আলিফ লায়লা : আরব্য রজনী_পর্ব-৬২
ইংরেজি অনুবাদ : ডঃ জে. সি. মারদ্রুস
বাংলা অনুবাদ : ক্ষিতিশ সরকার
চলতে চলতে অবশেষে একদিন সে সমুদ্রের ধারের বন্দর শহরে এসে হাজির হয়। শহরটার নাম তারাব। সেখানে কিন্তু কেউ বদরের কাহিনী শোনেনি। কিন্তু তার বদলে সেখানকার শাহজাদা কামার আল-জামানের অদ্ভুত দুরারোগ্য ব্যাধির কথা লোকের মুখে মুখে। কামার আল-জামান সেই দেশের সুলতানের একমাত্র সস্তান। নানা লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করে। কামার আল-জামানের আজব কাহিনী সব জেনে নিলো। সব শুনে তার মনে হয়, কোথায় যেন বদরের কাহিনীর সঙ্গে এর একটা যোগসূত্র আছে। একজনকে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা! ভাইসব, কোথায় গেলে সেই শাহজাদার দেখা পাওয়া যাবে?
লোকটি
বলে,
সুলতান
শাহরিমানের সলতানিয়ত কি
আর
এতটুকু!
সাত-সমুদ্র তের নদী
পারেও
তার
শেষ
নাই।
সুলতান
শাহরিমানের দরবার
হলো
খালিদানে। হাঁটাপথে ছ’মাস লাগে। আর
সাগর
পাডি
দিয়ে
গেলে
লাগবে
পুরো
এক
মাস।
মারজীবন একখানা নৌক ভাড়া করে যাত্রা করলো। পালের হাওয়া অনুকূলেই ছিলো! তর তর করে বয়ে চলে নৌকা। এইভাবে প্ৰায় একটা মাস কেটে গেছে, খালিদান শহর আর বেশি দূরের পথ নয়। মারজাবনের প্রাণ আশায় দুলে ওঠে।
হঠাৎ ঈশান কোণে মেঘ দেখা গেলো। এখনি ঝড় উঠবে। মারজাবনের মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। এখন কি হবে উপায়? এই অকুল দরিয়ায় বেঘোরে প্রাণ হারাতে হবে!
কয়েক
মুহূর্তের মধ্যে
ঝড়ের
তাণ্ডব
শুরু
হলো।
মাঝি
হাল
ঠিক
রাখতে
পারলো
না।
পালের
কাছি
ছিঁড়ে
গেলো।
প্রচণ্ড শব্দে
নৌকাটা
গিয়ে
ধাক্কা
খেলো
এক
পাহাড়ের গায়ে।
সঙ্গে
সঙ্গে
টুকরো
টুকরো
হয়ে
গেলো।
মারজাবন ভালো সাঁতারু। তা হলেও তাণ্ডবের সঙ্গে লড়াই করা—সে কি চাট্টিখানি কথা। যাইহোক, কোনও রকমে একটা ভাসমান বয়া ধরে সে প্রাণ রক্ষা করতে পারলো। ঢেউ-এর সঙ্গে উথলি পাতাল হতে হতে এক সময় সে সুলতান শাহরিমানের প্রমোদ প্রাসাদের ধারে এসে ভিড়লো।
বরাতের জোরে সে-যাত্রা সেখানে এসেছিলো। ঐ সময় সুলতানের উজির দরবারের দরকারি কাজকর্মে সেখানে এসেছিলো। তারই নজরে পড়ে মারজােবন! প্রাসাদের একটা জানলা দিয়ে সমুদ্রের দিকে চেয়ে চেয়ে তার তাণ্ডবলীলা দেখছিলো। হঠাৎ দেখতে পেলো, একটা বয়া এগিয়ে আসছে প্রাসাদের দিকে। সেই বয়াটা আঁকড়ে ধরে আছে একটি যুবক। তৎক্ষণাৎ নফর চাকরীদের বললো, যা, দেখতো, একটা লোক বোধহয় বয়া ধরে ভাসতে ভাসতে এসে ভিড়েছে। ঘাটের সিঁড়িতে। নিয়ে আয় তাকে।
চাকরবাকররা ছুটে গেলো। একটু পরে প্রায় অচৈতন্য মারজীবনকে ধরাধরি করে নিয়ে এলো তারা উজিরের সামনে। জামাকাপড় বদলে দেওয়া হলো। একজন এক গেলাস সরবৎ এনে ধরলো তার সামনে। সরবৎটুকু খাওয়ার পরে একটু চাঙ্গা হয়ে উঠলো সে।
ছেলেটিকে দেখে উজিরের বেশ ভালো লাগে। চোখে মুখে বুদ্ধিদীপ্ত ছাপ। সুন্দর চেহারা, সুঠাম দেহ। দেখে মনে হয় বহুদূর দেশের মুসাফির।
এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
একশো ছিয়ানব্বইতম রজনী :
উজির
মারজীবনকে উদ্দেশ
করে
বলে,
এই
ঘোর
বিপদের
দিনে
আল্লাহ
তোমাকে
বোধহয়
আমাদের
কাছে
পাঠিয়েছেন।
মারজীবন একথার অর্থ বুঝতে পারে না, কেন জনাব, একথা বলছেন কেন? আমি নৌকা করে চলছিলাম—উদ্দেশ্য ছিল খালিদানের শাহজাদা কামার আল-জামানের সঙ্গে মোলাকাৎ করবো। কিন্তু আল্লাহর বুঝি তা ইচ্ছা নয়, তাই ঝড়তুফানের মধ্যে পড়ে নৌকাটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। আমি কোনরকমে এই বয়াটা ধরে আত্মরক্ষা করেছি। তাও আপনারা না থাকলে হয়তো দরিয়ার জলে জান হারাতে হতো।
উজির অবাক হয়ে চেয়ে থাকে।–শাহজাদা কামার আল-জামানের সঙ্গে তোমার কি দরকার?
—না মানে,
শুনেছি
তিনি
খুব
অসুস্থ। মানে!—মাথার নাকি—
উজির বলে ঠিকই শুনেছো, শাহজাদা কামার আল-জামান বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। তাকে সারাবার অনেক চেষ্টাই করা হয়েছে-হচ্ছে, কিন্তু কোনও হেকিম বন্দিাই কিছু করতে পারছে না। তা-তোমার কি করা হয়?
–যে আজ্ঞে
আমিও,
রোগবালাই-ই সারাই। তবে কোনও
দাওয়াই
পত্র
দিয়ে
নয়।
–তবে?
তাবিজ
কবজ
ঝাড়ফুক
মন্তর—এই হচ্ছে আমার
তরিকা।
উজিরের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে—আমার মনে হচ্ছে তুমিই পারবে। কারণ এত ঝড় ঝঞার মধ্যেও আল্লাহ তোমাকে ঠিক জায়গাতেই পৌঁছে দিয়েছেন। এ হচ্ছে সুলতান শাহরিমানের বিলাস ভবন। তারই পুত্র কামার আল-জামানকে এখন এই প্রাসাদেই এনে রাখা হয়েছে। তুমি যদি চাও তার সঙ্গে দেখা করতে পারো।
মারজীবন বলে, নিশ্চমই দেখা করবো, জনাব। কিন্তু তার আগে আগাগোড়া বৃত্তান্ত সব একবার শোনা দরকার।
উজির বললো, একবার কেন, একশোবার শোনাবো। আমরা চাই, আমাদের সিংহাসনের একমাত্র উত্তরাধিকারী শাহজাদা জামান সুস্থ হয়ে উঠুক। তার জন্যে যে মূল্য প্রয়োজন আমরা দিতে প্রস্তুত।
এরপরে আগাগোড়া সব কাহিনী তাকে শোনালো উজির। মারজাবনের আর বুঝতে বাকি থাকে না শাহজাদা জামানের সে-রাতের নায়িকা বন্দর ছাড়া আর কেউ-ই নয়। একটা নতুন আবিষ্কারের আনন্দে তার মনে নেচে ওঠে। কিন্তু তখুনি নিজেকে সামলে নেয়। উজিরকে সে বুঝতে দিতে চায় না তার মনের ভাব। বললো, ঠিক আছে, আগে তার সঙ্গে আমার করিয়ে দিন। নিজের চোখে একবার দেখি রুগীকে। তারপর বলবো, পারবো কি পারবো না। তবে খোদা আমার একমাত্র ভরসা, কোনও দাওয়াই পত্রে আমি বিশ্বাস করি না, আশা হয়। পারবো।
আর মুহূর্ত মাত্র বিলম্ব না করে উজির মারজীবনকে শাহজাদা জামানের কক্ষে নিয়ে যায়। প্রথম দর্শনেই সে চমকে ওঠে। এত রূপ কোনও পুরুষের হয়? যেন মনে হয় রাজকুমারী বদরের জুটির জন্যেই সে জন্মেছে। আর বদরের মুখেও তার মেহেবুবের চেহারার যে বর্ণনা সে শুনে এসেছে তার সঙ্গে এই সুরৎ হুবহু মিলে যাচ্ছে।
কামার আল-জামান কৃশ অবসন্ন দেহে বিছানায় শুয়েছিলো। চোখের ইশারায় মারজীবনকে বসতে বললো সে। শাহরিমান ভাবছেন, ছেলে হয়তো কিছু ব্যক্তিগত কথাবার্তা বলতে চায় ছেলেটির সঙ্গে। তাই তিনি উজিরকে নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে যান।
মারজীবন ফিসফিস করে বলে : আর কোনও ভয় নাই। আল্লাহ আমাকে দূর করে পাঠিয়েছেন। এখানে। আপনারী ভালোবাসার’ খবর বয়ে নিয়ে এসেছি আমি।
জামান সন্দেহাকুল চোখে তাকায়। লোকটা এদেরই চর নয় তো। হয় তো বা কোনও নতুন ফন্দী।–ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। সে মারজীবনের মুখের দিকে।
—কী, বিশ্বাস হচ্ছে না? হবে হব। সব বলছি সব প্রমাণ আছে আমার কাছে। স্বয়ং ইষ্ট রাজকুমারী বদর আমাকে বলেছেন আপনাদের সেই রাতের সাহাগ মিলনরে কাহিনী।
এরপরে মারজীবন যে সব খুঁটিনাটি বিবরণ দিতে থাকলো তাতে সন্দেহের কোনও অবকাশ রইলো না-ছেলেটা আর যাই হোক তার বাবা বা উজিরের কোনও গুপ্তচর নয়।
মারজাবন বললো, রাজকুমারীর নাম বদর। সম্রাট ঘায়ুরের একমাত্র সন্তান। সে আমার পাতানো বোন। ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে আমরা মানুষ হয়েছি।
কামার আল-জামান-এর চোখ দুটো চকচক করে ওঠে। যেন একটা আশার আলো দেখতে পায়।–তা হলে আর দেরি নয় দোস্ত, চল আজই আমরা রওনা হয়ে যাই, সম্রাট ঘায়ুরের দেশে।
মারজীবন বলে, সে দেশ তো অনেক দূরের পথ। তোমার এই শরীরে এখনই রওনা হওয়া ঠিক হবে না। সে ধকল তুমি সহ্য করতে পারবে না। আগে শরীরটাকে সারিয়ে নাও, তারপর যাওয়া যাবে। আমি তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলে তবে রাজকুমারী বন্দর সুস্থ হয়ে উঠবেন।
এই সময় রাত্রি শেষ হতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
একশো নিরানব্বইতম রজনী :
আবার
সে
শুরু
করে
:
কৌতূহল
চাপতে
না
পেরে
সুলতান
শাহরিমান আবার
ঘরে
ঢুকেই
অবাক
হয়ে
যান।
আনন্দে
নেচে
ওঠে
তার
বুক।
এতদিন
পরে
ছেলের
মুখে
তিনি
হাসি
দেখলেন। এই
মুহূর্তেই তার
মুখের
বিষণ্ণতা মুছে
গেছে।
তিনি
শুনলেন,
জামান
বলছে,
তুমি
বসো,
দোস্ত,
আমি
হামাম
থেকে
হাতমুখ
ধুয়ে,
সাজপোশাক পালটে
একটু
পরিপটি
হয়ে
আসি।
সুলতান ছুটে এসে মারজাবনকে জড়িয়ে ধরেন। আনন্দে তিনি আজ আত্মহারা। কি যাদু দিয়ে, কেমন করে ছেলেকে সে প্রাণবন্ত করে তুললো সে সব আর জানতে চাইলেন না। তিনি। জামান যে আবার সুস্থ হয়েছে-এই-ই তার কাছে যথেষ্ট।
সবচেয়ে মূল্যবান রত্নাভারণে মারজাবনকে ভূষিত করলেন তিনি। উপহার দিলেন দামী দামী সাজপোশাক। সারা শহরের মানুষ নাচ গান হৈ হল্লায় মেতে উঠলো। আলোয় মালায় সাজানো হলে প্রাসাদ। দু’হাতে বিতরণ করা হতে থাকলো টাকা পয়সা, পোশাক-আশাক খানা-পিন্যা। বন্দীদের মুক্ত করে দেওয়া হলো। আবার দরবারকক্ষ গমগম করে উঠলো।
কয়েকদিন বাদে, শাহজাদা জামান তখন বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছে, মারজীবন বললো, এবার যাত্রার আয়োজন করো দোস্ত। আমার বোনের অবস্থা যে কি, তা তো বুঝতে পারছে।
কামার আল-জামান বিমৰ্ষভাবে বলে, কিন্তু, আব্ববাজান আমাকে যেতে দেবেন না, মারজাবন। তিনি আমাকে কাছ ছাড়া করে একটা দিনও থাকতে পারেন না। আমি আবার অসুখে পড়বো, মনে হচ্ছে। তার আদর্শন আমি সইবো কি করে।
মারজাবন তাকে সান্ত্বনা দেয় কিছু ভাবনার নাই, দোস্ত, সব ঠিক হয়ে যাবে। উপায় আমি বাৎলে দিচ্ছি। তবে একটুখানি মিথ্যের আশ্রয় নিতে হবে। তা-শুভ কাজে একটু আধটু মিথ্যে বললে এমন কিছু গোস্তাকি হয় না। তুমি শুধু সুলতানকে বলবে, মারজীবন তোমাকে নিয়ে দিন কয়েকের জন্য শিকারে যেতে চাইছে। দেখবে কোনও অমত করবেন না। আমার ওপর এখন তিনি দারুণ খুশি। তাছাড়া অনেকদিন একটা বদ্ধ ঘরের মধ্যে অসুস্থ হয়ে আটকে ছিলো। খোলামেলা মুক্ত আলো হাওয়া তোমার এখন যথেষ্ট প্রয়োজন।
মারজাবনের বুদ্ধির তারিফ করে জামান। সুলতানের কাছে গিয়ে বলতে তিনি না করতে পারলেন না। বললেন, কিন্তু বাবা, একটা রাতের বেশি তুমি বাইরে কাটাবে না। তা হলে আমি মরে যাবো। তুমি তো জানো, একটা রাত তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারি না।
দু’জনের জন্য দুটো সেরা তাগড়াই ঘোড়া সাজানো হলো। সঙ্গে আরও ছ’জন ঘোড়সওয়ার, লোক লস্কর, উট, খানা পিনা, সাজ পোশাক তাঁবু প্রভৃতির লাট বহর নিয়ে রওনা হলো তারা। শহরের সীমান্ত মুখ পর্যন্ত সঙ্গে সঙ্গে এলেন সুলতান। চোখের জল ফেলতে ফেলতে বিদায় জানালেন।
বেড়াবো। কেন জানো? সঙ্গের লোকজনের মনে কোনও সন্দেহ যাতে না হয়, সেইজন্য একটা দিন আমরা যথার্থ শিকারীই না হয় হলাম। তারপরের ফন্দী আমি ভেবেই রেখেছি।
সারাদিন ধরে খুব হৈ হল্লা দৌড় ঝাপ করে শিকার সমাধা করা হলো। সন্ধ্যাবেলা একটা বাগানের মধ্য তাঁবু ফেলে খানাপিনা শেষ করে শুয়ে পড়লো সকলে।
রাত্রি তখন তৃতীয় প্রহর। সঙ্গের লোকজন সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো। সবাই তখন বেঘোরে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। মারজাবন জামানকে জাগালো। ফিসফিস করে ওর কানে কানে বললো, এই রাতে এখুনি আমাদের পালাতে হবে। সবাই ঘুমে অচেতন কেউ টের পাবে না। নাও, ওঠ, দুজনে দুটো ঘোড়ায় চেপে কেটে পড়ি।
তখুনি, আর কাল বিলম্ব না করে, জামান আর মারজীবন অতি সন্তৰ্পণে সেখান থেকে সরে পড়লো। কিছুদূর ধীরে ধীরে চলার পর জোর কদমে ঘোড়া চালিয়ে ভোর না হতেই বহু যোজন পথ পার হয়ে গেলো তারা। আসার সময় তারা সঙ্গে এনেছিলো একটা তোরঙ্গ! তার মধ্যে ছিলো কিছু সাজপোশাক, এক বাক্স সোনার মোহর আর খানিকটা খানাপিনী। এছাড়া এনেছিলো একটা বাড়তি ঘোড়া।
সকাল হয়ে গেলো। একটা চৌরাস্তার মোড়ে এসে থামলো ওরা। মারজীবন বললো, দোস্ত, তোমার জামা আর পাতলুন খুলে আমার হাতে দাও। আর তোরঙ্গ থেকে একটা সাধারণ সাজ পোশাক বের করে পরে।
জামান বুঝতে পারে না কিছুই শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
–কী ব্যাপার? কেন?
–যা বলছি
করো,
কোনও
প্রশ্ন
করো
না।
জামান আর কথা না বাড়িয়ে সাজপোশাক বদলে জামা পাতলুন তুলে দেয় মারজাবনের হাতে। মারজীবন বলে, এবার তুমি এখানে অপেক্ষা করো, আমি আসছি।
এই বলে সে জামানের জামা পাতলুন কাঁধে ফেলে সেই ফালতু ঘোড়াটাকে নিয়ে পাশের জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ে।
একটু পরে সে ফিরে এলো। জামান অবাক হয়ে দেখলো, তার সাধের সৌখিন জামা পাতলুন রক্তে রাঙা। মারজীবন বলে ঘোড়াটাকে জবাই করে খুনে মাখিয়ে নিলাম তোমার সাজপোশাক। এবার দেখো, এ গুলোকে এই চৌমাথার এক পাশে ফেলে রেখে আমরা উধাও হয়ে যাবো।
জামান হাসে। সব তার কাছে জলের মতো পরিষ্কার হলো এতক্ষণে। কি অসাধারণ বুদ্ধি মারিজীবনের।
মারজীবন বলে, এসো এবার নাস্তা সেরে নিই! আবার কখন কোথায় থামবো, তার তো ঠিক নাই।
দু’জনে বসে পেট ভরে খানাপিনা করলো। মারজীবন বললো, আর দেরি নয়। এবার ঘোড়ার পিঠে ওঠে। টগবগিয়ে ছুটািবো। দুপুর হওয়ার আগেই আমাদের অনেক দূর চলে যেতে হবে। এতক্ষণে তোমার শিকারের সঙ্গী নফর চাকররা ঘুম থেকে উঠে আমাদের নিশ্চয়ই খোঁজাখুঁজি করছে। এরপর তারা অনেক খোঁজাখুজি করেও যখন কোনও হদিশ করতে পারবে না, সুলতানের কাছে গিয়ে জানাতেই হবে। সে ধরে, আজ দুপুর নাগাদ সুলতান খবর পাবেন। তারপর কি হবে বুঝতেই পারছে, তার হুকুমে একদল সৈন্যসামন্ত ছুটাছুটি শুরু করে দেবে। এক সময় তাদের কেউ চৌরাস্তার মোড়েও আসবে। দেখবে, তোমার সাজপোশাক রক্তে রাঙা-পড়ে আছে পথের ধারে। জঙ্গলটার মধ্যে ঢুকবে তারা। দেখবে, তোমার ঘোড়াটা মরে পড়ে আছে। ভাববে কোনও ভয়ঙ্কর জানোয়ারের মুখে পড়ে ঘোড়াটা ঘায়েল হয়েছে! তোমাকে সে খাবার করে নিয়ে চলে গেছে। এই সাংঘাতিক বিবরণ যখন সুলতান শুনবেন, সুলতানের সে যে কি নিদারুণ অবস্থা হবে আমার বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। কিন্তু কি করা যাবে, এছাড়া সহজ উপায়ে তোমাকে তার কাছ থেকে নিয়ে আসা যেত না। তবে এও ভাবো। বিষম শোকতাপে দগ্ধ হতে হতে একদিন যখন তোমাকে আবার ফিরে পাবেন তখন তিনি কত আনন্দ পাবেন? সে আনন্দের কোনও তুলনা নাই। জানি তো, সব ভালো, যার শেষ ভালো।
জামান বলে, তোমার মতো বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের কথা। তোমার উপস্থিত বুদ্ধি, বিচক্ষণতার কোনও তুলনা নাই। ধন্যবাদ জানিয়ে তোমাকে ছোট করবো না। কিন্তু চলার পথে তো আমাদের অনেক খরচ হবে। সে পয়সাকডি তো আমার সঙ্গে নাই। তবে আমার হাতে মহামূল্যবান কয়েকটা আংটি আছে। বিক্রি করলে লাখখানেক মোহর দাম হতে পারে। এগুলো কোথাও বেচে রাহাখরচ চালাবার ব্যবস্থা করো।
মারজীবন বলে, ও নিয়ে তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না, চাঁদ। আমি সব ব্যবস্থা পাকা করেই এসেছি। আমার ওপর খুশি হয়ে তোমার বাবা আমাকে বহু ধনরত্ন এবং নগদ এক লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার দিয়েছেন। সেগুলে সব এই তোরঙ্গের মধ্যে একটা বাক্সে নিয়ে এসেছি আমি। সম্রাট ঘায়ুরের সাম্রাজ্যে পৌঁছতে আমাদের এত পয়সার দরকারই হবে না; জামান। আর তাছাড়া তোমার হাতের ঐ অমূল্য রত্নগুলো বেচিতে গেলেই ধরা পড়ে যেতে হবে। জহুরীর হাতে পড়লেই তার সন্দেহ হবে। এসব বস্তু তো ইতর সাধারণের কাছে থাকতে পারে না। এদিকে তোমার বাবা সুলতান শাহরিমানও নিশ্চয়ই চুপ করে বসে থাকবেন না। তার নিজের দেশ ছাড়াও আশেপাশের আর পাঁচটা দেশেও হুলিয়া জারি করে দেবেন। একটা সামান্য জহুরী মোটা পুরস্কারের লোভে তোমাকে ধরিয়ে দেবে না, সে কি হতে পারে। সুতরাং ওগুলো বরং খুলে জেবের ভেতরে রেখে দাও।
একনাগাড়ে মাসখানেক চলার পর একদিন সকালে তারা সম্রাট ঘায়ুরের রাজধানীর উপান্তে এসে পৌঁছল। কামার আল-জামানের আর ধৈর্য মানে না, তখনি সে সম্রাট ঘায়রের সঙ্গে দেখা করতে চায়। কিন্তু মারজীবন বলে, ধৈৰ্যং কুরু, বন্ধু, এখানে তিষ্ঠ ক্ষণকাল।
শহরের প্রান্তমুখে একটা বনেদী সরাইখানা। মারজীবন বলে, এখানে উঠবো আমরা। দিন তিনেক বিশ্রাম করবো আগে। বাকবা, একটানা একমাস ঘোড়ার পিঠে-গায়ের হাড়মাংস আর নাই। বেদনায় টনটন করছে। টানটান হয়ে আগে শুয়ে কাটাবো তিনটে দিন। তারপর অন্যকথা।
সরাইখানার একটা ঘরে পাশাপাশি দুটো পালঙ্কে দুই বন্ধু তিন দিন তিন রাত্রি শুয়ে শুয়ে কাটালো। পথের ক্লান্তি কেটে গিয়ে ফোটাফুলের স্নিগ্ধতা ফুটে ওঠে। জামানের মুখে। দেহমান বেশ ঝরঝরে। মনে হয়। মারজাবন বলে, নাও, এবার হামামে চলো, তোমাকে আমি নিজে হাতে ঘষে মোজে সাফ করে গোসল করাবো।
স্নানাদি শেষ করে এক জ্যোতিষের বেশ ধারণ করল জামান। মারজীবন তাকে সুন্দর করে সাজালো। জামানের যা রূপ তাতে ওকে যে সাজেই সাজানো যাক, অপরূপ লাগবে।
সম্রাট ঘায়ুরের প্রাসাদের পথে পা বাড়াতেই শহরের আবালবৃদ্ধবনিতা এসে ভিড় জমাতে থাকলো; এমন রূপের হাট তারা আগে কখনও দেখেনি। পথচারীদের কেউ কেউ জানতে চাইলো, কী অভিপ্ৰায়ে যাওয়া হচ্ছে রাজদরবারে।
জামান গর্বভরে ঘোষণা করে, আমি ত্ৰিভুবন জয়ী জ্যোতিষ। আমার অসাধ্য কিছুই নাই। রাজকুমারী বদর-এর দুরারোগ্য ব্যাধির কথা শুনে বহু দূর দেশ থেকে আসছি। তার সব রোগ আমি সারিয়ে দেব।
জনতার মধ্যে গুঞ্জন ওঠে। লোকটা বলে কি? সে কি জানে না, আজ পর্যন্ত যত গুণীজ্ঞানী হেকিম বিদ্যি এসেছে, তাদের কি দশা হয়েছে।
কে একজন বলে, তা মরার জন্য যদি পাখা গজায়, কে আর আটকাতে পারে বলে। ঐ যে ওখানে যাদের কাটা মুণ্ডু, ঝুলছে ওখানে গুণতিতে আর একটা মুণ্ডু বাড়বে—এই আর কি
মেয়েরা চুকচুক করে, আহা রে, চাঁদের মতো সুরৎ, মনে হয় বড়ঘরের ছেলে। এমন রূপ এমন যৌবন-সব শেষ হয়ে যাবে।
অনেকে বারণ করে, দেখো বাপু, আমন কাজটি করতে যেও না। যা কেউ পারলো না, তা যে তুমিও পারবে না তা জানি। পাতালপুরীর রাজপুত্ত্বরের মতো তোমান মন ভোলানো রূপ আছে তাও মানছি—কিন্তু ওতে তো ভাবি ভুলবে না। আমাদের সম্রাটের প্রতিজ্ঞা বড় সাংঘাতিক। মুখ দিয়ে একবার যা বের করবে তার আর নড়াচড় হবে না। রাজকুমারীর রোগ যদি সারাতে না পারো বাছা, তা সে তোমার যত রূপ-গুণাই থাক, গর্দান তোমাকে দিতেই হবে। তাই বলছি, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও! কি দরকার অত লোভে। জানেই যদি না বাঁচলে কি হবে রাজত্ব আর রাজকন্যা দিয়ে?
কামার
আল-জামান সে-সব
কথায়
কৰ্ণপাত করে
না।-মুডিমিছরি এক করে দেখো
না
তোমরা,
এই
আমার
অনুরোধ। আমার
পীরের
কাছ
থেকে
যে
বিদ্যা
আমি
আহরণ
করেছি,
তাতে
মরা
মানুষকে আবার
বাঁচিয়ে দিতে
পারি—পাগল তো কোন
ছার।
এই কথা শুনে চমকে ওঠে সকলে। মরা মানুষকে জীয়ন্ত করতে পারে।
মুহূর্তে লোকের মুখে মুখে সারা শহর ছড়িয়ে পড়ে এই অদ্ভুত জ্যোতিষীর কথা। শহর ভেঙে পড়ে তাকে দেখতে।
মারজীবন বলে, প্রাসাদের ফটকে গিয়েই আমি কিন্তু কেটে পড়বো। তোমাকে আমার সঙ্গে দেখলে সম্রাট ঘায়ুর অন্যরকম ভাবতে পারেন। আমি প্রাসাদের অন্দরেই থাকবো। লক্ষ্য করবো তোমার কীর্তিকলাপ। কিন্তু সাবধান, যা শিখিয়ে দিয়েছি, সেইভাবে ঠিক ঠিক করে যাবে।
হুহু করে জনস্রোত বাড়তে থাকে। সবাই দেখতে ব্যাকুল জামানকে। নতুন চিড়িয়া ফাদে ধরা দিতে এসেছে। প্রধান ফটকের প্রহরী পথ রুখে দাঁড়ায়।
–আপ কৌন হ্যায়? কাকে চান?
জামান
বলে,
আমি
এক
বিদেশী
জ্যোতিষী। এসেছি।
রাজকুমারীর ব্যাধি
সারাতে। তুমি
মহামান্য সম্রাটকে খবর
দাও।
আমি
তার
সঙ্গে
দেখা
করতে
চাই।
প্রহরীরা অবাক হয়। সব জেনে শুনে এমন সোনার চাঁদ ছেলেটি হাড়ি কাঠে মাথা দিতে চায়। প্রধান প্রহরী এগিয়ে এসে বলে, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যান মালিক, এখানে একবার যে ঢুকেছে, প্ৰাণ নিয়ে আর ফিরে যেতে পারেনি।
জামান বিরক্ত হয়।–আমি কারো উপদেশ শুনতে আসিনি। রাজকুমারীর দুরারোগ্য রোগ সারাতে এসেছি। তুমি সম্রাটকে সংবাদ দাও। আমি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই।
বাইরে কোলাহল শুনে সম্রাট উজিরকে পাঠালেন। —যাও দেখতে বাইরে কোনও বিদেশী মুসাফীর এসেছে মনে হচ্ছে, নিয়ে এসো তাকে।
দরবারে প্রবেশ করে আভুমি আনত হয়ে সম্রাট ঘায়ুরকে কুর্নিশ জানায় জামান।
কামার আল-জামানের মুখের দিকে তাকিয়েই সম্রাট চোখ বন্ধ করে ফেলেন। একি অপরূপ সুন্দর চেহারা। এমন রূপবান মানুষ তো কোথাও দেখেন নি। কেমন যেন সব তালগোল পাকিয়ে যায়।
— শোনো বাবা, সম্রাট ঘায়ুর বলেন, চাঁদের মতো তোমার এই রূপ, আর এমন কচি বয়সী। পাত্র হিসাবে তুমি আমার পরমাসুন্দরী কন্যা বদরের আদর্শ জুটি হতে পারো সন্দেহ নাই। কিন্তু জানো তো আমার শর্ত, তাকে যদি সারাতে না পারো-আমি তোমাকে কোনও ভাবেই রেহাই দিতে পারবো না। তাই এখনও বলছি, নিজের প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি না খেলে ফিরে যাও। অবশ্য তুমি এসেছে, আমার মেয়ের রোগ সারাতে। তোমাকে নিরস্ত করলে আমার লাভ কি! বরং একটা আশা নিয়ে কিছু সময় কাটাতে পারবো–যদি আমার নয়নমণিকে তুমি সারিয়ে তুলতে পারো। কিন্তু তা যে অসম্ভব। কত দেশের কত ডাকসাইটে ডাক্তার, কবরেজ, হেকিম উনানী এলো, তাদের কেউই প্ৰাণে বেঁচে ফিরে যেতে পারে নি। তা তোমার যদি শখ হয়, চেষ্টা করে দেখতে পারো। তবে আমার ঐ এক শর্ত বাবা, না পারলে তোমার মুণ্ডু কেটে ঝুলিয়ে রাখা হবে।
—আমি রাজি আছি মহামান্য সম্রাট। আপনার সব শর্ত জেনেই আমি এসেছি।
সম্রাট ঘায়ুর প্রধান খোজাকে বললেন, একে অন্দর মহলে নিয়ে যা। রাজকুমারীর ব্যামো সারাতে এসেছে। যা বলবে শুনবি।
জামানকে সঙ্গে নিয়ে খোজা রাজকুমারী বন্দরের হারেমে যেতে যেতে বলে, তা সাহেবের, জামাই সাজার শখ হয়েছে বুঝি। এমন আহম্মক আর কতজন আছে কে জানে?
–আমি আহাম্মক নই।
জেনেশনে কেউ
জান
খোয়াতে
আসে
না—আসা উচিত না।
অন্ততঃ
আমি
আসিনি।
তোমাদের রাজকুমারীকে আমি
সারিয়ে
তুলবোই। আর
এ-ও আমার ক্ষমতা
আছে
তাকে
চোখে
না
দেখেই
আমি
তার
সব
রোগ
সারিয়ে
দেব।
দেখবে?
খোজাটা
এবার
ভ্যাবাচ্যাক খেয়ে
যায়।
—সে
কি?
রুগীকে
না
দেখেই
রোগ
সারবেন!
তা
যদি
পারেন,
আমরা
আপনার
কেনা
গোলাম
হয়ে
থাকবো,
মালিক।
আমাদের
সম্রাট
আপনাকে
মাথায়
করে
রাখবেন। রাজকুমারী আপনার
হবে।
—দেখা পারি কি না, জামান দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলে, আমাকে শুধু একবার রাজকুমারী বদর-এর দরজার সামনে নিয়ে চলো। আমি ভিতরে ঢুকবে না। পর্দার এপারে থেকেই তার সব রোগ সারিয়ে দেব।
জামান আর খোজা রাজকুমারীর দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। বলে, একখানা কুর্শি নিয়ে এসো। এখানে আমি বসবো।
সঙ্গে সঙ্গে একখানা আরামকেদারা এনে দেওয়া হলো। জামান জেব থেকে কাগজ কলম বের করে একখানা চিঠি লিখলো।
এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
বাংলা অনুবাদ : ক্ষিতিশ সরকার
চলতে চলতে অবশেষে একদিন সে সমুদ্রের ধারের বন্দর শহরে এসে হাজির হয়। শহরটার নাম তারাব। সেখানে কিন্তু কেউ বদরের কাহিনী শোনেনি। কিন্তু তার বদলে সেখানকার শাহজাদা কামার আল-জামানের অদ্ভুত দুরারোগ্য ব্যাধির কথা লোকের মুখে মুখে। কামার আল-জামান সেই দেশের সুলতানের একমাত্র সস্তান। নানা লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করে। কামার আল-জামানের আজব কাহিনী সব জেনে নিলো। সব শুনে তার মনে হয়, কোথায় যেন বদরের কাহিনীর সঙ্গে এর একটা যোগসূত্র আছে। একজনকে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা! ভাইসব, কোথায় গেলে সেই শাহজাদার দেখা পাওয়া যাবে?
মারজীবন একখানা নৌক ভাড়া করে যাত্রা করলো। পালের হাওয়া অনুকূলেই ছিলো! তর তর করে বয়ে চলে নৌকা। এইভাবে প্ৰায় একটা মাস কেটে গেছে, খালিদান শহর আর বেশি দূরের পথ নয়। মারজাবনের প্রাণ আশায় দুলে ওঠে।
হঠাৎ ঈশান কোণে মেঘ দেখা গেলো। এখনি ঝড় উঠবে। মারজাবনের মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। এখন কি হবে উপায়? এই অকুল দরিয়ায় বেঘোরে প্রাণ হারাতে হবে!
মারজাবন ভালো সাঁতারু। তা হলেও তাণ্ডবের সঙ্গে লড়াই করা—সে কি চাট্টিখানি কথা। যাইহোক, কোনও রকমে একটা ভাসমান বয়া ধরে সে প্রাণ রক্ষা করতে পারলো। ঢেউ-এর সঙ্গে উথলি পাতাল হতে হতে এক সময় সে সুলতান শাহরিমানের প্রমোদ প্রাসাদের ধারে এসে ভিড়লো।
বরাতের জোরে সে-যাত্রা সেখানে এসেছিলো। ঐ সময় সুলতানের উজির দরবারের দরকারি কাজকর্মে সেখানে এসেছিলো। তারই নজরে পড়ে মারজােবন! প্রাসাদের একটা জানলা দিয়ে সমুদ্রের দিকে চেয়ে চেয়ে তার তাণ্ডবলীলা দেখছিলো। হঠাৎ দেখতে পেলো, একটা বয়া এগিয়ে আসছে প্রাসাদের দিকে। সেই বয়াটা আঁকড়ে ধরে আছে একটি যুবক। তৎক্ষণাৎ নফর চাকরীদের বললো, যা, দেখতো, একটা লোক বোধহয় বয়া ধরে ভাসতে ভাসতে এসে ভিড়েছে। ঘাটের সিঁড়িতে। নিয়ে আয় তাকে।
চাকরবাকররা ছুটে গেলো। একটু পরে প্রায় অচৈতন্য মারজীবনকে ধরাধরি করে নিয়ে এলো তারা উজিরের সামনে। জামাকাপড় বদলে দেওয়া হলো। একজন এক গেলাস সরবৎ এনে ধরলো তার সামনে। সরবৎটুকু খাওয়ার পরে একটু চাঙ্গা হয়ে উঠলো সে।
ছেলেটিকে দেখে উজিরের বেশ ভালো লাগে। চোখে মুখে বুদ্ধিদীপ্ত ছাপ। সুন্দর চেহারা, সুঠাম দেহ। দেখে মনে হয় বহুদূর দেশের মুসাফির।
এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
একশো ছিয়ানব্বইতম রজনী :
মারজীবন একথার অর্থ বুঝতে পারে না, কেন জনাব, একথা বলছেন কেন? আমি নৌকা করে চলছিলাম—উদ্দেশ্য ছিল খালিদানের শাহজাদা কামার আল-জামানের সঙ্গে মোলাকাৎ করবো। কিন্তু আল্লাহর বুঝি তা ইচ্ছা নয়, তাই ঝড়তুফানের মধ্যে পড়ে নৌকাটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। আমি কোনরকমে এই বয়াটা ধরে আত্মরক্ষা করেছি। তাও আপনারা না থাকলে হয়তো দরিয়ার জলে জান হারাতে হতো।
উজির অবাক হয়ে চেয়ে থাকে।–শাহজাদা কামার আল-জামানের সঙ্গে তোমার কি দরকার?
উজির বলে ঠিকই শুনেছো, শাহজাদা কামার আল-জামান বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। তাকে সারাবার অনেক চেষ্টাই করা হয়েছে-হচ্ছে, কিন্তু কোনও হেকিম বন্দিাই কিছু করতে পারছে না। তা-তোমার কি করা হয়?
–তবে?
উজিরের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে—আমার মনে হচ্ছে তুমিই পারবে। কারণ এত ঝড় ঝঞার মধ্যেও আল্লাহ তোমাকে ঠিক জায়গাতেই পৌঁছে দিয়েছেন। এ হচ্ছে সুলতান শাহরিমানের বিলাস ভবন। তারই পুত্র কামার আল-জামানকে এখন এই প্রাসাদেই এনে রাখা হয়েছে। তুমি যদি চাও তার সঙ্গে দেখা করতে পারো।
মারজীবন বলে, নিশ্চমই দেখা করবো, জনাব। কিন্তু তার আগে আগাগোড়া বৃত্তান্ত সব একবার শোনা দরকার।
উজির বললো, একবার কেন, একশোবার শোনাবো। আমরা চাই, আমাদের সিংহাসনের একমাত্র উত্তরাধিকারী শাহজাদা জামান সুস্থ হয়ে উঠুক। তার জন্যে যে মূল্য প্রয়োজন আমরা দিতে প্রস্তুত।
এরপরে আগাগোড়া সব কাহিনী তাকে শোনালো উজির। মারজাবনের আর বুঝতে বাকি থাকে না শাহজাদা জামানের সে-রাতের নায়িকা বন্দর ছাড়া আর কেউ-ই নয়। একটা নতুন আবিষ্কারের আনন্দে তার মনে নেচে ওঠে। কিন্তু তখুনি নিজেকে সামলে নেয়। উজিরকে সে বুঝতে দিতে চায় না তার মনের ভাব। বললো, ঠিক আছে, আগে তার সঙ্গে আমার করিয়ে দিন। নিজের চোখে একবার দেখি রুগীকে। তারপর বলবো, পারবো কি পারবো না। তবে খোদা আমার একমাত্র ভরসা, কোনও দাওয়াই পত্রে আমি বিশ্বাস করি না, আশা হয়। পারবো।
আর মুহূর্ত মাত্র বিলম্ব না করে উজির মারজীবনকে শাহজাদা জামানের কক্ষে নিয়ে যায়। প্রথম দর্শনেই সে চমকে ওঠে। এত রূপ কোনও পুরুষের হয়? যেন মনে হয় রাজকুমারী বদরের জুটির জন্যেই সে জন্মেছে। আর বদরের মুখেও তার মেহেবুবের চেহারার যে বর্ণনা সে শুনে এসেছে তার সঙ্গে এই সুরৎ হুবহু মিলে যাচ্ছে।
কামার আল-জামান কৃশ অবসন্ন দেহে বিছানায় শুয়েছিলো। চোখের ইশারায় মারজীবনকে বসতে বললো সে। শাহরিমান ভাবছেন, ছেলে হয়তো কিছু ব্যক্তিগত কথাবার্তা বলতে চায় ছেলেটির সঙ্গে। তাই তিনি উজিরকে নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে যান।
মারজীবন ফিসফিস করে বলে : আর কোনও ভয় নাই। আল্লাহ আমাকে দূর করে পাঠিয়েছেন। এখানে। আপনারী ভালোবাসার’ খবর বয়ে নিয়ে এসেছি আমি।
জামান সন্দেহাকুল চোখে তাকায়। লোকটা এদেরই চর নয় তো। হয় তো বা কোনও নতুন ফন্দী।–ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। সে মারজীবনের মুখের দিকে।
—কী, বিশ্বাস হচ্ছে না? হবে হব। সব বলছি সব প্রমাণ আছে আমার কাছে। স্বয়ং ইষ্ট রাজকুমারী বদর আমাকে বলেছেন আপনাদের সেই রাতের সাহাগ মিলনরে কাহিনী।
এরপরে মারজীবন যে সব খুঁটিনাটি বিবরণ দিতে থাকলো তাতে সন্দেহের কোনও অবকাশ রইলো না-ছেলেটা আর যাই হোক তার বাবা বা উজিরের কোনও গুপ্তচর নয়।
মারজাবন বললো, রাজকুমারীর নাম বদর। সম্রাট ঘায়ুরের একমাত্র সন্তান। সে আমার পাতানো বোন। ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে আমরা মানুষ হয়েছি।
কামার আল-জামান-এর চোখ দুটো চকচক করে ওঠে। যেন একটা আশার আলো দেখতে পায়।–তা হলে আর দেরি নয় দোস্ত, চল আজই আমরা রওনা হয়ে যাই, সম্রাট ঘায়ুরের দেশে।
মারজীবন বলে, সে দেশ তো অনেক দূরের পথ। তোমার এই শরীরে এখনই রওনা হওয়া ঠিক হবে না। সে ধকল তুমি সহ্য করতে পারবে না। আগে শরীরটাকে সারিয়ে নাও, তারপর যাওয়া যাবে। আমি তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলে তবে রাজকুমারী বন্দর সুস্থ হয়ে উঠবেন।
এই সময় রাত্রি শেষ হতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
একশো নিরানব্বইতম রজনী :
সুলতান ছুটে এসে মারজাবনকে জড়িয়ে ধরেন। আনন্দে তিনি আজ আত্মহারা। কি যাদু দিয়ে, কেমন করে ছেলেকে সে প্রাণবন্ত করে তুললো সে সব আর জানতে চাইলেন না। তিনি। জামান যে আবার সুস্থ হয়েছে-এই-ই তার কাছে যথেষ্ট।
সবচেয়ে মূল্যবান রত্নাভারণে মারজাবনকে ভূষিত করলেন তিনি। উপহার দিলেন দামী দামী সাজপোশাক। সারা শহরের মানুষ নাচ গান হৈ হল্লায় মেতে উঠলো। আলোয় মালায় সাজানো হলে প্রাসাদ। দু’হাতে বিতরণ করা হতে থাকলো টাকা পয়সা, পোশাক-আশাক খানা-পিন্যা। বন্দীদের মুক্ত করে দেওয়া হলো। আবার দরবারকক্ষ গমগম করে উঠলো।
কয়েকদিন বাদে, শাহজাদা জামান তখন বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছে, মারজীবন বললো, এবার যাত্রার আয়োজন করো দোস্ত। আমার বোনের অবস্থা যে কি, তা তো বুঝতে পারছে।
কামার আল-জামান বিমৰ্ষভাবে বলে, কিন্তু, আব্ববাজান আমাকে যেতে দেবেন না, মারজাবন। তিনি আমাকে কাছ ছাড়া করে একটা দিনও থাকতে পারেন না। আমি আবার অসুখে পড়বো, মনে হচ্ছে। তার আদর্শন আমি সইবো কি করে।
মারজাবন তাকে সান্ত্বনা দেয় কিছু ভাবনার নাই, দোস্ত, সব ঠিক হয়ে যাবে। উপায় আমি বাৎলে দিচ্ছি। তবে একটুখানি মিথ্যের আশ্রয় নিতে হবে। তা-শুভ কাজে একটু আধটু মিথ্যে বললে এমন কিছু গোস্তাকি হয় না। তুমি শুধু সুলতানকে বলবে, মারজীবন তোমাকে নিয়ে দিন কয়েকের জন্য শিকারে যেতে চাইছে। দেখবে কোনও অমত করবেন না। আমার ওপর এখন তিনি দারুণ খুশি। তাছাড়া অনেকদিন একটা বদ্ধ ঘরের মধ্যে অসুস্থ হয়ে আটকে ছিলো। খোলামেলা মুক্ত আলো হাওয়া তোমার এখন যথেষ্ট প্রয়োজন।
মারজাবনের বুদ্ধির তারিফ করে জামান। সুলতানের কাছে গিয়ে বলতে তিনি না করতে পারলেন না। বললেন, কিন্তু বাবা, একটা রাতের বেশি তুমি বাইরে কাটাবে না। তা হলে আমি মরে যাবো। তুমি তো জানো, একটা রাত তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারি না।
দু’জনের জন্য দুটো সেরা তাগড়াই ঘোড়া সাজানো হলো। সঙ্গে আরও ছ’জন ঘোড়সওয়ার, লোক লস্কর, উট, খানা পিনা, সাজ পোশাক তাঁবু প্রভৃতির লাট বহর নিয়ে রওনা হলো তারা। শহরের সীমান্ত মুখ পর্যন্ত সঙ্গে সঙ্গে এলেন সুলতান। চোখের জল ফেলতে ফেলতে বিদায় জানালেন।
বেড়াবো। কেন জানো? সঙ্গের লোকজনের মনে কোনও সন্দেহ যাতে না হয়, সেইজন্য একটা দিন আমরা যথার্থ শিকারীই না হয় হলাম। তারপরের ফন্দী আমি ভেবেই রেখেছি।
সারাদিন ধরে খুব হৈ হল্লা দৌড় ঝাপ করে শিকার সমাধা করা হলো। সন্ধ্যাবেলা একটা বাগানের মধ্য তাঁবু ফেলে খানাপিনা শেষ করে শুয়ে পড়লো সকলে।
রাত্রি তখন তৃতীয় প্রহর। সঙ্গের লোকজন সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো। সবাই তখন বেঘোরে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। মারজাবন জামানকে জাগালো। ফিসফিস করে ওর কানে কানে বললো, এই রাতে এখুনি আমাদের পালাতে হবে। সবাই ঘুমে অচেতন কেউ টের পাবে না। নাও, ওঠ, দুজনে দুটো ঘোড়ায় চেপে কেটে পড়ি।
তখুনি, আর কাল বিলম্ব না করে, জামান আর মারজীবন অতি সন্তৰ্পণে সেখান থেকে সরে পড়লো। কিছুদূর ধীরে ধীরে চলার পর জোর কদমে ঘোড়া চালিয়ে ভোর না হতেই বহু যোজন পথ পার হয়ে গেলো তারা। আসার সময় তারা সঙ্গে এনেছিলো একটা তোরঙ্গ! তার মধ্যে ছিলো কিছু সাজপোশাক, এক বাক্স সোনার মোহর আর খানিকটা খানাপিনী। এছাড়া এনেছিলো একটা বাড়তি ঘোড়া।
সকাল হয়ে গেলো। একটা চৌরাস্তার মোড়ে এসে থামলো ওরা। মারজীবন বললো, দোস্ত, তোমার জামা আর পাতলুন খুলে আমার হাতে দাও। আর তোরঙ্গ থেকে একটা সাধারণ সাজ পোশাক বের করে পরে।
জামান বুঝতে পারে না কিছুই শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
–কী ব্যাপার? কেন?
জামান আর কথা না বাড়িয়ে সাজপোশাক বদলে জামা পাতলুন তুলে দেয় মারজাবনের হাতে। মারজীবন বলে, এবার তুমি এখানে অপেক্ষা করো, আমি আসছি।
এই বলে সে জামানের জামা পাতলুন কাঁধে ফেলে সেই ফালতু ঘোড়াটাকে নিয়ে পাশের জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ে।
একটু পরে সে ফিরে এলো। জামান অবাক হয়ে দেখলো, তার সাধের সৌখিন জামা পাতলুন রক্তে রাঙা। মারজীবন বলে ঘোড়াটাকে জবাই করে খুনে মাখিয়ে নিলাম তোমার সাজপোশাক। এবার দেখো, এ গুলোকে এই চৌমাথার এক পাশে ফেলে রেখে আমরা উধাও হয়ে যাবো।
জামান হাসে। সব তার কাছে জলের মতো পরিষ্কার হলো এতক্ষণে। কি অসাধারণ বুদ্ধি মারিজীবনের।
মারজীবন বলে, এসো এবার নাস্তা সেরে নিই! আবার কখন কোথায় থামবো, তার তো ঠিক নাই।
দু’জনে বসে পেট ভরে খানাপিনা করলো। মারজীবন বললো, আর দেরি নয়। এবার ঘোড়ার পিঠে ওঠে। টগবগিয়ে ছুটািবো। দুপুর হওয়ার আগেই আমাদের অনেক দূর চলে যেতে হবে। এতক্ষণে তোমার শিকারের সঙ্গী নফর চাকররা ঘুম থেকে উঠে আমাদের নিশ্চয়ই খোঁজাখুঁজি করছে। এরপর তারা অনেক খোঁজাখুজি করেও যখন কোনও হদিশ করতে পারবে না, সুলতানের কাছে গিয়ে জানাতেই হবে। সে ধরে, আজ দুপুর নাগাদ সুলতান খবর পাবেন। তারপর কি হবে বুঝতেই পারছে, তার হুকুমে একদল সৈন্যসামন্ত ছুটাছুটি শুরু করে দেবে। এক সময় তাদের কেউ চৌরাস্তার মোড়েও আসবে। দেখবে, তোমার সাজপোশাক রক্তে রাঙা-পড়ে আছে পথের ধারে। জঙ্গলটার মধ্যে ঢুকবে তারা। দেখবে, তোমার ঘোড়াটা মরে পড়ে আছে। ভাববে কোনও ভয়ঙ্কর জানোয়ারের মুখে পড়ে ঘোড়াটা ঘায়েল হয়েছে! তোমাকে সে খাবার করে নিয়ে চলে গেছে। এই সাংঘাতিক বিবরণ যখন সুলতান শুনবেন, সুলতানের সে যে কি নিদারুণ অবস্থা হবে আমার বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। কিন্তু কি করা যাবে, এছাড়া সহজ উপায়ে তোমাকে তার কাছ থেকে নিয়ে আসা যেত না। তবে এও ভাবো। বিষম শোকতাপে দগ্ধ হতে হতে একদিন যখন তোমাকে আবার ফিরে পাবেন তখন তিনি কত আনন্দ পাবেন? সে আনন্দের কোনও তুলনা নাই। জানি তো, সব ভালো, যার শেষ ভালো।
জামান বলে, তোমার মতো বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের কথা। তোমার উপস্থিত বুদ্ধি, বিচক্ষণতার কোনও তুলনা নাই। ধন্যবাদ জানিয়ে তোমাকে ছোট করবো না। কিন্তু চলার পথে তো আমাদের অনেক খরচ হবে। সে পয়সাকডি তো আমার সঙ্গে নাই। তবে আমার হাতে মহামূল্যবান কয়েকটা আংটি আছে। বিক্রি করলে লাখখানেক মোহর দাম হতে পারে। এগুলো কোথাও বেচে রাহাখরচ চালাবার ব্যবস্থা করো।
মারজীবন বলে, ও নিয়ে তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না, চাঁদ। আমি সব ব্যবস্থা পাকা করেই এসেছি। আমার ওপর খুশি হয়ে তোমার বাবা আমাকে বহু ধনরত্ন এবং নগদ এক লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার দিয়েছেন। সেগুলে সব এই তোরঙ্গের মধ্যে একটা বাক্সে নিয়ে এসেছি আমি। সম্রাট ঘায়ুরের সাম্রাজ্যে পৌঁছতে আমাদের এত পয়সার দরকারই হবে না; জামান। আর তাছাড়া তোমার হাতের ঐ অমূল্য রত্নগুলো বেচিতে গেলেই ধরা পড়ে যেতে হবে। জহুরীর হাতে পড়লেই তার সন্দেহ হবে। এসব বস্তু তো ইতর সাধারণের কাছে থাকতে পারে না। এদিকে তোমার বাবা সুলতান শাহরিমানও নিশ্চয়ই চুপ করে বসে থাকবেন না। তার নিজের দেশ ছাড়াও আশেপাশের আর পাঁচটা দেশেও হুলিয়া জারি করে দেবেন। একটা সামান্য জহুরী মোটা পুরস্কারের লোভে তোমাকে ধরিয়ে দেবে না, সে কি হতে পারে। সুতরাং ওগুলো বরং খুলে জেবের ভেতরে রেখে দাও।
একনাগাড়ে মাসখানেক চলার পর একদিন সকালে তারা সম্রাট ঘায়ুরের রাজধানীর উপান্তে এসে পৌঁছল। কামার আল-জামানের আর ধৈর্য মানে না, তখনি সে সম্রাট ঘায়রের সঙ্গে দেখা করতে চায়। কিন্তু মারজীবন বলে, ধৈৰ্যং কুরু, বন্ধু, এখানে তিষ্ঠ ক্ষণকাল।
শহরের প্রান্তমুখে একটা বনেদী সরাইখানা। মারজীবন বলে, এখানে উঠবো আমরা। দিন তিনেক বিশ্রাম করবো আগে। বাকবা, একটানা একমাস ঘোড়ার পিঠে-গায়ের হাড়মাংস আর নাই। বেদনায় টনটন করছে। টানটান হয়ে আগে শুয়ে কাটাবো তিনটে দিন। তারপর অন্যকথা।
সরাইখানার একটা ঘরে পাশাপাশি দুটো পালঙ্কে দুই বন্ধু তিন দিন তিন রাত্রি শুয়ে শুয়ে কাটালো। পথের ক্লান্তি কেটে গিয়ে ফোটাফুলের স্নিগ্ধতা ফুটে ওঠে। জামানের মুখে। দেহমান বেশ ঝরঝরে। মনে হয়। মারজাবন বলে, নাও, এবার হামামে চলো, তোমাকে আমি নিজে হাতে ঘষে মোজে সাফ করে গোসল করাবো।
স্নানাদি শেষ করে এক জ্যোতিষের বেশ ধারণ করল জামান। মারজীবন তাকে সুন্দর করে সাজালো। জামানের যা রূপ তাতে ওকে যে সাজেই সাজানো যাক, অপরূপ লাগবে।
সম্রাট ঘায়ুরের প্রাসাদের পথে পা বাড়াতেই শহরের আবালবৃদ্ধবনিতা এসে ভিড় জমাতে থাকলো; এমন রূপের হাট তারা আগে কখনও দেখেনি। পথচারীদের কেউ কেউ জানতে চাইলো, কী অভিপ্ৰায়ে যাওয়া হচ্ছে রাজদরবারে।
জামান গর্বভরে ঘোষণা করে, আমি ত্ৰিভুবন জয়ী জ্যোতিষ। আমার অসাধ্য কিছুই নাই। রাজকুমারী বদর-এর দুরারোগ্য ব্যাধির কথা শুনে বহু দূর দেশ থেকে আসছি। তার সব রোগ আমি সারিয়ে দেব।
জনতার মধ্যে গুঞ্জন ওঠে। লোকটা বলে কি? সে কি জানে না, আজ পর্যন্ত যত গুণীজ্ঞানী হেকিম বিদ্যি এসেছে, তাদের কি দশা হয়েছে।
কে একজন বলে, তা মরার জন্য যদি পাখা গজায়, কে আর আটকাতে পারে বলে। ঐ যে ওখানে যাদের কাটা মুণ্ডু, ঝুলছে ওখানে গুণতিতে আর একটা মুণ্ডু বাড়বে—এই আর কি
মেয়েরা চুকচুক করে, আহা রে, চাঁদের মতো সুরৎ, মনে হয় বড়ঘরের ছেলে। এমন রূপ এমন যৌবন-সব শেষ হয়ে যাবে।
অনেকে বারণ করে, দেখো বাপু, আমন কাজটি করতে যেও না। যা কেউ পারলো না, তা যে তুমিও পারবে না তা জানি। পাতালপুরীর রাজপুত্ত্বরের মতো তোমান মন ভোলানো রূপ আছে তাও মানছি—কিন্তু ওতে তো ভাবি ভুলবে না। আমাদের সম্রাটের প্রতিজ্ঞা বড় সাংঘাতিক। মুখ দিয়ে একবার যা বের করবে তার আর নড়াচড় হবে না। রাজকুমারীর রোগ যদি সারাতে না পারো বাছা, তা সে তোমার যত রূপ-গুণাই থাক, গর্দান তোমাকে দিতেই হবে। তাই বলছি, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও! কি দরকার অত লোভে। জানেই যদি না বাঁচলে কি হবে রাজত্ব আর রাজকন্যা দিয়ে?
এই কথা শুনে চমকে ওঠে সকলে। মরা মানুষকে জীয়ন্ত করতে পারে।
মুহূর্তে লোকের মুখে মুখে সারা শহর ছড়িয়ে পড়ে এই অদ্ভুত জ্যোতিষীর কথা। শহর ভেঙে পড়ে তাকে দেখতে।
মারজীবন বলে, প্রাসাদের ফটকে গিয়েই আমি কিন্তু কেটে পড়বো। তোমাকে আমার সঙ্গে দেখলে সম্রাট ঘায়ুর অন্যরকম ভাবতে পারেন। আমি প্রাসাদের অন্দরেই থাকবো। লক্ষ্য করবো তোমার কীর্তিকলাপ। কিন্তু সাবধান, যা শিখিয়ে দিয়েছি, সেইভাবে ঠিক ঠিক করে যাবে।
হুহু করে জনস্রোত বাড়তে থাকে। সবাই দেখতে ব্যাকুল জামানকে। নতুন চিড়িয়া ফাদে ধরা দিতে এসেছে। প্রধান ফটকের প্রহরী পথ রুখে দাঁড়ায়।
–আপ কৌন হ্যায়? কাকে চান?
প্রহরীরা অবাক হয়। সব জেনে শুনে এমন সোনার চাঁদ ছেলেটি হাড়ি কাঠে মাথা দিতে চায়। প্রধান প্রহরী এগিয়ে এসে বলে, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যান মালিক, এখানে একবার যে ঢুকেছে, প্ৰাণ নিয়ে আর ফিরে যেতে পারেনি।
জামান বিরক্ত হয়।–আমি কারো উপদেশ শুনতে আসিনি। রাজকুমারীর দুরারোগ্য রোগ সারাতে এসেছি। তুমি সম্রাটকে সংবাদ দাও। আমি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই।
বাইরে কোলাহল শুনে সম্রাট উজিরকে পাঠালেন। —যাও দেখতে বাইরে কোনও বিদেশী মুসাফীর এসেছে মনে হচ্ছে, নিয়ে এসো তাকে।
দরবারে প্রবেশ করে আভুমি আনত হয়ে সম্রাট ঘায়ুরকে কুর্নিশ জানায় জামান।
কামার আল-জামানের মুখের দিকে তাকিয়েই সম্রাট চোখ বন্ধ করে ফেলেন। একি অপরূপ সুন্দর চেহারা। এমন রূপবান মানুষ তো কোথাও দেখেন নি। কেমন যেন সব তালগোল পাকিয়ে যায়।
— শোনো বাবা, সম্রাট ঘায়ুর বলেন, চাঁদের মতো তোমার এই রূপ, আর এমন কচি বয়সী। পাত্র হিসাবে তুমি আমার পরমাসুন্দরী কন্যা বদরের আদর্শ জুটি হতে পারো সন্দেহ নাই। কিন্তু জানো তো আমার শর্ত, তাকে যদি সারাতে না পারো-আমি তোমাকে কোনও ভাবেই রেহাই দিতে পারবো না। তাই এখনও বলছি, নিজের প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি না খেলে ফিরে যাও। অবশ্য তুমি এসেছে, আমার মেয়ের রোগ সারাতে। তোমাকে নিরস্ত করলে আমার লাভ কি! বরং একটা আশা নিয়ে কিছু সময় কাটাতে পারবো–যদি আমার নয়নমণিকে তুমি সারিয়ে তুলতে পারো। কিন্তু তা যে অসম্ভব। কত দেশের কত ডাকসাইটে ডাক্তার, কবরেজ, হেকিম উনানী এলো, তাদের কেউই প্ৰাণে বেঁচে ফিরে যেতে পারে নি। তা তোমার যদি শখ হয়, চেষ্টা করে দেখতে পারো। তবে আমার ঐ এক শর্ত বাবা, না পারলে তোমার মুণ্ডু কেটে ঝুলিয়ে রাখা হবে।
—আমি রাজি আছি মহামান্য সম্রাট। আপনার সব শর্ত জেনেই আমি এসেছি।
সম্রাট ঘায়ুর প্রধান খোজাকে বললেন, একে অন্দর মহলে নিয়ে যা। রাজকুমারীর ব্যামো সারাতে এসেছে। যা বলবে শুনবি।
জামানকে সঙ্গে নিয়ে খোজা রাজকুমারী বন্দরের হারেমে যেতে যেতে বলে, তা সাহেবের, জামাই সাজার শখ হয়েছে বুঝি। এমন আহম্মক আর কতজন আছে কে জানে?
—দেখা পারি কি না, জামান দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলে, আমাকে শুধু একবার রাজকুমারী বদর-এর দরজার সামনে নিয়ে চলো। আমি ভিতরে ঢুকবে না। পর্দার এপারে থেকেই তার সব রোগ সারিয়ে দেব।
জামান আর খোজা রাজকুমারীর দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। বলে, একখানা কুর্শি নিয়ে এসো। এখানে আমি বসবো।
সঙ্গে সঙ্গে একখানা আরামকেদারা এনে দেওয়া হলো। জামান জেব থেকে কাগজ কলম বের করে একখানা চিঠি লিখলো।
এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Facebook: facebook.com/samoiki
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments