স্মৃতিতে বর্ষায় রাঙামাটি ভ্রমণ ।। শাহীন চৌধুরী ডলি

 
ঢাকায় জন্ম এবং বেড়ে ওঠা হলেও বিয়ের পর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে শ্বশুরবাড়িতে থাকা শুরু করি। অল্প বয়সে বিয়ে তাই আব্বু-আম্মা, ভাই-বোনদের ছেড়ে থাকতে প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগতো। আমার বর বাবু প্রায়ই আমাকে ঢাকায় আমাদের বাসায় নিয়ে যেতো। শুধু কি ঢাকায়, একটু সুযোগ পেলেই আমাকে নিয়ে দেশ -বিদেশে ঘুরতে যায়। বিয়ের পৌনে দুইবছরের মধ্যে এক রাজকন্যার মা হলাম। পিচ্চিকে নিয়েই বেড়াতে বের হই। তখনো বাচ্চা লালন-পালনের তেমন কিছুই আয়ত্ব হয়নি বলে ভালোভাবে সামলাতে পারি না।
 
আমার রাজকন্যা তখন বেশ ছোট। সপ্তাহখানেক থাকার ইচ্ছে নিয়ে ঢাকায় আমাদের বাসায় গেছি। বাবু বললো, চলো দূরে কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসি।
 
অনেকদিন চট্টগ্রামে বেড়াতে যাওয়া হয় না। আমি বললাম চট্টগ্রামে বেড়াতে যেতে চাই। বাবু ইলেকট্রনিকস ব্যবসায়ী। সেকারণে অনেক ইলেকট্রনিকস ব্যবসায়ীদের সাথে অত্যন্ত সুসম্পর্ক। তখন মাইক্রো স্টেবিলাইজার, মাইক্রো চার্জ লাইট সহ মাইক্রো ইলেকট্রনিকস পণ্যের ব্যবসা বেশ জমজমাট। চট্টগ্রামে মাইক্রোতে জব করা রফিক ভাই, ঈসমাইল ভাইকে কল দিতেই তারা হই হই করে উঠলেন।
 
বাবু ভাই সপরিবারে চলে আসেন। আপনাদের নিয়ে অনেক জায়গায় বেড়াবো।
 
আমরা চট্টগ্রাম বেড়াতে যাবো কিন্তু আমার মেয়ে কিছুতেই যেতে রাজি না। সে তার নানুআপু এবং তামনি, তিতিমনিদের সাথে নানুবাড়িতে থাকবে। ছোটমনির সাথে খেলবে। মেয়েকে পরম নিশ্চিন্তে আম্মার কাছে রেখে আমরা রওয়ানা হলাম।
 
কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে দীর্ঘ কয়েকঘন্টা পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রাম স্টেশনে নামতেই দেখি রফিক ভাই আমাদের রিসিভ করতে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি আমাদের হোটেলে উঠতে দিলেন না। আমরা তাদের আগ্রাবাদের বাসায় উঠলাম যেখানে মাইক্রোতে চাকুরিরত অনেকেই একসাথে থাকেন। আমাদের স্বামী-স্ত্রীর জন্য উনারা একটা রুম ছেড়ে দিলেন। আগষ্ট মাসের কাঠফাটা রোদ, কখনো মেঘলা আকাশ, কখনো বৃষ্টি ঝরছে। এর মধ্যেই চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাই। বায়েজিদ বোস্তামি মাজার দিয়ে বেড়ানো শুরু। একে একে পতেঙ্গা, ফয়েজ লেক, চিড়িয়াখানা,  চট্টগ্রাম ওয়ার্ল্ড ওয়ার সিমেট্রি, পার্কি বীচ, জিয়া মেমোরিয়াল মিউজিয়াম, নেভাল সী বীচ সহ আরো কয়েকটা দর্শনীয় স্থান বেড়ানো শেষ। রাতে সবাই মিলে বাংলা সিনেমা দেখতে হলে যাই। সেখানেই নায়ক রিয়াজের সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত 'প্রাণের চেয়ে প্রিয় ' ছবিটি দেখেছিলাম।
 
আমরা ঢাকায় ফিরে আসবো। ঈসমাইল ভাই বললেন, বাবু ভাই এক কাজ করেন। ভাবীকে নিয়ে রাঙামাটি চলে যান। এখন শ্রাবণ মাস। প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে, বর্ষায় কাপ্তাই লেক দেখলে অভিভূত হবেন। এই সিজনে শুভলং ঝর্ণায় অবিরাম জলের ধারা বয়ে যায়। শীতের সময় এমন দৃশ্য দেখতে পাবেন না। রাতেই আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঠিক করলাম সবাই মিলে একটা গাড়ি নিয়ে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ জেলা রাঙামাটি বেড়াতে যাবো। আমাদের নামিয়ে দিয়ে রফিক ভাই এবং শাহআলম গাড়ি নিয়ে চট্টগ্রাম ফিরে আসবে। অফিসের কাজ থাকায় ঈসমাইল ভাই সঙ্গী হতে পারলেন না। তিনি টেলিফোনে যোগাযোগ করে পর্যটন মোটেল বুকিং করে দিলেন।
 
ইতিপূর্বে আমার রাঙামাটি যাওয়া হয়নি। এই প্রথম যাচ্ছি বলেই কিনা আমি খুব রোমাঞ্চিত বোধ করছি। ছবিতে দেখা রাঙামাটির ঝুলন্ত ব্রিজ, কাপ্তাই লেক যেন চোখের সামনে ভাসছে। সবুজে ঘেরা সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে প্রচণ্ড ভাঙ্গা রাস্তাঘাট পেরিয়ে( কারণ অনেক বছর আগে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব ভালো ছিলো না) সূর্য যখন ঠিক মাথার উপরে, আমরা রাঙামাটির তবলছড়িতে পর্যটন মোটেলে এসে গাড়ি থেকে নামলাম। মোটেলের রিসেপশনে যোগাযোগ করে চেকইন সেরে নিলাম। কর্তৃপক্ষ আমাদের সাথে একজন সাহায্যকারী দিলেন সেই সাথে রুমের চাবি। সাহায্যকারী বয় মোটেলের চারতলায় আমাদের জন্য নির্ধারিত রুমে লাগেজ পৌঁছে দিয়ে বিদায় নিলেন। আমরা সবাই একে একে ফ্রেশ হয়ে মোটেলের ডাইনিং গেলাম। উদ্দেশ্য লাঞ্চ সেরে নেয়া। আগে থেকে লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে না রাখায় লাঞ্চ পাওয়া গেলো না। আমরা গাড়ি নিয়ে শহরের বাজারে চলে গেলাম। তখনো খুব ভালো রেস্টুরেন্ট সেখানে ছিলো না। স্থানীয় একটা খাবার হোটেলে সাধারণ মেনুতে উদরপূর্তি করলাম। তারপর বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দুইদিন পরের সরাসরি রাঙামাটি টু ঢাকা বাসের টিকেট কাটা হলো। রফিক ভাই এবং শাহআলম আমাদের মোটেলে পৌঁছে দিয়েই গাড়ি নিয়ে চট্টগ্রামের পথে রওয়ানা হলেন।
 
চারিদিকে অবিন্যস্ত ছোট ছোট টিলা আর পাহাড়ের সমারোহ সবুজে সবুজময়। আকাশের মেঘ ছুঁয়ে যায় পাহাড়ের বুক। শহরের শেষপ্রান্তে কর্ণফুলী হ্রদের কোলঘেঁষে পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্স। ১৯৮৬ সালে গড়ে তোলা পর্যটন মোটেলের ব্যবস্থাপকের কাছ থেকে বেড়ানোর গাইডলাইন নিলাম। মোটেলের বারান্দা থেকেই ঝুলন্ত সেতু, কাপ্তাই হ্রদের বিস্তীর্ণ জলরাশি আর দূরের নীলাকাশ দেখা যায়। ছোট বড় সারিবদ্ধ পাহাড় যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বিমুগ্ধ নেত্রে সেদিকে তাকিয়ে থাকলে বেলা কোনদিক দিয়ে বয়ে যায় বুঝতেই পারিনা। পর্যটন মোটেলে থাকার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো যখন তখন ঝুলন্ত সেতু দেখতে চলে যাওয়া যায়। যারা রাঙামাটি শহরে হোটেল ভাড়া করে থাকেন তাদের অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে ঝুলন্ত সেতু দেখতে আসতে হয়। মজার তথ্য হলো রিকশা আধিক্যের দেশ বাংলাদেশের ৬১১৬,১৩ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট রাঙামাটি শহরটি দেশের একমাত্র রিকশাবিহীন শহর।
 
আমরা রুমে শুয়ে বসে সময় নষ্ট করতে চাইলাম না। রুম লক করে চলে গেলাম মোটেল থেকে অনতিদূরত্বের ঝুলন্ত সেতুতে। কাপ্তাই হ্রদের উপর ৩৩৫ ফুটের ঝুলন্ত সেতুটি পর্যটন কমপ্লেক্সের গুরুত্ব এবং আকর্ষণে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। দুটি পাহাড়ের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়েছে এই ঝুলন্ত সেতু। পর্যটন কর্পোরেশনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে আমরা সেতুতে আরোহন করলাম। সেতুতে পা রাখতেই এদিকে ওদিকে দুলতে থাকে আর আমি ভয়ে শিহরণে বাবুকে আঁকড়ে ধরি, আবার এগোই। এর মধ্যে বাবুর হাতের ইয়াসাকি ক্যামেরা ক্লিক ক্লিক আমার ছবি তুলতে থাকে।  সেতুর দুলুনিতে আমি পোজ দেয়ার চেয়ে নিজের শারীরিক ভারসাম্য রাখতেই অধিক ব্যস্ত থাকি সেতুর বিপরীত দিক থেকে কেউ আগাতে থাকলে দুলুনি আরো বেড়ে যায়। তখনো মোবাইলের যুগ আসেনি। সেলফি কি জিনিস তার ধারণাই নেই। অনুরোধে আগত অন্যান্য পর্যটকদের কেউ কেউ আমাদের যুগল ছবি তুলে দেয় এবং আমরাও তাদের ছবি তুলে দেই।
 
সেতু পেরিয়ে পাহাড়ে নেমেই আমরা লাল মাটির আঁকাবাঁকা  সরু পথ বেয়ে গ্রামের ভেতরে হাঁটছি। মাঝে মাঝে উপজাতীয় লোকজনের দেখা পাই। ধারণা করা হয়, এই শহরের মাটির রঙ লাল বা রাঙা ছিল বলে এই জনপদের নাম হয় রাঙামাটি। লোকমুখে প্রচলিত আছে, বর্তমান রাঙামাটি জেলা শহরের পূর্বদিকে একটি ছড়া ছিল যা কাপ্তাই লেকের পানিতে ডুবে আছে। কাপ্তাই লেকের স্বচ্ছ পানি যখন লাল বা রাঙা মাটির উপর দিয়ে ঢাল বেয়ে নামতো, তখন তাকে লাল দেখাতো। তাই এই ছড়ার নাম হয়েছিল রাঙামাটি। পাহাড়, নদী লেকবেষ্টিত রাঙামাটি জেলা বৈচিত্র্যময় জনপদ যেখানে চাকমা,মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা,মুরং, বোম, খুমি,খেয়াং,চাক, পাংখোয়া, লুসাই, সুজে,সাঁওতাল, রাখাইন, বাঙালিসহ ১৪ টি জনগোষ্ঠীর বসবাস। এখানে কিছু অসমীয়া গুর্খা সম্প্রদায়ের লোকজনের বসবাস আছে। বাঙালি এবং আদিবাসীদের সম্প্রীতির রাঙামাটি শহরে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব ধর্মের মানুষের আবাস রয়েছে।
 
কাপ্তাই লেক ঘেঁঘে পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে বা বসে স্থানীয়রা বড়শি দিয়ে মাছ ধরছে দেখতে পাই। আমি এবং বাবু একটা নিরিবিলি জায়গা দেখে হ্রদের সৌন্দর্য্য সামনে নিয়ে বসে থাকি।স্নিগ্ধ শীতল হাওয়ায় আমার খোলা চুল অবাধ্যতায় ওড়ে। আমি চুলগুলো সরিয়ে দেই না। আস্তে আস্তে সূর্য অস্ত যাওয়ার আয়োজন করছে দেখে আমাদের সম্বিত ফিরে আসে। আমরাও অনিচ্ছায় উঠে দাঁড়াই। ধীরে ধীরে পর্যটন কমপ্লেক্সের গন্তব্যে এগুতে থাকি। আবার রাঙামাটির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ঝুলন্ত সেতু পেরিয়ে আসতে আসতে দেখি আকাশজুড়ে কালো মেঘের ঘনঘটা।
 
মোটেলে ফিরে রুমে যেতে ইচ্ছে করছিল না। কমপ্লেক্সের সাজানো গুছানো আশপাশে ঘুরতে ভীষণ ভালো লাগছিল।হঠাৎ টের পাই আমাদের গায়ে টুপটাপ ঝরে পড়ছে শ্রাবণী জলের ফোঁটা।
 
 
পরেরদিন সকালে আমরা মোটেলের ডাইনিং- প্রাতরাশ করতে এসে দেখা পাই অনেক বিদেশি পর্যটকের। নাস্তা সেরে পর্যটন এলাকা থেকে সারাদিনের জন্য একটা ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া করলাম। নৌকার চালকের সাথে কথা হলো। তিনি আমাদের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে ঘুরে দেখাবেন। কাপ্তাই লেকে নৌকায় চড়েই বুঝতে পারলাম ভরা বর্ষায় কাপ্তাই অপরূপ সাজে সেজেছে। জানতে পারলাম কিছুদিন আগে পর্যন্ত ঝুলন্ত সেতুটি বর্ষার পানিতে ডুবে ছিল। তখন পর্যটকদের জন্য সেতুতে আরোহনে নিষেধাজ্ঞা ছিলো। রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই হ্রদটি বাংলাদেশের একটি বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ। কর্ণফুলি পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১৯৫৬ সালে কর্ণফুলী নদীর উপর কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করা হলে রাঙামাটি জেলার ৫৪ হাজার একর কৃষি জমি পানির নিচে ডুবে যায় এবং অপরূপ সৌন্দর্য্যের কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টি হয়। এই হ্রদ রাঙ্গামাটি জেলার রাঙ্গামাটি সদর, কাপ্তাই,  বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি, বরকল, বাঘাইছড়ি, লংগদু নানিয়ারচর উপজেলা জুড়ে বিস্তৃত।
 
সবুজ পাহাড় যেন কাপ্তাই লেকের নীল জলে নিজেকে সঁপে দিয়েছে। জল- জঙ্গল পাহাড়ের মোহনা দেখে অভিভূত হতে হতে নৌকায় এগিয়ে যাচ্ছি। আয়তনে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম এই কৃত্রিম হ্রদের অথই জলে রয়েছে বহু প্রজাতির মাছ অফুরন্ত জীববৈচিত্র। লেকের চারপাশের পরিবেশ, ছোট ছোট দ্বীপ, নানাবিধ পাখি এবং জলকেন্দ্রিক মানুষের জীবনযাত্রা প্রতি মুহুর্তে মুগ্ধ হওয়ার মতো। কৃত্রিম হলেও প্রকৃতি তার সমস্ত রূপ উজার করে সাজিয়েছে একে। আমরা কাপ্তাই নেমেই কাপ্তাই ন্যাশনাল পার্কে প্রবেশ করলাম। পার্কে প্রবেশ করতেই কানে এলো পাখির কিচিরমিচির শব্দ, এক ডাল থেকে অন্য ডালে লম্ফঝম্প করছে বানরের দল। পার্কে নানা প্রাণীর আনাগোনা তো আছেই। কাপ্তাই ন্যাশনাল পার্ক বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যমন্ডিত এলাকা। পার্কের রেস্ট হাউজের বারান্দা থেকেই দেখা যায় ন্যাশনাল পার্কের সবুজ প্রকৃতি আর শান্ত নীল জলের বহমান কর্ণফুলী।
 
কাপ্তাই বাঁধ পরিদর্শন করতে চাইলে প্রথমে গার্ডের কাছ থেকে বাঁধা আসে। তারা জানান বাঁধ দেখার জন্য কাপ্তাই ওয়াগগা বিজিবি ব্যাটেলিয়ন অথবা কাপ্তাই বিদুৎ কেন্দ্রের অনুমতি নিতে হয়। আমরা অনুমতির জন্য বিজিবি ব্যাটালিয়ন প্রধান সিও'  শরণাপন্ন হতেই এক দারুণ সারপ্রাইজের অবতারণা হলো। সেখানে তখন যিনি দায়িত্বরত কর্মকর্তা ছিলেন তিনি ইতিপূর্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কালিকচ্ছ বিজিবির সিও হিসেবে  ( তখন বিডিআর)দায়িয়্ব পালন করে গেছেন। কর্ণেল এজাজ ভাই, রুমা ভাবী, উনাদের মেয়ে মাঈশা এবং একমাত্র ছেলে সবাইকে পেয়ে উল্লসিত হলাম। উনাদের পরিবারের সাথে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক ছিলো অনেক আন্তরিক।  উনি সপরিবারে কাপ্তাইয়ে থাকায় আমাদের আনন্দ বহুগুণ বেড়ে গেলো। আমরা সবাই মিলে কপ্তাই বাঁধে ঘুরে ঘুরে সব দেখলাম। ২৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন দেশের একমাত্র জল বিদুৎকেন্দ্র থেকে কিভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় সরজমিনে দেখার সৌভাগ্য হল। তারপর আমরা গেলাম একটি জুম রেস্তোরাঁয়। কাপ্তাই বিজিবি পরিচালিত এই জুম রেস্তোরাঁটি মূলত একটি পরিপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্র। কাপ্তাইয়ের অ্যাভিয়ারি পার্কে কৃত্রিক লেক এবং সবুজ প্রকৃতি ঘিরে তৈরি করা হয়েছে পাখির অভয়ারণ্য। আমরা যখন লেকে ঘুরে বেড়াচ্ছি তখন দেখতে পেলাম চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান বিখ্যাত গায়ক কুমার বিশ্বজিৎ উনার দলবল নিয়ে গানের শুটিং করছেন। আমি আগে জানতাম না কাপ্তাইয়ে চা-বাগান আছে। চট্টগ্রামের বৃহত্তম মনোমুগ্ধকর ওয়াগগা চা বাগানটি অত্যন্ত মনোরম। বর্ষার জলে স্নান সেরে চায়ের সবুজ পাতাগুলো চকচক করছে। নতুন কুঁড়ির আগমণে চা-বাগান সুফলা হয়ে উঠেছে।
 
আমরা কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী নদীর তীরে চিৎমরম ইউনিয়নে চিংম্রং বৌদ্ধ বিহার দেখতে গেলাম। সুন্দর আর পরিপাটি করে সাজানো গোছানো চিংম্রং বৌদ্ধবিহারটি বিশ্বের বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের কাছে সবিশেষ পরিচিত। চীন,  জাপান, থাইল্যান্ড,  মিয়ানমার,  ভারত, নেপাল প্রভৃতি দেশ থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষু,  দায়ক- দায়িকারা মন্দির পরিদর্শনে আসেন। মন্দিরটি সুউচ্চ পাহাড়ের উপর নির্মিত। অপরূপ সজ্জার বৌদ্ধ মন্দিরটি প্রায় দুই বছরের স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মাণ করেছে বৌদ্ধ দায়ক- দায়িকারা। রাজবন বিহারে প্রার্থনা চলে। এই বৌদ্ধ বিহারে প্রত্যেক বছরের কঠিন চীবর দান উৎসবে লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটে। এটি বাংলাদেশের প্রধান বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। বেশ কয়েকটি বৌদ্ধ মন্দির, বিশ্রামগার, হাসপাতাল, তাবতিংস স্বর্গসহ এখানে দেখার মতন অনেক কিছু রয়েছে। রাজবনবিহারের পাশে দাঁড়িয়ে কাপ্তাই লেকের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্য উপভোগ  করতেই মনে হলো চাকমা রাজার রাজবাড়ি ঘুরে আসি। রাজবনবিহারের পাশে কাপ্তাই লেকের ছোট একটি দ্বীপজুড়ে রয়েছে চাকমা রাজার রাজবাড়ি। চারিদিকে হ্রদ বিশিষ্ট এই রাজবাড়ি পুরানো হলেও দেখতে বেড়াতে খুব ভালো লাগলো। রাজদরবার, কাচারি, সজ্জিত কামানসহ দেখার মতন অনেক কিছু আছে। রাজবাড়ির পাশেই উপজাতীয় নারীরা তাদের হাতে বোনা বস্ত্রসম্ভার নিয়ে বিক্রির জন্য পসরা সাজিয়ে অপেক্ষা করে। রাঙামাটি শহরের প্রধান রাস্তার পাশে স্থাপিত  উপজাতীয় জাদুঘরটি ঘুরেফিরে দেখলাম। উপজাতীয় কৃষ্টি, সংস্কৃতি,  জীবনধারার নানান নিদর্শন ব্যবহার্য জিনিসপত্র এখানে রাখা আছে।
 
রাঙামাটি জেলার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ শুভলং ঝর্ণা।নৌকায় চড়ে শুভলং ঝর্ণা দেখার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। শুভলং যাওয়া আসার পথেই পড়ে পেদা টিং টিং, চাং পাং, এবং ইকো রিসোর্ট।  জলের স্রোত কেটে কেটে শুভলংয়ের মোহনায় ঢুকতে চোখে পড়লো পথের দুইপাশে নিশ্চল পাথুরে পাহাড়। পাহাড়ের বুকে ঘন সবুজের আচ্ছাদন। মুগ্ধ নেত্রে দেখছি মৌসুমি জলের ধারা। ভরা বর্ষার মৌসুম হওয়ায় প্রায় ৩০০ ফুট উপর থেকে নিচে আছড়ে পড়ছে মূল ঝর্ণার দুধ সাদা জলের ধারা। পাহাড়ের উপর থেকে ঝর্ণার পানি পাথুরে মাটিতে আছড়ে পড়ার অপূর্ব দৃশ্য নিজের চোখে না দেখলে বলে বোঝানোর নয়। বর্ষার এই সময়ে ঝর্ণা হয়ে উঠে নবযৌবনা। সম্মোহিত হয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্বয়ংভরা ঝর্ণার রূপ দেখছি। অনেকে ঝরণার পানিতে নেমে গোসল করছে। ঝর্ণার হিমশীতল জলে পা ডুবিয়ে হাঁটছিলাম, কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি এলো। আমরা দৌড়ে গিয়ে উঠলাম শুভলং বাজারে। সেখানে ক্যান্টিনে বসে চা-পান করে আবার রওয়ানা হলাম।
 
রাঙামাটিতে এসে অবধি প্রতিটি  মুহুর্ত উপভোগ করার নেশা পেয়ে বসেছে। কাপ্তাই লেকের সূর্যাস্তের নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে এককথায় অপূর্ব। ফুরোমন পাহাড়ের পিঠে হেলান দেয় সূর্য। বদলে যায় জলের রঙ। সোনালি আলোয় জলে সোনার রঙ খেলা করে। চারপাশ যেন পটুয়ার পটে আঁকা কোন জলরঙের ছবি। বাংলার ভূ- স্বর্গ রাঙামাটির সৌন্দর্য বুঝানোর জন্য কোন উপমাই যথেষ্ট নয়। এখানকার প্রকৃতির পরতে পরতে মিশে আছে অদেখা এক ভূবন। যত দেখি দেখার আঁশ মেটে না। চোখের পলকে দিনগুলো ফুরিয়ে এলো। শেষবারের মতন ঝুলন্ত সেতুতে আরোহন করলাম।ফিরে আসার জন্য পা যেন সরতে চায় না। রাঙামাটি - ঢাকা এডভান্স টিকেট কাটাই ছিলো। আমরা হোটেলে রুমে গিয়ে যাত্রার জন্য তৈরি হয়ে নিলাম। রুম চেকআউটের ফর্মালিটি সেরে একটা অটোতে চেপে রাঙামাটি শহরের বাসস্ট্যান্ডে রওয়ানা দিলাম। রাতের খাবার খেয়ে বাসে রাঙামাটি থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। চট্টগ্রাম থেকে শাহআলম
 
আমাদের সঙ্গী হলো।
 
এত সুন্দর একটা ভ্রমণের শেষ কতটা খারাপ হতে পারে তা কল্পনায়ও ছিলো না। বাস যখন ঢাকা- চট্টগ্রাম মহাসড়কের নায়ায়নগঞ্জে এসে পৌঁছুলো তারপরই আমরা বিরাট জ্যামে আটকে গেলাম। রাস্তায় দীর্ঘ গাড়ির সারি, আসা বা যাওয়ার দিকের কোন গাড়ি আগাতে পারছে না। এদিকে শুরু হয়েছে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। অগত্যা আমরা বাসেই বসে রইলাম। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো দুই পীরের অনুসারীদের মধ্যে মারামারি লেগেছে। কারো হাতে হকিস্টিক, কারো হাতে রামদা, দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দুই দলের লোকের ছুটাছুটি দেখে খুব ভয় পেলাম। এদিকে কয়েকঘন্টা পেরিয়ে গেলেও বাস অথর্ব পড়ে আছে। শরীরে জ্বর অনুভব করছি। কিচ্ছু করার নেই, খুব অসহায় লাগছে। অনেকেই বাস থেকে নেমে হাঁটা শুরু করেছে। আমি বা বাবু এদিকের রাস্তাঘাট তেমন কিছুই চিনি না। সাথে শাহআলম আছে এই ভরসা। আমরাও বাস থেকে নামলাম। ভাগ্য ভালো বড় লাগেজটা ছিলো ট্রলি সিস্টেমের, সাথে আরো ব্যাগ তো ছিলোই। সেসব নিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই হাঁটতে শুরু করলাম। অনেক মানুষ হাঁটছে। পথ যেন আর ফুরায় না। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। শাহআলম কিভাবে যেন একটা ভ্যান জোগাড় করলো। লাগেজ সমেত আমরা তিনজন ভ্যানে চেপে বসলাম। ভ্যান আদমজী জুট মিলের সামনে দিয়ে এগিয়ে গেলো। আমাদের যেখানে নামিয়ে দেয়া হলো সেখানে একটা নদী দেখতে পেলাম।  অনেক মানুষের সাথে আমরা একটা দেশি নৌকায় চড়ে বসলাম। অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। সাথে ছাতাও নেই। আমরা ভিজতে ভিজতে নৌকায় অন্যপাড়ে এসে শুনলাম এটা বন্দর এলাকা। সেখান থেকে রিকশা ভাড়া করে আগাতে থাকি। এমন করতে করতে এসে পড়লাম পুরান ঢাকায় পোস্তগোলায়। পোস্তগোলা থেকে একটা বেবিট্যাক্সি ভাড়া করে আমাদের রামপুরার বাসায় এসে পৌঁছুলাম। আমার হাত-পা ব্যথায় ভেঙ্গে আসছে। কথা বলতে পারছি না। কিভাবে আমাকে দোতলায় উঠিয়ে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়া হয়েছিল কিছুই মনে করতে পারি না। চারদিন পুরো অবচেতন ছিলাম। আম্মা এবং বোনদের সেবায় সুস্থ হয়ে উঠলাম। আমার রাজকন্যা বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তেই চোখ গড়িয়ে জলের ধারা পড়তে শুরু করলে বাবু বললো, ভাগ্যিস আমরা সাথে আদনকে নিয়ে যাই নি।
 
আম্মা বললেন, শুকরিয়া করো আল্লাহ এত বড় বিপদ থেকে বাঁচিয়ে বনেছে।
 
সুস্থ হয়ে যখন ঢাকা থেকে কন্যাসমেত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শ্বশুরালয়ে ফিরে এলাম শ্বাশুড়ি আম্মা সব শুনে বললেন, রাস্তাঘাটে প্রতি পদে পদে বিপদ হা করে থাকে। আর বেড়াতে যেতে হবে না,ঘরেই নিরাপদে থাকো। রাঙামাটি বেড়ানোর সুখস্মৃতি যেমন অটুট তেমনি ফেরার পথের শত বাঁধার দুঃসহ স্মৃতিও মনে গেঁথে আছে। ভ্রমণপিপাসু মন কি আর বাঁধা মানে! বিপদের কথা মাথায় রেখে নব উদ্যমে পথে নামি।
 
 
লেখাকাল, আগষ্ট ২০২০
টি রোড,  ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com

#গল্প
#মোলাকাত
#সাহিত্য_ম্যাগাজিন
#Molakat
#ওয়েব_ম্যাগাজিন
#সাহিত্য
#শাহীন_চৌধুরী_ডলি 

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.