বিষাদ সিন্ধু : মীর মশাররফ হোসেন_মহরম পর্ব : ২৭তম প্রবাহ

 
গৃ­হি­ণী বলি­লেন, "আসল কথা তো কি­ছুই শু­নি­লাম না। আমি জি­জ্ঞা­সা করি­লাম, এত বি­­ম্ব হইল কেন? তু­মি সাত গ্রাম বেড় দিয়া ভা­গ্য­লি­পি-অদৃ­ষ্ট মন্দ, এই সকল খা­­খেয়ালী কথা বলে বস­লে? সা­রা­টি দিন আর রা­ত্রিও প্রায় দেড় প্র­হর, এত সময় কো­থায় ছি­লে? কী করি­লে? তা­হাই শু­নি­তে চাই। আর এক­টি কথা। আজ তু­মি যে­মন দু­­খের সহিত আক্ষেপ করি­তেছ,-অদৃ­ষ্টের দোষ দি­তেছ, এরূপ আক্ষেপ, কপা­­দো­ষের কথা তো আর কখ­নো তো­মার মু­খে শু­নি নাই?"
হা­রেস দু­­খি­­ভা­বে নাঁকি­সু­রে ক্ষীণ স্ব­রে বলি­তে লা­গিল, "তো­মায় আর কী বলিব। আমা­দের বা­­শাহ জেয়াদ্, মদি­নার হজ­রত হো­সে­­কে প্রা­ণে মা­রি­বার যো­গাড় করিয়া, মি­থ্যা স্ব­প্ন, মি­থ্যা রা­জ্য­দান ভাণ করিয়া হজ­রত হো­সে­নের নি­কট পত্র দিয়াছেন -"
গৃ­হি­ণী বলি­লেন, "সে-সকল কথা আম­রা জা­নি। হজ­রত হো­সে­নের অগ্রে মো­স্লেম আসিল, তা­হার পর মো­স্লে­­কে কৌ­শল করিয়া মা­রি­বার কথাও জা­নি।"
"তবে তো তু­মি সক­লই জান। সেই মো­স্লে­মের দুই পু­ত্র পা­লাইয়াছে। তা­হা­দের জন্য রা­­­­কার হই­তে ঘো­­ণা হইয়াছে, ধরিয়া দি­তে পা­রি­লেই এক­টি হা­জার মো­হর পু­­স্কার পা­­বে। প্র­থম শহ­­কো­তোয়াল-হা­তে ধরা পড়িয়াছিল। বা­­শাহ না­­দা­রের দর­বা­রে হা­জির করি­লে, আমা­দের বা­­শাহ ছে­লে দু­­টির মু­খের ভাব, সু­শ্রী সু­ন্দর মুখ দু­খা­নি, দে­হের গঠন দে­খিয়া-মা­থা কা­টার আদেশ দি­তে পা­রি­লেন না। বন্দি­খা­নায় কয়েদ রা­খি­তে অনু­­তি করি­লেন। বন্দি­খা­নার প্র­ধান কর্ম­চা­রী 'মস্কুর' ছে­লে দু­­টির রূপে মো­হিত হইয়া তা­হা­দি­­কে ছাড়িয়া দেয়! বা­­শা না­­দার পর্য­ন্ত সেই খবর হই­লে মস্কু­রের শি­­চ্ছেদ হইয়াছে! আজ নূতন ঘো­­ণা জা­রি হইয়াছে, "যে সেই পলায়িত ছে­লে দু­­টি­কে ধরিয়া দি­বে, তা­হা­কে পাঁচ হা­জার মো­হর পু­­স্কার দেওয়া হই­বে। যে আশ্রয় দিয়া গো­­নে রা­খি­বে, মস্কু­রের ন্যায় তা­হারও শি­­চ্ছেদ সেই দণ্ডেই হই­বে।" আমি মো­স্লে­মের ছে­লে দু­টির জন্য আহার-নি­দ্রা-বি­শ্রাম ত্যাগ করিয়া কো­থায় না সন্ধান করিয়াছি। ধরিয়া বা­­শার দর­বা­রে হা­জির করি­তে পা­রি­লেই, পাঁচ হা­জার মো­হর! যে পা­­বে, সে কত কাল বসিয়া খা­­তে পা­রি­বে! বু­ঝিয়া চলি­লে হয়ত মহা ধনী হইয়া কত পু­রুষ পর্য­ন্ত সু­খে থা­কি­তে পা­রি­বে। এত সন্ধান করি­লাম, কি­ছুই করি­তে পা­রি­লাম না। আজ বে­শি টা­কার লো­ভে হা­জার হা­জার লোক পা­হাড়-জঙ্গল, যে­খা­নে যা­হার সন্দেহ হই­তে­ছে সে­­খা­নেই খুঁজি­তে­ছে। আমি বহু দূরে গিয়াছি­লাম। কো­থাও কি­ছু না-পাইয়া শে­ষে আমা­রই খো­­মার বা­গা­নে খুঁজিয়া তন্ন­­ন্ন করি­লাম, প্র­তি বৃ­ক্ষের গোড়া, কো­টর খুঁজি­লাম, কো­থাও কি­ছু পা­­লাম না। তা­হা­তেই বলি­তে­ছি­লাম, আমার ভা­গ্যে ঘটি­বে কেন? হত­ভা­গার চক্ষে পড়িবে কেন?"
গৃ­হি­ণী বলি­লেন, "হায়! হায়! সেই পি­তৃ­হীন অনাথ বা­লক দু­­টি­কে ধরিয়া দু­­ন্ত জা­লেম বা­­শার নি­­টে দি­লে পাঁচ হা­জার মো­হর পা­­বে তা­হা সত্য, কি­ন্তু আর এক­টি হৃদয়বি­দা­রক মর্মা­হত সা­­ঘা­তিক কথা­টা কী তো­মার মনে উদয় হয় নাই? নি­­­রাধ দুই এতি­­কে বা­­শার হা­তে দি­লে, সে নি­ষ্ঠুর পা­ষা­­প্রাণ শাহ জেয়াদ্ কী তা­হা­দি­­কে স্নেহ করিয়া যত্নে রা­খি­বে? না, তা­হা­দের চি­­দু­­খি­নী জন­নীর নি­কট মদি­নায় পা­ঠাইয়া দি­বে? হা­তে পা­­বা­মা­ত্র শি­­চ্ছেদ-উহু! বা­লক দু­­টির শি­­চ্ছে­দের হু­কুম প্র­দান করি­বে। তা­হা হই­লে হইল কি? তু­মিই বা­লক দু­­টির বধের উপ­স্থিত কা­রণ হই­লে। তৎপরি­­র্তে কত­­গু­লি মো­হর পা­­বে সত্য-আচ্ছা বল তো, সে মো­হর তো­মার কত­দিন থা­কি­বে? এখন যে অব­স্থায় আছ, দয়াময় দা­তা অনু­গ্র­­কা­রী ঈশ্ব­রের নি­কট কৃ­­জ্ঞ হও। তো­মার সম­শ্রে­ণীর লোক জগ­তে কত স্থা­নে কত প্র­কার কষ্ট ভোগ করি­তে­ছে। তো­মা অপে­ক্ষা কত উচ্চ­শ্রে­ণীর লোক তো­মা হই­তে মন্দ অব­স্থায় দিন কা­টা­­তে­ছে। তু­মি সকল বিষয়ে নি­শ্চি­ন্ত-মহা সু­খী। ইহার উপ­রেও তো­মার লো­ভের অন্ত নাই। বি­চা­­­র্তা অদ্বি­তীয় এলা­হির প্র­তিও তো­মার ভক্তি নাই ভয়ও নাই, তি­নি সর্ব­­র্শী তা­হাও যেন তো­মার মনে নাই! হায়! হায়! তো­মার মত পা­ষা­­প্রাণ-পা­­রের দেহ তো আমি কা­হা­রো দে­খি নাই! পি­তৃ­হীন নি­­­রাধ বা­­­দ্বয়ের দেহ-রক্তের মূল্যই নর­­তি জেয়াদ্-চক্ষে পাঁচ হা­জার মো­হর! হই­তে পা­রে-তা­হার চক্ষে অন্যরূপ। হউক পাঁচ হা­জার মো­হর। তু­মি সে রক্ত­মা­খা মো­­রের জন্য এত লা­লায়িত কেন? তু­মি কি বুঝ নাই- দুই বা­­কের শরী­রের রক্তের মূল্য পাঁচ হা­জার মো­হর। রক্ত­পো­রা মো­­রের লো­ভে অমূল্য বা­লক দু­টির জী­­নের প্র­তি লক্ষ্য না করিয়া নি­জের বি­ষময় অস্থায়ী সু­খের প্র­তি দৃ­ষ্টি করি­তেছ।আর এক কথা, সে দেয় কি-না? পাও কি-না? পঞ্চ­হা­জার মো­হর তো­মার লক্ষ্য, অন্ত­রেও কথা জা­গি­তে­ছে।বা­লক দু­­টি­কে যদি ধরি­তে পা­রি,-পাঁচটি হা­জার খাঁটি সো­নার টা­কা। হা অদৃ­ষ্ট!-আমার কপা­লে কি তা­হা আছে? মনে মনে এই ভা­বের কথাই তো ভা­বি­তেছ? বা­­বার সেই নর-রক্ত­মা­খা কদ­র্য মো­­­গু­লির প্র­তিই অন্তর-চক্ষু­তে কল্প­নার-'সা­জান'-পা­ত্র দে­খি­তেছ। মো­­রের জন্য প্র­কা­শ্য অক্ষেপও করি­তেছ। বা­লক দু­টির জী­­নের মূল্য হই­তে মো­­রের মূল্যই অধিক স্থির করি­তেছ। জা­লেম, তো­মার মনে মায়া দয়ার এক­টি পর­মা­ণুও নাই। এক ফোঁটা রক্তও নাই। তো­মার হৃদয়ে সা­ধা­রণ রক্ত নাই,-পা­­­চুয়ান রস থা­কি­তে পা­রে। কা­রণ তো­মার হৃদয় পা­ষাণ, দে­­টা পোড়া মা­টির, অস্থি-মজ্জা সমুদয় কঙ্ক­রে পূর্ণ। ইহা­তে আর আশা কী?"
"তু­মি বু­ঝি­বে কি? যা­হার শরীর কি­ছু­তেই সমা­­ভা­বে ঢা­কে না হা­জার ঢাক, হা­জার বেড় দাও-অস­মান থা­কি­বেই থা­কি­বে। তু­মি জগৎ সং­সা­রের কি বু­ঝি­বে? তু­মি বোঝ-প্র­থম অল­ঙ্কার, তা­হার পর টা­কা পয়সা, তা­হার পর স্বা­মী­কে এক­হা­তে রা­খা। আর কি বোঝ? ছে­লে হল মো­স্লে­মের, মা­থা কা­টি­বে জেয়াদ্, তা­হা­তে তো­মার চক্ষে জল আসে কেন? পরের ছে­লে পরে কা­টি­বে আমা­দের কি? রা­জা জেয়াদ্ মো­স্লে­­কে প্রা­ণে মা­রিয়াছে, তা­হার ছে­লে দু­টা­কেও মা­রিয়া ফে­লুক, ছে­লের মা­কে ধরিয়া আনিয়া হয় প্রা­ণে মা­রুক,-না হয় ভা­­বা­সিয়া, রা­ণী করিয়া অন্তঃ­পু­রে রা­খুক,-তো­মার আমার কি? মা­­খা­নে আমার পাঁচটি হা­জার মো­হর লাভ হই­বে। কা­র্যে চে­ষ্টা করিব না? তো­মার অঞ্চল ধরিয়া-চে­না নাই, জা­না নাই, মো­স্লে­মের জন্য-তা­হার দু­­টি পু­ত্রের জন্য কাঁদি­তে থা­কিব? এইরূপ বু­দ্ধি আমার হই­লে আর চাই কী?-সং­সার টন্ট­নে-কসা।-একে­বা­রে কা­বার।শুন কথা! ছে­লে দু­­টা যা' চক্ষে পড়বে সেই ধর­বে। ধর­লেও নি­শ্চি­ন্ত নহে। বি­ঘ্ন বা­ধা অনেক। কত লোক ছু­টা­ছু­টি করি­তে­ছে। কত গু­ণ্ডা খোঁজে বা­হির হইয়াছে। কার হাত থে­কে কে কাড়িয়া লইয়া বা­­শার দর­বা­রে দা­খিল করি­বে-তা­হা কে জা­নে? ধরি­তে পা­রি­লেও কৃ­­কা­র্যের আশা অতি কম। যা­হা হউক, শুন আমার মনের কথা। যদি ছে­লে দু­টি­কে হা­তে পাই-আর নি­রা­­দে জেয়াদ-দর­বা­রে লইয়া যা­­তে পা­রি-আর তো­মার ভাল হউক-যদি পঞ্চ­জা­হার মো­হর পাই, তিন হা­জার মো­হর ভা­ঙ্গিয়া মা­থা হই­তে পা পর্য­ন্ত, আবার পা হই­তে মা­থা পর্য­ন্ত ডবল পে­চে সো­না দিয়া তো­মার এই সন্দুর দে­­খা­নি মোড়াইয়া জড়াইয়া দিব। দেখ তো এখন লাভ কত?"
গৃ­হি­ণী অতিশয় বি­ষা­­ভা­বে স্বা­মীর মুখ চো­­পা­নে চা­হিয়া বলি­তে লা­গি­লেন, "দেখ! আমি তো­মার কথায় বাদ প্র­তি­বাদ করিব না। বা­ধা দি­তেও চা­হি না;-তো­মা­কে উপ­দেশ দি­বার ক্ষ­­তাও আমার নাই।আমি তো­মার নি­কট মি­­তি করিয়া বলি­তে­ছি, সবিনয়ে প্রা­র্থ­না করি­তে­ছি, তু­মি মো­­লে­মের সেই ছে­লে দু­­টির সন্ধা­নে আর যাইয়ো না;-ইহাই প্রা­র্থ­না। আমি তো­মার নি­কট রতি পরি­মাণ সো­নাও চা­হি না এবং রক্ত­মা­খা মো­­রের জন্য লা­লায়িতও নহি। পি­তৃ­হীন বা­­­দ্বয়ের শো­ণি­­­ঞ্জিত মো­হর চক্ষে দে­খি­তে ইচ্ছা করি না, ছুঁইতেও পা­রিব না। জী­বন কয় দি­নের? ঈশ্ব­রের নি­কট কি উত্তর করি­বে? আমি তো­মার দু­খা­নি হাত ধরিয়া অনু­রোধ করি­তে­ছি, আমার মা­থার দি­ব্বি দিয়া বলি­তে­ছি, তু­মি লো­ভের বশীভূত হইয়া এমন কা­র্যে প্র­বৃ­ত্ত হইও না।"
হা­রেস স্ত্রী­­ত্নের কথায় ক্রো­ধে আগুন হইয়া, রক্ত-আঁখি ঘু­রাইয়া বলি­লেন, "চুপ! চুপ! না­রী­জা­তির মু­খে ধর্ম­­থা আমি শু­নি না। এখন খা­­বার কি আছে শী­ঘ্র নিয়ে এস! এক­টু বি­শ্রাম করিয়া এই রা­ত্রি­তেই আবার সন্ধা­নে বা­হির হইব! দে­খি, কপা­লে কী আছে! তোর মি­­রি­মা­খা কথা আমি শু­নি­তে ইচ্ছা করি না।"
হা­রে­সের স্ত্রী আর কোন কথা কহি­লেন না। স্বা­মীর আহা­রের আয়োজন করিয়া দি­লেন হা­রেস মনে মনে না­না চি­ন্তা করি­তে করি­তে অন্য­­­স্কে আহার করি­লেন। হস্ত-মুখ প্রা­লন করিয়া অম­নই শয়ন করি­লেন। এত পরি­শ্র­মেও তাঁহার চক্ষে নি­দ্রা নাই। কো­থায় মো­স্লে­মের সন্তান দু­টি­কে পা­­বেন; কো­ন্ পথে, কো­থায়, কো­ন্ স্থা­নে গে­লে তাঁহা­দের দে­খা পা­­বেন? দে­খা পাইয়া কী প্র­কা­রে ধরিয়া রা­­­­বা­রে লইয়া যা­­বেন;-এই চি­ন্তা তাঁহার মা­থার মধ্যে ঘু­রি­তে লা­গিল। বা­লক দু­টির দে­খা পাওয়া-পাঁচ হা­জার সো­নার টা­কা-এই সকল ভা­বি­তে ভা­বি­তে বহু­ক্ষণ পরে ঘু­মাইয়া পড়িলেন

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.