আমার দ্বিতীয়বার ইংল্যান্ড সফর_মুহম্মদ মতিউর রহমান : পর্ব-১৪

 
আগস্ট জুমাবার
আজ জুমার নামায পড়তে গেলাম সিডার র‌্যাপিড্স-এর একটি নতুন মসজিদে।মুসলিম-আমেরিকান সোসাইটিনামে আমেরিকার একটি মুসলিম প্রতিষ্ঠান মাত্র বছর খানেক আগে মসজিদটি নির্মাণ করেছে। একটি পুরাতন দোতলা বিল্ডিং কিনে নিচের তলায় অফিস উপর তলায় নামাযের জায়গা করা হয়েছে। বিল্ডিংটি মোটামুটি বড়। প্রায় দুয়েক মুসল্লি এতে জামায়াতে নামায পড়তে পারে। তবে ঐদিন প্রায় ষাটজন নারী-পুরুষকে জুমার নামাযে শরীক হতে দেখলাম। ইমাম আমার পূর্ব পরিচিত। সিডার র‌্যাপিডস ইসলামিক সেন্টারের মসজিদে (স্থাপিত ১৯৩৪) তিনি আগে ইমামতি করতেন। ২০০৬ সনে আমি যখন আমেরিকায় বেড়াতে এসেছিলাম, তখন সেখানে তার ইমামতিতে নামায পড়েছি। বিভিন্ন সময় তার সঙ্গে ইসলাম মুসলমানদের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। তাঁর উদ্যোগেই নতুন মসজিদটি স্থাপিত হয়েছে।
Muslim American Society (MAS) সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রব্যাপী মুসলমানদের একটি প্রতিষ্ঠান। আমেরিকার বিভিন্ন শহরে এর শাখা-প্রশাখা রয়েছে। এর মাধ্যমে এদেশে বহু মসজিদ ইসলামি সেন্টার গড়ে উঠেছে। ইসলামের দাওয়াত সম্প্রসারণ এদেশবাসীর নিকট ইসলামের আদর্শ প্রচারের জন্য বিভিন্ন স্থানে   প্রতিষ্ঠানটি লাইব্রেরী পাঠাগার গড়ে তুলেছে, আধুনিক ইসলামী জ্ঞানসম্পন্ন বহু বক্তা তৈরি করেছে এবং তার মাধ্যমে সমগ্র আমেরিকায় যেখানে যেখানে সম্ভব ইসলাম প্রচারের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অনেক বিধর্মী ইসলাম কবুল করে মুসলমান হয়েছে। এসব  নওমুসলিমদের অনেকেই এখন দ্বীনের  মুবাল্লিগ হয়ে কাজ করছেন। গঅঝ-এর মূল কাজ হলো ইসলামের যথার্থ বাণী মানুষের নিকট পৌঁছে দেয়া এবং  এক্ষেত্রে জ্ঞান যুক্তিই হলো তাদের প্রধান হাতিয়ার। আধুনিক বিশ্বে দুটি হাতিয়ার অত্যন্ত কার্যকর বলে আমার ধারণা। তাই দেখা যায়, ইউরোপ-আমেরিকার নওমুসলিম নারী-পুরুষ প্রায় সকলেই শিক্ষিত, জ্ঞানী চিন্তাশীল। মরিয়ম জামিলার মত আমেরিকার ধর্মান্ধ ইহুদী পরিবারের চিন্তাশীল বিদূষী রমণী অথবা ইংল্যান্ডের সঙ্গীত জগতের হার্টথ্রব ইউসুফ ইসলামের মত উচ্চ শিক্ষিত প্রতিভাবান ব্যক্তিরা ইসলাম গ্রহণ করে জ্ঞান চিন্তার জগতে ইসলামের আলো যেভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন, আধুনিক বিশ্বে তার তুলনা অতিশয় বিরল। ইসলামী জ্ঞান-গবেষণা আধুনিক শিক্ষিতদের মধ্যে ইসলামের দাওয়াত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে এদের অবদান এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
গঅঝ-এর মসজিদে জুমার নামায পড়ে আমি, আমার স্ত্রী, আবিদ এনাম গেলাম সিডার র‌্যাপিডস এয়ারপোর্টে। আমার বড় ছেলে জাহিদ তার স্ত্রী ছেলে আফনানকে নিয়ে আজ দুবাই থেকে আসবে, তাদেরকে রিসিভ করার জন্য আমরা এয়ারপোর্টে গেলাম। সেখানে গিয়ে জানলাম, শিকাগো থেকে যে ফ্লাইটে তাদের আসার কথা, সেটা তারা মিস করেছে, এক ঘন্টা পর তারা আরেকটি ফ্লাইটে আসবে। তাই আমরা অপেক্ষা না করে ঘরে ফিরে গেলাম। এনাম তার অফিসে ফিরে গেল। এবার সুমাইয়া শুধু আবিদকে নিয়ে যথাসময়ে এয়ারপোর্টে গিয়ে ওদেরকে নিয়ে এল। ততক্ষণ আমি ঘরেই বিশ্রাম নিলাম। অনেকদিন পরে আমেরিকায় আমার বড় ছেলে জাহিদ নাতি আফনানকে দেখে আমি আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম। নাতি আফনান উল্লসিতভাবে দাদাকে জড়িয়ে ধরল।
সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া করলাম। গল্প-গুজবে সময় কাটতে লাগলো। এখানে এখন বিকাল সোয়া আটটায় মাগরিব হয়। তাই মাগরিব হতে এখনও অনেক সময় বাকি। ইতঃমধ্যে এনাম অফিস থেকে এল। সে বলল, সবাই মিলে চলুন আমরা লেকের পাড়ে মাছ ধরতে যাই। আমি অনেক দিন ধরেই প্রস্তাব দিয়ে আসছিলাম। এনামের কথা শুনে আমি তাকে জোর সমর্থন জানালাম। অন্যরাও কেউ অমত করল না। অতএব, আর অপেক্ষা না করে রওয়ানা হওয়া গেল। সাথে মাছ ধরার সরঞ্জাম হিসাবে দুটি বরশি এবং প্লাস্টিকের তৈরি কৃত্রিম কয়েকটি ছোট মাছ নেয়া হল।
শহর ছেড়ে সিডার র‌্যাপিডস নদী পাড় হয়ে দুপাশে সবুজ ফসলের মাঠ অতিক্রম করে আমরা অবশেষে ঘন বনঘেরা বিশাল সিডার র‌্যাপিডস হ্রদের ধারে গিয়ে পৌঁছলাম। মাছ-শিকারীদের জন্য হ্রদের পাড়ে মাঝে মাঝে কয়েকটি কাঠের মাচাল তৈরি করে রাখা হয়েছে। সেখানে কাঠের বেঞ্চ পাতা আছে। বেশ আরাম করে সপরিবারে বসে মাছ ধরার চমৎকার ব্যবস্থা। মাছ ধরার জন্য কোন ফি দিতে হয় না। তবে মাছ-শিকারীদেরকে বিশ ডলার দিয়ে লাইসেন্স নিতে হয়। সুমাইয়া এনামের নামে লাইসেন্স আছে। তাই তাদের সাথে আমরা সবাই মাছ ধরতে এসেছি।
হ্রদের পাড়ে আরো কয়েকজন মৎস্য-শিকারী নিরিবিলি মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত রয়েছে। আমরা যে মাচালে অবস্থান নিলাম, সেখানেও একজন শ্বেতাঙ্গ প্রৌঢ় বয়সের আমেরিকান মাছ ধরায় নিয়োজিত। তার মাছ ধরার পাত্রে দেখলাম চারটি তাজা মাছ অল্প পানিতে জলকেলি করছে। এনাম আর সুমাইয়া বড়শি ফেলে বসে আছে, নাতনি জারা, নাতি আফনান আইয়ানেরও বরশি চাই। তারা বরশি নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করলো। দুই বড়শি নিয়ে তিনজনের টানাটানি, হইচই, কান্নাকাটি এবং শেষ পর্যন্ত মারধোর। তাদের থামাতেই আমরা সকলে পেরেশান। ধারালো বড়শির ঘায়ে কে কখন আঘাত পায় বা কার গায়ে কে আঘাত করে সে ভয়ে, সুতা থেকে বড়শি কেটে তাদেরকে শুধু বড়শির সিপ সূতার গুটি দেয়া হলো। এতেই তারা মহা খুশি। অনেকক্ষণ পর্যন্ত তারা সেগুলো দিয়ে অসীম ধৈর্য্যরে সাথে  হ্রদে মাছ ধরার প্রাণান্তর চেষ্টায় সযত্নে নিয়োজিত থাকলো। কিন্তু মাছগুলো শুধু সুতোর সাথে গলায় অযথা ফাঁস লাগিয়ে আফনান আইয়ানের নাগালের মধ্যে ধরা দিতে রাজি হল না।
এদিকে অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আভা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্তব্যাপী। সে আভা এসে পড়েছে নীল হ্রদের গভীর জলরাশিতেও। সমস্ত হ্রদটা যেন রক্ত গোলাপের রঙে রাঙা হয়ে উঠেছে। আমাদের মাছ ধরার অভিযান সার্থক হলো না। আইয়ান আফনানের মনও বিষণ্ন। অগত্যা আমরা সকলে খালি হাতে আবার গাড়িতে উঠলাম। নিবিড় বনের মধ্য দিয়ে সবুজ ফসলের মাঠ পাড়ি দিয়ে, পথের দুপাশের ছোট ছোট বাড়ি-ঘরের সুরম্য দৃশ্যমালা অবলোকন করতে করতে আমরা অবশেষে ঘরে ফিরে এলাম। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। দিনের আলো নিভে দিগন্ত জুড়ে রাত্রি তার ঘনকালো আবরণ বিস্তার করে দিয়েছে।
 
আগস্ট, শনিবার
আমার ছোট ছেলে আবিদের আজ বিয়ে। আবিদের জন্ম দুবাইতে ১৯৭৯ সানের ১৪ জুলাই। আমি তখন দুবাইতে চাকরি করি। সে প্রথমে দুবাইতে আমার প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ইসলামিক ইংলিশ স্কুলে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে সেখানকার আল সাদিক ইসলামিক ইংলিশ স্কুল থেকে সব বিষয়ে গ্রেড পেয়ে লেভেল পাশ করে। তারপর আমি বাংলাদেশে চলে এলে সেও আমার সঙ্গে ঢাকায় চলে আসে এবং ঢাকার মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে লেভেল পাশ করে। তারপর ঝঅঞ টোফেল পরীক্ষায় অসাধারণ রেজাল্ট করে। ঝঅঞ পরীক্ষায় ১৫০০ নম্বরের মধ্যে ১৪৫০ নম্বর এবং টোফেল পরীক্ষায় সে শতকরা ৯৯. মার্ক পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। ১৯৯৯ সনের ডিসেম্বরে সে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে আমেরিকায় যায় এবং মিজুরী স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে স্কলারশীপ নিয়ে পড়াশোনা করে। সেখান থেকে সে যথাক্রমে ব্যাচেলর মাস্টার্স পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে (সব বিষয়ে গ্রেড) ঈড়সঢ়ঁঃবৎ ওহভড়ৎসধঃরড়হ ঝুংঃবস- এমএস ডিগ্রী নিয়ে ক্যানসাস সিটিতে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে প্রোগ্রামার হিসাবে চাকরি নেয়। চার বছরের মধ্যেই সে চাকুরিতে পর পর তিনটি প্রমোশন পেয়ে এখন ম্যানেজার পদে উন্নীত হয়েছে। মিজুরী ইউনির্ভাসিটিতে অধ্যায়নরত একটি মেয়েকে সে চিনত। মেয়েটির নাম আনা। তার জন্ম রাশিয়ায়। এখন সে স্কলারশীপ নিয়ে নার্সিংয়ে মাস্টার্স অধ্যয়ন করে। আবিদ তাকেসহ সেখানকার আরো কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীকে কিছু ইসলামী বই-পুস্তক পড়তে দেয়। সেগুলো পড়ে এবং আবিদের কাছে ইসলাম সম্পর্কে আরো নানা বিষয় অবহিত হয়ে তাদের কয়েকজন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তার মধ্যে আনাও একজন। সে সুবাদে আবিদ তাকে চিনতো। চার বছর আগে আনা মুসলমান হয়েছে। এখন সে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে, রোজা রাখে, হালাল-হারাম মেনে চলে এবং পুরোপুরি হিযাব পরিধান করে। আবিদ তাকে দীর্ঘদিন হলো জেনে-শুনে তার সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই আমাদেরকে জানায়। তাকে দেখে আমাদেরও ভাল লাগে। আমি, আমার স্ত্রী, বড় মেয়ে সুমাইয়া জামাই এনাম সবাই তাকে পছন্দ করি। তারপর আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে আবিদের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দিলে সে সাগ্রহে বিয়েতে তার সম্মতি জানায়। আনার মাও তখন রাশিয়া থেকে মেয়েকে দেখতে এসেছেন। তার সামনেই বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকি হয়। অবশ্য তার ছুটি শেষ হওয়ায় বিয়েতে তিনি  অংশগ্রহণ করতে পারেন নি। আমার বড় ছেলে ছোট মেয়ে-আফিয়ার সঙ্গে আলোচনা করে বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করি। জাহিদ আফিয়াকে আসতে বলি। আফিয়ার পক্ষে আসা সম্ভব ছিল না। তবে জাহিদ সপরিবারে আগস্ট আইওয়া রাজ্যের সিডার র‌্যাপিডস- আসে। আমরা সেখানে সুমাইয়ার বাসায় বিয়ের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করি।
বিয়ের অনুষ্ঠানে ২০/২৫ জন উপস্থিত ছিলেন। আবিদ আনার কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব এনামের পরিচিত কয়েকজন। সমাগত মেহমানরা ছিলেন মুসলমান, হিন্দু, খ্রীস্টান রাশিয়ান, আমেরিকান, ইন্ডিয়ান, বাংলাদেশী, থাই, তুর্কি মিশরি। বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ-জাতির লোকদের সমাবেশে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। বিয়ে পড়ান  স্থানীয় ইসলামিক সেন্টার মসজিদের মিশরি ইমাম। বিয়ে পড়ানোর পর সবাইকে বিরানী, কেক, ঘরে বানানো মিষ্টি দই দিয়ে আপ্যায়িত করা হয়। বিয়ের দেন-মোহর ধার্য হয় দশ হাজার একশো এক ডলার। বিয়ের পর ইমাম সাহেব খুব সুন্দরভাবে কুরআন-হাদীসের আলোকে স্বামী-স্ত্রীর দায়িত্ব-কর্তব্য শরীয়তের নির্দেশাবলী উপস্থিত সকলের সামনে ইংরাজিতে বর্ণনা করেন। তখন একটি ভাব-গম্ভীর পবিত্র পরিবেশের সৃষ্টি হয়। দোয়ার মাধ্যমে ইমাম সাহেব অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
আমেরিকায় বিয়ের জন্য ছেলে মেয়ে উভয়কেই শহর কর্তৃপক্ষের নিকট লাইসেন্সের আবেদন করতে হয়। লাইসেন্স ফরম পাওয়ার তিনদিনের মধ্যে বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে শহর-কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা আইনসঙ্গতভাবে বিয়ে রেজিস্ট্রি করে লাইসেন্সের একটি কপি প্রদান করে। এজন্য সিটি-কর্তৃপক্ষকে নির্দিষ্ট ফি প্রদান করতে হয়। আইনত এটাই বিয়ের চূড়ান্ত পর্যায়। তবে মুসলমানদের জন্য এটা যথেষ্ঠ নয়। তাই ইমাম ডেকে আত্মীয়-পরিজনদের দাওয়াত দিয়ে যথারীতি ইসলামী পদ্ধতিতে ইজাব-কবুলের মাধ্যমে বিয়ের কাজ চূড়ান্ত করা হয়। বিয়েতে আমাদের পক্ষ থেকে কনেকে তিনটি হীরার আংটি, কয়েকটি সোনার চুড়ি একটি নেকলেস, কিছু পোষাকাদি দুটি জায়নামাজ উপঢৌকন হিসাবে প্রদান করা হয়। বিয়েতে বর-কনে কারো পক্ষ থেকেই কোন দাবি-দাওয়া ছিল না। তাই খুব অনাড়ম্বরভাবে বিয়ের অনুষ্ঠান সুন্দরভাবে সুসম্পন্ন হয়। বিয়েতে মেয়ের সাথে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠি দুই বান্ধবী এসেছিল।
 
১০ আগস্ট, সোমবার
বিয়ের একদিন পর আবিদ আনা গেল ক্যানসাস সিটিতে। তাদের সঙ্গে গেলো জাহিদ, তার স্ত্রী ছেলে আফনান। আমি আমার স্ত্রী কয়েকদিন আগেই সেখান থেকে এসেছি, তাই আমরা আর সেখানে গেলাম না। আমার দুই ছেলে তাদের স্ত্রী আমার নাতি আফনানকে নিয়ে একদিন পরই আবার সিডার র‌্যাপিডস ফিরে আসে। কারণ ১৩ আগস্ট আমি আমার স্ত্রী  নিউইয়র্ক চলে যাব। সেখান থেকে ১৭ আগস্ট আমরা দেশে ফিরে যাব। তাই ওরা আমাদেরকে বিদায় জানাতে এসেছে।
আমার ছোট ছেলের নতুন বউ আনাকে কাছে পেয়ে আমি তাকে কিছু উপদেশ-পরামর্শ দিলাম। উপদেশের মধ্যে আমি তাকে তার ইসলাম গ্রহণের কারণ ইসলাম গ্রহণের পর তার অনুভূতি নতুন জীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে একটি বই লেখার অনুরোধ জানালাম। সে সানন্দে তাতে সম্মত হয়। তার বই লেখা শেষ হলে আমি বাংলাদেশ থেকে তা প্রকাশের ব্যবস্থা করব বলে তাকে আশ্বস্ত করলাম। সে খুশি হলো।
 
১৩ আগস্ট বৃহস্পতিবার
সকাল নয়টা পঁচিশ মিনিটে আমাদের নিউইয়র্ক যাবার ফ্লাইট। ফজরের নামাজ পড়ে নিচের তলায় নেমে দেখি রান্নাঘরে আমার নতুন বউমা আনা নাস্তা বানাচ্ছে। আমরা নাস্তা খেয়ে সকাল আটটায় গাড়িতে উঠলাম। আবিদ গাড়ি চালাচ্ছে। তার পাশে জাহিদ, পিছনের সীটে আমি, আমার স্ত্রী  আনা। ভোর ছয়টায় সুমাইয়া আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তার মেয়ে ছেলেকে নিয়ে স্কুলে চলে গেছে। এনামের অফিস আটটায়। তাই সে আমাদেরকে বিদায় দিয়ে তারপর তার অফিসে রওয়ানা হলো।
বাসা থেকে এয়ারপোর্ট মাত্র ১৫ মিনিটের পথ। কোন যানজট নেই। তাই আমরা যথাসময়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেলাম। বোর্ডিং পাস নিয়ে আমরা নিশ্চিন্তে বসে গল্প-গুজব করছি। ফটো তোলা হচ্ছে। ছেলেমেয়ে, জামাই, নাতি-পুতিদের ছেড়ে যেতে হৃদয় ব্যাকুলিত হয়ে উঠেছে। এভাবে কখন যে আমাদের প্লেন চলে গেছে, তা কেউ  খেয়াল করি নি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সময় পার হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালাম। চেকিং-এর কাজও শেষ। আবিদ দৌড়ে এসে বলল, প্লেন চলে গেছে, পরবর্তী ফ্লাইটে যেতে হবে। ১১টা বিশ মিনিটে পরবর্তী ফ্লাইট। আমরা এয়ারপোর্টেই বসে থাকলাম। সিডার র‌্যাপিডস থেকে  শিকাগো মাত্র চল্লিশ মিনিটের পথ। সেখান থেকে আমাদের আরেকটি প্লেনে উঠে নিউইয়র্কে যেতে হবে। শিকাগোতে যখন পৌছলাম ততক্ষণে আমাদের নির্দিষ্ট ফ্লাইট যথারীতি ছেড়ে গেছে। পরবর্তী ফ্লাইট .৫০ মিনিটে। ততক্ষণ কাউন্টারে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
যথাসময়ে আমেরিকান এয়ারলাইনসের প্লেন ছাড়ল, নিউইয়ার্কের দিকে। দুই ঘন্টা বিশ মিনিট লাগলো নিউইয়র্ক পৌঁছাতে। তখন নিউইর্য়কে বিকাল ছয়টা দশ মিনিট। সকাল আটটায় নাস্তা করে বাসা থেকে বের হয়েছি, এর মধ্যে আমেরিকা এয়ারলাইন্স মাত্র একবার একটি জুস খেতে দিয়েছে। ধনী দেশের এক নম্বর এয়ারলাইন্স। কিন্তু খাবার দেয়ার ব্যাপারে এত কনজুস তা চিন্তা করা যায় না। আমি ক্রুম্যানকে জিজ্ঞাসা করলাম তোমাদের খাবার দেয়ার কোন ব্যবস্থা নেই? সে বলল, আছে। তবে পয়সা দিয়ে কিনে খেতে হবে। প্লেনে পয়সা দিয়ে কিনে খেতে হয় এটা ভাবতে অবাক লাগে। আমেরিকায় আর্থিক মন্দার কারণেই কি তারা এতটা কনজুসী শুরু করেছে?
বিকাল সোয়া ছয়টায় যখন লাগুরডিয়া এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম তখন আমাদের দুজনেরই ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। মালপত্র সংগ্রহ করে ট্রলিতে তুলব, কিন্তু ট্রলি শিকল দিয়ে বাধা। শিকল কিছুতেই খুলছে না। পাশে এক যাত্রী আমাকে বলল, পাঁচ ডলার বাক্সে ঢাল, ট্রলি বেরিয়ে আসবে। এখানেও ব্যবসা। আমাদের যাত্রা-পথে পর্যন্ত ঢাকা, দুবাই, লন্ডন, শিকাগো, সিডার র‌্যাপিডস প্রভৃতি এয়ারপোর্ট অতিক্রম করে এসেছি, কোথাও ট্রলির জন্য পয়সা লাগেনি। কিন্তু নিউইয়র্কে এসে অবাক হলাম। ভাগ্যিস পকেটে খুচরা পাঁচ ডলার ছিল। ডলারগুলো বাক্সে ঢালতেই ট্রলির বাঁধন খুলে গেল। তাতে মালপত্র তুলে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে এলাম।
রাস্তার পাশেই প্রফেসর আশরাফ-উয-যামান গাড়ি নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমরা তার গাড়িতে উঠে পড়লাম। আমাদের মালপত্র উনি নিজেই তার গাড়িতে তুলে নিলেন। আমাদের কোন কষ্টই করতে হলো না। ১৯৬২ সনে আমি যখন ঢাকার সিদ্বেশরী নাইট কলেজে অধ্যাপনা শুরু করি, তখন আশরাফ-উয-যামান ওখানে ইন্টার্মিডিয়েট ক্লাসে ভর্তি হন। পাশাপাশি ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসায় তার টাইটেল ক্লাসে পড়াশোনাও চলছিল। বর্তমানে তিনি নিউইর্য়কে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক, একটি মসজিদের ইমাম এখানে বেশ কয়েকটি ইসলামী প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা, সভাপতি কর্মকর্তা। গত ২৩ বছর তিনি আমেরিকায় আছেন এখন সপরিবারে আমেরিকার নাগরিকত্ব পেয়েছেন। বাসা নিউইয়র্কের কুইনস বারোর জ্যামাইকাতে। দুই বেডরুমের ফ্ল্যাটে স্ত্রীসহ থাকেন। তার কোন ছেলে নেই। দুটি মাত্র মেয়ে, তাদেরও বিয়ে হয়েছে। মেয়েরাও আমেরিকাতেই থাকে এবং বর্তমানে আমেরিকার নাগরিক। আমরা যাবার পর আমাদের এ্যাটাস্ট বাথরুমসহ একটি বেড রুম বরাদ্দ করা হলো।
বাসায় ঢোকার পরই দেখলাম, ডাইনিং টেবিলে খানা সাজানো রয়েছে। ভাত এবং বাংলাদেশী মাছ-তরকারী। সারাদিন প্রায় না খাওয়া ক্ষুর্ধাত শরীর। খেয়ে-দেয়ে বেশ পরিতৃপ্তি বোধ করলাম। তারপর নানা গল্প-গুজব কুশল বিনিময়ে সেদিনটা কেটে গেল। পরিচিত কয়েকজনকে টেলিফোন করে আমার নিউইয়র্ক পৌঁছার খবরটা দিলাম। আশরাফুয-যামানও কয়েক জায়গায় টেলিফোন করে নিউইয়র্কে আমার পৌঁছার খবর তাদেরকে জানালেন।  সেদিন আর বাইরে বের না হয়ে এশার নামায পড়ে শুয়ে পড়লাম।

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.