আলিফ লায়লা : আরব্য রজনী_পর্ব-১০৫
ইংরেজি অনুবাদ : ডঃ জে. সি. মারদ্রুস
বাংলা অনুবাদ : ক্ষিতিশ সরকার
চারশো আটত্রিশতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে : এবার শুনুন, সওদাগর সিদি মুসিন আর খাতুনের কথা : সিদি মুসিন সাজ-পোশাক খুলে দিয়ে একেবারে দিগম্বর হয়ে অধীর আগ্রহে বসে থাকে সেই ছোট্ট খুপরীটাতে। বুড়ি তাকে বলে যায়, এখুনি সে এসে তার মেয়ের ঘরে নিয়ে যাবে তাকে। কিন্তু তিলে তিলে অনেক সময় কেটে যায়। বুড়ি ফিরে না। সিদি মুসিন অধৈর্য হয়ে বৈঠকখানা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ে।
এদিকে খাতুনের অবস্থাও তাই। বুড়িটা তাকেও ধোঁকা দিয়ে, সাজ-পোশাক গহনাপত্র নিয়ে, প্রায় বিবস্ত্ৰা করে, বসিয়ে রেখে সেই যে বেরিয়ে গেলো আর ফিরলো না। খাতুন ভাবে নিচে থেকে ফিরে আসতে এতো দেরি হওয়ার কারণ কী? অধৈর্য হয়ে সেও ঘর থেকে উইিকেত বাইরে বেরিয়ে আসে। হঠাৎ পিছন থেকে একটা কৰ্কশ আওয়াজ শুনে সে চমকে উঠে পিছনে ফিরে তাকায়। কিন্তু চোখ আর খুলে রাখতে পারে না। সেই নওজোয়ান সওদাগর একেবারে বিবস্ত্র —উলঙ্গ।
সিদি বেশ তেজের সঙ্গেই কৈফিয়ৎ চায়, তোমার মা কোথায়? এক্ষুণি, ডাকো তাকে। আমি আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করবো না। এখুনি শাদীর ব্যবস্থা করতে হবে।
খাতুন অবাক হয়ে বলে, আমার মা? সে তো কতকাল আগে মারা গেছে। তুমি কী সেই পীরের সাগরেদ নাকি?
খাতুন-এর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যেতে থাকে। মাথাটা বোঁ বৌ করে ঘুরে ওঠে। তবে কি বুড়িমা-আর সে ভাবতে পারে না কিছু।
সিদি মুসিনও বুঝতে পারে, ব্যাপারটা বড় সুবিধের না। এখন এই অবস্থায় সে কী করবে, কী করা উচিত কিছুই ঠাওর করতে পারে না।
খাতুনও আতঙ্কিত হয়ে নির্বোধের মতো সিঁড়ির দিকে ছুটে যায়। ভাবখানা এই-যেন সিঁড়ি দিয়ে নামলেই বুড়িটার সঙ্গে দেখা হবে। সিদিও তার পিছনে পিছনে নামতে থাকে।
এই সময় হজ মহম্মদ আর ছেলেটার কাজিয়া তুঙ্গে উঠেছে। ওপরে উঠে আসার জন্যে তারা সিঁড়ির কাছে ছুটে আসে। পিছনে বিরাট জনতা। সিঁড়িতে পা দিয়েই মহম্মদ দেখে, মেয়েটি আর ছেলেটি দুজনেই উলঙ্গ। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে। হজ মহম্মদ আর তার পিছনে একরাশ জনতাকে দেখে বিহ্বল হয়ে পড়ে, খাতুন। শেমিজটাকে প্রাণপণে টেনে হাঁটুর কাছে নামাতে চায়। আর সিদি মুসিন— সে বেচারা দু’হাত দিয়ে ঢেকে কোনও রকমে লজ্জা নিবারণের ব্যর্থ প্রয়াস করতে থাকে।
হজ মহম্মদ গর্জে ওঠে, এই খানকির বেটি খানকি, তোর মা মাগী কোথায় আগে বলে?
তার এই কথা শুনে হজ মহম্মদ তার দোকানের শোক ভুলে গেলো, ছেলেটা তার হারানো গাধার দুঃখও ভুলে গিয়ে হো হো করে হেসে উঠলো। অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো পিছনের জনতাও। কারুরই আর বুঝতে বাকী রইলো না তারা সবাই ঐ ধূর্ত ঠগ বুড়িটার শিকার হয়েছে।
হজ মহম্মদ, ছেলেটা আর সওদাগর সিদি মুসিন তিনজনে ঠিক করলো, শয়তান বুড়িটাকে শায়েস্তা করতেই হবে। কিন্তু তার আগে এই অসহায় মেয়েটার লজ্জা নিবারণের একটা ব্যবস্থা করা দরকার।
কিছুক্ষণের মধ্যে একটা পোশাক এনে পরতে দেওয়া হলো খাতুনকে। খাতুন তখন লজ্জা ভয় শঙ্কায় দিশাহারা। কোনও রকমে পোশাকটা পরে দ্রুত পায়ে সে বাড়ির পথে পা বাড়ায়।
বলো। তার চাইতে কোতোয়ালের কাছে চলো, নালিশ করে আসি।
সওদাগরের দিকে তাকিয়ে সে বললো, আপনি চলুন আমাদে সঙ্গে কোতোয়াল খালিদের কাছে। এজাহার দিয়ে আসবেন।
সব শুনে আমির খালিদ বললো, এতো বড় তাজ্জব কাণ্ড, আল্লার নাম নিয়ে বলছি, তোমরা যে কাহিনী শোনালে সবই আমি বিশ্বাস করছি। কিন্তু একটা কথা, এই বিরাট বাগদাদ শহরে সেই শয়তান বুড়িটাকে কী করে আমি ধরবো? হারেমে হারেমে ঢুকে সব মেয়ের বোরখা খুলে পরীক্ষা করে দেখা কী আমার পক্ষে সম্ভব? আমার পক্ষে কেন, কারো পক্ষেই তা সম্ভব নয়।
–তা হলে কী উপায় হবে?
ছেলেটা কেঁদে ফেলে, আমার গাধা—
আর সওদাগর সিদি মুসিন মাথা ঠুকতে থাকে, আমার এক হাজার দিনারের বটুয়া—
কোতোয়াল খালিদ বলে, তোমরা, যদি বুড়িটাকে ধরে এনে দিতে পোর, আমি তার যোগ্য সাজা দেবার ব্যবস্থা করতে পারি। এমন দাওয়াই তাকে দেবো, বাছাধন সব কবুল করতে পথ পাবে না। কিন্তু তাকে যদি হাতের মুঠোয় না পাই, আমার কিছু করার নাই।
খালিদের কথায় তারা আপাততঃ শান্ত হয়ে যুক্তি করে, যেভাবেই হোক তাকে তাকে থাকতে হবে, বুড়িটার হদিশ করতেই হবে।
এবারে ধূর্ত বুড়ি ডিলাইলাহর কথা বলি :
–মা, মাগো, তুমি দেখি বাজী মাৎ করে এসেছো?
ডিলাইলাহর মুখে দুৰ্গ জয়ের অহঙ্কার ফুটে ওঠে, এক ঢ়িলে চার পাখী মেরেছি। এক আমিরের বিবি আর এক ছোকরা সওদাগরের সাজ-পোশাক গহনাপত্র টাকাকডি লোপাট করে একেবারে উদাম করে রেখে এসেছি। আর এক দোকানদারের দোকানের সব ভালো ভালো দামী দামী জিনিসপত্র ফাঁক করে দিয়েছি। আর এই গাধাটা দেখছিস, এটাও বাগিয়ে নিয়ে এসেছি একটা ছেলের কাছ থেকে।
জাইনাবা শিউরে ওঠে, বলো কী মা, এতোগুলো কাজ একবেলার মধ্যে সেরে ফেললে?
