়ে গেল। অবশেষে পাওয়া গেল। এখানে রাস্তার পাশে বা যেখানে সেখানে গাড়ি পার্ক করার নিয়ম নেই, নির্দিষ্ট পার্কিং এরিয়াতেই কেবল গাড়ি পার্ক করা যায়। নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি পার্ক করে আমরা হাঁটতে বের হলাম। কিন্তু ততক্ষণে মাগরিবের ওয়াক্ত সমাগত। বেশিক্ষণ বেড়ানো গেল না। বাসায় গিয়ে নামায পড়তে হবে। তাই ঘন অরণ্যের মধ্য দিয়ে মনের আনন্দে দীর্ঘ পথ হেঁটে চলার বাসনা অনেকটাই অপূর্ণ রেখে আমরা আমাদের গাড়িতে এসে বসলাম। তবে আন্দাজ করতে অসুবিধা হলো না যে, শহর-কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের সুবিধার জন্য কত রকম সুন্দর আয়োজন যে করে রেখেছে তার ইয়ত্তা নেই।
ক্যানসাস সিটির যে এলাকায় আবিদের বাসা, সে এলাকাটির নাম-ঙাবৎষধহফ চধৎশ. মূলত পুরো শহরটাই একটা সাজানো সুরম্য বাগানের মত। এর চারদিকে শুধু গাছ আর গাছ-সবুজ বন-বীথিতে ঘেরা সারাটি শহর। দিনের বেলায় কোন উঁচু স্থান থেকে তাকালে পুরো শহরটাকে ঘন জঙ্গলে আকীর্ণ বলে মনে হয়। মাঝে মাঝে বাড়ি-ঘর, অধিকাংশই ভিলা বাড়ি। একতলা দোতলা, তিন-তলা, বড়জোর চার-তলার উপরে কোন বাড়ি নেই। ক্বচিৎ-কদাচিৎ আধুনিক দু’একটি বৃহৎ অট্টালিকা ছোখে পড়ে। শহরের মধ্য দিয়ে অসংখ্য রাস্তা, ব্রীজ, ওভারব্রীজ চলে গেছে। শহরের কোথাও যানজট নেই, গাড়ির কালো ধোঁয়া নেই, হর্ণের শব্দ নেই- নিরিবিলি সবাই যার যার গন্তব্য পথে অগ্রসর হচ্ছে।
আমাদের দেশের কথা মনে হল। সেখানে শহরগুলোতে গাদাগাদা দালানকোঠা। গাছ-গাছালি বা খোলা জায়গা নেই বললেই চলে। সরু সরু রাস্তাঘাট, হামেশা যানজট, আকাশ-বাতাস আচ্ছন্ন করা কালো ধোঁয়া, কান ফাটানো ভেপুর কর্কশ আওয়াজ-সবমিলিয়ে এক বিষাক্ত পরিবেশে নিত্যদিন পথ অতিক্রমের দুরূহ, ক্লান্তিপূর্ণ ঘর্মাক্ত আয়োজন। যান-জটের কারণে দিনের কর্ম-ঘন্টার প্রায় অর্ধেক সময়ই রাস্তায় দুঃসহ যান-জটের অপেক্ষায় অতিক্রান্ত হয়। এ অবস্থার অবসান হবার কি কোন সম্ভাবনা নেই?
জু’মার নামায পড়ার জন্য জনসন কাউন্টি ইসলামিক সেন্টারে গেলাম। নিচের তলায় প্রায় শ’তিনেক পুরুষ এবং উপর তলায় শ’খানেক মহিলা একসাথে নামায পড়েন। আমরা একটার একটু পর মসজিদে গিয়ে দেখলাম, জনৈক মিশরীয় আলেম খোৎবা দিচ্ছেন। তিনি এ মসজিদের ইমাম বা খতিব নন, অতিথি বক্তা। খুব সুন্দর খোৎবা দিলেন। তাঁর খোৎবা শেষ হলে মসজিদের ইমাম সাহেব নামায পড়ালেন। তিনিও মিশরীয়। চমৎকার তেলাওয়াত করেন। নামায শেষে আমরা ঘরে ফিরে এলাম।
বিকালে গেলাম ক্যানসাস শহরের আরেকটি পার্কে বেড়াতে। গিয়ে দেখি, সেখানে একটি স্কুলের ছেলেমেয়েরা তাদের শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীদের সাথে এসেছে Excursion-এ। পার্কের এক কোণায় তারা খেলাধুলা, হইহুল্লোরে মেতে আছে। আমরা তাদের পাশ দিয়ে পার্কের ভিতরে চলে গেলাম। বনের ভিতর দিয়ে দীর্ঘ পায়ে চলার পথ। আমরা হাঁটতে লাগলাম। দু’পাশে বড় বড় গাছ। মনে হল পার্কটি বেশ পুরনো। কিছুক্ষণ পরেই আমরা একটি ক্ষুদ্র প্রস্রবনের কাছে গিয়ে পৌঁছলাম। বনের মধ্যদিয়ে একটি সরু নালা চলে গেছে। তাতে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। কৃত্রিম ঝর্ণাধারা পানি প্রবাহকে সচল রেখেছে। এখানকার প্রতিটি পার্কেই কৃত্রিম জলাশয়, প্রস্রবন ও ঝর্ণাধারা নির্মাণ করা হয়। গাছের সাথে পানির সম্পর্ক। গাছ আর পানি প্রকৃতির অকৃত্রিম সম্পদ ও সৌন্দর্যের আধার। মানুষের জীবনধারণের জন্যও গাছ ও পানি অপরিহার্য। আর এ দু’য়ের সৌন্দর্য মানুষের মনের গভীরে প্রশান্তি এনে দেয়। সকলের জন্যই, বিশেষত কর্মচঞ্চল ব্যস্ত মানুষের জন্য এ প্রশান্তি একান্ত প্রয়োজন।
ছায়াঢাকা, পাখিডাকা, ঘন বনবীথির মধ্যে পায়ে হাঁটা সরু পথ দিয়ে চলতে চলতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। ঘন বনের দুর্ভেদ্য ছায়ায় গোধূলির রক্তরাগ চাপা পড়ে গেছে। আমাদের হাতের ঘড়ি বলে দিল-মাগরিক আসন্ন। তাই ঘরে ফেরার তাগাদা অনুভব করলাম। অতএব, অগ্রযাত্রা থামাতে হল। আমরা পিছন ফিরে পার্কের প্রবেশদ্বারে এসে উপস্থিত হলাম। অদূরে গাড়ি পার্ক করা আছে। মাগরিবের আগেই ঘরে ফিরে যেতে হবে।
গতকাল সন্ধ্যায় সিডার রেপিডস থেকে আমার বড় মেয়ে, জামাই ও নাতি-নাতনি এসেছে আমাদের সাথে উইকএন্ড কাটাতে। সাড়ে তিনশ মাইল পথ অতিক্রম করে সাড়ে পাঁচ ঘন্টা ড্রাইভ করে এসে উইকএন্ড কাটানোর কথা আমাদের দেশে কল্পনা করাও কঠিন। কিন্তু এখানে অনেকেই এটা করে থাকে। আমার মেয়ে ও জামাই দু’জনেরই লেটেস্ট মডেলের দু’টো দামী গাড়ি আছে। গাড়ি চালাতে তারা বিশেষত জামাই এনাম খুবই আনন্দ পায়। তাছাড়া, আমেরিকার হাইওয়েতে গাড়ি চালানোর মজাই আলাদা। যানজটবিহীন প্রশস্ত রাজপথে নিশ্চিত নিরুদ্বিগ্ন গাড়ি চালাতে ভালই লাগে।
সকালে নাস্তা খেয়ে আমরা সবাই গেলাম এখানকার হেরিটেজ পার্কে। একটি হ্রদের চারপাশ ঘিরে গড়ে উঠেছে পার্কটি। মাঝে মধ্যে ছাউনি আছে, বসার সুন্দর ব্যবস্থা আছে, হ্রদে মাছ ধরার ব্যবস্থা আছে। কেউ কেউ দেখলাম মাছ ধরছে, অনেকেই ছাউনির নিচে দল বেঁধে বসে গল্প-গুজব, খাওয়া-দাওয়া করছে, কেউ আবার হয়ত হ্রদের পাড় দিয়ে হাঁটাহাঁটি করে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য প্রাণভরে উপভোগ করছে। এখানে নাকি অনেকেই আসে পিকনিক, বিয়ে-সাদী ও নানারকম অনুষ্ঠান করতে। এসব করার জন্য এরচেয়ে সুন্দর জায়গা আর কী হতে পারে?
ওখান থেকে আমরা গেলাম একটি নামকরা আইসক্রীমের দোকানে। নানা স্বাদের হরেক রকম আইসক্রীম। আবিদ প্রত্যেকের জন্য একটি করে আইসক্রীম কিনলো। এক একটি আইসক্রীমের দাম বাংলাদেশী মুদ্রার মানে তিনশো টাকা। শুধু আইসক্রীম খেতে মুহূর্তে দেড়-দুই হাজার খরচ হলো। আইসক্রীম অভিনব-স্বাদের হলেও দামের কথা শুনে আমি খানিকটা বিস্মিত হলাম। জোনা রোসা থেকে আমরা শহরতলীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে অসংখ্য গ্রাম ও পাহাড়ি এলাকার অপরূপ সৌন্দর্যরাজি উপভোগ করতে করতে বাসায় ফিরে এলাম।
ক্যানসাস শহরে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চোখে পড়ল না। আবিদ বলল দু’একটি বাস নাকি আছে, কিন্তু আজ অবধি আমাদের চোখে কোন বাসের দেখা নেই। ট্যাক্সি আছে কিন্তু রাস্তায় সেটারও কোন দেখা নেই। ঙহ পধষষ -এ ট্যাক্সি পাওয়া যায়। প্রত্যেকেরই নিজস্ব গাড়ি আছে, তাই পাবলিক ট্রান্সপোর্টের তেমন একটা দরকার হয় না। ট্যাক্সির অবস্থাও তাই। ফলে রাস্তা-ঘাটে এগুলোর উপস্থিতি নেই বললেই চলে।
তবে এখানকার কেউ কেউ সকালবেলা পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে চড়ে অফিসে যায়। পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে করে অফিস করলে নাকি তাদেরকে একটা বিশেষ সুবিধা বা ধষষড়ধিহপব দেয়া হয়। কারণ পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে চললে মানুষের কায়িক পরিশ্রম হয়, স্বাস্থ্য ভাল থাকে এবং কোনভাবেই পরিবেশ দূষিত হয় না। ফলে নগর-কর্তারা এতে নাগরিকদের উৎসাহিত করে থাকেন। তাই গ্রীষ্মকালে অনেকেই গাড়ি থাকা সত্ত্বেও পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে করে অফিসে যাতায়াত করে। শীতের সময় অবশ্য এটা সম্ভব নয়। কনকনে শীত, তার উপর বরফাচ্ছাদিত পথঘাট-সেখানে পায়ে হাঁটা বা সাইকেলে চলা প্রায় অসম্ভব।
তবে আরো এক শ্রেণীর লোক সকাল বেলা দলবদ্ধভাবে পায়ে হেঁটে অফিসে যায়। এদের গাড়ি নেই এবং যেহেতু পাবলিক ট্রান্সপোর্ট দু®প্রাপ্য, অতএব, চরণযাত্রা ছাড়া এদের উপায় কী? আমি আবিদকে জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? কারণ এদেশী লোকদের তো এ রকম অবস্থা হবার কথা নয়। আবিদ বলল, এরা সবাই ভারতীয়। প্রতিদিন এখানে বহু ভারতীয় লোক আসে নতুন চাকরি নিয়ে। প্রথম অবস্থায় এরা কোন রকমে থাকার একটা ব্যবস্থা করলেও গাড়ির ব্যবস্থা করতে সময় লাগে, ততদিন তারা এভাবেই কষ্ট করে চলাফেলা করে। আমি জানতে চাইলাম, প্রতিদিন এভাবে এত ভারতীয় ভিসা পায় কীভাবে? সে বলল, এদেশের সাথে ভারতের একটি সমঝোতা চুক্তি আছে, যার ফলে চাকরির ক্ষেত্রে ভারতীয়দের বিশেষ সুবিধা দেয়া হয় এবং চাকুরি পেলেই তিন-চার মাসের জন্য তাদেরকে একটা ভিসা দেয়া হয়। সে সুবাদে তারা এভাবে দলে দলে আসার সুযোগ পায়। তাছাড়া, এদেশে কিছুসংখ্যক ভারতীয় বড় কোম্পানী আছে। যারা প্রতিষ্ঠার সময়েই এদেশের সরকারের সাথে এ মর্মে চুক্তিবদ্ধ হয় যে, তাদের কোম্পানীতে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ভারতীয় নাগরিককে চাকরি দিতে হবে। ফলে তারা সহজেই ভারত থেকে শ্রমিক নিয়োগের সুযোগ পায়। এ কারণে প্রতিদিন অসংখ্য ভারতীয় নাগরিক আমেরিকায় আসে বিভিন্ন ধরনের চাকরি নিয়ে।
শুনে আমি ভারত সরকার ও ভারতীয় কোম্পানীগুলোর দেশপ্রেমের তারিফ না করে পাররাম না। তারা নিজ দেশের স্বার্থ ও জনগণের কল্যাণের কথা যেভাবে চিন্তা করে আমাদের দেশের সরকার ও পুঁজিপতিরা কি সেভাবে কখনো চিন্তা করেছে?
যেহেতু বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ দরিদ্র ক্রমবর্ধমান দেশ। নগরায়ণ, শিল্পায়ন, গৃহায়ণ ও ঘনবসতির চাপে সেখানে জমির অভাব দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে, বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই বাংলাদেশ সরকারও সম্ভবত এসব কারণ দেখিয়ে আমেরিকায় ব্যাপক হারে শ্রমিক প্রেরণের চুক্তি করতে পারে। এ পদক্ষেপ উভয় দেশের উন্নয়নেই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এসব জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চিন্তা করার এবং সে সম্পর্কে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার মত দূরদর্শিতা, নিষ্ঠা ও সাহস আমাদের আছে কিনা সেটাই বড় প্রশ্ন।
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Facebook: facebook.com/samoiki
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments