আলিফ লায়লা : আরব্য রজনী_পর্ব-৬১

ইংরেজি অনুবাদ : ডঃ জে. সি. মারদ্রুস
বাংলা অনুবাদ : ক্ষিতিশ সরকার
 
উজির সুলতানের পায়ের ওপর আছাড় খেয়ে পড়ে, আপনি বিশ্বাস করুন জাঁহাপনা, আমি এক বিন্দু-বিসর্গ জানিনা। আল্লার নামে কসম খাচ্ছি, পবিত্র কেরাণ ছুঁয়ে হলফ করতে পারি, সবের কিছুই আমি জানি না।
সাব্বাবও সেই রকম একইভাবে কসম খেয়ে বললো, সে- কিছুই জানে না।
সুলতান এবারে দিশেহারা হয়ে পড়েন।তা হলে একমাত্র স্বয়ং খোদাতালা ছাড়া রহস্যের জাল কেউ ভেদ করতে পারবে না।
জামান এবার সত্যিই প্ৰায় উন্মাদের মতো বললো, কিন্তু আব্ববাজান, সে মেয়েকে না পেলে জীবন আমি রাখবো না। যেমন করেই হোক তাকে খুঁজে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করুন। আমি তাকে না দেখে আর এক মুহূর্ত বাঁচবো না।
সুলতান অসহায় ভাবে বলে, কিন্তু বেটা তা কি করে সম্ভব। এত বড় বিশ্বসংসারে সেই অজানা অচেনা মেয়ের সন্ধান কি করে পাবো আমি। তুমি তার নাম জানো না, তার বংশ পরিচয় দিতে পারছে না, আন্দাজে কোথায় খুঁজে বেড়াবো তাকে? এখন একমাত্র আল্লাহ, তিনি সর্বজ্ঞ, একমাত্র ভরসা। তিনি যদি তোমার মনস্কামনা পূর্ণ করেন তবেই সব সমস্যার সমাধান হতে পারে। এখন তার ওপর সব ছেড়ে দিয়ে। হা হুতাশ করা ছাড়া আর আমাদের অন্য কোনও পথ নাই, বাবা। তোমার মনের ব্যথা আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু, এই বিশাল সলতানিয়তের অধিপতি হয়েও আমি আজ নিরুপায়। কি করে তার হদিশ করবো?
ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে সুলতান প্রাসাদে ফিরে আসেন। সারা প্রাসাদে বিষাদের ছায়া নেমে আসে। সুলতান এবং জামান কারো সঙ্গে দেখা করেন না। দরবারে সব কাজ কাম মুলতুবী রাখা হয়। পুত্রের ব্যথায় ব্যথিত সুলতান, কোনও কাজে মন দিতে পারেন না। কোথায় গেলে ছেলের মানসী প্রিয়ার সন্ধান পাওয়া যাবে কিছুই বুঝতে পারেন না।
প্রাসাদে নিজের কক্ষে পুত্র জামানকে নিয়ে তিনি বিষগ্লমানে দিন কাটাতে থাকেন। তার একমাত্র ভাবনা কি করে পুত্র জামানের মুখে হাসি ফোটানো যায়। কিন্তু না, দিন যায় সন্ধ্যা হয়, আবার ফিরে আসে সকাল, জামান বিরহে কাতর হয়ে পড়ে থাকে। শেষে প্রাসাদের পরিবেশও বিষময় মনে হয় তাদের।
দরিয়ার মাঝখানে সুলতানের এক বিলাস ভবন ছিলো। তীর থেকে সেতু বাধা ছিলো সেই প্রাসাদ পর্যন্ত। সুলতান ঠিক করলেন, পুত্রকে নিয়ে সেই নিরালা নির্জন প্রাসাদে গিয়ে দিন কাটাবেন। প্রাসাদের এই কোলাহল আর তার ভালো লাগছিলো না।
কিন্তু সেই অনিন্দ্য সুন্দর প্রমোদ প্রাসাদে গিয়েও জামান এতটুকু সান্ত্বনা পায় না। দিনে দিনে সে আরও বেশি বিষাদগ্বস্ত হয়ে পড়ে।
দিকে দানাশ এবং কশকশ রাজকুমারী বন্দরকে তার শয্যায় শুইয়ে রেখে আসার ঘণ্টাদুই বাদে সকাল হয়। বদরের ঘুম ভাঙে। চোখ মেলে তাকায়। দারুণ খুশি খুশি ভাব। মুখে মৃদু হাসি। গত রাতের সুখ-সম্ভোেগ তাকে মোহিত করে রেখেছে। বিছানার পাশে চোখ ফেরালো, ভুরু দুটো কুঁচকে এদিক ওদিক খুঁজতে থাকেকোথায় গেলো সে। তখনও ভালো করে ঘুমের ঘোর কাটেনি তার। আবার চোখ বন্ধ করে। দুহাত দিয়ে কি যেন হাতড়াতে থাকে। কিন্তু না, সে তো শয্যায় নেই। তবে, এই ভোরে গেলো কোথায়? ঘর থেকে বেরুবার তো কোনও উপায় নাই! অজানা আশঙ্কায় তার অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়। দিশাহারা হয়ে চিৎকার করে ওঠে। প্রধান বাঁদী ছুটে আসে। না জানি রাজকুমারীর কি বা হয়েছে। কী হলো, মালকিন, আমন করে চেঁচালেন কেন? স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছেন?
এই সময় রাত্রি অবসান হয়। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
পরদিন একশো একানব্বইতিম রজনী :
আবার সে শুরু করে : বদর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, ন্যাকামি করছো? তুমি জানো না কেন আমি চিৎকার করছি। সাফ সাফ বলো, কাল রাতে আমার পাশে যে ছেলেটা শুয়েছিলো সে কোথায়? ওফ, কী তার রূপ, কী তার পৌরুষ-আমাকে সে একটা রাতে যা দিয়েছে সারা জিন্দগীভর কেউ তার দিতে পারবে না। যাক ওসব কথা শুনে তোমার কাজ নাই। এখন বলে তাকে আবার কোথায় নিয়ে গেছো।
বদরের কথা শুনে বুড়ি বঁর্দীর চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়, কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলে, ইয়া আল্লা, একি কথা বলছেন, রাজকুমারী? এমন অসৎ আলুক্ষণে কথা মুখে আনা পাপ। এতকাল আমি আপনার বাঁদীগিরি করছি, কোনও দিন তো মতিভ্বম আপনার হয়নি রাজকুমারী? না না, আপনি আমার সঙ্গে মস্করা করছেন, তাই না?
বদর বিছানার ওপরে ভর দিয়ে হাতের তালুতে মাথা রেখে আধশোয়া অবস্থায় বুড়ি বঁর্দীর দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি ছুঁড়ে বলে, দেখো বুড়ি, তোমর কপালে আজ অনেক দুঃখ আছে। আমাকে তুমি চেনো না? আমার রাগ কখনও দেখোনি? এখনও লক্ষ্মী মেয়ের মতো সত্যি কথা বলো। কাল রাতে সে আমাকে বেহেস্তের সুখ দিয়েছে। আমি আমার এতকালের যত্ন-ললিত এই দেহ-রূপযৌবন সব তার হাতে তুলে দিয়েছি। সে এখন আমার ভালোবাসা। তাকে ছাড়া মুহূর্ত আমি থাকতে পারবো না। বলে সে কোথায়?
বুড়ি-বাদী চোখে সর্ষে ফুল দেখতে থাকে। মনে হয়। সারা প্রাসাদটা জুলছে। বুঝিবা এখুনি হুড়মুড় করে সব ধসে পড়বে। নিজের কানকে সে বিশ্বাস করতে পারে না। সব কী কথা শুনলো সে। আবার নিজের কপাল চাপড়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো, ওগো, আমার কী হলো গো, এমন সব্বোনাশ কে করলো গো। হায় আল্লাহ, একি করলে তুমি!
তার চেঁচামেচি চিৎকারে হারেমের অন্যান্য দাসী বাঁদীরা সব ছুটে আসে। রাজকুমারীর মাথা খারাপ হয়ে গেছে শুনে তারাও হা-হুতাশ করে চোখের জল ফেলতে থাকে।
রাজকুমারী এবার বাঘিনীর মূর্তি ধারণ করে। দাঁড়াও তোমাদের সন্ট করে শয়তানী আমি ভেঙে দিচ্ছি। সবগুলো এক গোয়ালের গরু। হাড়ে হাড়ে বজাৎ। কিন্তু এখনও শোনো বলছি, আমার মেহেবুবকে এখুনি নিয়ে এসো। না হলে তোমাদের সবাইকে আমি কুকুর দিয়ে খাওয়াবে।
দাসী বাঁদীরা শিউড়ে ওঠে, কিন্তু রাজকুমারী, -কথা সম্রাটের কানে গেলে কি কাণ্ড হবে। বলুন, দেখি। আমাদের যেমন গর্দান যাবে, সেই সঙ্গে আপনাকেও কোতল করে ফেলবে।
সব কথা এমন করে চাউর করা কি ভালো হচ্ছে মালকিন?
ওসব ছেদো কথা আমি শুনতে চাই না, রাজকুমারী বদর কঠিন কণ্ঠে বলতে থাকে, আমার চোখের মণি, দিল-কা-পিয়ারাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে বলে। কাল রাতে তার সঙ্গে আমি যে এক বিছানায় রাত কাটিয়েছি তার প্রমাণ আমার শরীরে এখনও জুলজুলি করছে।
বুড়ি বাঁদী হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো, হায় আল্লাহ একি হলো, আমার সোনার বাছার মাথা খারাপ হয়ে গেলো? এযে একেবারে বদ্ধ পাগলের প্রলাপ বকছে সে। এখন আমি কি করি। তখনই বলেছিলাম, মেয়েছেলে সোমখ হলে শাদী দিয়ে দিতে হয়। তা না হলেই যত বিপত্তি। এখন এই ঠ্যােলা কে সামলাবো? সম্রাটের কাছে কে জানাবে এই দুঃসংবাদ। যে বলতে যাবে, তারই তো গর্দান যাবে সঙ্গে সঙ্গে।
বদর এবার ক্ষেপ কুকুরের মতো তেড়ে যায়, তবে রে শয়তানী? আমার সঙ্গে মস্করা করা হচ্ছে। আমি তোর ইয়ার্কির পাত্রী?
ছুটে গিয়ে দেওয়ালে টাঙানো ঢাল-তলোয়ারের একখানা পেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে মারে। দাসী-বাদীরা আঁতকে ওঠে। আর একটু হলেই দু-এক জনের জান খতম হয়ে যেত। ভাগ্যে তারা ছিটকে সরে যেতে পেরেছিলো। তাই রক্ষে।
রাজকুমারী বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছেএই সংবাদ সারা প্রাসাদে মৃত্যু সংবাদের মতোই মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়লো। সম্রাট ঘায়ুরেরও কনে পৌঁছতে বেশি দেরি হলো না। তিনি তৎক্ষণাৎ হারেমের তাবৎ দাসী বঁটী খোজদের তলব করলেন। বুড়ি বাঁদী সাশ্রু নয়নে আদ্যোপোন্ত সবিস্তারে সব বর্ণনা দিল। ঘায়ুর শুনে স্তম্ভিত হলেন। এক রাতের মধ্যে এমন অনাসৃষ্টি কাণ্ড কি করে ঘটতে পারে, তিনি কিছুই ভাবতে পারেন না। শুধু চিন্তিতভাবে একটি কথাই বলতে পারলেন, ভয়ঙ্কর কথা!
বুড়ি-বাদী বললো, সে যে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে তাতে আর কোনও সন্দেহ নাই। তলোয়ার ছুঁড়ে আমাদের খতম করতে চেয়েছিলো, বরাতজোরে বেঁচে গেছি।
ঘায়ুর এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না, চিৎকার করে প্রাসাদ ফাটিয়ে দিতে চান। তুমি যে সব কথা বলছে, তা কি সত্যি?
এক বৰ্ণও মিথ্যা নয় হুজুর।
বড় সাংঘাতিক কথা, কিন্তু কি করে হলো? আর বদর যা বলছে তার সবটাই কি পাগলামী?
সম্রাট মহানুভব, প্রথমে আমার তাই মনে হয়েছিলো। কিন্তু পরে যা দেখেছি তাতে আমার মনেও খানিকটা দ্বিধা এসেছে।
সম্রাট উত্তেজিত অধৈৰ্য হয়ে কৈফিয়ত তলব করেন, কি দেখেছে, বলে। হুজুর, আজ সকালে যখন রাজকুমারী ঘুম থেকে জেগেছেন, তার পরেই তার চিৎকারে আমি ঘরে ছুটে যাই। তখন তিনি মাত্র একটি শেমিজ পরেছিলেন। রোজ রাতে শোবার সময় এই পোশাকেই তিনি শুয়ে থাকেন। দেহের নিচের অংশ একেবারে নগ্ন থাকে। আমি দেখেছি, তার জঙ্ঘার দুপাশে শুকনো রক্তের ছোপ-উরু পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। দৃশ্য আমার কাছে নতুন। আপনি সম্রাট, আমার কাছে মেয়েদের এসব ব্যক্তিগত ব্যাপার খুলে বলা সম্ভব না। তবে জেনে রাখুন। ধরনের রক্তপাত, স্বাভাবিকভাবে হয় না। কোনও পুরুষ-সঙ্গ ছাড়া হতে পারে না। কিন্তু তাও একেবারে অসম্ভব। প্রাসাদের যা কড়া পাহারাতাদের চোখে ধুলো দিয়ে কোন কাক-পক্ষীরও হারেমে ঢোকা সম্ভব নয়।
সম্রাট ঘায়ুর উত্তেজনায় কাঁপতে থাকেন, তাজ্জব ব্যাপার! সম্রাট আর তিলমাত্র দেরি না করে কন্যা বদরের মহলে ছুটে এলেন। কন্যাকে সস্নেহ চুম্বন দিয়ে বললেন, মা
জননী, এইসব দাসী-বাদীরা তোমার নামে কী সব বলছে! আমি ওদের সর্প শূলে চাপাবো।
কেন বাবা, কি বলেছে তারা?
ওরা বলেছে, কাল রাতে নাকি তোমার ঘরে কোন এক অচেনা অজানা যুবক ঢুকেছিলো! তুমি নাকি তাকে গ্রহণ করেছো, এক বিছানায় রাত্রিবাস করেছো তোমার নামে -সব অপবাদ আমি কিছুতেই সহ্য করবো না মা। আমি ওদের শূলে দেব। শুধু একবার বলো, সব মিথ্যে।
মিথ্যে? মিথ্যে কেন হতে যাবে বাবা। এর চেয়ে বড় সত্যি আজ আর আমার জীবনে কিছু নাই, বাবা! আমি এতকাল পুরুষ বিদ্বেষী ছিলাম। তার কারণ, যে সব পত্র আপনি হাজির করেছিলেন তাদের কাউকেই আমার যোগ্য বলে মনে হয়নি। কিন্তু কাল রাতে যে অপূর্ব সুন্দর ছেলেটিকে আমার ঘরে পাঠিয়েছিলেন, তার জুড়ি বিশ্ব সংসারে নাই। সেদিক থেকে আপনার পছন্দের তারিফ করছি বাবা। আমি কাল রাতেই তাকে আমার দেহ-মন সব সঁপে দিয়েছি। এখন আমার আর কোনও অমত নাই। তার সঙ্গে আমার শাদীর ব্যবস্থা করুন। আমি শাদী করবো। বাবা, তাকে যদি আমার ঘরে পাঠালেন। তবে ভোর না হতেই আবার তাকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন কেন? সে যে আমার, সে যে আমার নয়নমণি-তাকে আমি সব দিয়েছি। সেও আমাকে মনে প্ৰাণে গ্রহণ করেছে। এই দেখুন, তার প্রমাণ। সে আমাকে তার হাতের আংটি পরিয়ে দিয়েছে।
সম্রাট ঘায়ুর মাথায় হাত দিয়ে বসলেন, মা, তুমি সত্যিই উন্মাদ হয়ে গেছে। ওরা ঠিক কথাই বলেছে। কিন্তু কি করবো, ঈশ্বর যা চান তাই হবে। যাক, তুমি আর ওসব নিয়ে মাথা ঘামিও না। আমি তোমার ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি।
বাবার কথা শুনে বদর ক্ৰোধে ফেটে পড়ে। নিজের সাজপোশাক ছিঁড়ে খুঁড়ে টুকরো টুকরো করতে থাকে। ঘায়ুর ভাবলেন, পাগল হলে কোনই কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। হয়তো সে তার প্রাণটাই শেষ করে দিতে পারে। দাসী বাদীদের হুকুম করলেন, রাজকুমারীকে ধরে। জোর করে ওকে শুইয়ে দাও; যেন সেনা ওঠে। লক্ষ্য রাখবে। আর যদি দেখো, তাকে সামলানো যাচ্ছে না, সোনর শিকর দিয়ে তাকে জানলার গরাদের সঙ্গে বেঁধে রাখবে। কোনও ক্রমেই যেন সে ছুটে না যায়।
ঘায়ুর দরবারে ফিরে গেলেন। তার একমাত্র সন্তান, নয়নের আলোসে আজ পাগল হয়ে গেলো! কি হবে এই সাম্রাজ্যে? কিসের প্রয়োজন এত বিত্ত বৈভবের? কান্নায় রুদ্ধ হয়ে আসে। কণ্ঠ। হায় ঈশ্বর একি ভয়ঙ্কর শাস্তি দিলে তুমি, কি আমার অপরাধ?
দরবারে গণমান্য অমাত্য পরিষদদের ডেকে পাঠালেন। তাদের সঙ্গে একটা পরামর্শ করা দরকার। এই অন্ধকারাচ্ছন্ন বিপদের দিনে কেউ যদি আলোর রেখা দেখাতে পারে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই শহরের গণমান্য সম্রান্ত ব্যক্তি, হেকিম বদ্যি, গণৎকার সব হাজির হলেন। সম্রাট তাদের কাছে সব খুলে বললেন।
এখন সে বদ্ধ উন্মাদ। তবে আমার বিশ্বাস রোগ সারানো সম্ভব। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ তার এই ব্যধি সারাতে পারো আমি তার হাতেই তুলে দেব আমার প্রতিমা বদরকে। তার সঙ্গে ছেড়ে দেব আমার এই সিংহাসন-বিশাল সাম্রাজ্য। কিন্তু একটা শর্ত-যদি কেউ সারাতে পারবে বলে এগিয়ে আসে, অথচ সারাতে না পারে, তবে তার গর্দান যাবে।
সম্রাটের এই ঘোষণা নানা দেশের নগরে প্রান্তরে জারি করে দেওয়া হলো। বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক গুণীজ্ঞানী বদ্যি, হেকিম, জ্যোতিষী গণৎকার আসতে লাগলো। সবাই রাজকুমারীকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললো, নিঃ, বড় দুরারোগ্য কঠিন রোগ। সারবে কি সারবে না বলা শক্ত। অবস্থায় হাড়ি কাঠে মাথা গলিয়ে দিতে বিশেষ কেউই ভরসা। পেলো না। যারা ধনদৌলত সাম্রাজ্য আর রাজকুমারীর লোভ সামলাতে না পেরে পতঙ্গের মতো উড়ে এলো তাদের ভাগ্যে যা জুটতে পারে তাই জুটলো।
রাজকুমারী বদরের এক পাতানো ভাই ছিলো। বুড়ি বাঁদীের একমাত্র পুত্র, ছোট থেকে একসঙ্গেই তারা হোসে-খেলে মানুষ হয়েছে। ছেলেটি খুব ধর্মবিশ্বাসী। ছোট থেকেই সে তন্ত্রমন্ত্র নিয়ে সাধনা করত। মজার যাদুবিদ্যা দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিত। হিন্দু এবং মিশরীরীয় তন্ত্রমন্ত্র সম্বন্ধে পড়াশুনাও করেছে সে প্রচুর। এই তার নেশা। দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়। নতুন কোনও যাদু নতুন কোনও মন্ত্র যদি কোথাও শেখা যায়। সারা দুনিয়ার নানা দেশ ঘুরে ঘুরে তার বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে। কত রাজা বাদশাহের দরবারে সে সম্মোহন বিদ্যা দেখিয়ে উপস্থিত। সকলকে অবাক করে দিয়েছে তার ইয়ত্ত নাই।
ছেলেটির নাম মারজাবন। অনেক দিন বাদে, অনেক দেশ ঘুরে সে দেশে ফিরছে। শহরে ঢোকার মুখেই দেখে, প্রবেশ দ্বারের সামনেই গোটা চল্লিশেক নরমুণ্ডু ঝোলানো রয়েছে। কি ব্যাপার, কিছুই ঠাওর করতে পারে না। এক সঙ্গে এতগুলো মানুষ বলি হয়েছে। পথচারীদের জিজ্ঞেস করতে একজন বললো, রাজকুমারী পাগল হয়ে গেছেন। সম্রাট ঘোষণা করেছেন যে সারাতে পারবে তাকে রাজকন্যা রাজত্ব দুই- হাতে তুলে দেবেন। তিনি। আর যে না পারবে তার গর্দান যাবে। তাই-লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু। বেচারীদের জন্মের সাধ মিটে গেছে। রাজকুমারীকে কেউ সারাতে পারেনি।
এইসময় রাত্রি শেষ হতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
একশো চুরানব্বইতম রজনীতে আবার কাহিনী শুরু করে সে :
আর বলিস নি, বাবা, মেয়েটা পাগল হয়ে গেছে। দেশে বিদেশের কত ডাক্তারবিদ্যি আসছে, কিন্তু কেউ সারাতে পারছে না। সম্রাট ট্যাড়া পিটে দিয়েছেন, যে তার মেয়েকে সারিয়ে তুলতে পারবে তার সঙ্গে মেয়ের শাদী দিয়ে দেবেন। সেই সঙ্গে দেবেন তার গোটা সাম্রাজ্য। কিন্তু যারা লোভে পড়ে এলো কেউই তারা প্ৰাণ নিয়ে দেশে ফিরতে পারলো না।
মারজীবন বুঝলো, পথচারী লোকটা যা বলেছিলো, কথাটা তাহলে ঠিকই। মারজাবনের মনটা ভীষণ খারা হয়ে গেলো। ছোটবেলা থেকে এক সঙ্গে হেসে খেলে তারা ভাইবোনের মতো মানুষ হয়েছে। অনেকক্ষণ চিন্তার করার পর সে মাকে বললো, মা, একবার তুমি তার সঙ্গে আমার দেখা করিয়ে দাও। আমার বিশ্বাস, আমি তাকে সারিয়ে তুলতে পারবো।
মা শঙ্কিত হয়, সে বড় কঠিন ব্যামো, বাবা। দেশে বিদেশের কত নামজাদা হেকিম বদ্যি এলো, কিন্তু কেউ কিছু করতে পারলো না। ওসবের মধ্যে তোমার গিয়ে কাজ নাই।
মারজীবন কিন্তু নাছোড়বান্দা। বললো, তুমি একবার তার সঙ্গে মোলাকাৎ করিয়ে দাওই না। তারপর আমি বুঝবো।
পুত্রের বায়না ঠেলতে পারে না বুড়ি বাদী।ঠিক আছে, তুমি এক কাজ করো। মেয়েদের সাজপোশাক পরে আজ রাতে তুমি আমার সঙ্গে হারেমে ঢুকবে।
মায়ের কথামতো নারীর ছদ্মবেশ ধরে যথাসময়ে মায়ের কাছে আসে মারজাবন। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে রাজকুমারী বদরের হারেমে ঢুকতে যায়। প্রথমে খোজারা বাধা দিলো, নতুন কোনও লোকের ঢোকার হুকুম নাই।
বুড়ি বাঁদী বলে, আহা, নতুন লোক আবার কোথায় দেখলে? তো আমার লেড়কী।
রাজকুমারী বদরের সঙ্গে এক সঙ্গে মানুষ হয়েছে। ওরা দুজনে বড় পিয়ারের সখী।
খোজা ভাবে, রাজকুমারীর সখীসে তো সোজা কথা নয়। বাধা দিলে রাজকুমারী হয়তো তার গর্দান নিয়ে নেবে। তাই আর কথাটি না বলে দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালো।
হারেমে ঢুকে বদরে দেখে সে বোরখা খুলে ফেলে দিলো। বোরখার মধ্যে সে একখানা জ্যোতিষ দর্পণ লুকিয়ে এনেছিলো। আর এনেছিলো খানকয়েক যাদুমন্ত্রের বই এবং একটি মোমবাতি।
মারজীবনকে দেখে ছুটে আসে বন্দর। ওর ঘাড়ে মাথা রেখে বলে, কোথায় ছিলে ভাই? এরা সবাই আমাকে পাগল বানিয়ে রেখেছে। ওর যাই ভাবুক, তুমি তো আমাকে ভালো করে জানো ভাই। ওদের মতো তুমিও যেন আমাকে ভুল বুঝে না।
মারজীবন বলে, সেইজন্যেই তো নিজের চোখে দেখতে এসেছি বোন। তুমি কিছু ভেবো না, আল্লা ভরসা করো, সব ঠিক হয়ে যাবে। যাক, সে কথা, আমি তোমার একখানা ঠিকুজী বানাতে চাই।
বদর বলে, তোমার যা ইচ্ছা বানাও। আমার কোনও অমত নাই। যে ভাবে চাও আমাকে পরীক্ষা করে দেখো, তাহলেই বুঝবে, সত্যি আমি পাগল, কি সুস্থ মানুষ।
মারজীবন বলে, যারা সুস্থ, জ্ঞানী তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করলেই পরিষ্কার বোঝা যায়। তাই আগে তোমার কাহিনী শোনাও আগাগোড়া। একটুও বাদসাদ দেবে না।
বদর সব বৃত্তান্ত হুবহু খুলে বললো তাকে। কোনও কিছু গোপন করলো না।
এখন সারা দিনরাত শুধু আমার কেঁদে কেঁদে কাটে। কোথায় আমার ভালোবাসা, কোথায় গেলে তাকে পাবো জানি না। ভাই মারজাবন, তুমি আমার শুধু পাতানো ভাই না, তুমি আমার বন্ধু। তোমাকে আজ কাছে পেয়েছি, যে কথা কাউকে মুখ ফুটে বলতে পারি না, তবু তোমাকে বলা যায়। আমি ধনদৌলত সাম্রাজ্য কিচ্ছ চাই না, ভাই। শুধু তাকে চাই। তার জন্যে আমাকে যদি ভিক্ষা করেও জীবনধারণ করতে হয় আমি রাজি আছি। দুনিয়াতে চাইবার মতো আর কোনও বস্তুই আমার নাইশুধু তাকে ছাড়া। সে আমার কলিজা, সে আমার সর্বস্ব।
মারজাবন মাথা নত করে বসে থাকে।তোমার দুঃখ আমি বুঝি বোন। বিরহের যে কি ব্যথা তা। ওরা বুঝবে কি করে। ওরা জীবনটাকে হীরে জহরৎ আর ধনদৌলত দিয়ে মাপতে শিখেছে। যাই হোক, তোর সব কাহিনীই শুনলাম। সবই আমার কাছে জলের মতো পরিষ্কার। কিন্তু আমি কসুর করবো না। আমার বিশ্বাস আমি তোমাকে সুখী করতে পারবো। কিন্তু বোন, যথেষ্ট ধৈর্য ধরতে হবে। আমি দেশে দেশে ঘুরি, বহু রাজাবাদশাহর দরবারে আমার অবাধ গতি। আর তোমার ভালোবাসা সে কোনও সে যে ঘরের ছেলে নয়। তার যা রূপের বর্ণনা দিলে তেমন রূপবান পুরুষ তো আকছাড় পথে-ঘাটে মেলে না। তাছাড়া, এই যে মহামূল্যবান হীরের আংটি-- যার তার হাতে থাকা সম্ভব না। এর বেশি আর কিছু তোমাকে এখন বলতে পারছি না, বোন। আজই আমি আবার পথে বেরিয়ে পড়বো। পথে প্রবাসে ঘোরাই আমার কাজ। কিন্তু এবার যাবো। শুধু তোমার জন্যে। দেখি চেষ্টা করি, যদি আমার বোনের মুখে আবার হাসি ফোটাতে পারি। মনে একটু বসন্তের রঙ ধরাতে পারি।
সেইদিনই সে মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার নিরুদেশের পথে বেরিয়ে পড়ে। সারাটা মাস ধরে সে শহর থেকে শহরে ঘুরে বেড়ায়। যেখানেই যায় বদরের পাগল হওয়ার কাহিনী শোনে।

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.