গৃহিণী বলিলেন, "আসল কথা তো কিছুই শুনিলাম না। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, এত বিলম্ব হইল কেন? তুমি সাত গ্রাম বেড় দিয়া ভাগ্যলিপি-অদৃষ্ট মন্দ, এই সকল খামখেয়ালী কথা বলে বসলে? সারাটি দিন আর রাত্রিও প্রায় দেড় প্রহর, এত সময় কোথায় ছিলে? কী করিলে? তাহাই শুনিতে চাই। আর একটি কথা। আজ তুমি যেমন দুঃখের সহিত আক্ষেপ করিতেছ,-অদৃষ্টের দোষ দিতেছ, এরূপ আক্ষেপ, কপালদোষের কথা তো আর কখনো তোমার মুখে শুনি নাই?"
হারেস দুঃখিতভাবে নাঁকিসুরে ক্ষীণ স্বরে বলিতে লাগিল, "তোমায় আর কী বলিব। আমাদের বাদশাহ জেয়াদ্, মদিনার হজরত হোসেনকে প্রাণে মারিবার যোগাড় করিয়া, মিথ্যা স্বপ্ন, মিথ্যা রাজ্যদান ভাণ করিয়া হজরত হোসেনের নিকট পত্র দিয়াছেন -"
গৃহিণী বলিলেন, "সে-সকল কথা আমরা জানি। হজরত হোসেনের অগ্রে মোস্লেম আসিল, তাহার পর মোস্লেমকে কৌশল করিয়া মারিবার কথাও জানি।"
"তবে তো তুমি সকলই জান। সেই মোস্লেমের দুই পুত্র পালাইয়াছে। তাহাদের জন্য রাজসরকার হইতে ঘোষণা হইয়াছে, ধরিয়া দিতে পারিলেই একটি হাজার মোহর পুরস্কার পাইবে। প্রথম শহরকোতোয়াল-হাতে ধরা পড়িয়াছিল। বাদশাহ নামদারের দরবারে হাজির করিলে, আমাদের বাদশাহ ছেলে দুইটির মুখের ভাব, সুশ্রী সুন্দর মুখ দুখানি, দেহের গঠন দেখিয়া-মাথা কাটার আদেশ দিতে পারিলেন না। বন্দিখানায় কয়েদ রাখিতে অনুমতি করিলেন। বন্দিখানার প্রধান কর্মচারী 'মস্কুর' ছেলে দুইটির রূপে মোহিত হইয়া তাহাদিগকে ছাড়িয়া দেয়! বাদশা নামদার পর্যন্ত সেই খবর হইলে মস্কুরের শিরচ্ছেদ হইয়াছে! আজ নূতন ঘোষণা জারি হইয়াছে, "যে সেই পলায়িত ছেলে দুইটিকে ধরিয়া দিবে, তাহাকে পাঁচ হাজার মোহর পুরস্কার দেওয়া হইবে। যে আশ্রয় দিয়া গোপনে রাখিবে, মস্কুরের ন্যায় তাহারও শিরচ্ছেদ সেই দণ্ডেই হইবে।" আমি মোস্লেমের ছেলে দুটির জন্য আহার-নিদ্রা-বিশ্রাম ত্যাগ করিয়া কোথায় না সন্ধান করিয়াছি। ধরিয়া বাদশার দরবারে হাজির করিতে পারিলেই, পাঁচ হাজার মোহর! যে পাইবে, সে কত কাল বসিয়া খাইতে পারিবে! বুঝিয়া চলিলে হয়ত মহা ধনী হইয়া কত পুরুষ পর্যন্ত সুখে থাকিতে পারিবে। এত সন্ধান করিলাম, কিছুই করিতে পারিলাম না। আজ বেশি টাকার লোভে হাজার হাজার লোক পাহাড়-জঙ্গল, যেখানে যাহার সন্দেহ হইতেছে সেইখানেই খুঁজিতেছে। আমি বহু দূরে গিয়াছিলাম। কোথাও কিছু না-পাইয়া শেষে আমারই খোরমার বাগানে খুঁজিয়া তন্নতন্ন করিলাম, প্রতি বৃক্ষের গোড়া, কোটর খুঁজিলাম, কোথাও কিছু পাইলাম না। তাহাতেই বলিতেছিলাম, আমার ভাগ্যে ঘটিবে কেন? হতভাগার চক্ষে পড়িবে কেন?"
গৃহিণী বলিলেন, "হায়! হায়! সেই পিতৃহীন অনাথ বালক দুইটিকে ধরিয়া দুরন্ত জালেম বাদশার নিকটে দিলে পাঁচ হাজার মোহর পাইবে তাহা সত্য, কিন্তু আর একটি হৃদয়বিদারক মর্মাহত সাংঘাতিক কথাটা কী তোমার মনে উদয় হয় নাই? নিরপরাধ দুই এতিমকে বাদশার হাতে দিলে, সে নিষ্ঠুর পাষাণপ্রাণ শাহ জেয়াদ্ কী তাহাদিগকে স্নেহ করিয়া যত্নে রাখিবে? না, তাহাদের চিরদুঃখিনী জননীর নিকট মদিনায় পাঠাইয়া দিবে? হাতে পাইবামাত্র শিরচ্ছেদ-উহু! বালক দুইটির শিরচ্ছেদের হুকুম প্রদান করিবে। তাহা হইলে হইল কি? তুমিই বালক দুইটির বধের উপস্থিত কারণ হইলে। তৎপরিবর্তে কতকগুলি মোহর পাইবে সত্য-আচ্ছা বল তো, সে মোহর তোমার কতদিন থাকিবে? এখন যে অবস্থায় আছ, দয়াময় দাতা অনুগ্রহকারী ঈশ্বরের নিকট কৃতজ্ঞ হও। তোমার সমশ্রেণীর লোক জগতে কত স্থানে কত প্রকার কষ্ট ভোগ করিতেছে। তোমা অপেক্ষা কত উচ্চশ্রেণীর লোক তোমা হইতে মন্দ অবস্থায় দিন কাটাইতেছে। তুমি সকল বিষয়ে নিশ্চিন্ত-মহা সুখী। ইহার উপরেও তোমার লোভের অন্ত নাই। বিচারকর্তা অদ্বিতীয় এলাহির প্রতিও তোমার ভক্তি নাই ভয়ও নাই, তিনি সর্বদর্শী তাহাও যেন তোমার মনে নাই! হায়! হায়! তোমার মত পাষাণপ্রাণ-পাথরের দেহ তো আমি কাহারো দেখি নাই! পিতৃহীন নিরপরাধ বালকদ্বয়ের দেহ-রক্তের মূল্যই নরপতি জেয়াদ্-চক্ষে পাঁচ হাজার মোহর! হইতে পারে-তাহার চক্ষে অন্যরূপ। হউক পাঁচ হাজার মোহর। তুমি সে রক্তমাখা মোহরের জন্য এত লালায়িত কেন? তুমি কি বুঝ নাই-ঐ দুই বালকের শরীরের রক্তের মূল্য পাঁচ হাজার মোহর। রক্তপোরা মোহরের লোভে অমূল্য বালক দুটির জীবনের প্রতি লক্ষ্য না করিয়া নিজের বিষময় অস্থায়ী সুখের প্রতি দৃষ্টি করিতেছ।আর এক কথা, সে দেয় কি-না? পাও কি-না? পঞ্চহাজার মোহর তোমার লক্ষ্য, অন্তরেও ঐ কথা জাগিতেছে।বালক দুইটিকে যদি ধরিতে পারি,-পাঁচটি হাজার খাঁটি সোনার টাকা। হা অদৃষ্ট!-আমার কপালে কি তাহা আছে? মনে মনে এই ভাবের কথাই তো ভাবিতেছ? বারবার সেই নর-রক্তমাখা কদর্য মোহরগুলির প্রতিই অন্তর-চক্ষুতে কল্পনার-'সাজান'-পাত্র দেখিতেছ। মোহরের জন্য প্রকাশ্য অক্ষেপও করিতেছ। বালক দুটির জীবনের মূল্য হইতে মোহরের মূল্যই অধিক স্থির করিতেছ। জালেম, তোমার মনে মায়া দয়ার একটি পরমাণুও নাই। এক ফোঁটা রক্তও নাই। তোমার হৃদয়ে সাধারণ রক্ত নাই,-পাথরচুয়ান রস থাকিতে পারে। কারণ তোমার হৃদয় পাষাণ, দেহটা পোড়া মাটির, অস্থি-মজ্জা সমুদয় কঙ্করে পূর্ণ। ইহাতে আর আশা কী?"
"তুমি বুঝিবে কি? যাহার শরীর কিছুতেই সমানভাবে ঢাকে না হাজার ঢাক, হাজার বেড় দাও-অসমান থাকিবেই থাকিবে। তুমি জগৎ সংসারের কি বুঝিবে? তুমি বোঝ-প্রথম অলঙ্কার, তাহার পর টাকা পয়সা, তাহার পর স্বামীকে একহাতে রাখা। আর কি বোঝ? ছেলে হল মোস্লেমের, মাথা কাটিবে জেয়াদ্, তাহাতে তোমার চক্ষে জল আসে কেন? পরের ছেলে পরে কাটিবে আমাদের কি? রাজা জেয়াদ্ মোস্লেমকে প্রাণে মারিয়াছে, তাহার ছেলে দুটাকেও মারিয়া ফেলুক, ছেলের মাকে ধরিয়া আনিয়া হয় প্রাণে মারুক,-না হয় ভালবাসিয়া, রাণী করিয়া অন্তঃপুরে রাখুক,-তোমার আমার কি? মাঝখানে আমার পাঁচটি হাজার মোহর লাভ হইবে। এ কার্যে চেষ্টা করিব না? তোমার অঞ্চল ধরিয়া-চেনা নাই, জানা নাই, মোস্লেমের জন্য-তাহার দুইটি পুত্রের জন্য কাঁদিতে থাকিব? এইরূপ বুদ্ধি আমার হইলে আর চাই কী?-সংসার টন্টনে-কসা।-একেবারে কাবার।শুন কথা! ছেলে দুইটা যা'র চক্ষে পড়বে সেই ধরবে। ধরলেও নিশ্চিন্ত নহে। বিঘ্ন বাধা অনেক। কত লোক ছুটাছুটি করিতেছে। কত গুণ্ডা ঐ খোঁজে বাহির হইয়াছে। কার হাত থেকে কে কাড়িয়া লইয়া বাদশার দরবারে দাখিল করিবে-তাহা কে জানে? ধরিতে পারিলেও কৃতকার্যের আশা অতি কম। যাহা হউক, শুন আমার মনের কথা। যদি ছেলে দুটিকে হাতে পাই-আর নিরাপদে জেয়াদ-দরবারে লইয়া যাইতে পারি-আর তোমার ভাল হউক-যদি পঞ্চজাহার মোহর পাই, তিন হাজার মোহর ভাঙ্গিয়া মাথা হইতে পা পর্যন্ত, আবার পা হইতে মাথা পর্যন্ত ডবল পেচে সোনা দিয়া তোমার এই সন্দুর দেহখানি মোড়াইয়া জড়াইয়া দিব। দেখ তো এখন লাভ কত?"
গৃহিণী অতিশয় বিষাদভাবে স্বামীর মুখ চোখপানে চাহিয়া বলিতে লাগিলেন, "দেখ! আমি তোমার কথায় বাদ প্রতিবাদ করিব না। বাধা দিতেও চাহি না;-তোমাকে উপদেশ দিবার ক্ষমতাও আমার নাই।আমি তোমার নিকট মিনতি করিয়া বলিতেছি, সবিনয়ে প্রার্থনা করিতেছি, তুমি মোসলেমের সেই ছেলে দুইটির সন্ধানে আর যাইয়ো না;-ইহাই প্রার্থনা। আমি তোমার নিকট রতি পরিমাণ সোনাও চাহি না এবং রক্তমাখা মোহরের জন্য লালায়িতও নহি। পিতৃহীন বালকদ্বয়ের শোণিতরঞ্জিত মোহর চক্ষে দেখিতে ইচ্ছা করি না, ছুঁইতেও পারিব না। জীবন কয় দিনের? ঈশ্বরের নিকট কি উত্তর করিবে? আমি তোমার দুখানি হাত ধরিয়া অনুরোধ করিতেছি, আমার মাথার দিব্বি দিয়া বলিতেছি, তুমি লোভের বশীভূত হইয়া এমন কার্যে প্রবৃত্ত হইও না।"
হারেস স্ত্রীরত্নের কথায় ক্রোধে আগুন হইয়া, রক্ত-আঁখি ঘুরাইয়া বলিলেন, "চুপ! চুপ! নারীজাতির মুখে ধর্মকথা আমি শুনি না। এখন খাইবার কি আছে শীঘ্র নিয়ে এস! একটু বিশ্রাম করিয়া এই রাত্রিতেই আবার সন্ধানে বাহির হইব! দেখি, কপালে কী আছে! তোর ও মিছরিমাখা কথা আমি শুনিতে ইচ্ছা করি না।"
হারেসের স্ত্রী আর কোন কথা কহিলেন না। স্বামীর আহারের আয়োজন করিয়া দিলেন। হারেস মনে মনে নানা চিন্তা করিতে করিতে অন্যমনস্কে আহার করিলেন। হস্ত-মুখ প্রালন করিয়া অমনই শয়ন করিলেন। এত পরিশ্রমেও তাঁহার চক্ষে নিদ্রা নাই। কোথায় মোস্লেমের সন্তান দুটিকে পাইবেন; কোন্ পথে, কোথায়, কোন্ স্থানে গেলে তাঁহাদের দেখা পাইবেন? দেখা পাইয়া কী প্রকারে ধরিয়া রাজদরবারে লইয়া যাইবেন;-এই চিন্তা তাঁহার মাথার মধ্যে ঘুরিতে লাগিল। বালক দুটির দেখা পাওয়া-পাঁচ হাজার সোনার টাকা-এই সকল ভাবিতে ভাবিতে বহুক্ষণ পরে ঘুমাইয়া পড়িলেন।
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments