স্বাধীনতার মর্যাদা রাখবে তরুণ প্রজন্ম ।। মোহাম্মদ অংকন

স্বাধীনতা প্রতিটি পরাধিন জাতি-গোষ্ঠির জন্য অবধারিত। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার মধ্যে নিহীত থাকে স্বাধীনতার অসংখ্য উপাদান। স্বভাষায় কথা বলার স্বাধীনতা, মুক্তভাবে চলাফেরার স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, স্বাচ্ছন্দ্যভাবে জীবনধারণের স্বাধীনতা ইত্যাদি। যেকোনো পরাধিন জাতি-গোষ্ঠি এইসব স্বাধীনতা থেকে নির্ঘাত বঞ্চিত। কর্তৃতাধিন রাষ্ট্র তাদের পাওনাকে কখনো অধিকার মনে করে না, করুনা মনে করে। দাসত্বের অন্তরালে বন্দি করে ফেলে। যখন চাইবে, তখনই তাদের ওপর নির্যাতন করতে পারবে, অধিকার হরণ করতে পারবে। প্রয়োজনে ভূ-খন্ড থেকে নিঃচিহ্ন করে দিতে পারবে। গণহত্যা করতে পারবে। জাতিগত বিদ্বেষ থাকলে রক্তপাত সুনিশ্চিত। দেশত্যাগে বাধ্য করবে। ধর্মীয় রাজনীতির করালগ্রাসে পৃথিবীতে অসংখ্য জাতি-গোষ্ঠি তাদের মূল ভূখন্ড, জন্মভিটা থেকে বিতারিত হয়েছে, দাসত্বের শিকার হয়েছে, প্রতিবাদে জীবন দিতে হয়েছে। সত্যি, স্বাধীনতা-হীনতা এক চরম দুর্ভাগ্যের নাম, দৈন্যদশার নাম। রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায় যতার্থ লিখেছিলেন, ‘স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়?/ দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়।
 
আজকের বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র ঠিক ঊনপঞ্চাশ বছর আগে স্বাধীন ছিল না। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের দুঃশাসনের বেড়াজালে বন্দি ছিল, তাদের দাসত্বের শিকার ছিল। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভক্তির পর ভারত পাকিস্তান নামে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠিত হয়। জন্ম হয় দুটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের। পাকিস্তান তখন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ) পশ্চিম পাকিস্তান নামে দুটি ভিন্ন ভূখন্ড নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালিত হতে থাকে। এই দুটি ভূখন্ডের মধ্যে যেমন ছিল পথগত দূরত্ব (প্রায় ১২০০ কিমি), তেমনি ছিল ভাষাগত অমিল। ছিল সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদ, ভিন্ন মতাদর্শ। পূর্ব পাকিস্তানিদের ভাষা ছিল বাংলা, পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভাষা ছিল উর্দু। মূলত ভাষাকে কেন্দ্র করে৪৭ পরবর্তী সময় থেকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলাদেশকে দুঃশাসন করতে থাকে। চাপিয়ে দিতে থাকে তাদের ভাষা। উর্দুকে রাষ্ট্রীয় ভাষাকরণের জন্য যত প্রকার কূটকৌশল নীল নকশার চিত্র আঁকতে থাকে। শেষ অবধি বাংলার দামাল ছেলেরা এই অন্যায়কে রুখতে সক্ষম হয়। ১৯৫২ সালের সেইসব ঘটনা আজ ইতিহাস, যা সবারই জানা।
 
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই বাঙালিকে সীমাবদ্ধ থাকতে হয়নি। প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানি দোসরদের সাথে। একের পর এক অন্যায়-অত্যাচার, অনিয়ম, রাজ্যত্ব কায়েমের স্পৃহা বাংলার প্রতিটি মানুষকে চরমভাবে বিষিয়ে তুলেছিল। প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়েছে নিজেদের অস্তিত্ব টিকাতে। এরই মধ্যে সংঘটিত হয়েছে ছয়দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুথানসহ বেশ কিছু জোড়ালো আন্দোলন। ১৯৭০ সালের নির্বাচন সংঘটনের মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান তাদের চূড়ান্ত পরিকল্পনাকে সমগ্র জাতির সামনে হাজির করে। নচেৎ তারা কখনোই বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে কুণ্ঠাবোধ করত না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সরকার গঠন করতে দিতে আপত্তি ছিল কোথায়? পাকিস্তান সরকার যখন দেখল, বাঙালিরা তাদের ন্যায্য অধিকারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে, ভোট বিপ্লবে তাদেরকে প্রতিহত করে ফেলেছে, তখনই যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে বাঙালি জাতিকে নিঃচিহ্ন করার কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ল।
 
পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ তখন কোনো অবস্থাতেই পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাথে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নিয়ে ছিল না। বাঙালি তখনও ছিল শান্তি প্রিয় জাতি, এখনও তাই। ছিল কর্মঠ, সংগ্রামী। নিজেদের কর্মগুণে পশ্চিম পাকিস্তানের আমলাদের পেট ভরিয়েছে, দিয়েছে বেশি রাজস্ব। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতের নির্মম হত্যাযজ্ঞ, বাঙালিদের ওপর অর্তকিত হামলা বাঙালিদের ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলল। না, এখন আমাদের যুদ্ধ করতে হবে। এটাই মোক্ষম সময় পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে ফেলার, স্বাধীনতা প্রাপ্তির এটিই যেন মহা সুযোগ। মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালিদের দুর্বিষহ মনে হলেও যুদ্ধরতদের চিন্তা-চেতনা ছিল, পশ্চিম পাকিস্তানি মিলিটারিদের ভারি অস্ত্রের সাথে আমাদের দৈহিক মানসিক মনোবল নিয়ে যুদ্ধ করার মাধ্যমে চূড়ান্ত স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা। এইতো মহা সুযোগ। এজন্য বাংলার দামাল ছেলেরা, শিক্ষক, ছাত্র, কৃষক, কামার-কুমার, শিল্পী-সাহিত্যিকসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ মা, মাটি, মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে অর্জিত হয় কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা বিনিময়ে জীবন দিতে হয় ত্রিশ লাখ মুক্তিকামী মানুষকে, ইজ্জ্বত হারায় প্রায় দুই লাখ মা-বোন। প্রতিবছর মহান স্বাধীনতা দিবসসহ ভিন্ন জাতীয় দিবসে আমরা তাদেরকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।
 
মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালির স্বাধীনতা প্রাপ্তির এক অন্যতম মাধ্যম। এই মুক্তিযুদ্ধকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য কাজ করেছেন তৎকালিন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। বাঙালি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বান প্রতিটি বাঙালিকে যুদ্ধে যাওয়ার প্রণোদনা যোগায়। তাঁর ৭ই মার্চের ১৮ মিনিটের দূরদর্শি ভাষণ, ২৬শে মার্চ পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেফতারের পূর্বে সবাইকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার যে আহ্বান তিনি করেছিলেন, তা মুক্তিকামি বাঙালি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। পূর্ব পাকিস্তান সেই৪৭ পরবর্তী থেকেই ছিল নিপীড়িত, নির্যাতিত এবং ছিল দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত। মূলত পশ্চিম পাকিস্তানিদের রাজস্ব দিতেই হিমসিম খেতে হত। সামরিক, অথনৈতিকভাবে পূর্ব পাকিস্তান শক্তিশালি  হলে পশ্চিম পাকিস্তানকে প্রতিহত করতে নয় মাস সময় লাগত না, জীবন দিতে হত না এতগুলো মানুষকে। তবুও আমরা এটা ভেবে আশান্বিত হই, পৃথিবীর বিভিন্ন যুদ্ধবিগ্রহ রাষ্ট্রের চেয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে ততটা বেগ পেতে হয়নি। বছরের পর বছর যুদ্ধ চললে বাঙালিরা খাদ্যের অভাবেই ধ্বংস হয়ে যেত। পাকিস্তানিদের গোলাবারুদ তখন যেন অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ত। এদিক থেকে আমরা সৌভাগ্যবান যে দৃঢ় মনোবল দুঃসাহসিকতা দিয়ে স্বাধীনতার মুকুট ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল বাঙালি জনগোষ্ঠি।
 
স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন আমাদের এখন সে সময় চলছে। দেশের স্বাধীনতা হরণের পথে কি না? স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের প্রাক্কালে আমাদের মনে পড়ে, স্বাধীনতা হরণ হতে চলেছে সত্যি। স্বাধীনতার নীতি-নৈতিকতা-আর্দশ তার পথ হারাতে বসেছে। নইলে এই বাংলায় আজও কেন অরাজকতা-অনিয়ম-নৈরাজ্য-খুন-সন্ত্রাসী চলছে? কেন আমলা-পুলিশ-প্রশাসন দুর্নীতির শীর্ষে? কেন রাজনৈতিক নেতাকর্মী-ব্যবসায়ীরা বিদেশে টাকা পাচার করছে? কেন দুই টাকার দ্রব্যমূল্য দশ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে? কেন ঘুষ দিয়ে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে হচ্ছে? কেন দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা? কেন গণতন্ত্র নিয়ে মানুষের মাঝে ধোঁয়াশা? এমন আরও কিছু প্রসঙ্গ আছে, যা একাত্তরে  অর্জিত স্বাধীনতাকে কলুষিত করে চলেছে প্রতিনিয়ত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিন্তু এইসব অনিয়মের বিষয়গুলো দূরীকরণের কথা কঠোরভাবে বিভিন্ন ভাষণে বলেছিলেন। তার কথা কি সবাই ভুলে গেছে? হ্যাঁ, তাই। বিপরীতে এক শ্রেণির মানুষ নামমাত্র বঙ্গবন্ধুর আর্দশকে বুকে ধারণ করে দেশকে নিয়ে যাচ্ছে রসাতলে। পদেপদে স্বাধীনতাকে করছে লাঞ্চিত। করছে ক্ষমতার চরম অপব্যবহার। কিন্তু এদের কোনো বিচার হয় না। স্বাধীনতা দিবস পালন করতে গিয়ে এরা বিজাতীয় সংস্কৃতিচর্চা করে, অশালিন গান, নৃত্য পরিচালনা করে থাকে। খোঁজ নিলে চোখে পড়ে স্বাধীনতাকে বুকে ধারণ করা শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, নেতা-নেত্রী এসবের আয়োজক। এই যদি হয় দেশে স্বাধীনতা চর্চার দৃশ্যপট, মুক্তিযুদ্ধকে বুকে লালন করার উদাহরণ, তবে কি স্বাধীনতার কাক্সিক্ষত মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে না?
 
মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্ধশত বছর পূর্ণ হওয়ার পথে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার ২০২০ ২০২১ সালকে মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। আমি মনে করি, এই মুজিববর্ষে সরকারের প্রধান কর্তৃব্য হবে মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা। কেননা, বর্তমান প্রজন্ম মহান মুক্তিযুদ্ধ দেখে নাই। মুক্তিযুদ্ধ সর্ম্পকে পত্র-পত্রিকা, বই-পুস্তক, টেলিভিশন পরিবারের প্রবীণদের মাধ্যমে জানতে পেরেছে মাত্র। এর মধ্যে কত যে বিকৃত ইতিহাসের জন্ম হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কত যে ভুল গল্প শুনেছে, তার ইয়াত্তা নেই। মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকার, রাজাকারকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর নাটকও দেখেছে প্রজন্ম। তরুণ প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানোর মাধ্যমে স্বাধীনতার স্বরূপ নির্ণয়ে-বিশ্লেষণে সহযোগিতা করতে হবে। এতে তারা স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষার বিষয়ে সচেতন হবে, অপরকে সচেতন করতে পারবে। সর্বোপরি, স্বাধীনতার চেতনাকে বুকে ধারণ করে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হতে পারবে। বর্তমানে স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষার ধারক বাহক এই তরুণ প্রজন্ম।
 
পরিশেষে যে কথাটি না লিখলেই নয়, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের কারণে মানবকূল আজ বড়ই ভয়-সংঙ্কায়-বিপদের মুখোমুখি। বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাব। প্রতিনিয়ত আসছে নতুন করোনা আক্রান্তের খবর, ভেসে আসছে মৃত্যুর আহাজারি। লকডাউন হয়ে পড়ছে বিভিন্ন করোনা সম্ভাব্য এলাকা। দেশের এখন অচলাবস্তা। খেটে খাওয়া মানুষের মাঝে আহাজারি শুরু হয়েছে।  বাংলাদেশের মানুষের মাঝে এখন বাঁচার আকুতি। ১৯৭১ সালের মতই যেন ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার আমরা। তখন যুদ্ধ করতে হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীদের সাথে, এখন যুদ্ধ করতে হচ্ছে প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসের সাথে। এমতাবস্থায় ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস জাকজমক, আনন্দঘনভাবে উদযাপনের কোনো প্রশ্নই আসে না। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জনসমাগম এড়িয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে এবারের মহান স্বাধীনতা দিবস পালন করা হবে। মহান স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের চেয়ে স্বাধীনতার মর্মবাণীকে বুকে ধারণ করাই বাঙালি হিসেবে আমাদের চরম সার্থকতা। স্বাধীনতার মর্যাদা অক্ষত, অম্লান থাকুক সে প্রত্যাশা সবসময়।
 
 
লেখক : শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ ইউভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি (বিইউবিটি), ঢাকা।
-মেইল: md.angkon12@gmail.com

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.