লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত জেদ্দা কিং আবদুল আজিজ আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, সৌদি আরব। ২০০৪ সালের ২৪ জানুয়ারি দিবাগত রাত পৌনে ৩টা। ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া বাংলাদেশ বিমানের ০৩৭ উড়োজাহাজটি অবতরণ করল এইমাত্র। কিছুক্ষণ পূর্বে বিমানবালার ঘোষণায় ঝিমুনি থেকে উঠলাম। প্রথম বিমানে চড়ছি বিধায় একটুখানি ঘুম এসে ভর করেছিল। বিমান থেকে ঘোষণা হচ্ছে, “সম্মাণিত ভদ্র মহিলা ও মহোদয়গণ, আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করছি। আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণিতে আমরা কিং আবদুল আজিজ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট জেদ্দায় অবতরণ করব। বিমান পুরোপুরি না থামা পর্যন্ত কেউ সিট বেল্ট না খোলার অনুরোধ রইল।” বিমান থামার পর সারিবদ্ধভাবে অন্যান্য যাত্রিদের সাথে নামলাম। সেখান থেকে গাড়িতে করে এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন লাউঞ্জে আসলাম। প্রয়োজনীয় অফিসিয়াল কার্যাদি সারতে সারতে আরো কিছু সময় ব্যয় হল। ফজরের সময় হয়ে গেছে। আযান ধ্বনিত হচ্ছে চারদিকে। এয়ারপোর্ট লাউঞ্জেই ফজরের সালাত আদায় করলাম।
ঢাকা থেকে বিমান ছাড়ে রাত ১০.৪৫ মিনিটে। সিডিউল টাইম ছিল। ৯টা ৪৫ মিনিট। ১ ঘন্টা লেট। পরে কারণ জানলাম মাননীয় অর্থমন্ত্রী জনাব সাইফুর রহমান (মরহুম) মহোদয়ের জন্য অপেক্ষা! আমার আসন ছিল ফার্স্ট ক্লাসে। কিছুক্ষণ পর লক্ষ্য করলাম মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে। সাথে অর্থমন্ত্রণালয়ের আরো কয়েকজন কর্তকর্তা ছিলেন। উনাকে সহযাত্রি হিসেবে পেয়ে দারুণ খুশি হলাম! কিন্তু বিমান থেকে নামার পর তার আর কোন হদিস পাইনি। উনি কী হজ্জ করতে গিয়েছিলেন নাকি অন্য কোন রাষ্ট্রীয় কাজে গিয়েছিলেন জানতে পারিনি।
আমি ঢাকাতে মেজ ভাই আলহাজ্জ দিদারুল ইসলাম এবং সেজ ভাই আলহাজ্জ মামুনুর রশীদের বাসা থেকে ইহরামের কাপড় পরিধান করি। সবার থেকে বিদায় নিয়ে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঢাকার পানে এগিয়ে যাই। সাথে ছিলেন সেজ ভাই মামুনুর রশীদ এবং চাচাতো ভাই কাউসার। মেজ ভাই দিদার সাহেব হজ্জের নিয়ম-কানুন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন বাসা থেকে রওয়ানা হবার সময়। আমাদের ট্রাভেলস্ এবং রিক্রুটিং ব্যবসা আছে বেশ কয়েক বৎসর থেকে। তখনো আনুষ্ঠানিকভাবে হজ্জ কাফেলার কার্যক্রম শুরু করিনি। ১৯৯৫ সালে মেজ ভাই দিদার সাহেব আমার মাকে নিয়ে হজ্জ করেন। পরবর্তীতে সেজ ভাই ১৯৯৬/৯৭ সালে প্রথম সৌদি আরব গমন করেন আমার মেজ মামা আবদুল কাদের সাহেবের সাথে। ঢাকা এয়ারপোর্টে যাওয়ার পথে চট্টগ্রামে মাকে ফোন করলাম। আম্মার সাথে কথা বলার সময় কোত্থেকে কান্না এসে গেল। শিশুর ন্যায় কান্না পেয়ে গেল। কথা বলতে পারছি না। কান্না জড়িত কন্ঠে আম্মাকে দোয়া করতে বললাম। এয়ারপোর্টে পৌঁছার পর সেজ ভাইদের থেকে বিদায় নিলাম। আমি ছিলাম ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রি, সিট কনফার্ম করা ছিল। কিন্তু দেখলাম আমিসহ অনেককে বোর্ডিং পাস দিচ্ছে না কোন অজ্ঞাত কারণে। বেশ কিছুক্ষণ পর অচলাবস্থা কেটে গেল। বোর্ডিং পাস নিয়ে ইমিগ্রেশন পেরিয়ে বিমানে উঠার অপেক্ষা করতে থাকি।
দীর্ঘক্ষণ আকাশের উড়ার পর বিমান অবতরণ করে। বিমান থেকে নামার পর এয়ারপোর্টের গাড়িতে উঠি। পাশে দেখতে পেলাম নেজামে ইসলাম পার্টির মুফতি ইজহারুল ইসলাম এবং খেলাফত মজলিশের নায়েবে আমীর আহমদ আবদুল কাদের সাহেবকে। মুফতি ইজহারের বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে। কথায় কথায় আমার বাড়ি চট্টগ্রাম জানার পর আরো অনেক কথা-বার্তা হল। উনি বেশ খুশি হলেন কম বয়সে হজ্জে গমনের জন্য। জনাব আহমদ আবদুল কাদের আমাকে উনার ভিজিটিং কার্ড দিলেন। গাড়ি থেকে নামার পর আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর আমাদের ডাক পড়ে ইমিগ্রেশনের জন্য। ইমিগ্রেশন পেরিয়ে হজ্জ টার্মিনালে আসলাম। সেখানে বিভিন্ন দেশের হজ্জ মিশনের কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশ হজ্জ মিশনের পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত হজ্জকর্মীগণ হাজিদের দিক-নির্দেশনা প্রদান করছেন। বাংলাদেশ প্লাজার সামনে বাংলাদেশ থেকে আগত হাজিরা জড়ো হয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন মক্কা যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
তখন শীতকাল। মরুর দিগন্তের দেশ সৌদি আরবেও শীত ঝেঁকে বসেছে। সকালবেলা হওয়ায় তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে। হজ্জ টার্মিনালে কেউবা বসে, কেউ পায়চারি করছে। কেউ কেউ একটুখানি উষ্ণতার সন্ধানে চায়ের দোকান খুঁজে বেড়াচ্ছে। এয়ারপোর্ট এরিয়ায় হওয়ায় খুব একটা রেষ্টুরেন্ট নেই। হজ্জকর্মীরাও মৌসুমি হওয়ায় বেখবর! হাজিদের কাঙ্খিত সেবা কিংবা সুখবর দিতে পারছেন না! সময় গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায়। হৃদয়তীর্থ, প্রাণের মক্কা নগরিতে কখন পৌঁছব সেই চিন্তায় বিভোর সবাই। হাজিরা মোয়াল্লেমের অধিনে থাকায় স্বাধীনভাবে গাড়ি ভাড়া করে যেতে পারেন না! একজন বাংলাদেশী হজ্জকর্মী বলল, ‘ভাই এসব মোয়াল্লেম-টোয়াল্লেমের কথা বাদ দেন। দেখুন, কখন গাড়ি আসে?’ আমরা তার কথায় হতাশ হলাম। একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাম। কী হবে উপায়? তবুও আশায় বুক বেঁধে রইলাম। কখন আমাদের মোয়াল্লেমের গাড়ি আসে। আমাদের মোয়াল্লেম অফিসের নম্বর ছিল ৫৮। কিছুক্ষণ পর ৫৮ নম্বর মোয়াল্লেম বলে বলে একজন লোক মাইক দিয়ে লাইনে দাঁড়ানোর জন্য বলতে থাকেন। ৫৮ নম্বর মোয়াল্লেমের হাজিরা মালামাল নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যান। হজ্জ কর্মীগণ প্রথমে আমাদের কাছ থেকে ব্যাগ বুঝিয়ে নিয়ে নির্দিষ্ট গাড়িতে তোলেন। এরপর পিলগ্রিম পাস বুঝিয়ে নেন। কেউ কেউ আপত্তি করেন, পিলগ্রিম পাস দিতে অস্বীকৃতি জানান। তারা বলেন ডকুমেন্টস্ না থাকলে আমাদের সমস্যা হবে। বিদেশ বিভুই, কখন না জানি বিপদে পড়ি! পুরাতন হাজি এবং হজ্জকর্মীরা বুঝিয়ে বললে রাজি হন। তখন হজ্জের জন্য পাসপোর্ট সিস্টেম চালু ছিল না। টিকেট এবং বাকি কাগজ-পত্র আমরা রেখে দিই। আমরা গাড়িতে উঠে বসে পড়লাম। শিহরিত তনু মন, আর কিছুক্ষণের মধ্যে প্রভুর সান্নিধ্যে ‘খানায়ে কাবায়’ পৌঁছে যাব।
এমন হৃদয় তোলপাড় করা ঘটনাকে জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনা বা স্মরনীয় দিন না বলে উপায় আছে? আল্লাহর দরবারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্মৃতিধন্য আরবের বুকে আমি এখন স্বশরীরে! ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’। প্রভু আমি হাজির, প্রভু আমি হাজির! আল্লাহু আকবর!
যে কোনো মুসলমানের জীবনের লালিত স্বপ্ন-সাধনা প্রভুর সান্নিধ্যে যাওয়া। বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করা। হৃদয়ের সমস্ত আবেগ উজাড় করে দিয়ে বলি আল্ হামদুলিল্লাহ! ভীরু ভীরু শিহরিত মন! রোমাঞ্চিত পুরো হৃদয়খানি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য পাগল পারা! সে আবেগ-অনুভুতির বর্ণনা সঠিকভাবে লেখা আমার সাধ্যের বাইরে! আল্লাহ তুমি সেই তৌফিক আমাকে দাও।
গাড়িতে যত হাজি ছিলো তন্মধ্যে তুলনামূলকভাবে আমার বয়সই কম। সবাই বয়স্ক হজ্জ যাত্রি। কেমন যেন আমার দিকে উৎসুক নেত্রে থাকায়! ইয়াং থাকতে হজ্জ করা ভালো, কারণ হজ্জ করতে অনেক শক্তি-সামর্থ্য প্রয়োজন। পরবর্তীতে হজ্জের সময়কালে এবং মক্কায় অবস্থানকালে দেখেছি হজ্জ করতে আসা বয়স্ক লোকের সংখ্যাই বেশি। আমাদের উপমহাদেশের হাজিরাই তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য। মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার হাজিরা অনেক ইয়াং। আর আফ্রিকানরা দৈহিকভাবে অনেক শক্তির অধিকারি। ফলে হাটা চলায় বেশ সুবিধা তারা পায়। আমার মতে, বয়স ফিফটির মধ্যে পুরুষ এবং চল্লিশের মধ্যে নারীদের যদি সামর্থ্য থাকে তাহলে হজ্জ সম্পন্ন করা দরকার! কারণ দেখেছি হজ্জ পালনে যথেষ্ট কষ্ট সহ্য করতে হয় এবং দেহে শক্তি থাকলে ইবাদত করাও সহজ হয়।
আমিরুল মোমেনীন হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা) বলেছেন, “আল্লাহর ঘর পর্যন্ত পৌঁছার মত যার পথের সম্বল ও বাহন আছে, অথচ সে হজ্জ করে নি, তবে এ অবস্থায় সে ইয়াহুদি অথবা নাসারার মৃত্যুবরণ করুক তাতে কিছু যায় আসে না। আর এটা এ কারণেই যে, আল্লাহ্তায়ালা বলেন, ‘‘সেই ব্যক্তির উপর বায়তুল্লাহর হজ্জ ফরয, যে ব্যক্তি সে পর্যন্ত পৌঁছার সক্ষমতা লাভ করেছে।” (তিরমিযী) আবার অনেক সময় দেখা যায় বিভিন্ন অজু হাতে মানুষ হজ্জ পালনে বিলম্ব করে, এবছর নয় আগামি বছর এভাবে সময় ক্ষেপন করতে দেয়া যায় অথবা যুবক বয়সে হজ্জ করে কী হবে, আরেকটু বয়স হোকÑএ জাতীয় কথা-বার্তা বলে হজ্জের ফরযকে উপেক্ষা করে। এদের জন্য শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল-উসাইমীন (রহ.) নসিহত হচ্ছে: “হজ্জ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি রুকন এবং বিরাট ভিত্তি। হজ্জের শর্ত পাওয়া গেলে হজ্জ আদায় না করলে মানুষের ইসলাম পরিপূর্ণ হয় না। হজ্জ ফরয হওয়ার পর বিলম্ব করা বৈধ নয়। কেননা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা) নির্দেশ তাৎক্ষণিকভাবে আদায় করতে হবে।” (ফতোয়ায়ে আরকানুল ইসলাম)
মক্কা অভিমুখে আমাদের গাড়ি চলছে। এয়ারপোর্ট এরিয়া থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে। ড্রাইভার ছিল সিরিয়ান। গাড়ির স্পীড খুব বেশি নয়। অনেক বড় বড় রোডগুলো। রোড না বলে হাইওয়ে বলাই বাঞ্ছনীয়। কোথাও চার লেন, কোথাও ছয় লেন বা আট লেন। হাইওয়ের দু’পাশে সারি সারি খেজুর গাছ। যেদিকে তাকাই কেবল পাহাড় আর পাহাড়। বরযাত্রীদের নিয়ে যে স্টাইলে গাড়ি চলে সেভাবে। মক্কায় পৌঁছতে কতক্ষণ লাগে কে জানে? দীর্ঘ ভ্রমণের কারণে সবার মুখে ক্লান্তির ছাপ! একজন মুরব্বী গোছের লোক ড্রাইভারের কাছে মাইক্রোফোন চাইল। ড্রাইভার মাইক্রোফোন হাতে দিতেই মুরব্বীটি একটু নেড়ে চেড়ে দেখলেন। হাতের আঙ্গুলে মাইক্রোফোনের মাথায় টোকা দিলে আওয়াজ আসে। আলতো করে ‘ফু’ দেন! তিনি সবাইকে ভয়, শ্রদ্ধা ও আদবের সাথে ‘তালবিয়া’ পড়ার আহ্বান জানালেন। “লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শরীকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্নি’আমাতা, লাকা ওয়ালমূলক লা শরীকা লাক।” অর্থাৎ ঃ “আমি আপনার সকাশে হাজির, হে আল্লাহ! আমি আপনার দরবারে হাজির। আমি আপনার আহব্বানে সাড়া দিয়েছি। আপনার কোন অংশীদার নেই। নিঃসন্দেহে সকল প্রশংসা ও সম্পদরাজি আপনার এবং এবং সমগ্র বিশ্বের একচ্ছত্র সা¤্রাজ্য আপনার, আপনার কোন অংশীদার নেই।” (বুখারী ও মুসলিম)
উম্মতের সকল আলেমগণ একমত যে, তালবিয়া হজ্জের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। হযরত উম্মে সালমা থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূল সা. বলেছেন, হে মুহাম্মদ সা.এর বংশধরগণ! তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি হজ্জ করবে, সে যেন তালবিয়া পড়ে।” (আহমদ ও ইবনে হিব্বান) আল্লামা যমখশরীর (র) মতে, ‘লাব্বাইক’ শব্দের অর্থ হলো, বান্দা সর্বক্ষণ তোমার আনুগত্যে বহাল আছে। হযরত জাবের রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন, “কোন ইহরামকারি যদি পুরো দিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত তালবিয়া পড়ে কাটিয়ে দেয়, তবে তার গুনাহগুলো উধাও হয়ে যায়। ফলে সে সদ্যপ্রসূত শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে যায়।” (আহমদ ও ইবনে মাযা)
সবাইকে সালাম জানিয়ে হজ্জের গুরুত্ব ও তাৎপর্য আলোচনা করলেন। কিছুক্ষণ পর পর তালবিয়া পাঠের জন্য হাজিদের আহ্বান করেন। এভাবে চলছি আমরা। মুরুব্বী সামনের সিটে। ড্রাইভার উরার দিকে তাকায়। বেশ উপভোগ করছেন আলোচনা। কিন্তু তিনি তো বাংলা বুঝেন না। আরবী উচ্চারণ করলে বুঝতে পারেন। তবুও মুরব্বীর কথা বলার স্টাইলে উনিও উজ্জীবিত মনে হচ্ছে। আলোচনা শুনে বাংলাদেশের হাজি শুনেও প্রীত হলেন। খিদেয় অবস্থা কাহিল। মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না, তবুও কেউ আস্তে, কেউ মনে মনে পাঠ করতে থাকে। এক জায়গায় গাড়ি থামল। দুরত্ব এখনো ১৫/১৬ কি: মি’র মতো বাকি আছে। বাইরে তাকিয়ে দেখি ‘পিলগ্রিম রিসেপশন সেন্টার।’ কী জানি কী দিয়ে রিসেপশন করেন! একজন কালো লোক এবং দু’তিনজন নিয়ে গাড়িতে ঢুকেন।
অতঃপর লোকটি হাজি সংখ্যা গুণতে লাগলেন। গুণে বেরিয়ে যান। আবার ঢুকেন তারা বিরাট বাক্স নিয়ে। সবাইকে একটি করে প্যাকেট দেন। প্যাকেট খুলে দেখতে পেলাম বিস্কুটের ছোট প্যাকেট, ৪টি করে খেজুর এবং ছোট পানির বোতল। আরবি এবং ইংরেজীতে লেখা আছে ‘জমজম’। বুঝলাম জমজমের পানি। যাক, উত্তপ্ত মরুর বুকে শীতল পরশ পেলাম। আল্ হামদুলিল্লাহ! আমরা প্যাকেট খুলে খিদে নিবারণ করতে থাকি। বেলা তিনটা। মক্কার স্থানিয় সময় অনুসারে। আমরা হারামের হুদুদের মধ্যে। খানায়ে কা’বার কয়েকটা মিনার দেখা যাচ্ছে। মন ভীরু ভীরু, না জানি মহান রবের দরবারে হাজির হয়ে হজ্জের সকল আহকাম সঠিকভাবে পালন করতে পারি কি না? আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করতে লাগলাম। গাড়ি ৫৮ নং মোয়াল্লেম অফিসের সামনে এসে পার্ক করে। মোয়াল্লেম অফিসের লোকজন এসে সকল হাজিদের একটি করে অফিসের কার্ড এবং একটি করে ইলাস্টিক ব্যান্ড দিলেন। ব্যান্ডটি হাতে চুড়ির ন্যায় পরিয়ে নিতে বললেন।
এগুলো থাকলে হাজি হিসেবে সহজেই চেনা যায় এবং অনেক সময় দেখা গেছে হাজি হিসেবে সবাই সম্মান করেন। সম্বোধন করেন, ‘হাজ্জ মাবরুর’ বলে।
মরুর উত্তপ্ত হাওয়া, খিদে পেটে আগুন। মোয়াল্লেম অফিস থেকে গাড়ি এখনও ছাড়ছে না। লোকজন গাড়ি থেকে কাউকে না নামার নির্দেশ দিয়েছেন। পাশে একটা মুদির দোকান দেখা যাচ্ছে। ‘বাকালাহ্’ বলে এখানকার লোকেরা। কে শোনে কার কথা? ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী পাথরময়। কেউ কেউ নেমে পড়েছে গাড়ি থেকে। পছন্দ মতো জিনিস নিয়ে খিদে মিটাবার চেষ্টা করছেন। আমিও নেমে পড়লাম। দোকানে ঢুকে চারদিক থাকালাম। দোকানি একা চেয়ারে। কাস্টমারদের থেকে টাকা বুঝিয়ে নিচ্ছেন। কোন সহকারি দেখা যাচ্ছে না। মনে করেছি অর্ডার দিলে দোকানি এনে দেবেন। কিন্তু না, নিজেকেই বাকালাহ থেকে সংগ্রহ করে পেমেন্ট করতে হবে। আমি একটা রুটি এবং পেপসি ক্যান নিলাম। মাত্র ২ রিয়াল। দোকানিকে ১০০ রিয়াল দিলাম। আমার কাছে আর ছোট নোট ছিল না। উনি ৯৮ রিয়াল ফেরত দিলেন। কোন কথা বললেন না। যদি বাংলাদেশ হতো তাহলে দু’টাকার জিনিস কিনলে সহজে ভাংতি দিতো না। আপনাকে কোনভাবে ম্যানেজ করতে হতো। গাড়িতে উঠে বসতেই আবার গন্তব্য পানে ছুটলো।
গাড়িতে বিভিন্ন মোয়াল্লেমের হাজি থাকলে ড্রাইভার যে মোয়াল্লেমের হাজি বেশি সেখানে প্রথমে হাজি নামিয়ে দেন। আমি ইনডিভিজুয়েল হজ্জ করছি বিধায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় থাকবো। তাই অন্য মোয়াল্লেমের হাজিদের এক বিল্ডিংয়ের সামনে এসে গাড়ি দাঁড়ায়। প্রথমে হাজিরা নামে। রিসেপশনে হাজিরা বসেন। মালামাল নামিয়ে দেবার লোকও রেডি। এলাকার নাম আজিয়াদ। জিয়াদ নামে পরিচিত। সেই এলাকায় বাদশার রয়েল প্যালেস থাকায় লোকেরা ‘জিয়াদ সৌদ’ নামে বলে থাকেন। দেখলাম হারামের কাছাকাছি। সেজ ভাই মামুনের পরামর্শ মতো গাড়ি থেকে নেমে বাংলাদেশি লোক খুুঁজতে থাকি। দেখতে বাংলাদেশির মতো একজনকে পেয়ে গেলাম। হ্যাঁ, ঠিকই। উনাকে একটা কলের রিকোয়েস্ট করলাম। উনি সরাসরি ‘না’ করে দিলেন। কয়েকদিন পর আমি সবার কাছে একজন এজেন্সির মালিক হিসেবে পরিচিত হয়ে গেলাম। আগে থেকেই অনেকের কাছে পরিচিত ছিলাম। একদিন কোথাও আবার দু’জনের দেখা। আমাকে দেখে এবং পরিচয় পেয়ে ভীষণ লজ্জিত হলেন এবং দুঃখ প্রকাশ করলেন। আবদুন নুর মাস্টার বা ফখরুল আমিন কালু ভাইকে ফোন করতে হবে। আবদুন নুর ভাই, মাস্টার নুর হিসেবে মদিনা প্রবাসিদের কাছে পরিচিত। বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালী। উনি আমাদের ব্যবসায়িক একান্ত শুভাকাঙ্খি। উনার আব্বার আবদুল জব্বার সাহেবও এবার হজ্জে গেছেন। তাই তিনি এখন মক্কায়। আরেকজন শুভাকাঙ্খী লোহাগাড়ার কালু ভাই। তাদের দু’জনের মোবাইল নম্বর আমার কাছে আছে। আরেকজনকে পেয়ে গেলাম। নাম সেলিম এবং বাড়ি সাতক্ষীরা। প্রথমে উনি রাজি হননি। পরে জরুরি প্রয়োজনের কথা বলে উনার থেকে ফোন নিয়ে কালু ভাইকে ফোন দিলাম। কালু ভাই লোকেশন জেনে বললেন, দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।
তখন আসরের সময়। হারাম শরীফের কাছাকাছি ছিলাম বিধায় চারদিক হাজিতে পরিপূর্ণ। হাজিরা আগেই থেকেই কাতার বন্দি হয়ে গেছে। আযানের অপেক্ষায় সবাই। মিসফালাহ্র দিক থেকেই আসছেন মাস্টার নুর এবং কালু ভাই। দু’জনেরই হাসি মুখ। আমাকে দেখে আনন্দ-উৎফুল্ল হয়তো! এসেই কোলাকুলি করলেন। শরীরের খোঁজ-খবর নিলেন। মাস্টার ভাই ব্যাগটা নিলেন আমার কাছ থেকে। আমি ফোন করলাম মদিনায় অবস্থানরত মামা মোস্তফা সাহেবকে। উনি চিন্তিত ছিলেন আমি ঠিকমত এসে পৌঁছেছি কি না? কুশল বিনিময়ের পর বারবার তাগিদ দিলেন একটু রেস্ট নিয়ে উমরাহ সেরে ফেলার জন্যে। আমার বাসায় গেলাম। সবার পরামর্শক্রমে সিদ্ধান্ত হলো রাতে উমরাহ করবো। সফরে যথেষ্ট দখল গেছে। এই প্রথম দেশের বাইরে এসেছি। সবমিলে শরীর কাহিল। খাওয়া-দাওয়া করলাম। কালু ভাইয়ের বিছানায় শুয়ে পড়েছি। কখন যে রাজ্যের ঘুম এসে হাজির হয়েছে বুঝতেই পারিনি। রাত এগারটাদিকে ঘুম ভাঙল। অযু-কালাম শেষে পবিত্র উমরাহ সম্পন্ন করার জন্য মাস্টার আবদুন নুর এবং রুহুল আমিন ভাই বেরিয়ে পড়লাম। সেই যে মরু দিগন্তের দেশ সৌদি আরব সফর জীবনের প্রথম উমরাহ করা আমার জীবনের পাতায় সোনার হরফে লেখা থাকবে।
(লেখক ও গবেষক)
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
#গল্প
#মোলাকাত
#সাহিত্য_ম্যাগাজিন
#Molakat
#ওয়েব_ম্যাগাজিন
#সাহিত্য
#মিনহাজুল_ইসলাম_মাসুম
No comments