–তুই থাম তো জাইনাব। তোর ঐ আমির খালিদকে আমি ট্যাঁকে গুঁজে রাখতে পারি। খালি ভয় আমার ঐ ছোঁড়াটাকে। বেটাচ্ছেলে, আমাকে চেনে। সে যাক গে, ও-নিয়ে আমি চিন্তা করি না।
ডিলাইলাহ একটু দম নেয়। তারপর আবার বলতে থাকে : এ আর কী দেখলি আমার কেরামতী। আসল কাজে তো এখনও হাতই দিইনি।
জাইনাব আতঙ্কিত হয়ে বলে, কিন্তু মা, আমার বড় ভয় করছে। যদি তুমি ধরা পড়ে যাও–
-আমাকে যে ধরবে সে এখনও মায়ের গবভে। ওসব ভয় আমাকে দেখাস নে। জানিস আমি হচ্ছি। পাকাল মাছ, হাতে মুঠো করে ধরেও ধরে রাখা যায় না। পালিয়ে আমি যাবোই।
রাত্রি শেষ হতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
চারশো উনচল্লিশতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে :
বাজার। রাস্তার দুধারে বাহারী রঙদার বিলাসদ্রব্যের দোকান। নানারকম কায়দায় সুন্দর সুন্দর জিনিস সব এমনভাবে সাজিয়ে রেখেছে, দেখে চোখ ঝলসে যায়। ডিলাইলাহ এদিক ওদিক দেখতে দেখতে চলছিলো। হঠাৎ তার নজরে পড়লো, একটা বড় লোকের চাকরানীর কাঁধে ফুটফুটে সুন্দর একটা ছেলে। এক নজরেই বোঝা যায়, কোনও আমির বাদশার খানদানী ঘরের দুলাল। সারা অঙ্গে তার সজের কী বাহার। জমকালো জরির কাজ করা কুর্ত কামিজ। মাথায় শিরোপা। হীরা চুনী পান্না মুক্ত বসানো-মহামূল্যবান টুপী। তার গলায় ইয়া বড় একটা মুক্তোর মালা। মাঝে মাঝে হীরা বসানো। একটাবাড়ি থেকে চাকরানীটা ছেলেটিকে কাঁধে করে রাস্তায় নামলো। এই বাড়িটা বাগদাদ শহরে বিখ্যাত। শহরের সওদাগর-সমিতির সভাপতির বাড়ি। সুতরাং প্রায় সব লোকেই চেনে। এই বাচ্চা যে সওদার সভাপতির সে-কথা হয়তো না বললেও বোঝা যায়।
ছেলেটাকে কাঁধে নিয়ে চাকরানীটা তার সঙ্গে গপ্লো করতে করতে বাড়ির সামনেই পায়চারী করতে থাকলো। তাদের কথাবার্তা থেকে একটা কথা পরিষ্কার সে জানতে পারে, সওদাগরের বাড়িতে আজ উৎসব আছে। তার কন্যার বাগদানের উৎসব। ছেলেটা বড় দামাল। বাইরের অভ্যাগতদের সামনে ওর মাকে নাজেহাল করবে, এই আশঙ্কায় চাকরানীর কাছে দিয়ে বলেছে, বাইরে নিয়ে যা। মেহেমানরা চলে গেলে, নিয়ে আসবি।
ডিলাইলাহ ভাবে, যেভাবেই হোক ছেলেটাকে গায়েব করতে হবে। সচ্ছন্দভাবেই সে চাকরানীটার সামনে এগিয়ে যায়। আর বোলো না বাছা, আমার বড় দেরি হয়ে গেলো।
চাকরানীটা কিছুই বুঝতে পারে না। ডিলাইলাহর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়। এই ফাঁকে ডিলাইলাহ তার হাতে একটা আচল দিনার গুঁজে দিয়ে বলে, এটা রাখো, তোমার মালকিনকে গিয়ে একবার খবর দাও, বাছা, তার পুরোনো আয়াউম অল খায়ের এসেছে দেখা করতে। আজ এই শুভ দিনে আমার দেয়া জানাতে এসেছি আমার বেটিকে। আমার নিজ হাতে মানুষ করা লেড়কী। আজ তার শাদীর পাকা দেখা। এ আনন্দ আমি কি চেপে রাখতে পারি। তাই না ডাকলেও ছুটে এসেছি, যাও তুমি মালকিনকে একবার গিয়ে বলো, তাহলেই তিনি সব বুঝতে পারবেন।
চাকরানীটা উৎফুল্ল হয়ে ওঠে; এ তো ভারি। আল্লাদের কথা মা, আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমি এক্ষুণি মালকিনকে আপনার কথা বলছি।
কিন্তু মুহূর্ত মধ্যেই চুপসে যায় চাকরানীটা! বলে, কিন্তু কী করে ভিতরে এখন যাবো, মা?
—ওঃ, এই কথা! তা দাও ওকে আমার কোলে, আমি ততক্ষণ ওর সঙ্গে আলাপ জমাই। তুমি চটপট খবর দিয়ে চলে এসো, কেমন?
সরল বিশ্বাসে চাকরানীটা তার কোলে শিশুটিকে তুলে দিয়ে দোতলায় উঠে যায়।
এদিকে তক্ষুণি ধূর্ত শয়তান বুড়িটা শিশুটিকে কোলে নিয়ে হন হন করে হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূরে বা পাশের একটা সরু অন্ধকার গলির মধ্যে ঢুকে সদর রাস্তার গোচর থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। ঝটপট সে শিশুটির গা থেকে মূল্যবান হীরে জহরতগুলো খুলে নিয়ে বটুয়ায় ভরে ফেলে। তারপর ভাবে, একে দিয়ে আরও অনেক রোজগার করা যাবে।
দ্রুতপায়ে সে বাজারের স্যাকরা-পট্টিতে চলে আসে। এখানকার নামজাদা জহুরী এক ইহুদী। লোকটা পয়সার কুমির। কিন্তু বাগদাদের ব্যবসায়ী মহলে তার কোনও প্রতিষ্ঠা নাই।
দোকানের গদীতে বসে খন্দেরের আশায় পথের দিকে তাকিয়েছিলো। ডিলাইলাহর কোলে সওদাগর-সভাপতির পুত্রকে দেখে তার চোখ দুটো জুলজুল করে ওঠে। এই সওদাগর-সভাপতির ওপর তার মনে মনে দারুণ হিংসা। পয়সায় ইহুদী অনেক বড়, কিন্তু তার মতো ইজৎ সে পায় না। লোকে তাকেই সন্মান করে সমিতির সভাপতি বানিয়েছে। কিন্তু ইহুদীকে ডাকেনি।
ডিলাইলাহ দোকানের ভিতরে ঢোকে। ইহুদী স্বাগত জানিয়ে বসতে বলে। ভাবে, সওদাগর-সভাপতির বাড়ির বায়না—মোটা মাল বিক্রি হবে। কণ্ঠে মধু ঢেলে জিজ্ঞেস করে, কী চান মা?
ডিলাইলাহ বলতে থাকে, এই বাচ্চাটার বড় বোনের আজ শাদীর পাকা কথার উৎসব হচ্ছে বাড়িতে। ওহো, আমি কোনবাড়ি থেকে এসেছি, দেখুন, তাই-ই বলতে ভুলে গেছি।
ইহুদী আজারিয়াহ বলে, আমি জানি, আপনি আমাদের সওদাগর শাহবানদার-প্রাসাদ থেকে আসছেন। এই বাচ্চা দেখেই বুঝতে পেরেছি। তা বলুন, কী কাজে লাগতে পারি। আমি?
-জানি। আমারও নেমন্তন্ন আছে সেখানে। দোকানপাট বন্ধ করেই যাবো।
ডিলাইলাহ মুহূর্তের জন্য মিইয়ে যায়। কিন্তু পর মুহূর্তেই আবার নিজেকে সহজ করে নিয়ে বললে, মালকিনের ইচ্ছা তার এই বাচ্চাটাকে একেবারে শাহজাদার মতো করে সাজাতে হবে। তিনিই আমাকে পাঠালেন। আপনার কাছে। আপনার দোকানের সেরা জহরৎ দিয়ে সাজিয়ে দিন-মালকিনের তাই ইচ্ছে।
ইহুদী শুনে গদগদ হয়, এ আর বেশি কথা কী। এমন সব দামী-দামী জড়োয়া-জহরৎ দিচ্ছি, আপনার মালকিনের পছন্দ হবেই হবে।
জহুরী বেছে বেছে দু’খানা বাহুর তাগা, দু’খানা বালা, এক জোড়া মুক্তোর কানবালা, একখানা কোমরের দোয়াল, দুই রকম জামার বোতাম এবং হাতের কয়েকটি আংটি ডিলাইলাহর হাতে তুলে দিয়ে বললো, দেখান আপনার মালকিনকে। আমার মনে হয় অপছন্দ হবে না।
ডিলাইলাহর চোখ নেচে ওঠে। সবগুলো গহনায় হীরে চুনী পান্না প্রভৃতি নানারকম রত্ন বসানো। অনেক দাম হবে বোধ হয়। জহুরীকে বলে, বহুৎ বাহারী চমৎকার জিনিস সব। আমি মালকিনকে দেখিয়ে দামটা দিয়ে যাচ্ছি। কত লাগবে, আপনি ক’ষে বলে দিন।
জহুরী বলে, দামের জন্য চিন্তা কী। সে পরে হবে ’খন। আগে তো তার পছন্দ হোক। তারপর দামের জন্য কী আটকাবে?
ডিলাইলাহ বলে, বাচ্চাটা এখানে ততক্ষণ থাক, আমি দৌড়ে যাবো। আর ছুটে আসবো।
ইহুদী হাসে, বুঝেছি আপনার কোথায় আটকাচ্ছে। ওসব কিছুর দরকার নাই। ছেলেকে জমা রেখে আপনি নিয়ে যাবেন, আর আমি তাই হতে দেবো? ছিঃ ছিঃ ছিঃ, এসব আপনি ভাবলেন কী করে। যান, চলে যান। আপনাকে এ নিয়ে আর কিছু চিন্তা করতে হবে না। ছেলেকে যদি এমনিই রেখে যেতে চান, থাকুক। এখানে খেলা করুক। কিন্তু আমার কোনও প্রয়োজন নাই।
ছেলেটিকে ইহুদীর দোকানে বসিয়ে রেখে ডিলাইলাহ সোজা বাড়ির পথে হন হন করে হেঁটে চললো।
জাইনাব ঠগের সেরা মাকে ফিরতে দেখে সাগ্রহে জিজ্ঞেস করে, আবার কাকে ফাঁসিয়ে এলে, মা?
কিন্তু মা, জাইনাব শঙ্কিত হয়ে বলে, এই রকম বেপরোয়া হয়ে এমন সব কাজ তুমি করে আসছ, এরপর ভেবে দেখেছো বাগদাদের হাটে বাজারে আর তুমি বেরুতে পারবে?
এদিকে সেই নির্বোধ চাকরানীটা দোতলায় উঠে যায়। বিরাট বিশাল ভোজসভার আয়োজন হয়েছে মাঝের বড় ঘরে। সওদাগর বিবির কানে ফিস ফিস করে সে বলে, মালকিন, আপনার পুরোনো আয়া উম আল খাইর এসেছে। নিচে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। শাদীর পাকা-দেখা শুনে সে মেয়েকে দোয়া জানাতে এসেছে।
এই কথা শুনে সওদাগর-বিবি প্ৰায় চিৎকার করে ওঠে, তোর ছোট মালিককে কোথায় রেখে এলি?
সওদাগর-বিবি দিনারটা হাতে নিয়ে দেখে, জাল। পিতলের তৈরি। সঙ্গে সঙ্গে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে। সে, শিগ্গির ছুটে যা, খানকি মাগী, নিয়ে আয় আমার বাছাকে।
চাকরানীটা দিগভ্ৰান্ত হয়ে পড়ে। হুড়পাড় করে সে নিচে নেমে এসে দেখে পাখী পালিয়েছে। কোথায় আয়া? কোথায় তার ছোট মালিক? হাঁউমাউ করে কেঁদে ওঠে সে। তার চিৎকার শুনে অন্যান্য মেয়েরা ছুটে নেমে আসে নিচে। নিমেষের মধ্যে দারুন চেঁচামেটি-চিৎকার মহা-সোরগোল পড়ে যায়। সওদাগর সভাপতি নিজেও ছুটে আসে, কী ব্যাপার? কী হয়েছে? এতো গোল কীসের? যখন তার বিবির মুখ থেকে শুনলো, ছেলেকে নিয়ে ভেগেছে একটা শয়তানী ছেলে-চোর, সওদাগর পাগলের মতো এদিক-ওদিক ছুটিছুটি করে খুঁজতে থাকলো। তার সহগামী হলো উপস্থিত অভ্যাগত আমন্ত্রিত সকলেই। নানা দিকে ছত্রাকারে ছড়িয়ে পড়লো তারা শিশুর সন্ধানে। শত সহস্ব পথচারীদের জিজ্ঞেস করলো, কেউ একটি সুন্দর ফুটফুটে ছেলেকে কোনও বুড়ির কোলে দেখেছে কি না। কিন্তু কেউ কোনও হদিস দিতে পারলো না। দোকানদার, ফিরিওলা, ভিস্তিওলা কাউকেই জিজ্ঞেস করতে বাদ রাখলো না তারা। কিন্তু কেউই আশার কথা শোনাতে পারে না। অবশেষে অনেকক্ষণ পরে তারা স্যাকরা বাজারে এসে ছেলের সন্ধান পেলো। ইহুদী আজারিয়াহর দোকানের দরজার পাশে বসে সে একমনে খেলা করছিলো। তার সাজ-পোশাক এলোমেলো, গায়ের হীরে জহরৎ কিছু নাই। শাহবানদার ক্ৰোধে আনন্দে অধীর হয়ে ইহুদীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
এ্যাই শয়তান পাজী বুড়ো, আমার ছেলে তোর কাছে কেন, বল? কী করে এলো এখানে? নিশ্চয়ই গহনার লোভে চুরি করিয়ে এনেছিস। তোর জিভ আমি টেনে ছিঁড়ে ফেলবো, বদমাইশ। বল, ওর গায়ের হীরে জহরৎ কোথায় রেখেছিস?
–দোহাই, মালিক, আমার অপরাধ নেবেন না। আমি কোনও দোষ করিনি, কোন চুরি ছেনতাই আমার ব্যবসা নয়।
সওদাগর রাগে ফেটে পড়ে, ওরে আমার পীর রে। তুমি চুরি করনি তো আমার ঘরের ছেলে তোমার দোকানে এলো কী করে? ঐটুকু দুধের বাছা, হেঁটে হেঁটে একাই চলে এলো 으T55 에?
শাহবানদার এবার জ্বলে ওঠে, ওহে কালাবাঁদর, আমার মেয়ের গহনাপত্রের কী কিছু অভাব আছে? তোমার দোকানে লোক পাঠিয়ে গহনা না নিয়ে গেলে আমার মেয়ে সেজেগুঁজে দাঁড়াতে পারবে না। ও সব বুজরুকী রাখ, ছেলের গায়ের হীরে-জহরৎ কোথায় রেখেছ, বের করা?
শাহবানদার ছেলেকে নিয়ে চলে গেলো। ইহুদী জহুরী সেই তিন প্রতারিতকে প্রশ্ন করে, আপনারা এর কোনও বিহিত করবেন না?
হাতে তুলে দিলে সে তাকে উপযুক্ত সাজা দেবে, এই কথা দিয়েছে।
ইহুদী বলে, তা হলে আসুন আমরা সবাই একজোট হয়ে তাকে ধরে ফেলার ব্যবস্থা করি। আচ্ছা, আপনাদের মধ্যে কেউ কী আগে ঐ বুড়িটাকে চিনতেন?
ইহুদী বলতে থাকে, সবাই মিলে একসঙ্গে দল বেঁধে তাকে খুঁজে বেড়াতে থাকলে কোনও কাজ হবে না। চারজন চারদিকে নজর রাখুন। পথে-ঘাটে যত বুড়ি মেয়েছেলে চোখে পড়বে তাদের সবাইকে ভালোভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবেন। কিন্তু সাবধান, কেউ যেন না বুঝতে পারে আমরা কিছু লক্ষ্য করছি।
রাত্রি শেষ হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
চারশো একচল্লিশতম রজনীর মধ্যযামে আবার সে বলতে আরম্ভ করলো :
ডিলাইলাহ ফিস ফিস করে বলে, আঃ অত চেঁচাচ্ছে কেন? মামলাটা কী বাবা?
ডিলাইলাহ কষ্ঠে মধু ঢেলে বলে, আমি জানি তুমি গরীব লোক। তোমার জিনিসে আমার কোনও লোভ নাই, বাবা। আমি ছিনতাই করতে চাই আমির বাদশাহদের ধন-দৌলত। তোমার গাধাটা আমি তোমাকে ফেরত দেবো বলেই ঐ মুর-নাপিতের দোকানের সামনে বেঁধে দিয়েছি। তুমি যাও, পাবে। দোকানের মালিকের নাম হিজ মাসুদ। ওকে বলা আছে, গিয়ে চাইলেই তোমাকে দিয়ে দেবে। আচ্ছা, তোমাকে যেতে হবে না, তুমি এখানে দাঁড়াও। আমিই গিয়ে নিয়ে আসছি। এই রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেই বাঁক ঘুরলেই তার দোকান। একটুক্ষণ তুমি অপেক্ষা কর, আমি তোমার গান্ধটাকে নিয়ে আসছি।
চোখে ততক্ষণে অশ্রুধারা নামিয়ে ফেলেছে সে। নাপিতের হাত ধরে কাঁদতে বলে, হায় হায় আমার সব শেষ হয়ে গেলো।
—কেন? কেন, কী হয়েছে বুড়ি মা?
হজ মাসুদ বলে, কী এমন কাজ মা, যা আপনি পারবেন না-অথচ আমি পারবো? যাক, বলুন, আমি জান দিয়েও করে দেবো আপনার কাজ।
ডিলাইলাহ হজ মাসুদের হাতে একটা দিনার গুঁজে দিয়ে বললো : হেকিম জী বলেছেন : ছেলের এই পাগলামীর আসল কারণ ওর দু’টো শ্বদন্ত। এই দু’খানা উপড়ে ফেলে সেখানে গরম দু’খানা লোহার গজাল গেঁথে দিলেই ওর পাগলামী ভালো হয়ে যাবে।
ডিলাইলার কথা শুনে মাসুদ বলে, আপনি কিছু ভাববেন না। আপনার ছেলের পাগলামী আমি এক্ষুণি সারিয়ে দিচ্ছি।
মাসুদ তার দুই সহচরকে হুকুম করলো। দু’খানা পেরেক উনুনে পোড়াতে দাও। আমি ওকে ডেকে আনি।
মাসুদ দোকানের বাইরে এসে গাধার মালিককে দেখতে পেয়ে বলে, ও ছেলে, দোকানে চলো। তোমার গাধা ফেরত নিয়ে এসো।
ছেলেটা হস্তদন্ত হয়ে মাসুদের পিছনে পিছনে দোকানে ঢোকে। মাসুদ তাকে পাশের কামরায় নিয়ে গিয়ে আচমকা পেটের ওপর এক ঘুষি মারে। ছেলেটা চিৎপাৎ হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে অনুচর দু’টো এসে তাকে চেপে ধরে। এর ফলে আর সে নড়া-চড়া করতে পারে না। মাসুদ ওর বুকের ওপর চেপে বসে, গলাটা টিপে ধরে। ছেলেটার দম বন্ধ হয়ে আসে। আপনা থেকেই মুখটা হাঁ হয়ে যায়। তখন একখানা সাঁড়াশী দিয়ে পটাপট দু:খানা স্বদন্ত তুলে ফেলে সে। গজাল দু’খানা ততক্ষণে তেন্তে.লাল হয়ে গিয়েছিলো। মাসুদ নির্মম হাতে সেই দাঁতের গর্তে দু’খানা গজাল ঠুকে বসিয়ে দিয়ে বলে, এই তো হয়ে গেলো। এবার তুমি তোমার গান্ধাকে নিয়ে নাচতে নাচতেবাড়ি চলে যাও, কেমন! দাঁড়াও তোমার মাকে ডাকি, যা যা বলেছিলেন, ঠিক ঠিক মতো করতে পেরেছি কি না তাকে দেখাই।
নাপিতের সাগরেদ। দু’টো তখনও ছেলেটাকে চিৎপাৎ করে ধরে রাখলো। আর ছেলেটা দারুণ যন্ত্রণায় হাঁপাতে থাকলো। নাপিত তার মাকে ডাকতে চলে গেলো পাশের ঘরে।
কিন্তু একি! ঘরতো ফাকা। কেউ নাই। বুড়ি মা কোথায় গেলো? এই তো সে এখানেই বসেছিলো!
সে এক জাঁদরেল সিদেল চোর। আর আজ এই দিন-দুপুরে তারই নাকের ডগা দিয়ে তার দোকানের সর্বস্ব লোপাট করে নিয়ে গেছে একটা মেয়ে-ছেলে? এতো বড় ক্ষমতা-রাগে গরগর করতে থাকে সে। পিছনের ঘরে ছুটে গিয়ে রেগে ছেলেটার দুই গালে প্রচণ্ড মুষ্ঠাঘাত করে কৈফিয়ৎ তলব করে, বল, তোর মা মাগী কোথায় গেছে? বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা। আমার ভয়ে গৃহস্থের চোখে ঘুম আসে না, আর আমার দোকানেই বাটপাড়িা! এখনও বাঁচিতে চাস তো তোর মা কোথায় থাকে আস্তানার পাত্তা বল।
ছেলেটির তখন মৃতকল্প দশা! বলে, আল্লাহ কসম, আমার মা অনেক কাল আগে দেহ রেখেছে। আমি অনাথ। গাধা খাটিয়ে খাই।
মাসুদ বলে, ওসব কসম আমি বিশ্বাস করি না। ঐ বুড়ো খানকিটা আলবাৎ তোর মা। বলো সে কোথায়? সে আমার সর্বস্ব চুরি করে নিয়ে গেছে।
যখন তারা এই রকম তর্ক-বিতর্ক করে চলেছে, এমন সময় দোকানের সামনে দিয়ে সেই তিন প্রতারিত হজ মহম্মদ, সওদাগর সিদি আর জহুরী ইহুদী ধূর্ত বুড়ির অনুসন্ধান করে ফিরছিলো। গাধার মালিকের আর্তনাদ শুনে তারা নাপিতের দোকানের ভিতরে ঢুকে পড়লো। ছেলেটার তখন দুগাল বেয়ে রক্ত-নদীর ধারা বয়ে চলেছে! যন্ত্রণায় সে কাতরাচ্ছিল। ওর তিন সতীর্থকে দেখতে পেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। সে; আমাকে মেরে ফেললো, এই বিধমী বদমাইশটা। আপনারা আমাকে বাঁচান।
ওরা দেখলো ছেলেটার মুখের অবস্থা অবর্ণনীয়। দু’খানা তাজা দাঁত উপড়ে তুলে ফেলেছে। তার। উত্তপ্ত লীেহশালাকার ছেকায় তার মুখের প্রায় আধখানাই পুড়ে আংরা হয়ে গেছে। নাপিতের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে তারা মারমুখী হয়ে উঠতে হজ মাসুদ আদ্যোপোন্ত সব ঘটনা তাদের সামনে খুলে বলে। তখন ওরা বুঝতে পারলো, আসল দোষী সেই ধূর্ত শয়তান বুড়িটা। তাকে শায়েস্তা না করা পর্যন্ত তাদের গায়ের ঝাল যাবে না। সবাই মিলে আবার হলফ করলো, যেভাবেই হোক, যতদিনেই হোক এর বিহিত তারা করবেই।
শাহরাজাদ দেখলো, রাত্রি শেষ হয়ে আসছে। গল্প থামিয়ে সে চুপ করে বসে রইলো।
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
#উপন্যাস
#অনুবাদ
#মোলাকাত
#মোলাকাত
#Molakat
#Novel
#Translation
#BanglaLiterature
#Literature
#ওয়েব_ম্যাগাজিন
#বাংলাসাহিত্য
#বাংলাসাহিত্য
#আলিফ_লায়লা
#সাহিত্য

No comments